কাজললতা পর্ব ১১

0
635

#কাজললতা
পর্ব:১১
লেখিকা:ইভা আক্তার।

🍁🍁🍁🍁🍁
বাড়িতে এসে ইফতি ভাইয়ার সাথে একটা কথাও বলি নি। কেমন জানি মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। বুঝতে পারছি না ইফতি ভাইয়া আমাকে সবার সামনে পেত্নি বলেছিলো বলে রাগ উঠছে নাকি ইফতি ভাইয়ার জিএফ আছে বলে। দুপুরে খাবার টেবিলে বসেও ইফতি ভাইয়ার সাথে কথা বললাম না। আমাকে রাগানোর আর কথা বলানোর অনেক ট্রাই করেছিলো কিন্তু আমি মুখ দিয়ে একটু শব্দও বের করি নি।
মাগরিবের নামাজের পর সব কাজিনরা আর ছোটো চাচ্চু মিলে ছাদে আড্ডা দিচ্ছি। ছোটো চাচ্চু একবার আমার আরেকবার ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছে। ইফতি ভাইয়া সেই কতক্ষণ ধরেই আমার দিকে এক পানে চেয়ে আছে কিন্তু আমি বাইরে তাকিয়ে থাকার ভান করছি। ছোটো চাচ্চু ইফতি ভাইয়াকে বললো,
– কি ভাতিজা? ভাতিজির সাথে কোনো সমস্যা হইলো নাকি? তো কি নিয়া ঝগড়া লাগছে? (ছোটো চাচ্চু)
ছোটো চাচ্চুর কথায় ইফতি ভাইয়া তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। সেটা দেখে ছোটো চাচ্চু বললো,
– ওহ বুঝেছি। এসব অহরহ সব প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেই ঘটে। বাচ্চার নাম রাখতে গিয়ে ঝগড়া লেগেছে তাই না (ছোটো চাচ্চু)
ছোটো চাচ্চুর কথা শুনে ইফতি ভাইয়া রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ডাক দিলো,
– ছোটো কাকি (ইফতি ভাইয়া).
ইফতি ভাইয়ার চিৎকারে ছোটো চাচ্চু দৌড়ে কাজিনদের মাঝখানে ঢুকে পড়লো। অবশ্য ইফতি ভাইয়ার আওয়াজ নিচ পর্যন্ত যায় নি ৷ ইফতি ভাইয়া উঠে আমার কাছে আসতে গেলেই নওশিন আপু বললো,
-ইফতি একটা গান গেয়ে শুনা তো আমাদের। দেখ ইমন গিটার নিয়ে এসেছে। আয় একটা গান গা (নওশিন আপু)
নওশিন আপুর কথায় ইফতি ভাইয়া তাদের কাছে গিয়ে গিটারটা হাতে নিলো।
– কিরে ইভা সেই কতক্ষণ ধরে দেখছি তোর মুড অফ। কি হয়েছে বল তো? মেঝো কাকি কি বকাবকি করেছে?(ইলমা)
– না রে তেমন কিছুই না। ভালো লাগছে না কেমন জানি বোরিং ফিল হচ্ছে (আমি)
– আরে এ জন্য? এদিকে আয় দেখ ভাইয়া গান গাবে এখন। এদিকে এসে বস (ইলমা)
ইলমা উঠে আমার হাত ধরে নিয়ে এসে ওর পাশে বসালো। আমি মুখ গোমড়া করে তাদের পাশে বসে ইফতি ভাইয়ার গান শুনার অপেক্ষা করছি। আমার মুখোমুখি ইফতি ভাইয়া বসে আছে। হাতে ইমন ভাইয়ার গিটার। কলেজে থাকতে ইফতি ভাইয়া কলেজের বিভিন্ন ফাংশনে গান গেয়েছে তাই তার গিটারের সুর অসাধারণ। ইফতি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে গান গাইতে শুরু করলো,,,,

“যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে
মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে
বাকিটা সময় যেন মরণ আমার
হৃদয় জুড়ে নামে অথৈ আঁধার
বাকিটা সময় যেন মরণ আমার
হৃদয় জুড়ে নামে অথৈ আঁধার

ব্যথার সমাধিতে বসে এ মন
ফোটায় আশার ফুল রাশি রাশি
যখন দেখি ওই মুখে হাসি

স্বপ্ন থেকে আসো নয়নেতে
নয়ন থেকে তুমি স্বপ্নে হারাও
জাগরণে এসে কাছে দাঁড়াও।

যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে
মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে
[বাকিটা সময় যেন মরণ আমার
হৃদয় জুড়ে নামে অথৈ আঁধার]২

শিশুকালের রূপকথাগুলো
পায়ে পায়ে সব আসে ফিরে
তোমার কথা রূপকথা ঘিরে

ভুলে ভরা যত স্বরলিপি
গানের কোকিল হয়ে ওঠে ডেকে
কাছে এলে তুমি দূরে থেকে।
যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে
মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে
[বাকিটা সময় যেন মরণ আমার
হৃদয় জুড়ে নামে অথৈ আঁধার]-৪”
…………………………………………………………………………
ইফতি ভাইয়ার গান শেষ হতেই সকল কাজিনরা করো তালি দিতে শুরু করলো। তাদের তালির শব্দে আমার হুশ ফিরে আসলো। সাথে সাথে দুজনেই চোখ সরিয়ে নিলাম।
– বাহ বাহ ভাতিজা পুরো ফাটিয়ে দিয়েছিস। এই না হয় আমার ভাতিজা ওয়াহ (ছোটো চাচ্চু)
ছোটো চাচ্চুর কথায় ইফতি ভাইয়া একটু মুচকি হাসলো।
-সত্যিই ইফতি ভাই। আপনার গানের জবাব নেই। আপনি কিন্তু চাইলেই চোখের ডাক্তারের পাশাপাশি একজন সিঙ্গারও হতে পারেন। দেখবেন সকলে আপনার বড় ফ্যান হয়ে যাবে (ইমন ভাই)
ইমন ভাইয়ের কথায় শুনে ইফতি ভাইয়া এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে তারপর ইমন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি চোখের ডাক্তার সকলের জন্য কিন্তু একজন গায়ক শুধুমাত্র আমার প্রিয় সেই মানুষটার জন্য। তার কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে হাজার হাজার গান রচনা করে তাকে শুনাতে চাই। আমার সেই প্রেয়সীর মুগ্ধ নয়নের দিকে তাকিয়ে আমি আমার সকল আবেগ আর ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই। তাকে বলতে চাই যে আমাকে মারার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে তার মায়াতে ভরপুর সেই চোখ জোড়া। (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার প্রেমের রোমান্টিক আবেগীয় কাহিনী শুনে উপস্থিত সকলে হা হয়ে গেলো। আসলেই কি আমরা আমাদের ইফতি ভাইয়ার মুখ থেকে এসব শুনছি? যে ছেলে কিনা আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় নি সেই ছেলেই একটা মেয়ের প্রশংসা করছে?
– ইফতি? এসব কি শুনছি আমরা? তারমানে তুই প্রেমে পড়েছিস? লাইক সিরিয়াসলি? আমাদের ইফতি প্রেমে পড়েছে বাহ (নওশিন আপু)
– আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে ইফতি ভাইয়া একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে। আমি শিওর যে ইফতি ভাইয়া আমাদের সাথে ফ্লার্ট করছে (নাহিল ভাইয়া)
– কেনো? কেনো? তুমি মেয়েদের পিছে আঠার মতো ঘুরতে পারো তাতে দোষ নেই? অথচ আমার ভাইটা একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে তাতে দোষ? বাহ কি যুক্তি তোমার (ইলমা)
– এই ইলমা একদমই বাজে কথা বলবি না। তোর কাছে প্রমাণ কি যে আমি মেয়েদের পিছে ঘুরে বেড়াই? (নাহিল ভাইয়া)
– প্রমাণ লাগবে তোমার? প্রমাণ? আচ্ছা বলছি। ওই দিন মনে আছে যে আমার কোচিংএর সামনে দাড়িয়ে কি করছিলে? একটা মেয়ের ফোন নম্বর,,,,,(ইলমা)
ইলমা পুরোটা বলার আগেই নাহিল ভাইয়া এসে ইলমার মুখ চেপে ধরলো।
-হয়েছে হয়েছে থাম বোন আমার। এসব কথা পাব্লিক প্লেসে কেনো বলছিস? (নাহিল ভাইয়া)
– ওকে থামিয়ে লাভ নেই আমি সবই জানি আমার আদরের সোনা মনা ভাইটা। আম্মুকে বলি নি এটা তোর ভাগ্য নাহলে আজ তোর পিঠের ছাল উঠিয়ে দিতো (নওশিন আপু)
নওশিন আপুর কথা শুনে নাহিল ভাইয়া একটা ঢোক গিলে তার ৩২ টা দাঁত বের করে হাসি দিলো। নওশিন আপু একটা ভেংচি দিয়ে ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ইফতি তুই কার কথা বলছিস বল তো? কে সেই মেয়েটা আমিও একটু শুনি। দেখি চিনতে পারি নাকি? (নওশিন আপু)
– মেয়ে? কোন মেয়ে? কিসের কথা বলছো তুমি? (ইফতি ভাইয়া)
-একদম নাটক করবি না। এতোক্ষণ যে তোর সেই সুন্দরী প্রেমিকাকে নিয়ে এতো ব্যাখ্যা দিলি সে কে? (নওশিন আপু)
– প্রেমিকা? কি বলছো কি তুমি? কই আমার তো কোনে প্রেমিকা নেই (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় সকলে হকচকিয়ে গেলো। আর এদিকে আমি উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
-তার মানে তোমার জিএফ নেই তাই তো (আমি)
– না নেই। কিন্তু আমার একটা সুন্দরী শশুরের মেয়ে আছে। যাকে এক পলক দেখার জন্য আমি আমার বাসা থেকে ছুটে যাই (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় আমার পুরো মুখ কালো হয়ে গেলো। লোকটা এতো ঘুরানো পেচানো কেনো কে জানে। ডাইরেক্ট বললেই তো পারে যে তার একটা পছন্দের মেয়ে আছে।
সেদিন সারাটা সন্ধ্যা সকলে ইফতি ভাইয়ার মুখ থেকে সেই মেয়ের কথা বের করার হাজারো চেষ্টা করেছিলো তবে তাদের সকল চেষ্টাই বিফলে গেলো। আর এদিকে আমি চুপচাপ ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি। মনটা ভিষণ একাকি লাগছে। সকলের মুখে একটাই কথা ইফতি ভাইয়া যেহেতু কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছে নিশ্চয়ই মেয়েটা ভারী সুন্দরী হবে। হয়তো বা মেয়েটি ইফতি ভাইয়ারই মেডিকেলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে হবে। ইফতি ভাইয়া যেমন একটা মেয়েকে ভালোবাসে আমিও তো তেমনি একটা ছেলেকে ভালোবাসি। আমার সেই চিঠি দেওয়া শ্যামপুরুষ। কিন্তু যাকে কখনো দেখিই নি, যার গলার স্বর কখনো শুনিই নি তাকে কি সত্যিই মন থেকে ভালোবাসা যায়? কে জানে।
সকলে গিয়েছে নিচে লুডু খেলতে। আমাকে অবশ্য তারা নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলো কিন্তু আমি না করে দিয়েছি। তাই তারাও আর আমাকে ডাকে নি। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে উপরের চাঁদটাকে দেখছি। আচ্ছা চাঁদ এতো সুন্দর তাও এর কোনো সঙ্গী নেই কেনো? সুন্দরী রমনীর প্রেমেই তো সকলে পড়ে তাহলে চাঁদের কোনো প্রেমিক নেই কেনো? হঠাৎই পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ পেলাম। তাকিয়ে দেখি ইফতি ভাইয়া এসেছে। আমি ইফতি ভাইয়াকে দেখেও না দেখার ভান করে চাঁদের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
– আজকে সারাটাদিন আমার সাথে কথা বললি না কেনো? কি হয়েছে তোর? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথা শোনার পরও কোনো জবাব দিলাম না। সেই আগের মতোই উপরে তাকিয়ে আছি।
– আমি তোকে কিছু বলছি। তোর কি কানে যাচ্ছে না? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কথায় কোনো জবাব না দিয়ে চলে যেতেই ইফতি ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে একদম তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো। ইফতি ভাইয়ার গরম নিশ্বাস আমার মুখে এসে পড়তেই সারা শরীরে শিহরণ ধরিয়ে দিলো।
– চুপ করে আছিস কেনো? আমার কথায় জবাব দে। আমি কি কোনো ভুল করেছি? (ইফতি ভাইয়া)
– আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য মোটেও বাধ্য নই। কে তুমি? কি হও আমার? তুমি আমার শুধুমাত্র চাচাতো ভাই। এছাড়া আমার উপর তোমার একদমই অধিকার নেই। তাই মোটেও নিজের অধিকার আমার উপর খাটানোর চেষ্টা করবে না (আমি)
– তোর জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিনও আমি তোকে বোন বলে মনে করি নি (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় বুকটা ফেটে গেলো। এতোটাই ঘৃণা করে আমায়? খুব কষ্টে বললাম,
-কিন্তু আমি তোমাকে ভাই বলেই মনে করি (আমি)
কথাটা বলে চলে আসতেই পেছন থেকে ইফতি ভাইয়া বলে উঠলো,
– আমার কথার জবাব না দিলে কিন্তু আমি ভেবে নিবো যে আমার জিএফ আছে বলে তুই জেলাস ফিল করছিস। বায় এনি চান্স তুই আবার আমার প্রেমে টেমে পড়লি না তো? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় চোখ কপালে উঠে গেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখি ইফতি ভাইয়া ঠোঁট কামরে হাসছে। চারপাশে একবার তাকিয়ে দৌড়ে ইফতি ভাইয়ার সামনে এসে বললাম,
-মোটেও না। তোমার জিএফ আছে না বউ আছে তাতে আমার কি? একদমই বাজে কথা বলবে না। তোমার প্রেমে পড়ার থেকে থেকে ইমন ভাই কে বিয়ে করে সংসার করা অনেক ভালো (আমি)
-ওহ তার মানে তুই ইমনের প্রেমে পড়েছিস তাই তো? ঠিক আছে। তাহলে আমি গিয়ে মেজো চাচ্চুকে বলি যে আমাদের প্রিয় ইভা রানী নওশিন আপুর চাচাতো ভাই ইমনের প্রেমে পড়েছে এবং তাকে বিয়ে করে সংসার করতে চায়। কেমন? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় ভয়ে একটা বড়সড় ঢোক গিললাম। আল্লাহ না করুক যদি এই রাক্ষসটা সত্যি সত্যি বাবাকে কথাটা বলে দেয় তাহলে না জানি বাবা আমার কি অবস্থা করবে।
– না না না আমি তো মজা করেছি ইফতি ভাই। প্লিজ বাবাকে কিছুই বলো না। ট্রাস্ট মি ওই ইমন ভাইয়াকে আমি বিয়ে করতে চাই না। ওনাকে ছাড়া আমি দুনিয়ার সবাইকে বিয়ে করতে রাজি (আমি)
-তার মানে আমাকেও বিয়ে করতে রাজি? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কথাটা ঠোঁট কামড়ে বললো।
-তাহলে কি আমি ভেবে নিবো তুই আমাকে ভালোবাসিস আর বিয়েও করতে চাস? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথাগুলোয় প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো। কি পেয়েছে আমাকে? তার থেকে ছোটো বলে আমার সাথে ফ্লার্ট করতে পারবে? আমার কি মন বলে কিছুই নেই? রাগের মাথায় চিৎকার করে বললাম,
-না আমি তোমাকে ভালোবাসি, না আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কি ভেবেছো আমাকে? তোমার থেকে বয়সে ছোটো বলে অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবেসে আমার সাথে এসে ভালোবাসা নিয়ে ফ্ল্যার্ট করবে? আমারও মন বলে কিন্তু একটা জিনিস আছে সেটা ভুলে যেও না। কষ্ট কিন্তু আমিও পাই। তুমি যেমন কাউকে ভালোবাসো আমিও তেমনি একজনকে ভালোবাসি বুঝতে পেরেছো? আমি ভালোবাসি আমার সেই চিঠি দেওয়া শ্যামপুরুষকে। আর বিয়ে করলে আমি তাকেই করবে। অন্য কাউকে কোনো দিনও না। (আমি)
জানি না কোথা থেকে এতোটা সাহস পেয়ে কথাগুলো ইফতি ভাইয়াকে বলে ফেললাম। কথাগুলো বলেই হনহন করে নিচে এসে রুমের দরজা আটকে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আসার সময় ইফতি ভাইয়ার ওই কালো হয়ে যাওয়া মুখখানিও দেখেছিলাম। ইফতি ভাইয়া তার পছন্দের মেয়ের কথা বলতে পারলে আমি কেনো বলতে পারবো না? অবশ্যই আমার বলার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ভয় হচ্ছে ইফতি ভাইয়া আমার বলা কথাগুলো যদি বাবাকে বলে তাহলে কি হবে আমার?
কিছুক্ষণ রুমে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলাম। বাকি কাজিনরা নওশিন আপুর রুমে লুডু খেলছে। বড় কাকির ডাকে ডায়নিং রুমে গেলাম ডিনার করতে। ভেবেছিলাম ইফতি ভাইয়া হয়তো বাবাকে আমার বলা শ্যাপুরুষের কথাগুলো হয়তো বলে দিয়েছে। কিন্তু খাবার রুমে গিয়ে দেখি সকলে একদম হাসিমুখে শান্তশিষ্টভাবে গল্প করছে আর খাচ্ছে। ডায়নিং টেবিলে সকলে উপস্থিত একমাত্র ইফতি ভাইয়া বাদে। চুপচাপ চেয়ারে বসতেই দাদুভাই বলে উঠলো,
– আমাদের ইফতি কই? সন্ধ্যা থেকে যে ওকে আর দেখলামই না (দাদুভাই)
-ঠিক তো। কোথায় ইফতি? (বড় কাকি)
-ইফতি মনে হয়ে ছাদেই আছে বড় মামি। লুডু খেলতে বসার সময় আমাদের বলে ছাদে চলে গিয়েছিলো (নওশিন আপু)
-ইভা মা। যাতো গিয়ে ইফতিকে ডেকে নিয়ে আয় (বড় কাকি)
বড় কাকির কথায় নাও তো বলতে পারি না। তাই লক্ষী মেয়ের মতো ছাদে চলে গেলাম ইফতি ভাইয়াকে ডাকতে। ছাদে গিয়ে দেখি ইফতি ভাইয়া কার সাথে যেনো উত্তেজিত হয়ে ফোনে কথা বলছে। একটু কাছে যেতেই শুনতে পেলাম ইফতি ভাইয়া বলছে,
-তুই এতো কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারলি জবাব দে আমায়। আজ তোর জন্যই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তিটাকে হারিয়ে ফেলতে চলেছি। মনে রাখিস শুভ। যদি আমি ওকে তোর জন্য কখনো হারিয়ে ফেলি তাহলে তোকে আমি কখনোই ছাড়বো না (ইফতি ভাইয়া)
কথাটা বলে ফোন পকেটে রেখে পেছনে ফিরতেই ইফতি ভাইয়া আমাকে দেখতে পেলো। ইফতি ভাইয়ার পারসোনাল ব্যাপারে নাক না গলিয়ে মাথা নিচু করে ভদ্র মেয়ের মতো বললাম,
-সবাই তোমাকে খাওয়ার জন্য টেবিলে ডাকছে। চলে এসো (আমি)
কথাটা বলেই সেখান থেকে প্রত্যাখ্যান করলাম। ডায়নিং টেবিলে বসে খেতে বসেছিলাম তখনই ইফতি ভাইয়া চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লো,
-কি হয়েছে আমার ইফতি দাদু ভাইয়ের? এতো মন খারাপ কেনো? (দাদুভাই)
ইফতি ভাইয়া স্বভাবসুলভ একটা হাসি দিয়ে বললো,
-কই কিছু না (ইফতি ভাইয়া)
-কিছু না বললেই চলে নাকি ভাতিজা? একবার দেখি ইভার মুড অফ আরেকবার দেখি তোর মুড অফ। বুঝলাম না আজকে কি মন খারাপের দিবস নাকি? (ছোটো চাচ্চু)
-তাহলে তুমিও মন খারাপ করে বসে থাকো কেমন ছোটো চাচ্চু? (নাহিল ভাইয়া)
-মন খারাপ? সেটা তো আজীবনই থাকে ভাতিজা। বিয়ে করলে বুঝবা ঠেলা (ছোটো চাচ্চু)
ছোটো চাচ্চু কথাটা বলেই ছোটো কাকির দিকে তাকিয়ে দেখলো ছোটো কাকি রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। না দেখার ভান করে ছোটো চাচ্চু খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
– ইফতি দাদুভাই খান বাড়ির পেছনের দিকে খুব সুন্দর ব্রিজ বানানো হয়েছে। আর তার পাশেই নদী। পূর্নিমার রাত তো তাই বোধ হয় চারিদিকে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে এখন। মন খারাপ হলে সেখানে গিয়ে বসে থাকিস দেখবি মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে (দাদুভাই)
দাদুভাইয়ের কথা শেষ হতেই ইফতি ভাইয়া খাবার না খেয়েই উঠে পড়ে কাউকে কিছু না বলেই বাইরে চলে গেলো। সকলে ইফতি ভাইয়ার যাওয়ার পানে প্রশ্নসূচকভাবে তাকিয়ে আছে।
রাতের খাওয়া শেষে সকলে যে যার মতো রুমে শুতে গিয়েছে। ইফতি ভাইয়া এখোনো বাড়িতে আসে নি। রাতে না খেয়ে বাইরে যাওয়ার ফলে বড় কাকি প্রচন্ড টেনশনে পড়ে যায়। বাকি সবাই বড় কাকিকে কোনো রকম ভুলিয়ে -ভালিয়ে বলেছে যে “ছেলে মানুষ একা আর কতক্ষণ ঘরে থাকবে। ঘরে থেকে মন খারাপ হয়েছিলো তাই হয়তো বাইরে গিয়েছে। সমস্যা টা কোথায়?” সকলের কথায় বড় কাকির মন শান্ত হতেই রুমে চলে গেলো ঘুমোতে। ঘুমোতে এসে বারবার বিছানায় এপিঠ ওপিঠ করছি। ইফতি ভাইয়া বাড়িতে আসলে ঠিকই বাইরের গেট খোলার শব্দ শোনা যেতো। ইফতি ভাইয়া এতো রাতে এখোনো বাড়িতে না ফিরায় চিন্তায় চোখের সব ঘুম সব উড়ে গেছে। পাশেই ইলমা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে যেনো তার ভাইয়ের জন্য তার কোনো টেনশনই নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২ টা ৪৫ বাজে। হায় আল্লাহ এতে রাতে ইফতি ভাই এখোনো বাইরে? কোনো বিপদ আপদ হলো না তো? এতো রাগে তো বাইরে একটা কীটপতঙ্গও নেই। চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। বিছানা থেকে উঠেই মাথায় ওড়না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য ইফতি ভাইয়াকে খুঁজতে খান বাড়ির পেছনের ব্রিজের রাস্তায় যাবো। আমার মন বলছে ইফতি ভাইয়া ওখানেই আছে। ধীর পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খান বাড়ির পেছনের ব্রিজের রাস্তায় গেলাম। চাঁদের আলোয় চারদিক এতোটাই আলেকিত হয়ে আছে যে অতিরিক্ত মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোরও প্রয়োজন পড়ে নি। খান বাড়ির ব্রিজের সামনে আসতেই দেখতে পেলাম ইফতি ভাইয়া ব্রিজে বসে আছে পা ঝুলিয়ে। ইফতি ভাইয়াকে দেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ধীর পায়ে ইফতি ভাইয়ার কাছে গেলাম যাতে আমাকে হুট করে দেখে ভয় পেয়ে আবার যেনো নদীতে পড়ে না যায়। কিন্তু আমার চিন্তা ভাবনা ছিলো পুরোটাই ভুল। ইফতি ভাইয়ার পাশে যেতেই হুট করে ইফতি ভাইয়া আমার দিকে তাকালো যার ফলে আমি ভয়ে চিৎকার দিতেই ইফতি ভাইয়া আমার মুখে হাত দিয়ে ধরলো।
-কি করছিস এখানে? এতো রাতে এখানে কেনো এসেছিস? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার হাত আমার মুখের উপর থাকায় কথা বলতে পাড়ছিলাম না। মুখ থেকে শুধু “উম” “উম” বেরোচ্ছিলো।জিনিসটা ইফতি ভাইয়া খেয়াল করতেই মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে ফেলে। ইফতি ভাইয়া হাত সরাতেই আমি জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলাম।
-ঘড়ির দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেছো যে এখন কয়টা বাজে? (আমি)
আমার কথায় ইফতি ভাইয়া তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কোনো রকম অবাক না হয় বললো,
– হুম ১ টা বাজে (ইফতি ভাইয়া)
– একটা বাজা কি তোমার কাছে কম মনে হচ্ছে? আশেপাশে তাকিয়ে দেখো কোনো লোক নেই। ভুত – টুত এসে তোমাকে খেয়ে ফেললেও লোকে বাঁচাতে আসবে না (আমি)
– বেশি কথা না বলে কেনো এসেছিস এটা বল (ইফতি ভাইয়া)
– সেই সাড়ে দশটা বাজে তুমি না খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো আর এখন একটা বাজে তাও বাড়িতে ফিরো নি। এ জন্য খুব টেনশন হচ্ছিল (আমি)
শেষের কথাটা বলেই মাথা নিচু করলাম।
-আমার জন্য তোর টেনশন হচ্ছিল? কেনো? (ইফডি ভাইয়া)
– এমনিই। তুমি আগে জবাব দেও এতো রাতে এতোক্ষণ ধরে এখানে বসে কি করছিলে? (আমি)
আমার কথায় ইফতি ভাইয়া গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
-আমি তোর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য মোটেও বাধ্য নই। কে তুই? কি হস আমার? তুই আমার শুধুমাত্র চাচাতো বোন। এছাড়া আমার উপর তোর একদমই অধিকার নেই। তাই মোটেও নিজের অধিকার আমার উপর খাটানোর চেষ্টা করবি না (ইফতি ভাইয়া)
একি? আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। কত বড় বজ্জাত একটা। রাগে দুঃখে সেখান থেকে চলে আসতেই ইফতি ভাইয়া আমায় কোলে তুলে নিলো। ইফতি ভাইয়ার এমন কাজে আমি অবাকের চরম সিমানায় পৌঁছে গেলাম। ইফতি ভাইয়া আমাকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে নদীর পাড়ে বসালো। এখনো ইফতি ভাইয়া তার কোলেই আমাকে বসিয়ে রেখেছে। ইফতি ভাইয়ার এতো কাছে এসে যেনো আমার হৃৎস্পন্দনের গতি প্রচন্ড পরিমাণে বেড়ে গেলো। কিছু বলতে যাবো তার আগেই ইফতি ভাইয়া তার আঙ্গুল আমার ঠোঁটে দিয়ে কথা না বলতে ইশারা করলো। ইফতি ভাইয়া আর আমি একে অপরের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছি। পূর্ণিমার চাঁদের আলো একদম ইফতি ভাইয়ার চেহারায় এসে পড়লো। চাঁদের আলোয় ইফতি ভাইয়াকে অসাধারণ সুন্দর লাগছিলো। হালকা বাতাসে ইফতি ভাইয়ার চুলগুলো দুলছিলো। হঠাৎ করে ইফতি ভাইয়া আমাকে কোল থেকে নামিয়ে তার সামনে বসিয়ে দিলো আর ইফতি ভাইয়া আমার পিছে বসে কাঁধে তার থুতনি ঠেকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বললো,

“এই চাঁদের আলো আমাদের প্রতিদিনের প্রেম আলাপের সঙ্গী হয়ে থাকুক।
এই চাঁদের আলোয় আলোকিত তোমার মুখখানি আজীবন আমার সামনে ভাসুক।
আমি এই মায়াবতীর মুখখানি দেখে সারাজীবন পাড় করে দিবো,
তাই তো যেনো সে আমায় ভালোবাসুক। ”

চলবে,,,,,,,,,,🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here