কাঠগোলাপের সুবাস পর্ব ৯

0
1296

“কাঠগোলাপের সুবাস”

৯.
দুই মাস পেরিয়েছে। এই দুইমাসে অনেকটাই বদলে গেছে তিনজনের জীবন। সাদ রুম থেকে বেরিয়ে উপরে রেলিং -এর কাছে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালো। দুই সতীনের হাবভাব দেখছে আর মুচকি হাসছে।

হুমায়রা সোফায় আরাম করে বসে সামনে টেবিলের উপর দুই পা তুলে বই পড়ছে আর চকলেট খাচ্ছে। এমন সময় খাদিজা পাশ থেকে উঠে সবগুলো চকলেট হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। ভ্রু কুচকে তাকালো হুমায়রার দিকে। হুমায়রা বইটা পাশে রেখে খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললো,

— “কি হয়েছে?”
— “তুই কয়টা চকলেট খেয়েছিস?”
— “কেনো?”
— “তোকে আমি আর চকলেট দিবো না। আমি মাত্র দুইটা খেয়েছি। আর তুই…।”

খাদিজা নিচে ঝুকে হুমায়রার পাশের চকলেটের প্যাকেট হিসেব করে বললো,

— “আমি দুইটা খেতে খেতে তুই আটটা খেয়েছিস। তোর ভাগ শেষ। রাক্ষসী কোথাকার। এতো তাড়াতাড়ি খেলি কেনো? আর চকলেটও দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেতে হয়? আর পাবি না তুই।”

হুমায়রা গাল ফুলিয়ে ফেললো। অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বললো,

— “লাগবে না হুহ।”
— “না লাগলে ভালো। এখন এই দশটা চকলেট আমার। হাহা। আমি একটু পরপর খাবো আর তুই দেখবি।”
— “আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবে?”
— “তুই যে কাল আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাদাম খাইলি মনে নেই? কয়বার খুজেছি আমাকে একটা দে। একটা তো দূরে থাক তুই আমাকে অর্ধেক বাদামও দেস নি। তাই এখন আমিও তোকে দিবো না। মুহাহাহা।”

খাদিজা শয়তানি হাসি হাসলো। হুমায়িরা ভেঙচি কেটে বললো,

— “না দিলে নেই। আমার ওতো খাওয়ার অভ্যাস নেই।”
— “হু..! সেজন্য এই পাঁচ মিনিটে আটাটা চকলেট খেয়েছিস আরকি।”

সাদ উপর থেকে দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। এই মুহুর্তে কেউ ওদের দেখলে বলবে দুইজন একই মায়ের গর্ভে জন্মানো দুই বোন। কাল দুজনকে বাদাম এনে দিয়েছিলো। হুমায়রা আগে ভাগে সব বাদাম নিজের করে নিয়েছিলো। খাদিজাকে লোভ লাগানোর জন্য দেখিয়ে দেখিয়ে খেয়েছে। সাদ ওদের দুজনের মাঝে তেমন কথা বলেনা। দুজনকে আলাদা একটা স্পেস দিয়েছে। যাতে তাদের মধ্যে একটা শক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠে।

খাদিজা আড়চোখে হুমায়রার দিকে তাকালো। হুমায়রা গাল ফুলিয়ে বসেই আছে। খাদিজা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো। দুইটা চকলেট হুমায়রার দিকে বাড়িয়ে দিতেই হুমায়রা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেছে। খাদিজা ভাব নিয়ে বললো,

— “তুই তো আমার ছোট তাই দিলাম। না দিলে যদি আবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিস তাই। তাই একটু দান করলাম আরকি।”
— “হুহ…!”

হুমায়রা মুখ ভেঙিয়ে খেতে শুরু করে। সাদ নিচে নেমে এসে বললো,

— “আজকের খাবার কি পাবো না? নাকি শুধু দুই সতীনের ঝগড়া দেখবো?”

খাদিজা এবং হুমায়রা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। সাদ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। দুইজনের হাবভাবে বলছে মাথায় দুষ্টুমি চক্রান্ত সেট করে রেখেছে। খাদিজা ভাব নিয়ে বললো,

— “প্রতিদিন তো আমরাই করি। আজকে তুমি করো। আমরা বসে থাকবো।”
— “আমাকে দিয়ে কাজ করানোর ফন্দি আঁটছো দুই সতীন?”
— “সে আপনি যাই ভাবেন৷ আজকে আপনাকে খাবার রান্না করে আমাদের খাওয়াতে হবে।” হুমায়রা হেসে বললো।
— “ঠিকাছে আজকে আমি তোমাদের শেফ। তাহলে এবার বলো দুইজনে কি খাবে?”

খাদিজা খুশি হয়ে বললো,

— “চিংড়ির মালাই তরকারি।”
— “আর আমার জন্য বেগুন ভর্তা।” হুমায়রা ঠোঁট গোল করে বললো।

সাদ এবং খাদিজা দুজনেই হেসে ফেললো। হুমায়রা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

— “তোমরা হাসছো কেনো?”
— “তোর এভাবে বলাতেই হাসছি। মনে হচ্ছে বাচ্চা একটা মেয়ে বায়না ধরেছে আমাকে চক্কেত দাও।” খাদিজা বললো।

সাদ হেসে উঠে রান্নাঘরে গেলো। দুইজনের জন্য রান্না করে শেষ করলো। সাদ ডাকার আগেই দুই বিবি হাজির। বড় একটা প্লেটে খাবার নিয়ে মাদুর বিছিয়ে তিনজন গোল হয়ে বসলো। এভাবে খাওয়াটা এখন তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। তিনজন একই প্লেটে ভাত খাবে। একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিবে এটাই নিয়ম হয়ে গেছে।

______________________
— “তুইও চলনা আমাদের সাথে মার্কেটে।”
— “আপু আমি যাবো না। আমার ভাল্লাগেনা। আমার জন্য তোমরা দুইজনই পছন্দ করে কাপড় নিয়ে এসো।”
— “তাই বলে তুই ঘরে একা থাকবি?”
— “তো কি হয়েছে? আমি ভূতে ভয় পাইনা।”
— “হু..! জানালা দিয়ে এসে এক টান দিবে। তারপর তোকে ওদের প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করাবে।”
— “রাজকুমারীও করতে পারে। টয়লেট কেনো পরিষ্কার করাবে।”
— “আমি বলেছি তাই। হাহ হা হাহা।”

হুমায়রা মুখ ভেঙিয়ে গাল ফুলিয়ে ফেললো। খাদিজা হুমায়রার মুখটা নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বললো,

— “তুই এভাবে যখন ভেঙচি কাটিস তখন তোকে খুব কিউট লাগে। তুই পুরাই একটা কিউটের ডিব্বা।”
— “উনিও বলেছে এইকথা।” হুমায়রা লজ্জা পেলো।
— “ওরে লজ্জাবতী রে। আচ্ছা চকলেট আনবো?”
— “হ্যাঁ। অনেক গুলো কিন্তু।”

হুমায়রা খুশি হয়ে বললো। খাদিজা হুমায়রার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। হুমায়রাও খাদিজার পিছন পিছন নিচে নেমে এলো। মেইন ডোরের সামনে সাদ দাঁড়িয়ে আছে। খাদিজা সাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।

সাদ হুমায়রাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,

— “সাবধানে থাকবে।”
— “শুনুন। আজকে ফিরে এসে আমাকে অনেক ভালোবাসতে হবে।”
— “ঠিকাছে বিবি সাহেবা। আপনার কথাই পালন হবে।”

সাদ হাসলো। হুমায়রার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলো। হুমায়রা দরজা বন্ধ করে উপরে চলে গেলো।

সাদ যাওয়ার বিশ মিনিট পর কলিংবেলে বেজে উঠে। হুমায়রা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে ‘এই সময় কে এলো?’ হুমায়রার চিন্তার মাঝেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। হুমায়রা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসে। লুকিংগ্লাস দিয়ে বাহিরে দেখলো খাদিজার মা এসেছে। পাশে আরো একজন মহিলা। হুমায়রা দরজা খুলে দিলো। লিমার পাশে রাণীকে দেখে হুমায়রা ভয় পেলো। দুইজন একসাথে এই সময়ে কেনো এলো বুঝতে পারছে না। হুমায়রা তাদের বসতে দিলো। লিমা হিজাব খুলে বললো,

— “খাদিজাকে ডাকো।”
— “আপু তো বাসায় নেই। উনারা দুজন মার্কেটে গেছে।”
রাণী টিটকারি করে বললো,
— “তোকে নিলো না কেনো? নিবে কেনো সবার মাঝখানে অপয়া হয়ে ঢুকে যাস তাই হয়তো নেয়নি।”
হুমায়রা মিনমিনে স্বরে বললো,
— “আমি ইচ্ছে করে যাইনি। আপু আমাকে অনেকবার বলেছে যেতে। আমিই যাইনি।”
— “যা নাস্তা আন।” রাণী বললো।

হুমায়রা যেতেই লিমা রাণীকে বললো,

— “সব ঠিকঠাক তো?”
— “হ্যাঁ। এবার সব ঠিকঠাকই হবে। হয়ত এই ঘরেই জায়গা হবে না।”
— “ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো এসেছে কিনা।”
— “হুম।”

রাণী কাউকে কল দিতেই সে বললো ‘বাহিরে এসে নিয়ে যেতে।’ রাণী তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে শান্ত হয়ে বসলো। হুমায়রা নাস্তার প্লেট তাদের সামনে রাখতেই লিমা বললো,

— “খাদিজার সাথে আমি দেখা করেই যাবো। তোমার কোনো কাজ থাকলে তুমি সেটা করোগে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”

হুমায়রা রান্নাঘরে চলে গেলো রান্না করতে। অজানা আশংকায় হুমায়রার বুক কাঁপছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে আজকে খারাপ কিছু হবে। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,

‘আউযু বিকালিমা- তিল্লা- হিত্তা- ম্মা- তি, মিং- শাররি মা -খ্বলাক।’ বিষ, যাদু ও অন্যান্য ক্ষতি থেকে বাঁচতে এই দোয়া অনেক কার্যকরী।[১]’

রান্নাবান্না শেষে হুমায়রা ড্রয়িংরুমে এসে ঘড়ি দেখলো। বারোটা বেজেছে। সাদরা আসার সময় হয়ে গেছে। লিমা এবং রাণী তাদের মতো কথা বলছে। হুমায়রা উপরে চলে এলো গোসল করতে। কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকে গেছে।

হুমায়রা ওয়াশরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। খাটের উপর চোখ যেতেই ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠল। এমন বিপদের মুখোমুখি হবে সেটা কল্পনাতেও ভাবেনি। রবিন হুমায়রার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসলো। এমন সময় সাদ এবং খাদিজা রুমে এলো। হুমায়রা দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও পাচ্ছে না। মাথাটা ঘুড়ছে। এটা যে তার ভাবির চক্রান্ত সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কেনো এই মহিলা তার পেছনে কুড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হুমায়রা কিছুতেই বুঝতে পারেনা।

.
ড্রয়িংরুমে সবার সামনে মাথা নিচু করে হুমায়রা দাঁড়িয়ে আছে। নিরবে চোখের পানি ফেলছে। রবিন বললো,

— “আমি কিছুই জানি না সাদ। হুমায়রাই আমাকে ডেকেছে।”

সাদ নিশ্চুপ। শুধু গভীর দৃষ্টিতে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। খাদিজাও চুপ করে আছে। আর কি যেনো ভাবছে। রাণী বললো,

— “আমার ভাইয়ের সাথে তোর আগে থেকেই সম্পর্ক এটা বললেই তো হতো। তাহলে তোকে আমি আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতাম। কিন্তু তুই তো কিছু বললি না। বিয়ের পর এভাবে এসব পরকিয়া করার কি দরকার? তোর ভাইয়ের সম্মানের কথা একবারও ভাবলি না?”

হুমায়রা নিশ্চুপ। লিমা বললো,

— “এইজন্য তুমি আমাগোরে ঘরে ঢুকাইতে চাও নাই। এবার বুঝলাম। ছি! ছি! এমন মাইয়া আমি কখনো দেখি নাই। তোমারে এখানে কোন কষ্টে রাখছে সাদ বাবায়। সব তো দিলো। তারপরেও এমন জঘন্য কাম করার কি দরকার আছিলো। এখন সাদ তোমারে ডিভোর্স দিলে তুমি কি করবা? মাঝখান দিয়া আমার মাইয়ার মাঝে চইলা আসছো।”

হুমায়রা মাথা তুলে লিমার দিকে তাকালো। লিমার কথায় খুব বেশিই অবাক হয়েছে। রাণীর দিকে চোখ যেতেই দেখলো সে হাসছে। রাণীর হাসিটা হুমায়রার কাছে কাটা গায়ে নুনের ছিটার মতোই লাগছে। হুমায়রা সাদের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই ভয়টা আরো বেড়ে গেছে। সাদ যেনো চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে অবস্থা। হুমায়রা চোখ নামিয়ে নিলো। হুমায়রা ভাবছে, ‘সাদ কি প্রথম দিনের মতোই তাকে মারবে? নাকি এবার ঘর থেকেই বের করে দেবে? নাকি আরো কঠিন শাস্তি দেবে তার কাছে রেখে?’

লিমার গাঁ জ্বালানো কথার সাথে রাণী আরেকটু ঘি ঢালার জন্য তো আছেই। এবার খাদিজা উঠে দাঁড়ালো। হুমায়রার সামনে দাঁড়িয়ে এক চড় দিলো। সাদ খাদিজার নাম ধরে ডাক দিলো। খাদিজা সাদকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

— “আমাকে বলতে দাও।”
লিমা বললো,
— “তুই-ই বল। একজন আরেকজনকে পছন্দ করলে তোদের মাঝে কেনো এলো?”

খাদিজা তার মায়ের দিকে তাকাতেই লিমা চুপ হয়ে গেলো। হুমায়রার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বললো,

— “তুই এমন ছ্যাঁচড়া কেনো বলতো? এমন ছিঁচকাদুনে কেনো? তুই কি এতোই সস্তা যে, যে কেউ এসেই তোর নামে অপবাদ দিবে আর তুই মেনে নিবি। এই তুই প্রতিবাদ করতে পারিস না? কেনো তোকে সবার সব কিছু চুপচাপ মেনে নিতে হবে? আর একফোটা চোখের পানি ফেলেছিস তো মেরে হাড্ডি-গুড্ডি সব ভেঙে দেবো৷”

খাদিজা রাণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আপনার বহু কথা শুনেছি। আর একটা অপবাদ যদি আপনি দিয়েছেন আমি ভুলে যাবো আপনি আমাদের কিছু হোন। যেদিক দিয়ে এসেছেন সেদিক দিয়ে বেরিয়ে যান। এরচেয়ে ভালো ব্যবহার করতে পারলাম না।”

লিমা বললো, ‘খাদিজা তুই এসব কি বলছিস? ওর পরকিয়াকে তুই…।”
— “মা!!!!!! তুমি নিজের চোখে দেখেছো ওর পরকিয়ার কান্ড?”
— “হ্যাঁ। আমাদেরকে বাসায় ঢুকতে দিচ্ছিলো না।”
— “তুমি যখন এলে তখন ওর গায়ের ড্রেস কি ছিলো?”
— “থ..থ্রিপিস ছিলো।”
— “তুমি তো ওকে থ্রিপিস পরা দেখলে। একটু আগে না বললে ওদেরকে পরকিয়ায় মেতে উঠতে দেখেছো।”
— “ওই একই তো।”
— “তুমি হুমায়রার রুমে ঢুকেছিলে?”
— “আরে না। এই মেয়ে তো আমাদের এখানে নাস্তা দিয়েই বসিয়ে রেখেছিলো।”
— “তাহলে কিভাবে জানলে ওর রুমে কেউ আছে? এই বাড়ির দেয়াল এতো পাতলা না যে, কেউ রুমে কিছু করছে আর সেটা দোতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত শুনা যাবে। তোমরা কয়টায় এসেছো?”
— “তোরা যাওয়ার পর পরই।”
— “আমরা যাওয়ার পর পর রবিনও আসলো৷ তোমারাও আসলে। তোমাদেরকে নাস্তা দিয়ে হুমায়রা উপরে গিয়ে পরকিয়ায় জড়ালো। তাহলে রান্না করলো কে?”
— “আব..হু..হুমায়রাই করেছে।”
— “তুমি আমার মা বলে কঠিন ব্যবহার করতে পারলাম না। বেরিয়ে যাও। আর কোনোদিন আসবে না এ বাড়িতে।”

খাদিজা রবিনের দিকে তাকালো। দাড়োয়ানকে দিয়ে আচ্ছামত মার খাইয়েছে। রাণী কিছু বলতে যাবে খাদিজা কঠিন হুঙ্কার দিয়েছে। সবাই চলে যাওয়ার পর খাদিজা হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরতেই হুমায়রা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। খাদিজা বললো,

— “ওদের কথাবার্তা শুনেই আমি সব বুঝে গেছিলাম। তখন তোকে চড় মেরেছি রাগ করে। কেনো তুই সবার সব কথা নিরবে শুনে যাস বলতো?”
— “আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম আপু।”

খাদিজা হুমায়রাকে ছেড়ে হুমায়রার পাশে দাঁড়িয়ে সাদের দিকে তাকালো। খাদিজা আঁতকে উঠে। ফিসফিস করে হুমায়রাকে বললো,

— “আববে সামনে তো তাকা। এবার তো উনি আমাদের চিবিয়ে খাবে। কি ভুল করেছি রে?”

হুমায়রা ঠোঁট উল্টিয়ে ইশারায় বুঝালো সে কিছুই জানে না। এতো সময় সাদ সম্পূর্ণ নিরব দর্শক ছিলো। যা করার, বলার খাদিজাই বলেছে। সাদ এবার উঠে দাঁড়ায়। খাদিজা হুমায়রা দুজনেই ভয়ে মিইয়ে গেলো। সাদ দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— “এতোক্ষণ ওর হয়ে কথা বললে আমি খুব খুশি হয়েছি। এটা আমি আশা করিনি যে, তুমি হুমায়রাকে সাপোর্ট করবে।”
— “হিহি। তারপর রেগে আছো কেনো? এতো খুশির মুহুর্তেও মানুষ প্যাচার মতো মুখ করে রাখে?”

হুমায়রাও মিটমিটিয়ে হেসে ফেললো। সাদ হুঙ্কার দিয়ে বললো,

— “রবিন যে তোমাদের মাহরাম না এটা মাথায় ছিলো না? এগুলা যে ওদের চাল এসব তো আমি ওদের মুখ দেখেই বুঝে গেছি। তোমাদের মাথায় এটা ছিলো না আমি আছি মানে আমি সামলে নিতে পারবো সব। ভেতরে না গিয়ে এখানে সঙ সেজে বসে ছিলে কেনো? আর আরেকজন তো সঙ সেজে ওড়না ছাড়াই দাঁড়িয়ে ছিলো।”
— “আস..আসলে!”
— “চুপ। আমি কোনো কৈফিয়ত চাইনি। আমাকে তো আর দরকার নেই তোমাদের দুজনের। থাকো তোমরা আমি গেলাম।”

সাদ রেগে উপরে উঠে গেলো। খাদিজা রাগি লুক নিয়ে তাকালো হুমায়রার দিকে। হুমায়রা কাচুমাচু করে বললো,

— “আমার কোনো দোষ নেই।”
— “এহ! উনার কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোর। তুই এভাবে দাঁড়ালি কেনো? হিজাব পরে আসিস নি কেনো?”
— “তখন মাথা ঘুড়ে উঠেছিলো। তাই হিজাব পরার কথা ভুলে গেছিলাম।”
— “তো এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? পরে যা।”

হুমায়রা গাল ফুলিয়ে ফেললো। খাদিজা কোমড়ে দুই হাত রেখে বললো,

— “উনি শুধু গাল ফুলিয়ে রাখতেই জানে। হুহ..! যা সাদের রাগ ভাঙা।”
— “আমি?”
— “তোর কারণে রেগেছে। তুই-ই রাগ ভাঙাবি।”
— “আমার ভয় করছে উনার সামনে যেতে। তখন তো এমনভাবে তাকিয়ে ছিলো যেনো চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে। আপু তুমি যাও।”
— “হুশ! তুই সাদের রাগ সম্পর্কে জানিস না। একবার রেগে গেলে ও খুব ভয়ংকর রেগে যায়। তখন সামনে না যাওয়াই ভালো।”
— “এখন কি হবে?”
খাদিজা করুন মুখে বললো,
— “দেখি কি হয়। ছেলে হয় নাকি মেয়ে হয়।”
হুমায়রা ভ্রু কুচকে তাকালো। খাদিজা ঠোঁট উলটে বললো,
— “কি?”
— “এই মুহুর্তেও ফাইজলামি?”
— “তো এখন কিরুম? নাচুম? তুই যাইয়া নাচ। হুহ..! সব তোর জন্য হইছে।”

হুমায়রা আবারও গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ খাদিজা কিছু বলতে যাবে সাদ নিচে নেমে এলো। হাতে ব্যাগ। মানে সাদ সত্যিই চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায়?

— “আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” দুইজনই একসাথে বলে উঠলো। সাদ দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
— “ভিক্ষা করতে যাচ্ছি। যাবে?”
— “আর রাগ করে থাকবেন না। ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন প্লিজ।” হুমায়রা বললো।
— “সাদ প্লিজ মাফ করে দাও। এমন ভুল আর হবে না।” খাদিজা করুন স্বরে বললো।

সাদ কিছু না বলে গটগট করে হেটে চলে গেলো। হুমায়রা খাদিজার দিকে তাকিয়ে ভৌ দৌড় দিয়েছে। খাদিজা হুমায়রার পেছনে ছুটতে ছুটতে বললো,

— “তোরে এখন হাতের কাছে পাইলে কি যে করুম।”
— “আজিব। আমি কি করেছি? যা করার সব তো ওরা করেছে।”
— “তুই হিজাব ছাড়া নিচে নামলি কেন? তাইতো সাদ চলে গেছে।”
— “তখন ভয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম। তাই..।”

পুরো ড্রয়িংরুমে দৌড়ে সিড়িতে গিয়ে হুমায়রা বসে পরলো। খাদিজাও হুমায়রার পাশে বসে পরলো। দুইজনেই হাপাচ্ছে। খাদিজা হুমায়রার কোলে মাথা রেখে বললো,

— “সাদ সত্যিই চলে গেলো।”
— “কোথায় গেছে উনি?”
— “সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
— “জানো আপু আমি আমার জীবনে আগে কখনো দৌড়াদৌড়ি খেলিনি। আজকে তোমার ভয়ে দৌড় দিয়ে মজা পেয়েছি।”

খাদিজা কিছু না বলে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। হুমায়রার চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় একটা নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ে তার পাশে বসে রুপকথার রাজ্যের গল্প করছে। হুমায়রাকে দেয়া কষ্টের দিনগুলো ভাবতেই খারাপ লাগে খাদিজার৷ এই পিচ্চিটাকে সে বিনা কারণেই কষ্ট দিয়েছে। খাদিজা হুমায়রার হাত ধরতেই হুমায়রা খাদিজার দিকে তাকালো। খাদিজা বললো,

— “মাফ করে দিস আমাকে। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি বিনা কারণে। সাদের কাছ থেকে সরাতে মায়ের কথায় তোর সাথে অন্যায় করেছি অনেক।”
— “আপু প্লিজ এভাবে বলো না। তোমাকে পেয়ে আমি কি যে খুশি বলে বুঝাতে পারবো না। আমি সবসময় আপসোস করতাম আমার বড় একটা বোন নেই বলে।”

হুমায়রা খাদিজাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— “আল্লাহ আমাকে বড় বোন হিসেবে তোমাকে দিয়েছেন। তাই আমি আল্লাহর কাছে কত কত শুকরিয়া যে আদায় করেছি। এখন তো আমি আরো খুশি কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো তাই। আমার সাথে দুষ্টামি করো, আমার চুল আঁচড়ে দাও, খাইয়ে দাও। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করে দিয়েছেন।”

খাদিজার চোখে পানি চলে এসেছে। হুমায়রাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। খুব আপন আপন লাগে হুমায়রাকে এখন। মনে হয় অনেক বছর আগ থেকেই দুজন দুজনকে চিনে। দুজনে আবেগে আপ্লুত হয়ে ছিলো। এমন সময় সাদের কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখলো সাদ দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আমি চলে গেছি কোথায় আমার রাগ ভাঙাবে তা না করে এখানে দুঃখ বিলাশ করছে দুজনে। এবার আমি সত্যিই সত্যিই যাচ্ছি।”

সাদ আবার গটগট করে বেরিয়ে গেলো। হুমায়রা খাদিজার হাত ধরে বললো,

— “আপু এবার কি হবে?”
— “দাড়া ভাবতে দে আমাকে।”
কিছুক্ষণ চিন্তা করে খাদিজা বললো,
— “উঠ। তাড়াতাড়ি রেডি হো। আমি জানি সাদ কোথায় গেছে।”
— “কোথায়?”
— “ওর মায়ের কাছে গেছে। ওদের গ্রামে। চল চল তাড়াতাড়ি।”

খাদিজার কথামতো হুমায়রা রেডি হয়ে নিলো। দুজনের কাপড় এক ব্যাগে নিয়ে খাদিজা দারোয়ানকে বলে বেরিয়ে গেলো। হুমায়রার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে খাদিজা। দুজনে বাসস্টেশনে চলে এসেছে। হুমায়রা বললো,

— “আপু আমাদের কাছে তো টাকা নেই। কিভাবে যাবো?”
— “তোরে বেঁচে দিবো। যেই টাকা পাবো সেগুলো দিয়ে আমি সাদের বাড়ি চলে যাবো। মুহাহহা।”
— “আপু। সত্যিই আমাকে বিক্রি করে দিবে?”

কথা বলতে বলতে দুজনে টিকিট কেটে সিটে বসে পরলো। হুমায়রার শেষের কথা শুনে খাদিজা হেসে সিটে গড়িয়ে পরলো। হুমায়রা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে খাদিজার দিকে। খাদিজা হুমায়রার কপালে টোকা দিয়ে বললো,

— “আমি বললাম আর তুই বিশ্বাস করে নিলি? তোকে রেখে গেলে সাদ মনে হয় আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। হুহ.. গবেট কোথাকার। আমি তোদের দুজনের কাউকেই ছাড়তে চাইনা।”

যথাসময়ে এসে তারা পৌছে গেলো কিশোরগঞ্জ। একটা রিকশা নিয়ে সেখানে উঠে বসে। হুমায়রা বললো,

— “উনাদের গ্রামের বাড়ি তুমি চিনো?”
— “হ্যাঁ। যখন জব করতাম প্রজেক্টের কাজে এখানে এসেছিলাম। তখন সাদ তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো।”
— “ওহ..!”

রিকশা থেকে নেমে পাঁচ মিনিট হাটলেই সাদদের বিশাল বাড়ি। অল্প সামনে যেতেই সাদের গাড়ি পার্ক করা দেখলো। খাদিজা হুমায়রাকে বললো,

— “দেখ তোর স্বামী এখানেই এসেছে।”
— “তোমার মনে হয় কিছু হয়না।”
— “হিহি।”

বাড়ির উঠানে যেতেই দেখলো সাদ তার মায়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সাদ ওদের দুজনকে দেখে ওদের সামনে আসলো। দুজনেই সালাম দিলো সাদকে। সাদ গম্ভীর মুখ করে ফেলেছে। দুজনকে রুমে এনে বসিয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। সাদের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তিনি জানেন না সাদের দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে।

.
সাদ গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। খাদিজা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সাদের দিকে। হুমায়রা সাদের মায়ের কাছে গেছে। খাদিজা এবার সাদের হাত ধরে বললো,

— “প্লিজ আর রেগে থেকো না। তখন সিচুয়েশন এমন ছিলো যে, মাথায় ছিলো না রবিনের কথা। হুমায়রার সম্পর্কে এসব শুনে রাগ উঠে গেছিলো। তাই…।”

খাদিজা মাথা নিচু করে কেঁদে ফেললো। সাদ আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,

— “এখন আর রেগে নেই আমি।”
— “সত্যি?”
— “হুম। প্রথমে ভিষণ রাগ উঠেছিলো। পরে যখন তোমাদের দুজনকে সিড়িতে বসে থাকতে দেখেছি রাগ কমে গেছিলো। এরপর মিছেমিছি রাগ দেখিয়ে এখানে চলে এসেছি। কারণ আমি তো জানি আমার খাদু পাখি বুঝে গেছে আমি কোথায় এসেছি।”
— “যদি আমি হুমায়রাকে না আনতাম বা অন্য কোনো ক্ষতি করে দিতাম৷ তখন?”
— “আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে তোমার উপর। তাইতো চলে এসেছি।”

খাদিজা আবেগে আপ্লুত হয়ে একটু রোমান্টিক হয়ে গেলো। সাদ খাদিজার কাজে অবাক হয়ে গেলো। পরক্ষণেই হেসে নিজেও খাদিজার রোমান্টিকতায় সাড়া দিলো।

চলবে,,,
® ‘নাহার’

___________________________
রেফারেন্স, [১] জামে তিরমিজি, ৩৫৫৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here