কাজললতা পর্ব ১৮

0
495

#কাজললতা
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_১৮

———————————————————————–
কলেজ থেকে বের হয়ে রওনা দিচ্ছি ইলমার মেসেজে পাঠানো মার্কেটের এড্রেসে। আজ দুজনেই প্ল্যান করেছি একসাথে সারাটাদিন ঘুরবো। ইলমা আমার আগেই বের হয়ে মার্কেটে গেছে। আর আমার খানিকটা দেরি হয়েছে লাইব্রেরি থেকে কিছু বই নিতে গিয়ে। যেতে যেতে হঠাৎই শুভর ফোন আসলো। শুভকে এখন আর ভাইয়া বলে ডাকি না আর এটা ওরই রিকোয়েস্ট। আমার আর শুভর রিলেশনের তিনদিন চলে। মোবাইল স্ক্রিনে “শ্যামপুরুষ ” নামটা ভেসে উঠতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
– হ্যালো কেমন আছে আমার প্রেয়সী?
– হুম আলহামদুলিল্লাহ তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। কই তুমি?
– আমি আজকে ইলমার সাথে মার্কেট যাবো। ইলমা এখন মার্কেটে আছে। আমি সেখানেই যাচ্ছি।
– ওহ আচ্ছা তাহলে সাবধানে যেও।
– ঠিক আছে।
মার্কেটের সামনে পৌঁছে ইলমাকে দেখতে না পেয়ে যেইনা ওকে ফোন করতে যাবো ওমনি পেছন থেকে “কাজললতা” বলে কারো ডাক শুনলাম। “কাজললতা” ডাক শুনে বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো। চিঠি ব্যতীত শুভ কখনোই আমাকে কাজললতা বলে ডাকে নি। কিন্তু আমি তো চেয়েছিলাম আমার চিঠিওয়ালা সেই প্রেমিক পুরুষের মুখ থেকেই “কাজললতা” সম্বোধনটা শুনতে। পেছনে ঘুরেই দেখি আমার সামনে সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন ছেলে আর একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
– জ্বি আমাকে বললেন?
– হুম। তুমিই তো কাজললতা তাই না?
ওনাদের মধ্যে একজন ছেলের মুখ থেকে এরূপ কথা শুনে আমি অসম্ভব ধরণের অবাক হয়ে গেলাম। কাজললতা নামটা তো শুধুমাত্র আমাকে শুভই ডাকতো। তাহলে এরা কি করে জানলো?
– কাজললতা? দুঃখিত আমার নাম কাজললতা না।
আমার কথায় ওরা প্রত্যেকে একে অপরের দিকে অবাক চাহনিতে তাকালো। তাদের মধ্যে আরেকজন ছেলে পাশে থাকা মেয়েটিকে ফিসফিস করে বললো,
– এই জান্নাত। তুই কি শিওর যে ইফতির মোবাইলে এই মেয়ের ছবিই দেখেছিলি?
– আরে হ্যা আমি একদম শিওর। দেখ ওর চোখগুলো একদম ব্রাউন যেটা আমি ইফতির মোবাইলে দেখেছিলাম।
ইফতি ভাইয়ার মোবাইলে আমার ছবি মানে? এটা কি করে সম্ভব? আসলেই কি ইফতি ভাইয়া তার মোবাইলে আমার ছবি রাখে?
– আচ্ছা সত্যি করে বলো তো। তোমার নাম কাজললতা না?
– না আপু আমার নাম কাজললতা না। আমার নাম ইভা।
আমার কথায় সকলে একসাথে হা হয়ে গেলো।
– কি বলছো? আচ্ছা তুমি কি ইফতিকে চিনো?আর ইফতি তোমার কি হয়?
– ইফতি আমার চাচাতে ভাই। বড় চাচার ছেলে হয়।
– মানে ইফতির সেই কাজললতা হচ্ছে ওর চাচাতো বোন? তাহলে ও কেনো তোমাকেই ওর বউ বলে সম্বোধন করতো সবজায়গায়? আর কেনোই বা তোমাকে কাজললতা বলে সবাইকে পরিচয় দিতো?
জান্নাত নামে আপুটার কথা শুনে যেনো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ইফতি ভাইয়া কেনো আমাকে বউ বলে সম্বোধন করবে? আর কাজললতা? এই নামেই বা কেনো ইফতি ভাইয়া আমাকে ডাকবে? তাহলে কি আমার চিঠি দেওয়া আসল প্রেমিক ইফতি ভাইয়া? তাহলে শুভ?শুভ কে?
– কি হলো বলছো না কেনো?
– দেখুন আপু আমি এসব কিছুই জানি না আর আপনাদের কথা বুঝতেও পারছি না। আপনারা হয়তো কোথাও ভুল করছেন। কেননা ইফতি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে আর ওনার নাম সুহাসিনী খান। সুহাসিনী আপুই হয়তো বা ইফতি ভাইয়ার সেই কাজললতা।
আমার কথা শুনে ওরা তিনজন একসাথে বলে উঠলো,
– কি?
– জ্বি বিশ্বাস না হলে আপনারা ইফতি ভাইয়ার মেডিকেলে যান। সেখানে সকলেই জানে ইফতি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড সুহাসিনী।
– কি বলছো কি এসব তুমি? আমরা ইফতির সেই মেডিকেলের প্রথম বর্ষের বন্ধু আর আমরাই জানি না ইফতির সাথে সুহাসিনীর রিলেশন রয়েছে? এটা একদমই ইম্পসিবল। সুহাসিনী কে তো ইফতি দু চোখে সহ্য করতে পারে না। আর তুমি কিনা বলছো সুহাসিনী ইফতির গার্লফ্রেন্ড? এসব কিছু তোমাকে সুহাসিনী বলেছে রাইট?
– জ্বি কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?
– সুহাসিনী একটু পাগলাটে টাইপের। এক কথায় ইফতির জন্যই ও পুরো পাগল। কিন্তু ইফতি ওকে মোটেও পাত্তা দেয় না ইনফেক্ট সহ্য পর্যন্ত করতে পারে না। গতকাল মেডিকেলে ইফতি আর সুহাসিনীকে নিয়ে কি একটা ঝামেলা হয়েছিলো। ইফতি সুহাসিনীর উপর প্রচন্ড রেগে চিৎকার করছিলো। পরে জানতাম পারলাম সুহাসিনী নাকি ইফতির সেই কাজললতাকে আজেবাজে কথা বলেছে আরও নাকি বলেছে সুহাসিনী নাকি ইফতির গালর্ফ্রেন্ড। একারণেই নাকি ইফতি প্রচুর পরিমানে সুহাসিনীর উপর রেগে ছিলো।
ওনাদের কথা শুনে একটু একটু করে নিজের মনে ক্ষত তৈরি হচ্ছিল৷
– তাহলে সুহাসিনী আপু যা বলেছে তা সব মিথ্যা? (আমি)
– হুম মিথ্যা। আর মেডিকেলের কিছু কিছু মানুষ মনে করে সুহাসিনী আর ইফতি হয়তো সত্যিই রিলেশনে রয়েছে কেননা সুহাসিনী যেমন মেডিকেলের প্রত্যেকটা ছেলের ক্রাশ এন্ড পড়ালেখায় টপে রয়েছে ঠিক তেমনি ইফতিও মেডিকেলের প্রত্যেকটা মেয়ের ক্রাশ এন্ড পড়ালেখায়ও টপ লিস্টে রয়েছে। একারণেই কিছু কিছু গুজব ছড়ানো স্টুডেন্টরা এসব বলে থাকে।
ইফতি ভাইয়ার বন্ধুর কথায় আমি ঘন ঘন শ্বাস নিতে শুরু করলাম। এসব কি শুনছু আমি? কি বলছে ওনারা?
– আরে আরে ঠিক আছো তুমি?
– জ্বি আপু ঠিক আছি। কিন্তু ইফতি ভাইয়া আমাকে কাজললতা বলে কেনো ডাকে? আর আপনারা কি শিওর যে ইফতি ভাইয়া যাকে কাজললতা বলে ডাকে সেটা আমি?
– হুম আমি একদম শিওর। যখনই কোনো মেয়ে ইফতিকে প্রপোজ করে বসে তখনই ইফতি বলে ” সরি আমার বউ আছে আর ওর নাম কাজললতা”। আমরা বন্ধুরা ইফতিকে ওর কাজললতা মানে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলেই ও বলতো ” একেবারে বিয়ের দিন আমার কাজললতাকে তোরা দেখতে পাবি “। একদিন লুকিয়ে ইফতির মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম সেখানে তোমার ছবি দিয়ে পুরো গ্যালারি ভর্তি। যখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটাকি সেই কাজললতা নাকি তখন ও একটা মুচকি হাসি দিয়েছিলো যার ফলে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ইফতির কাজললতা আর কেউ নয় বরং তুমি। সারা মেডিকেলের স্টুডেন্টরা ইফতির কাজললতা সম্পর্কে পুরোই ভাবুক। সারাটাক্ষন মেডিকেলের স্টুডেন্টদের মুখে একটাই প্রশ্ন কে এই কাজললতা?
ইফতি ভাইয়ার বন্ধুর মুখে এমন কথাগুলো শুনে আমার মাথায় বাজ পড়লো। ইফতি ভাইয়া কি তাহলে সত্যিই আমায় ভালোবাসে?
– শুভ? শুভ কি তাহলে কাউকে কাজললতা বলে ডাকতো না? কখনো কি এরকম কোনো নামে কারে কথা বলতো না?
– শুভ মানে ইফতির বেস্ট ফ্রেন্ড? নাহ ওর মুখে তো কাজললতা নামে কোনো মেয়ের কথাই আজ পর্যন্ত শুনি নি। কিন্তু ইফতি মেডিকেলে ভর্তির পর যবে থেকে সব মেয়ের ক্রাশ হয়ে উঠলো তবে দেখেই ওর মুখে কাজললতা নামটা শুনা যাচ্ছিল।
তারমানে কি শুভ আমার সাথে প্রতারণা করেছে? আমার চিঠি দেওয়া সেই প্রেমিকটাই কি তাহলে ইফতি ভাইয়া? একারণেই কি গত কয়েকমাস ইফতি ভাইয়া সুযোগ পেলেই আমাকে কাজল দিয়ে দিতো? নিজেকে সামলাতে না পেরে কখন যে মার্কেটের সামনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম তা নিজেও জানি না।
———————————————————————————
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে ইফতি ভাইয়ার রুমে আবিষ্কার করলাম। এই মুহুর্তে তো আমার মার্কেটে থাকার কথা ছিলো তাহলে ইফতি ভাইয়ার রুমে কি করে এলাম। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম ইফতি ভাইয়া চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে চেয়ারে বসে আছে। ইফতি ভাইয়ার বন্ধ চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিলো। ইফতি ভাইয়ার চোখের পানি দেখে আমার হৃদয় কেঁপে উঠলো। এই মুহুর্তে আমার মনে রয়েছে ইফতি ভাইয়াকে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। বিছানায় উঠে বসতে যাচ্ছিলাম কিন্তু শরীরে যেনো কোনে শক্তিই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কপালে ভেজা কাপড় দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার শরীরে কি পরিমাণে জ্বর রয়েছে। জ্বরের কারণে ভালো করে চোখ দুটো মেলতেও পারছিলাম না। সামান্য কাশি দিতেই ইফতি ভাইয়া ধরফরিয়ে উঠে আমার কপলা হাত দিয়েই হুট করে আমাকে তার কোলে নিয়ে নিলো। তারপর আমার গায়ে থাকা মোটা কাঁথাটা ভালো করে আমার গায়ে দিয়ে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে হুট করেই কপালাে একটা চুমু বসিয়ে দিলো। ইফতি ভাইয়ার এরকম কাজে চরম অবাক হলেও মুখ ফুটে কিছু বলার মতো শক্তি যেনো আমার ছিলো না। কিছুক্ষণ পর ইফতি ভাইয়ার বুকে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙতেই দেখতে পেলাম আশেপাশে অনেক মানুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধুমাত্র ইফতি ভাইয়া বাদে। আগের থেকে শরীরটা খানিকটা ভালো লাগায় বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই ছোটো কাকি বললো,
– আরে ইভা করছিসটা কি তুই? একে তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আবার শরীরটাও কি পরিমাণে দূর্বল তাও শুয়ে থাকতে মন চায় না তাই না?
– আমি এখন ঠিক আছে ছোটো কাকি। শুধুমাত্র মাথাটা একটু ভার হয়ে আছে।
– হুম কতোটা ভালো আছিস তা তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখন তুই শুয়ে পড় আর একদমই ওঠার চেষ্টা করবি না।
ছেটে কাকির সাথে পেড়ে উঠবো না জানি তাই চুপচাপ শুয়ে পড়লাম বিছানায়।
– আচ্ছা ইভা এখন বিশ্রাম করুক। ইলমা নাহয় ইভার সাথেই থাক। চলো তোমরা। আর ইভাকে এখন কোনো প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই (বড় চাচ্চু)
বড় চাচ্চুর কথায় একে একে সকলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
– কি হয়েছিলো তোর ইভা?এমন হুট করে তুই মার্কেটের সামনে জ্ঞান হারালি কিভাবে? (ইলমা)
– তেমন কিছু না। গরমে হটাৎ করে শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যার কারণে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাই।
– ওহ আচ্ছা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইলমা বললো,
-ইলমা
– হু
– আমি এখানে কি করে এলাম?
– জানি না রে। ইফতি ভাইয়া সবাইকে কল করে বলতে লাগলো তুই অসুস্থ হয়ে গেছিস তোকে দেখতে যেনো সকলে আমাদের বাসায় আসে। তোর অসুস্থতার কথা শুনে আমি মার্কেট থেকে দৌড়ে বাসায় চলে আসি। জানিস তোর জ্বর এতো বেশি ছিলো যে আমাদের থেকে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ইফতি ভাইয়া ছিলো। থার্মোমিটার দিয়ে তোর জ্বর মেপে যখন প্রচুর পরিমাণে জ্বর দেখলো তখন ইফতি ভাইয়া পাগলের মতো করছিলো। বারবার এদিক সেদিক ফোন করছিলো আর দৌড়াদৌড়ি করছিলো। মিনিমাম ভাইয়া পনেরো জন ডাক্তারকে তো কল করেছেই।
ইলমার কথায় নিজের প্রতি প্রচন্ড রাগ লাগছিলো। ইফতি ভাইয়া যা বলেছিলে ঠিক বলেছিলো। আমি প্রচন্ড বোকা একটা মেয়ে। যে যাই বলে তাই বিশ্বাস করি। শুভ বলেছে ও আমার সেই চিঠি দেওয়া প্রেমিক আর আমি বিশ্বাসও করে ফেলেছি। অথচ আমার কাছাকাছি থাকা আমার সেই চিঠি দেওয়া প্রেমিক পুরুষটাকে দেখেও দেখলাম না। যার কারণে তার ছোটো ছোট কেয়ারগুলোকে তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দিয়েছি।
– আমি মনে হয় অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি রে ইলমা।
– ভুল? কি ভুল?
– প্লিজ আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ।
আমার কথায় ইলমা আমার কাঁধে হাত রেখে শান্ত-শিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুম ত্যাগ করলো। আর এদিকে আমার অবস্থা যত যাচ্ছে খারাপ হয়েই যাচ্ছে। শুভ আর ইফতি ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতেই মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ইফতি ভাইয়ার রুমের দেয়ালে তাকাতেই দেখি নানা ধরণের চোখের বিভিন্ন ছবি যেগুলো দেখে আমার ভয় লাগতে শুরু করলো। এতো বড় বড় পোস্টার গুলো ছিলো যে সামনের দেয়ালেই তাকালেই মনে হয় একজোড়া বড় চোখ আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। ভয়ে দ্রুত কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
——————————————————————————–
বড় চাচ্চুর বাড়ির ছাদের এক পাশের দোলনায় বসে দোল খাচ্ছি। আগে যখন স্কুলে পড়তাম তখন প্রতিদিনই বড় চাচ্চুর বাসায় আসতাম। আমার মনে আছে একদিন আমি ইফতি ভাইয়াকে বলেছিলাম আমার জন্য যেনো দোলনা বানায় তাও এই ছাদেই। কেননা আমাদের নিজেদের বাড়ি ছিলো না বলে ছাদে দোলনা বানাতে পারতাম না। আমার একবার বলা আবদারেই ইফতি ভাইয়া লোক ডেকে দোলনা বানিয়ে ফেলে। সেদিন থেকেই এই দোলনাটা আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস হয়ে যায়।
চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে গেছে। বড় চাচ্চু আর কাকির জোড়াজুড়িতে আমাকে আর মাকে আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। তাছাড়া আমার জ্বর কমলেও পুরোপুরি এখোনো কমে নি। দোলনায় বসে একা একা পা দিয়ে ঠেলে দোল খাচ্ছি আর ভেবে চলছি শুভকে আর ইফতি ভাইয়াকে নিয়ে কি করা যায়। হুট করেই কেউ একজন পেছন থেকে দোলনায় ধাক্কা দিতে লাগলো। ইলমা ভেবে বলতে লাগলাম,
– আচ্ছা ইলমা ইফতি ভাইয়া কই রে? বিকেল থেকে দেখতে পাচ্ছি না যে।
– এই যে তোর পিছেই।
ইফতি ভাইয়ার কন্ঠস্বর পেতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি এতোক্ষণ ধরে ইফতি ভাইয়াই দোলনায় ধাক্কা দিচ্ছিল। আমি পিছনে তাকাতেই ইফতি ভাইয়া দোলনা ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
– ইফতি ভাইয়া
– হুম
– এসো এদিকে এসে বসো।
ইফতি ভাইয়াকে ডাকতেই ইফতি ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলো। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলতে লাগলাম,
– ইফতি ভাইয়া
-হুম
-কেনো লুকালে সত্যি কথাটা? কেনো সব কিছু যেনেও চুপ করে ছিলে? কেনো আমরা ভুলগুলো আমাকে ধরিয়ে দিলে নি?
ইফতি ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে লাগলো,
-বিশ্বাস করতি যদি আমি বলতাম সেই ব্যক্তিটা আমিই যে কিনা তোকে চিঠিপত্রের সাথে কাজল দিয়ে এসেছি? তোর সম্পূর্ণ মোহ ছিলো শুভর উপর। যদি আমি সত্যিটা তোকে বলতাম তাহলে হয়তো তুই আমায় মিথ্যাবাদীভেবে দূরে সরিয়ে যেতি। হয়তো বা আমি আমার কাজললতাকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলতাম।
ইফতির ভাইয়ার কথায় আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।
-তারমানে তুমিই আমার সেই চিঠিপ্রেমী পুরুষ?
ইফতি ভাইয়া আমার দিকে ফিরে বলতো লাগলো,
-উহু না। আমি শুধুমাত্র তোর চিঠি দেওয়া প্রমিক পুরুষই না বরং বাইশ বছরের প্রেমিক পুরুষ। যেই বাইশটা বছর ছিলো আমার কাছে সম্পূর্ণ তুই নামক কাজললতাটা। যখন তুই জন্ম হয়েছিলি তখন আমার নামের সাথে মিলিয়েই তোর নামটা সকলে রেখেছিলো। আর এটা ছিলো আমার আরও একটা আনন্দের জিনিস। আমি এই ভালোবাসাটাকে বাইশটা বছরের ভালোবাসা কেনো বলছি জানিস? আমার সাথে তোর সম্পর্কটা ভাই বোনের থাকলেও আমি কিন্তু সেটা ভাই বোন মনে করতাম না। আমার কাছে তুই নামটাই ছিলি সৌন্দর্যের প্রতীক। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ ছিলি তুই । ভালোবাসা জিনিসটা বুঝতে শেখার পর থেকেই তোর জন্য আমার মনে তৈরি হয়েছিলো একরাশ ভালোবাসা।
ইফতি ভাইয়ের কথা যতই শুনছি ততই আমি চরম অবাক হয়ে যাচ্ছি। আসলেই মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসাকে নিজের চোখের সামনে দেখেও চিনতে পারেনা। তারা সেই মানুষটির ভেতরের অনুভূতিটাকে বোঝার চেষ্টা করে না। তারা শুধুমাত্র সেই মানুষটির বাইরের কাজকর্ম দেখে তাকে নির্বাচন করে।
– তাহলে সুহাসিনী আপু?
– সুহাসিনীকে আমি সত্যিই কখনো চিনতাম না। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে ওর সাথে পরিচয় হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমি ওকে ইগনোর করতাম। আর শুভ ? আমার জীবনের সবকিছুর গোপনীয়তা সম্পর্কে একমাত্র জানতো শুভ। আমার জীবনের এমন কোনো কাহিনী নেই যা শুভ জানতো না। মেডিকেলে ভর্তির পর থেকেই ওর সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক তৈরি হয় আর তখন থেকেই আমার সব সিক্রেট আমি ওর কাছে বিশ্বাস করে শেয়ার করতাম । আমি যাকে কাজললতা বলে ডাকতাম সেটা যে তুই ছিলি তাও ও জানতো। কিন্তু কখনো ভাবি নি আমার সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুই আমার এতো বড় ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। শুভ তোকে সামনাসামনি প্রথম দেখেছিলো যেদিন আমরা সবাই তোদের কলেজে গিয়েছিলাম। আর তখন থেকেই ও তোর প্রেমে পড়ে যায়৷ আর সুহাসিনী তোর কাছে গিয়ে যা যা বলেছিলো সে সব কিছুই মিথ্যা ছিল যা শুভই ওকে শিখিয়ে দিয়েছিলো।
– তারমানে শুভ আমাকে যা বলেছে সব কিছু মিথ্যা বলেছে?
– হুম
– তাহলে আমি যখন পিয়নকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই চিঠিগুলো আমাকে কে দেয় তখনতো সে শুভর চেহারার কথাই বলেছিল।
– উনি ঠিকই বলেছিলো। আমি জানতাম একদিন না একদিন তুই পিয়নকে চিঠি দেওয়া ব্যাক্তির কথা জিজ্ঞেস করবি। একারণেই আমি শুভকে বিশ্বাস করে এই কাজ করতে পাঠাই।
-তাহলে তুমি কেনো আগে আমাকে এইসবকিছু বলো নি ইফতি ভাইয়া?
– ইভা তুই আমাকে কখনোই বিশ্বাস করতি না। চেয়েছিলাম তোর জন্মদিনে আমি সবকিছু তোকে বলে সারপ্রাইজ দিব। তোকে আমার মনে থাকা সকল ভালোবাসার কথা বলবো। আর একারণেই গত দুমাস আমি তোর সাথে যোগাযোগ রাখি নি।
ইফতি ভাইয়ার কথায় আমি হু হু করে কেঁদে দিলাম। ইফতি ভাইয়া আমাকে তার বুকে নিয়ে বললো,
– কাঁদিস না প্লিজ।
– তুমি ঠিকই বলেছিলে ইফতি ভাইয়া। আমি অনেক বোকা একটা মেয়ে। সহজেই মানুষের কথা বিশ্বাস করে ফেলি। নিজের চোখের সামনে থাকা আসল ব্যক্তিটাকে না খুঁজে আমি এক প্রতারণাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাকে আমি সেই চিঠি দেওয়া পুরুষ ভেবেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।
ইফতি ভাইয়া আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
– তুই জ্ঞান হারানোর পরই রিমন আমাকে কল করেছিলো মানে তোর সাথে মার্কেটের সামনে যারা কথা বলেছিলো তাদের মধ্যেই একজন। তুই জ্ঞান হারিয়েছিস এটা শোনার সাথে সাথে আমি তোকে হসপিটালে নিয়ে যাই। সেখানেই ওরা আমাকে সব খুলে বলে যে ওরা তোকে কি কি বলেছিলো যার কারণে তুই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস। তোকে হসপিটাল থেকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। আর হটাৎ করেই তোর গায়ে প্রচন্ড জ্বর চলে আসে তখনই আমি সবাইকে বাসায় ডাকে বলি যে তোর গায়ে প্রচন্ড জ্বর আসায় তুই জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিলি যার কারণে তোকে সেখানকার লোকেরা হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে আমার পরিচিত ডাক্তার থাকায় সে আমাকে কল করে আর আমি তোকে বাসায় নিয়ে আসি।
ইফতি ভাইয়ার বুকে চুপচাপ শুয়ে আছি আর ইফতি ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বারবার নিজের উপর রাগ উঠে আসছিলো এক প্রতরাণকে বিশ্বাস করার জন্য।
-এবার উঠে নিচে চল। সেই দুপুরে অল্প একটু খেয়ে শুয়ে পড়েছিলি আর কিছুই খাস নি। এবার নিচে গিয়ে বেশি করে খেয়ে তারপর ওষুধ খাবি বুঝেছিস।
– উহ এখন এতো আল্লাদ দিতে এসেছো কেনো হ্যা? সবসময় তো শত্রুতামি করো।
ইফতি ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– শত্রুতামি না করলে কি আর তোর সাথে এতো সুন্দর একটা সন্ধ্যা পেতাম। তোর সাথে কি এতোটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হতো আমার ?
ইফতি ভাইয়ার কথায় একটা মুচকি হেসে উঠে যেতেই ইফতি ভাইয়া আমার হাত ধরে বললো,
– আমার কাজললতাকে কিন্তু সবসময় কাজল দেওয়া চোখে দেখতে চাই। এই আশাটা পূরণ করবে তো আমার কাজললতা?
ইফতি ভাইয়ার মুখে কাজললতা ডাক শুনে মনে হলো হাজার দিনের স্বপ্ন যেনো আজ পূরণ হয়েছে। প্রিয় মানুষের মুখে প্রিয় ডাক সত্যি হৃদয় কাঁপানো সুরের মতো। একটা ভুল প্রিয় মানুষকে হারানোর মতো যন্ত্রণা দেয় যেমনটা ইফতি পেয়েছিলো শুভকে বিশ্বাস করে। আর আজ যেনো তাদের মধ্যে বাঁধা দেওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি আর নেই।

চলবে,,,,,,,🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here