কাঠগোলাপের সুবাস পর্ব ৮

0
1285

“কাঠগোলাপের সুবাস”

৮.
হুমায়রা খাটে বসে ঘাড় ঘুড়িয়ে কিছুক্ষণ সাদকে দেখলো। আবার নিজে নিজে ভেঙচি কেটে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। আবার উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে আয়মায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো। হুমায়রা বেশ বিরক্ত হচ্ছে। এদিকে সাদের কোনো হেলদোল নেই। লেপটপ নিয়ে বসে আছেই তো আছে। হুমায়রা দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছে সাদের দিকে। হুমায়রার এখন ইচ্ছে করছে সাদের সামনে থেকে লেপটপটা নিয়ে এক আছাড় মারতে। এই লেপটপকে এখন সাদের তিন নাম্বার বউ মনে হচ্ছে।

ধপ করে বিছানায় বসে আবারও সাদের দিকে তাকালো। সাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ লেপটপের দিকে তাই হুমায়রা যে তার দিকে এমন বাঘিনীর মতো তাকিয়ে আছে সেটা সাদ জানে না। এবার আর সইতে না পেরে হুমায়রা গটগট করে হেটে সাদের সামনে আসলো। সাদ লেপটপ থেকে মুখ তুলে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলেছে। আবার লেপটপের দিকে তাকিয়ে টাইপিং শুরু করলো। হুমায়রা সাদের পাশে গাঁ ঘেঁষে বসেছে। সাদ একটু হেসে বললো,

— “কি ব্যাপার? আজ নিজ থেকে এতো কাছে আসলেন কেনো? হুম…!”
— “আপনার মুন্ডু। আপনার এই তিন নাম্বার বউকে ফেলবেন? নাকি আমি এটাকে বাইরে ফেলে আসবো?”

সাদ এবার হো হো করে হেসে দিলো। হুমায়রা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। সাদ লেপটপ বন্ধ করে বললো,

— “এই দেখো তিন নাম্বার বউকে রেখে দিয়েছি। এবার বলো কি বলবে?”

হুমায়রা সাদের কলার টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললো,

— “বুঝেন না আপনি কি চাই আমার? অনেক অনেক ভালোবাসা চাই।”
— “আচ্ছা তাই? ঠিকাছে আসো ভালোবাসা দেই।”
— “হুহ..! লাগবে না।”
— “এই না বললে লাগবে।”
হুমায়রা অন্যদিকে ফিরে বললো,
— “আমি বলার আগে কেনো বুঝেন নি আপনি?”
— “ওহো! ভুল হয়ে গেছে। এবার কি করতে হবে?”
— “কান ধরে উঠবস করুন।”
— “ওকে।”

হুমায়রা ভাবলো সাদ এমনিতেই বলেছে। হুমায়রাকে অবাক করে দিয়ে সাদ সত্যি সত্যিই কান ধরে উঠবস শুরু করেছে। হুমায়রা অবিশ্বাস্য চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষ্ময়ে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে। সাদ মুখটা কাচুমাচু করে বললো,

— “আটবার হয়েছে। আর কতক্ষণ করতে হবে বউ? বেশিক্ষণের শাস্তি দিও না। পরে কিন্তু তোমাকেই পা টিপে দিতে হবে।”

হুমায়রা তাড়াতাড়ি উঠে সাদকে থামিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সাদ হাপিয়ে গেছে। হুমায়রাকে আলতো করে আগলে ধরে বললো,

— “এই কয়েকদিন ব্যায়াম করা হচ্ছে না বউ। তাই অল্পতেই হাপিয়ে গেছি। দেখো একদম ঘাম ছুটে গেছে।”

সাদ হাসলো। হুমায়রার গালটা দুইহাতের মাঝে নিয়ে বললো,

— “পাগলি মেয়ে কাঁদছো কেনো?”
— “আমার জন্য আপনার কষ্ট হয়েছে তাইনা?”
— “ইশ্! তোমার কাছে আসলে আমি সত্যি অন্যরকম একটা আনন্দ পাই। পিচ্চি মেয়ে। কথাবার্তা সব পিচ্চিদের মতো। একদম কিউটের ডিব্বা তুমি। ইচ্ছে করে একদম গেড়ে রাখি বুকের মাঝে।”

হুমায়রা লজ্জা পেলো। লজ্জায় মুখটা এতটুকুন হয়ে গেছে। সাদ বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বললো,

— “মার ডালা।”

তারপর দুজনেই দুজনার মধ্য আবদ্ধ হলো।

.
সকালবেলা হুমায়রার ডাকে ঘুম ভাঙলো সাদের। হুমায়রার সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টামি করে মসজিদে গেলো।

সাদ চলে যেতেই হুমায়রা রুম থেকে বেরিয়ে এসে খাদিজার দরজার সামনে দাড়ালো। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। হুমায়রার খুব খারাপ লাগলো। কি কারণে তার বোনটা কষ্ট পাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না। আজ দুই সপ্তাহ হলো খাদিজা রুম থেকে বের হয়না। ডাকলেও বের হয়না। মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ আসে রুম থেকে। হুমায়রা মন খারাপ করে রুমে চলে এলো। নিজের ইবাদাতের দিকে মনোযোগ দিলো।

আজ শুক্রবার হওয়ায় সাদ বাসাতেই আছে। এখন বিকেল তিনটা। হুমায়রা সাদের সামনে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ মুচকি হেসে বললো,

— “কি হয়েছে? আরো ভালোবাসা চাই নাকি?”
— “উহু।”

হুমায়রার মন খারাপ দেখে সাদ হুমায়রাকে কাছে টেনে নিলো। পাশে বসিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— “কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ কেনো?”
— “আজ দুই সপ্তাহ পার হয়ে নতুন আরেকটা সপ্তাহ আসতে চললো অথচ খাদিজা আপু এখনো রুম থেকে বের হচ্ছে না। কি হয়েছে উনার? আপনার সাথে কিছু হয়েছে?”
— “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। দরজায় নক করলে বলে কিছুদিন সময় চায়। সামনে আসতে চাইছে না। মেয়েটা কি নিয়ে আপসেট সেটাই বলছে না।”
— “আপনি এখন একটু দেখে আসুন না প্লিজ। আমার খুব টেনশন হচ্ছে। উনি ভেতরে কেমন আছেন। আর খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করছে না।”
— “এই মেয়ে এমনি এমনি দরজা খুলবে না। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েই দরজা খুলতে হবে।”
— “তাহলে এখনি যান।”

সাদ উঠে গেস্টরুম থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এলো। খাদিজার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ডাকলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সাদ চাবি দিয়েই দরজা খুলে ফেললো।

দরজা খোলার শব্দে খাদিজা তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। সাদ খাদিজার দিকে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠে। দৌড়ে গেলো খাদিজার কাছে। হুমায়রা রুমে চলে এসেছে। কারণ এখন তাদের দুজনের একটু স্পেস দরকার।

খাদিজার চোখের নিচে, চোখ, নাক, গাল একদম লাল হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এই দুই সপ্তাহ শুধু কেদেছে। সাদ কি রিয়েক্ট করবে ভেবে পাচ্ছে না। মেজাজ প্রচুর খারাপ হচ্ছে। খাদিজা ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে সাদের দিকে। সাদ চোখ গরম করেই তাকিয়ে আছে। দরজা চাপিয়ে দিয়ে খাদিজার সামনে গিয়ে দাড়ালো। একটানে দাড় করিয়ে নিজের মুখোমুখি করলো সাদ। খাদিজা মাথা নিঁচু করে রেখেছে। সাদ বেশ গম্ভীর স্বরে বললো,

— “কি হয়েছে বলবে আমায়? এতোদিন রুম বন্ধী হয়ে থাকার কারণ কি? আমাকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণ কি?”
— “(—–)”
— “বলো।”
— “(—–)”

খাদিজার নিশ্চুপতায় সাদের মেজাজ এবার চড়ে গেলো। খাদিজার আরো কাছে এগিয়ে গিয়ে পেছনে চুল মুঠ করে ধরে বললো,

— “টেনশনে মারতে চাও আমায়? কি করেছি আমি যার কারণে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছো? প্রতিদিন এসেছি দরজার সামনে আর প্রতিদিন ফিরিয়ে দিয়েছো। তুমি জানো কতটা টেনশনে ছিলাম আমি ভেতরে ভেতরে? এই তুমি চুপ করে আছো কেনো? কথা বলো।”

খাদিজা এবার হু হু করে কেঁদে দিলো। সাদ কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। খাদিজাকে সময় দিলো স্বাভাবিক হওয়ার। একটু পরেই খাদিজা ধপ করে বসে পরলো সাদের পায়ের কাছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো,

— “আমাকে মাফ করে দাও সাদ। আমি…আমি তোমাকে আর হুমায়রাকে আলাদা করার জন্য ওই পিচ্চিটাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। তোমার অনুপস্থিতিতে ওর সাথে দুর্ব্যবহার করেছি। ওকে তাড়ানোর জন্য ওকে খাবারও পর্যন্ত কম দিয়েছি। প্লিজ মাফ করো আমাকে। আমি তোমার সামনে আসার সাহস পাচ্ছিলাম না তাই দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।”

সাদ খাদিজাকে টেনে দাঁড় করালো। খাদিজা নজর মিলাতে পারছে না। মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। সাদ খাদিজাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো,

— “তাই বলে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে? কতটা টেনশনে ছিলাম জানো? হুমায়রার সামনে স্বাভাবিক থেকেছি। মেয়েটাও তোমার জন্য টেনশন করেছে অনেক।”
— “আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। তুমি যেই শাস্তি দিবে আমি মেনে নেবো। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
— “হুম শাস্তি তো দিতেই হবে। তুমি জানো তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছো। আর এইজন্য তোমার উপর আল্লাহ নারাজ হয়েছেন।”

খাদিজা আবারও হু হু করে কেঁদে ফেললো। সাদের থেকে এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,

— “আমি তোমার যোগ্য নই সাদ। আমি ভাবতাম হুমায়রা আমাদের মাঝে এসেছে। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি আমিই তোমাদের মাঝে এসেছি। তোমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি।”

সাদ চুপ করে আছে। খাদিজার হাবভাব বুঝতে চাইছে। খাদিজা চোখ মুছে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নিয়ে বললো,

— “তুমি চাইলে এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে পারো।”
— “মানে?”
— “ডি..ডিভোর্সের মাধ্য…..।”

খাদিজা পুরোটা বলতে পারলো না। ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পরলো। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলেছে। সাদ খাদিজার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

— “এই আমি তোমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য বিয়ে করেছি? সব জেনেই তোমাকে আমার সাথে জড়িয়েছি। আর দুইজনের সমস্যা কি? কিছু থেকে কিছু হলেই শুধু ওই শব্দটা উচ্চারণ করো। এটা ছাড়া আর কি কোনো মাধ্যম নেই সমাধানের? কেনো এতো জ্বালাও তোমরা আমায়? একদিন দুইজনকে ছেড়েই আমি আল্লাহর কাছে চলে যাবো। তখন শান্তিতে থেকো।”

খাদিজাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাদ চলে গেলো। খাদিজা বেডের উপর পরে গেলো। সাদ ধাক্কা দিয়েছে রেগে। রাগের মাথায় এটাও খেয়াল রেখে বেডের উপর ফেলেছে। সাদের এই কেয়ার, দায়িত্ব এগুলো দেখে খাদিজার আরো সম্মান বেড়ে গেলো সাদের প্রতি। খাদিজা গুটিসুটি মেরে বিছানায় বসে আছে। আর চোখের পানি ফেলছে। সমাজের এতো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এই মানুষটা তাকে মাসনা করে সম্মানিত করেছে। আজ সেই মানুষটাকে কষ্ট দিলো, রাগিয়ে তুললো। খাদিজা নিজের ভেতরে অপরাধবোধে ভুগছে।

সেদিন বেশকিছু হাদিস, শায়খদের আরো আরো লেকচার শুনে খাদিজা ভয়ে মিইয়ে গেছিলো। নিজের ভেতরে অপরাধবোধ এতোই বেড়ে গেছিলো যে কারো সামনে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও পাচ্ছিলো না। তাই এভাবে রুম বন্ধী হয়ে থেকেছে।

.
রাত আড়াইটা। ঠোঁটের কাছে কারো স্পর্শ পেয়ে খাদিজার ঘুম ভেঙে গেলো। রুমটা অন্ধকার। তারপরেও বুঝতে পারছে কে এসেছে। গায়ের ঘ্রাণেই বুঝে গেছে খাদিজা। কিছু না বলে চুপ করে রইলো। কাটা জায়গায় বারবার আলতো উষ্ণ স্পর্শ পাচ্ছে৷

একটু পর বেডের পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো সাদ। তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে পরিষ্কার করে দিলো কাটা জায়গাটা। সাদ তখন রাগের মাথায় থাপ্পড় মেরেছিলো। খাদিজার মুখ অন্যদিকে ঘুড়িয়ে রাখায় থাপ্পড়টা ঠোঁটে পরেছিলো।

খাদিজা উঠে বসলো। সাদ গম্ভীর মুখ করে রেখেছে। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার সাদের দিকে তাকালো। তখনই দেখলো সাদ মুখের সামনে ভাতের লোকমা ধরে রেখেছে। খাদিজা খেয়ে নিলো। সাদ নিজেই প্লেটগুলো গুছিয়ে নিচে রেখে এলো। খাদিজা লাইট বন্ধ করে শুয়ে পরবে কিনা এসব ভাবছিলো। তখন সাদ রুমে এলো। কপালে হাত রাখলো খাদিজার। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা নাপা বের করে খাদিজাকে খাইয়ে দিলো৷ খাদিজা মনে মনে ভাবলো ‘একজন মানুষ এতোটা পারফেক্ট কি করে হতে পারে?’

সাদ এবার খাদিজার মুখোমুখি হয়ে বসলো। খাদিজা চোখ নামিয়ে নিলো। ওই চোখে তাকিয়ে কথা বলার সাহস খাদিজার নেই। বারবার হারিয়ে যায় ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালে। এতোটা মায়াবী সাদের চোখ দুটো। খাদিজা ভাবছে, ‘আচ্ছা হুমায়রা কি সাদের চোখের মায়ায় পরেনি? ওর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পরেনি? হয়ত পরেছে। এমন একজন পুরুষকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়?’

সাদ এবার গম্ভীর স্বরে বললো,

— “এবার বলো কি সমস্যা তোমার?”
— “কোনো সমস্যা নেই।”
— “তাহলে এভাবে রুম বন্ধী হয়ে থাকার কারণ? সময় চেয়েছো। তাই বলে এভাবে?”
— “আমি অপরাধবোধে ভুগছিলাম তাই..।”
— “তাই আমাকে এতোটা চিন্তায় রেখেছিলে।”
— “প্লিজ মাফ করে দাও।”

বেশকিছু সময় এরকম নিরবতা পালন হলো। খাদিজা মাথা তুলে দেখলো সাদ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। খাদিজা তাড়াতাড়ি সাদের হাত ধরে বললো,

— “প্লিজ ক্ষমা করো আমায়।”
— “আমি তোমাদের দুইজনকেই খুব কষ্টে রেখেছি তাইনা? আমি তো আমার সবরকম চেষ্টা দিয়েই চাইছি দুইজনকে হ্যাপি রাখতে তারপরেও আমি ব্যর্থ। আমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ। তোমাদের দুজনের জীবনটা আমিই বিষিয়ে তুলেছি। দুজনকে এক জায়গায় এনে হ্যাপি রাখতে গিয়ে আরো কষ্টে ফেলে দিয়েছি। মাফ করো আমায়।”

খাদিজা কেঁদে ফেললো। ব্যস্ত হয়ে বললো,

— “সাদ! সাদ! প্লিজ এভাবে বলো না। প্লিজ তুমি কেঁদো না। তুমি তোমার জায়গা থেকে ঠিক আছো সাদ। এমনকি হুমায়রাও ওর জায়গা থেকে ঠিক আছে। আমিই মায়ের কথা শুনে অশান্তি করেছি। হুমায়রাকে তাড়ানোর জন্য ওকে অনেকভাবে কষ্ট দিয়েছি। সমস্যাটা আমার মধ্যেই। প্লিজ এভাবে মন খারাপ করো না।”

খাদিজা মুখ নামিয়ে বললো,

— “আমার কারণে তুমি কষ্ট পেলে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবেন। আর তাছাড়া জান্নাতে তোমার জন্য যেই হুরগণ আছেন তারাও আমাকে অভিসম্পাত করবেন। প্লিজ আমার উপর আর নারাজ হয়ে থেকো না।”
— “সবই তো জানো। তাহলে জেনেশুনে আমাকে কষ্ট দেয়ার মানে কি? কেনো এমন করলে? তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতাম না।”
— “আসলে আমি হাদিসে পেয়েছি, ‘দ্বিতীয় বিবাহ করলে স্বামী যদি উভয় স্ত্রীর মধ্যে সমতা বা ইনসাফ না করে, তাহলে কেয়ামতের দিন তার শরীরের এক অংগ বিকলাঙ্গ অবস্থায় উথিত হবে।’ সাদ! আমিতো এখনই ভাবতে পারি না যে তোমার কোনো অঙ্গের ক্ষতি হোক। আমি এটা চিন্তা করলেই খুব খারাপ লাগে। কান্না আসে। তুমি তো সমতা করতে চাইছো। শুধু আমার কারণে হচ্ছে না। এইজন্য আরো বেশি আপসেট ছিলাম। আরো অনেক হাদিস শুনেছি, পড়েছি। তাই…। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।”

সাদ এগিয়ে এসে খাদিজার কপালে চুমু দিলো। খাদিজার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— “ঘুমাও। আর কখনো এমন করবে না। যাই হয়ে যাক অন্তত আমাকে সব নির্দ্বিধায় জানাবে। আমি চাইনা আমার কোনো বিবি কষ্ট পাক বা হীনমন্যতায় ভুগুক।”
— “হু।”

সাদ উঠে যেতে নিলেই খাদিজা সাদের হাত ধরে বললো,

— “এতোদিন যেই কষ্ট দিয়েছি সেগুলো ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার জন্য একটু সুযোগ দিবে আমায়?”

সাদ মুচকি হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— “আপনার সতীনকে একটু দেখে আসি। খেয়েছে কিনা। তারপর আবার আপনার কাছেই আসছি।”

খাদিজা কিছু বললো না। সাদ বেরিয়ে যাওয়ার পর খাদিজা বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে হালকা একটু সাজলো। কালো রঙের জরজেট শাড়ি পরে নিলো। খাদিজা ধবধবে ফর্সা হওয়ায় বেশ মানিয়েছে কালো রঙটা। গায়ে একটা মিষ্টি স্মেলের সুগন্ধি মাখলো। রুমটা হালকা গুছিয়ে মিষ্টি সুবাসের একটা রুম স্প্রে চারিদিকে স্প্রে করে দিলো। সব জানালা এবং বারান্দার দরজা খুলে দিলো। এখন সাদ আসার অপেক্ষায় বসে রইলো।

[স্বামীর কাছাকাছি বা সহবাসের আগের এই প্রসেসটা হাদিসে এসেছে। তাই দিয়েছি।]

বেশকিছু সময় পর সাদ রুমে ঢুকেই থমকে গেলো। সাদের উপস্থিতি টের পেয়ে খাদিজা দাঁড়িয়ে গেলো। সাদের মুগ্ধ চাহিনি দেখে খাদিজা লজ্জায় মিইয়ে গেলো। সাদ শুধু মুচকি হাসলো। খাদিজার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বললো,

— “দশ মিনিট টাইম দাও। তোমার চক্ষু শীতলকারী হয়ে আসছি।”

খাদিজা মাথা নাড়ালো। বারান্দায় এসে বসলো। ঝিরিঝিরি বাতাসের কারণে চারিদিকে কাঠগোলাপের মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে পরেছে। খাদিজা মিনমিনে স্বরে বললো,

— “সাদ! আমি এবং হুমায়রা তোমার জীবনে এই কাঠগোলাপের ন্যায় হতে চাই। গাছ আগাগোড়াই ঠুনকো। অথচ ফুলের মিষ্টি সুবাস তার ঠুনকো গাছটাকে যেমন সুবাসিত করেছে। আজ থেকে আমরা দুজন মিলে তোমাকে সুবাসিত করে তোমার জীবন রাঙিয়ে তুলবো।”

সাদ খাদিজার পছন্দের ডার্ক চকলেট রঙের শার্ট পরেছে। চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। খাদিজার পছন্দের আতর লাগিয়ে নিলো। মুচকি হেসে খাদিজাকে ডাকলো। খাদিজা রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই সাদের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলো। খাদিজা নিচু স্বরে বললো,

— “আমাকে দেখে তোমার চোখ জুড়িয়েছে সাদ? হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে?”
— “হু!”
— “গত কয়েকদিনের ব্যবহারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। তোমাকে আর কষ্ট দিবো না আমি। আর হুমায়রাকেও না।”

সাদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসলো। খাদিজা অপলক তাকিয়ে রইলো সাদের হাসির দিকে। সাদ খাদিজার নাক টেনে বললো,

— “কি দেখছো?”
— “তোমার হাসির মায়ায় গভীর ভাবে আটকা পরেছি।”
— “সেজন্যেই ডিভোর্সের কথা বলেছিলে।” সাদ মলিন হাসলো। খাদিজা মাথা নিঁচু করে ফেললো। সাদের হাত ধরে বললো,
— “প্লিজ মাফ করে দাও।”
— “ভালোবাসা দাও। মাফ করে দিবো।”
— “তোমায় খুব সুন্দর লাগছে।”
— “তোমাকেও। এই শাড়িতে আমি তোমাকে কল্পনায় যেভাবে চিন্তা করেছি তার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে।”

খাদিজা লজ্জা পেলো। সাদ আবারও মুচকি হাসলো। বললো,

— “স্বামী যেমন স্ত্রীকে সাজগোছ করা অবস্থায় দেখতে ভালোবাসে। তেমনি স্ত্রীও স্বামীকে সাজগোছ করা অবস্থায় দেখতে ভালোবাসে। স্বামীরও উচিত স্ত্রীকে খুশি করার জন্য সাজগোছ করা। ইমাম ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি আমার স্ত্রীর জন্য সাজসজ্জা করি, যেমন সে আমার জন্য করে। ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষের।'[১]। বুঝলে কিছু?”
— “হু!”

সাদ খাদিজাকে যেই গালে চড় মেরেছিলো সেই গালে চুমু দিয়ে বললো,

— “ক্ষমা করো। তখন রাগের মাথায় চড় মেরে দিয়েছিলাম। আমার রাগ কন্ট্রোল করা উচিত ছিলো।”
— “আমি কিছু মনে করিনি। আমি কাজই করেছি এমন।”
— “হুশ! বহু কথা হয়েছে।”

খাদিজা মুচকি হাসলো। সাদও হাসলো। দুজন দুজনার মধ্যে আবদ্ধ হলো।

________________________
সকাল থেকেই বেশ তোড়জোড় চলছে। আজকে খাদিজার মা এবং বোনরা আসবে। এদিকে হুমায়রার ভাই এবং ভাবিও আসবে। হুমায়রা রান্নার কাজ করছে। খাদিজা ঘর গোছানোর কাজ করছে। সাদ ডাইনিং স্পেস এবং রান্নাঘরের মাঝ বরাবর এক বিশাল পর্দা লাগানোর ব্যবস্থা করছে।

দুপুর হতেই সবাই চলে এসেছে। খাদিজা এবং হুমায়রা দুজনেই রান্নাঘরের পাশে যেই গেস্ট রুম আছে সেখানে এসে রেস্ট নিচ্ছে। সাদের কড়া আদেশ ভুলেও যেনো দুজন এদিকে না আসে। কারণ খাদিজার বোনের স্বামীরা আসবে। আর হুমায়রার ভাইও আসবে।

খাদিজা রান্নাঘরে খাবার গরম করছিলো। হুমায়রা সেখানে গিয়ে বললো,

— “আপু তুমি তোমার আম্মার কাছে যাও। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।”
— “আচ্ছা।”

হুমায়রা সব প্লেটে গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় হুমায়রার ভাবী রাণী রান্নাঘরে প্রবেশ করলো।

.
— “ওই মেয়ের কি খবর?”
— “কার কথা বলছো তুমি?”
— “তোর সতীনের কথা।”
— “মা আমি আর তোমার কোনো কথাই শুনবো না। তাই তুমি আর কোনো কিছু বলবে না।”
— “তুই দেখি ওই মেয়ের পক্ষে কথা বলছিস।”
— “হু!”
— “দেখিস তোর জামাইরে ওই মাইয়া লইয়া যাইবো।”
— “আমার স্বামীকে ওই মেয়ে নিয়ে নেয়নি। বরং ওর স্বামীকে আমি নিয়ে নিয়েছি। তারপরেও আমি তুমি ক্ষান্ত হচ্ছি না। ওই পিচ্চিটার পেছনে কুড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।”

খাদিজার ছোট বোন আসমা তার মাকে বললো,

— “আচ্ছা মা তোমার এতো সমস্যা হচ্ছে কেন বলোতো? সে যদি তার সতীনকে নিয়ে সংসার করতে পারে সুন্দর করে তাহলে তুমি এতো জ্বলছো কেনো?”
— “কোথাও দেখেছিস সতীনের সংসার সুখে যায়?”
— “না দেখিনি। এবার দেখবে। আপু তুই আম্মুর কথায় কান দিস না।”

খাদিজার মেঝোবোন ফোড়ন কেটে বললো,

— “তোর জামাই দুই বিয়ে করলে বুঝবি কেমন লাগে।”

খাদিজা আর নিতে পারলো না এসব। তাই বেরিয়ে এলো রুম থেকে। এখানে থাকলে মনে আবার বক্রতা আসতে পারে। তাই উঠে চলে এসেছে। খাদিজা রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেলো। দরজা থেকে সরে এসে রান্নাঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। যদিও কারো কথা এভাবে আড়াল থেকে শুনা ঠিক নয়। কিন্তু খাদিজা না শুনে পারলো না।

— “বাসর রাত কেমন গেলো তোর?”
— “তুমি যেমন চেয়েছো তেমনই গেছে ভাবী।”

রাণী হাসলো। হুমায়রা নিজের কাছে মন দিয়েছে। রাণী তাচ্ছিল্য করে বললো,

— “আমি বলেছিলাম তোকে আমি কোনোদিন সুখে থাকতে দেবো না। তাই তো এতো প্ল্যান করেছি। তা তোর সতীন কেমন ব্যবহার করে তোর সাথে?”
— “তোমার থেকে ভালো ব্যবহার করে। অন্তত পেট ভরে খেতে দেয়। কাজ করালেও আমাকে যার তার সামনে যেতে দেয়না। পর্দা করতে সাহায্য করে। সে রাগী হলেও তোমার থেকে অনেক গুণ উপরে।”
— “ওমাহ! এতো ভালোবাসা সতীনের জন্য?”

রাণী হেসে উঠলো। হুমায়রার খুব কান্না পাচ্ছে। বাপের বাড়ি থেকে মানুষ আসলে সবাই কত খুশি হয়। অথচ সে! রাণী বললো,

— “তোকে এখানে কেনো বিয়ে দিয়েছি জানিস? তোকে আগুনের আচ থেকে এনে উত্তপ্ত কড়াইতে ফেলতে। সাদের বিবি যে তোকে মেনে নেবে না এইজন্যই তোকে এখানে বিয়ে দেয়া। আর প্রথম দিন ওসব করেছি যাতে প্রথম থেকেই সাদের সাথে তোর সম্পর্কের অবনতি হয়।”
— “ভালো করেছো। অন্তত তোমার ওই লাফাঙ্গা ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছো। তোমার ভাই তো মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারেনা। সত্যি আমার উপকার করল..।”

রাণী ঠাটিয়ে চড় দিলো হুমায়রার গালে। গাল দুটো চেপে ধরে বললো,

— “একদম তর্ক করবি না আমার মুখে মুখে। এখানে আছিস বলে ভাবিস না আমার থেকে বেঁচে গেছিস। আমার ভাইকে লাফাঙ্গা বলিস কোন সাহসে? তোর চরিত্রের ঠিক আছে? রাস্তাঘাটে আমার ভাইয়ের সাথে ডলাডলি করে আমার ভাইকে মার খাইয়েছিস। সেই শোধ আমি তুলবো না ভেবেছিস চরিত্রহীনার বাচ্চা কোথার।”
— “আমাকে গালি দাও৷ আমার বাবা-মাকে কেন গালি দিচ্ছো?”

রাণী আরেকটা চড় দিয়ে দিলো। হুমায়রার গাল দুটো আবারও শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

— “অপয়া কোথাকার। চুপ করে থাকবি একদম। মুখে মুখে তর্কে করতে আসলে মার খাবি। মনে নেই বিয়ের তিনদিন আগের মারের কথা। তোকে এখানে কেনো বিয়ে দিয়েছি জানিস? এখানে বিয়ে দিয়েছি যাতে তুই সবসময় এটা ভাবতে পারিস যে তুই আসলেই একটা অপয়া। আমি আগে থেকেই জানতাম সাদ আর খাদিজার কথা। তোকে তাদের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে কালপ্রিট বানিয়ে দিয়েছি। এবার সারাজীবন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকবি। অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করবি। এগুলোর উপর ঘি ঢালার জন্য তো আমি আছিই। হাহা।”

রাণী বেরিয়ে গেলো। হুমায়রা রাণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পরলো। তা আবার সাথে সাথেই মুছে ফেলেছে। কাজে মন দিলো।

খাদিজা হিজাবের একপ্রান্ত খামছে ধরে এখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের সবই শুনেছে সে। এবং এটাও বুঝে গেছে হুমায়রার জীবনটা কেমন কেটেছে। এবার সাদের বলা কথাটা মনে পরলো। সাদ প্রায় বলতো হুমায়রার জীবন খুব দুর্বিষহ ছিলো তাই তাকে একটু বেশি সময় দি। খাদিজারও চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো। রান্নাঘরে ঢুকে দেখলো হুমায়রা কাজ করছে। গাল দুটো লাল হয়ে আছে। মুখটা এতটুকুন হয়ে আছে। খাদিজার খুব মায়া হলো। ইচ্ছে করছিলো একবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু জড়তার কারণে পারছে না।

.
রাতে খাদিজা সাদের পাশে শুয়ে পরলো। সাদ খাদিজার সাথে দুষ্টামি করছিলো। খাদিজা সাদকে বললো,

— “আচ্ছা তোমার আর হুমায়রার বিয়ের প্রথমদিন কি কিছু হয়েছিলো?”
— “কেনো বলো তো?”
— “এমনি বলো না।”
— “হ্যাঁ। ওর ভাবি ইচ্ছেকরে ওকে আমার কাছে খারাপভাবে উপস্থাপন করেছে। তার ভাইয়ের সাথে কিছু ছবি ইডিট করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলো। আমিও বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। প্রথম রাতেই ওকে আমি থাপ্পড় মেরেছি। মেয়েটা কিছু বলেওনি। চুপচাপ সয়ে গেছে।”

খাদিজার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সাদের দিকে ফিরে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,

— “সাদ জানো আজ ওর ভাবি ওকে মেরেছে।”
— “মানেহ? কখন?”
— “তুমি যখন ড্রয়িংরুমে ছিলে তখন। সাদ তুমি এখন হুমায়রার কাছে যাও। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে হুমায়রা ঠিক নেই।”
— “আমাকে সব খুলে বলো।”

খাদিজা সাদকে সব খুলে বললো। তারপর বললো,

— “সাদ তুমি হুমায়রার কাছে যাও। ও নিশ্চয়ই এখন খুব কাঁদছে।”

সাদ তাড়াতাড়ি উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। খাদিজাও পিছন পিছন গেলো। হুমায়রার রুমের সামনে যেতেই দেখলো ভেতরে লাইট জ্বলছে। সাদ তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকলো। খাদিজা যা ভেবেছিলো তাই। হুমায়রা ভীষণ কাঁদছে। সাদ সামনে যেতেই সাদের বুকে ঝাপিয়ে পরলো। সাদ হুমায়রার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

— “কেঁদো না প্লিজ। এরকম হবে জানলে ওদের আমি আসতে বলতাম না।”

হঠাৎই হুমায়রা সাদের কাছ থেকে সরে গেলো। সাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। খাদিজাও অবাক হলো। হুমায়রা বললো,

— “আপনি আমার কাছে আসবেন না। আমি চাইনি আপনাদের মাঝে আসতে। আমি কখনোই চাইনি। সত্যিই আমি কিছুই জানতাম না। আমি আপনাকে বিয়েও করতে চাইনি। কিন্তু ভাবির মারের কারণে ভয়ে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। আমি তৃতীয় ব্যক্তি হতে চাইনি। আমি চলে যাবো এখান থেকে। আপনারা একসাথে থাকুন। আমি চলে যাবো।”

সাদ ধরতে গেলেই হুমায়রা পিছিয়ে গেলো। খুব কাঁদছে। এতোদিনের জমানো কষ্ট সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে মেয়েটার। খাদিজার খুব খারাপ লাগছে। সাদ যতই ধরতে যাচ্ছে। হুমায়রা ততই পিছিয়ে যাচ্ছে। বারবার শুধু এক কথাই বলছে,

— “আমি চাইনি কারো মাঝে আসতে। আমি জানতাম না কিছু। আমি চলে যাবো। অনেক দূরে চলে যাবো।”

সাদ পানির গ্লাস নিয়ে দেখলো পানি নেই। হুমায়রাকে পানি খাওয়ানো দরকার। সাদ নিজেই গেলো রান্নাঘরে পানি আনতে। খাদিজা ভীতু হয়ে ধীরে ধীরে হুমায়রার দিকে এগিয়ে গেলো। হুমায়রার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো।

সাদ জলদি পায়ে উপরে এলো। হুমায়রার রুমের সামনে এসে থেমে গেলো। ভেতরে যেতে চেয়েও গেলো না। ভেতরের দৃশ্য দেখে একটা প্রশান্তি কাজ করলো মনে।

হুমায়রার মাথাটা খাদিজার বুকে। খাদিজা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে হুমায়রাকে। হুমায়রা বেশ শান্ত হয়ে গেলো। খাদিজা ধীরে ধীরে বললো,

— “তুই তো আমার চেয়েও অনেক হাদিস জানিস। তাহলে কেনো এখন এমন করছিস? তুই-ই তো সাদকে পাঠিয়েছিলি আমাকে আনতে। কারণ তুই তাকদিরে প্রতি বিশ্বাস রাখিস। তাহলে এখন কেনো পাগলের মতো ব্যবহার করছিস আমাকে বল।”
— “(—–)”
— “তোর ভাবি যা বললো তুই এসব গিলে নিলি? তুই জানিস না সব তো আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমাদের তিনজনের তাকদির একসাথে করে দিয়েছেন। এগুলো আমার থেকে বেশিই জানিস। তাহলে কেনো নিজেকে দোষ দিচ্ছিস? তোর তো দোষ নেই। আরেকটা ব্যাপার দেখ। তোর ভাবি তোর খারাপ করতে গিয়ে ভালোই করে দিয়েছেন। সাদের মতো একজন দায়িত্বশীল, প্রেমময় পুরুষের স্ত্রী করে দিয়েছেন। সবই তো আল্লাহর ইশারা তাইনা? তাহলে কেনো কান্না করছিস? আর কাঁদবি না ঠিকাছে? নিজেকে আর দোষ দিবি না। তুই খুব ভালো একটা মেয়ে। খুব কিউট একটা মেয়ে। তাই তোর ভাবি তোকে নিয়ে হিংসা করে। আজকের পর থেকে আর ওই মহিলার কথা মাথায় আনবি না। ভাববি এটাই তোর বাপের বাড়ি এবং এটাই তোর স্বামীর বাড়ি। মনে থাকবে?”
— “হু..!”

খাদিজা হুমায়রার কপালে আলতো চুমু দিলো। হুমায়রা চোখ বন্ধ করে ফেললো। একটু পর আবার চোখ খুলে বললো,

— “আপু তুমি আমার সাথে আজকে থাকবে?”

খাদিজা হাসলো। তারপর বললো,

— “ঠিকাছে থাকবো। এবার খুশি?”
— “হ্যাঁ।”
— “এবার ঘুমা।”
— “আমি ঘুমিয়ে গেলে তুমি চলে যেও না প্লিজ।”
— “যাবো না। আমি এখানেই থাকবো। তোকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাবো।”

হুমায়রা চোখ বন্ধ করে ফেললো। একটু পরেই ঘুমিয়ে গেলো। খাদিজা আস্তে করে হুমায়রাকে বালিশে শুইয়ে দিলো। সাদ হেটে এসে দুইজনের সামনে দাঁড়ালো। একটু ঝুকে হুমায়রার কপালে চুমু দিয়ে খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আজ থেকে তোমাদের একটা মিষ্টি সম্পর্কের শুরু হয়েছে। দেখো একদিন তোমাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হবে। দুজন দুজনাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। তোমার স্বামীর দোয়া বলে কথা।”

খাদিজা হেসে ফেললো। সাদও হাসলো। সাদের মুখটা দুইহাতে ধরে একটু টেনে এনে কপালে চুমু দিয়ে বললো,

— “তুমি চাইলে আমাদের রুমে ঘুমাতে পারো। অথবা এই রুমের সোফায়।”

খাদিজা মিটিমিটি হাসছে। সাদ বললো,

— “বাহ দুই সতীনের গলায় গলায় ভাব হয়েছে। এখন আমি তো পর হয়ে গেছি তাইনা।”

সাদ নিজেও হাসলো। ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে সোফায় শুয়ে পরলো। খাদিজা হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো।

এই দৃশ্যটা আজকের সমাজে খুবই বিরল। মাসনার বুকে ওয়াহিদা মাথা রেখে নিজের কষ্ট হালকা করছে। সাদ আনমনেই প্রশান্তির নিশ্বাস নিলো।

চলবে,,
® ‘নাহার।’

____________________
রেফারেন্স, [১] সূরা বাকারা: ২২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here