কাজললতা পর্ব ১০

0
638

#কাজললতা
পর্ব: ১০
লেখিকা: ইভা আক্তার।

🍁🍁🍁🍁🍁
সকালে বাজলো আরেক ঝামেলা। ইফতি ভাইয়ার দাবি আমি নাকি তার ব্রাশ ব্যবহার করেছি। এই নিয়ে সকাল থেকে ইফতি ভাইয়ার যত চিৎকার-চেঁচামেচি। ঘুম থেকে উঠেই ইফতি ভাইয়া আমাকে ব্রাশ করতে দেখে চিৎকার করা শুরু করে দিলো। অন্যের ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছি? তাও আবার আমি? ইয়াক থু। আজ পর্যন্ত অন্যের মুখ লাগানো পানি পর্যন্ত খাই নি আর ব্রাশ ব্যবহার তো দূরের কথা। এই ইফতি ভাইয়ার যে হঠাৎ হঠাৎ কি হয় আল্লাহ জানে।
– ইভার বাচ্চা। বাড়িতে এতো মানুষের ব্রাশ থাকতে তুই আমার ব্রাশ কোন সাহসে ইউজ করলি হ্যা?আর আমার ব্রাশ তোর পছন্দ হয়েছে সেটা বলললেই হতো আমি দোকান থেকে কিনে দিতাম কিন্তু তাই বলে তুই আমার ব্রাশ নিয়ে ব্যবহার করবি এটা কি ধরণের নির্যাতন? (ইফতি ভাইয়া)
-সেটআপ ইফতি ভাইয়া। কি সব বাজে বকছো তুমি হ্যা? আমার এখনো এমন অসহায় দিন আসে নি যে নিজের ব্রাশ রেখে অন্যের ব্রাশ ব্যবহার করবো। অন্ধ লোকদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই আবার অন্ধ হয়ে যাও নি তো। (আমি)
আমার কথায় ইফতি ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বাথরুমে ঢুকে হাতে করে একটা ব্রাশ নিয়ে এসে ছোঁ মেরে আমার হাতের ব্রাশটাও নিয়ে দেখিয়ে বলতো লাগলো,,
– আমি অন্ধ তাই না? তুই অন্ধ। বিশাল বড় অন্ধ। ভালো করে চেয়ে দেখ তোর ব্রাশের নিচটা সাদা রঙের আর আমার ব্রাশের নিচটা নীল রঙের (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার হাতের ব্রাশগুলো দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। তার মানে আমি এতোক্ষণ ধরে ইফতি ভাইয়ার ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজেছি। ভাবতেই গা গুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমিও ছেড়ে দেবার পাত্রী না। ইতিমধ্যে বাড়ির সকলেই আমাদের ঝগড়া শুনে দৌড়ে এসেছে।
– এখানে আমার দোষটা কথায় হ্যা? দুনিয়াতে এতো রঙের ব্রাশ থাকতে আমার ব্রাশের মতোই ব্রাশ কেনো কিনতে হবে তোমায়? (আমি)
– ওহ আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। এখন থেকে তাহলে আমার তোকে জিজ্ঞেস করে ব্রাশ কিনতে হবে তাই না? ব্রাশ কোম্পানি কি তোর শশুরের? (ইফতি ভাইয়া)
– এই ইফতি ভাইয়া একদম আমার শশুর তুলে কথা বলবে না। নিজের দোষ ঢাকতে আমায় কেন দোষ দিচ্ছো? এখানে কোথাওই আমি আমার দোষ দেখতে পাচ্ছি না (আমি)
– দেখতে পাবি কিভাবে? তুই তো বড় মাপের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তোর জন্য মনে হয় আমাকে এখনই মেডিকেল পাশ না করেই ডাক্তার হতে হবে। যে মানুষ নিজের সামান্য ব্রাশই চিনতে পারবে না সে তো ভবিষ্যতে নিজের জামাইকে দেখলেও বলবে এটা আমার জামাই না। কি ভয়ঙ্কর মহিলা বাবারে বাবা (ইফতি ভাইয়া)
– আমি আমার জামাইকে চিনতে পারবো নাকি পারবো না তাতে তোমার কি তুমি তো আর আমার জামাই না (আমি)
– আরে আরে থাম তোরা। সামান্য ১০ টাকার ব্রাশ নিয়ে এভাবে ঝগড়া কেনো করছিস তোরা? ( ছোটো চাচ্চু)
– ১০ টাকার ব্রাশ মানে? ( আমি আর ইফতি ভাইয়া একসাথে)
আমাদের এমন ধমক শুনে ছোটো চাচ্চু চুপসে গেলো। ইফতি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে নিজের শার্টের কলার টেনে বলতে লাগলো,
– তোর ভাগ্য অনেক ভালো যে বাড়িতে এতো মানুষের ব্রাশ থাকতে আমার ব্রাশ দিয়েই তুই ব্রাশ করেছিস। (ইফতি ভাইয়া)
– কি? আমার ভাগ্য ভালো?আমার তো প্রচুর বমি পাচ্ছে। ওয়াক ওয়াক। মনে হয় পেটের নাড়ি-ভুড়ি সব বেরিয়ে যাবে। ইয়া মাবুদ এতো মানুষের ব্রাশ থাকতে এর ব্রাশই কেনো ব্যবহার করলাম। (আমি)
আমার কথা বোধ হয় ইফতি ভাইয়ার গায়ে লাগলো খুব।
– কি বললি তুই? নিজে তো বছরে একদিনও ব্রাশ করিস কিনা সন্দেহ আর আমাকে বলছিস আমি ব্রাশ করি না? আগে নিয়মিত ব্রাশ কর তারপর আমার সাথে লাগতে আয়। ছেঁচড়া মেয়ে কথাকার (ইফতি ভাইয়া)
– আরে হয়েছে ইফতি দাদু ভাই থাম। ব্রাশ নিয়ে আর কোনো ঝগড়াঝাটি করতে হবে না। আমি আজই তোর জন্য নতুন ব্রাশ কিনে আনবো। (দাদুভাই)
দাদুভাইয়ের কথায় ইফতি ভাই গা ছাড়া ভাব নিয়ে ব্রাশগুলো নিয়ে বাথরুমের ভিতর চলে গেলো। আর এদিকে আমার অবস্থা বেহাল। কিভাবে আমি অন্য একজনের ব্রাশ ব্যবহার করলাম। ভাবতেই গা গুলিয়ে বমি আসছে। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে থু থু ফেললাম। আজ আর মনে হয় আমার খাওয়া হবে না। সবাই চলে যেতেই কিছুক্ষণ পর দেখলাম ইফতি ভাই আসছে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে। ইফতি ভাই ব্রাশ কোন দিক থেকে পেলো খেয়াল করতেই দেখলাম ব্রাশটা আমার। এটা দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো।
– এই ইফতি ভাইয়া এটা তুমি কি করলে। আমার ব্রাশ কেনো ব্যবহার করছো তুমি? (আমি)
– তুই আমার ব্রাশ ইউজ করলি আমিও তোর ব্রাশ ইউজ করলাম। হিসাব বরাবর। (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কথাটা বলেই বাথরুমে ঢুকে পড়লো। আর এদিকে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। ইফতি ভাইয়া আমার থেকেও প্রচুর খুঁতখুঁতে স্বভাবের। যে ছেলের জিনিস অন্য কেউ ব্যবহার করলে সেটা আর জীবনে ধরেও দেখে না। সেই ছেলে আজ অন্য একজনের ব্রাশ দিয়ে দাতঁ মাঝছে। তাও আবার ইচ্ছে করে। অদ্ভুত!
🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁
সকালের নাস্তা করেই আমরা কাজিনরা বের হলাম মারকেটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে ইমন ভাইয়াও আছে।যদিও আমাদের মারকেট করা কমপ্লিট। আমরা ঢাকা থেকেই নওশিন আপুর বিয়ের জন্য সব কিনে নিয়েছিলাম। ছোটো খাটো কিছু কিনার জন্যই মূলত মারকেটে যাওয়া । নওশিন আপু আর তানিয়া ব্যতীত আমরা তিন কাজিন যাচ্ছি। বাড়ি থেকে বের হয়ে ইফতি ভাইয়াদের গাড়িতে করে আমরা মার্কেটে যাবো। সামনের সিটে ড্রাইভিং করতে বসেছে নাহিল ভাইয়া। নাহিল ভাইয়া নতুন ড্রাইভিং করা শিখেছে এর জন্যই মূলত ড্রাইভ করা নিয়ে তার এতো আগ্রহ। পেছনের সিটে জানালার পাশে ইলমা আর তার পাশেই গিয়ে আমি বসলাম। আমার ডান পাশে ইমন ভাইয়া বসতেই ইফতি ভাইয়া বলে উঠলো,,
-ইমন তোমাকে ভেতর থেকে কে যেনো ডাক দিলো(ইফতি ভাইয়া)
ইমন ভাইয়া অবাক চোখে ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-কই ভাইয়া আমি তো শুনলাম না (ইমন ভাই)
-তুমি হয়তো শুনতে পাও নি। গিয়ে ভেতরে দেখো হয়তো কেউ ডাকছে (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় ইমন ভাই গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে চলে গেলো। হঠাৎই ইফতি ভাইয়া আমার পাশের সিটে বসে পড়লো। ইফতি ভাইয়ার এরকম কাজে বিরক্তি নিয়ে বললাম,,
-তুমি এখানে কেনো বসেছো ইফতি ভাই? এখানে তো ইমন ভাই বসেছে (আমি)
ইফতি ভাইয়া ফিসফিস করে কঠোর গলায় আমার কানের কাছে এসে বললো,
-একটা কথা বলবি গলায় চাকু বসিয়ে দেব। ননসেন্স (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় আমি ভয়ে চুপসে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ইমন ভাইয়া এসে বললো,
-কই ভাইয়া কেউ তো ডাকে নি। (ইমন ভাই)
-ওহ আচ্ছা। মনে হয় আমি একটু ভুল শুনেছি। ঠিক আছে তুমি গিয়ে সামনে বসো। ইভা আবার গাড়িতে উঠলে বমি করে তাই ওর পাশে বসেছি। তুমি আমাদের মেহমান হুটহাট যদি তোমার গায়ে বমি করে দেয় তাহলে কেমন না? তাই তুমি সামনে গিয়েই বসো সেটাই বেটার হবে (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় ইমন ভাই বিরক্তি নিয়ে সামনের সিটে বসলো। আমি রাগী চোখে ইফতি ভাইয়ের দিকে তাকাতেই ইফতি ভাইয়া গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে মোবাইল বের করলো।
সবার কেনাকাটা শেষ হলেও আমার টা এখনো শেষ হয় নি। সেই তখন থেকেই চুড়ির দোকানের সামনে দাড়িয়ে আছি। হলুদের চুড়ি কিনতে গিয়ে একটা ফুলের গহনা দেখে এতোই ভালো লেগেছে যে ইচ্ছে করছে এখনি এটা কিনে নিতে। ইমন ভাইয়া একবার আমার দিকে আরেকবার ফুলের গহনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোমার কি এগুলো পছন্দ হয়েছে? (ইমন ভাইয়া)
– না এমনি দেখছিলাম (আমি).
– আরে ইমন এই রাক্ষসীটাকে এসব জিজ্ঞেস করো না। পছন্দ না হলেও বলবে পছন্দ হয়েছে তারপর তোমার পকেট ফাঁকা করবে (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। নিজে তো কোনোদিন কিছু কিনে দেয় না ইন্টারনেশন্যাল হারকিপ্টা আবার আসছে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলতে।
-আরে না ভাইয়া আমার তো কোনে সমস্যা নেই ইভাকে কিছু কিনে দিতে (ইমন ভাইয়া)
ইমন ভাইয়ার কথায় ইফতি ভাইয়ার ভ্রু কুচকে তাকালো।
-তারমানে তোমার কাছে টাকা আছে তাই তো (ইফতি ভাইয়া)
– জ্বি ভাইয়া। আমি টাকা নিয়েই এসেছি (ইমন ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কিছু একটা ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আর কত ক্ষণ লাগবে তোর? আমাকে কি তোর চামচা মনে হয় যে যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ব্যবহার করবি। সবাই গাড়িতে ওয়েট করছে। তাড়াতাড়ি চল তোর আর কিছু কিনা লাগবে না (ইফতি ভাইয়া)
– দাঁড়াও না ইফতি ভাইয়া। আসছি (আমি)
-ইফতি ভাই আপনি যান আমি ইভার সাথে থাকি(ইমন ভাই)
ইমন ভাইয়ের কথাটা বোধ হয় ইফতি ভাইয়ের পছন্দ হয়নি। রাগে নিজের একপাশের চুল টেনে ধরে দোকানদারকে বললো,
– মামা ওই হলুদ রঙের চুড়িটা তাড়াতাড়ি প্যাক করে দিন তো (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় দোকানদার লোকটি হলুদ রঙের চুড়িগুলো প্যাক করে দিলো। কিন্তু আমার চোখ এখনো ওই লাল ফুলের গহনার দিকে। চুড়িগুলোর ব্যাগ নিয়ে ইফতি ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো।
– কি হয়েছে ইফতি ভাইয়া। এতো দেরি হলো কেনো তোমাদের? (নাহিল ভাইয়া)
-জানিস না আমাদের ইভা যে কি জিনিস। তখন থেকেই এই লোভী মহিলা হলুদের চুড়ি না দেখে অন্য গহনাগুলো দেখছিলো। মানে বুঝলাম না ওর বাবা কি আমাকে ওর বডিগার্ড হিসেবে রেখেছিলো নাকি (ইফতি ভাইয়া)
– কে বলেছে তোমাকে আমার সাথে থাকতে হ্যা?আমি আর কোনোদিন যদি তোমার সাথে মারকেটে আসি তাহলে আমার নাম ইভা না (আমি)
– হ্যা পরে তোর নাম হয়ে যাবে সকিনা বানু (ইলমা)
ইলমার কথায় ওর দিকে রাগী চোখে তাকাতেই ওরা সবাই আরো জোড়ে জোড়ে হাসা শুরু করলো।
মাঝপথে আমরা একটা ক্যাফেতে আসলাম । পাশের টেবিলে বসা ২ টা মেয়ে একটু পর পর ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছে। নির্ঘাত ক্রাশ খেয়েছে দেখে। ইফতি ভাইয়া আজকে ব্ল্যাক কালারের জিন্স সাথে কফি কালারের শার্ট হাতা গোটানো আর সাথে কালো রঙের বেল্টের ঘড়ি। সান গ্লাস শার্টের সাথে লাগানো। চুল গুলোতে জেল দেওয়া স্বাভাবিক যে কেউ দেখলেই ফিদা হয়ে যাবে। আমিও ইফতি ভাইয়ার এমন রূপ দেখে যে কতবার ফিদা হয়েছি তার হিসেব নেই। ভাগ্যিস ইফতি ভাই আমার বফ না নাহলে এতো সুন্দর বফকে আজীবন পাহাড়া দিয়ে রাখা লাগতো । ইমন ভাইয়া আমাকে রেস্টুরেন্টের খাবারের মেনু দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে,,
– ইভা কি খাবে? এখান থেকে দেখো অনেক কিছু আছে। আজকে আমি খাওয়াবো তোমাকে (ইমন ভাইয়া)
আমি মেনু কার্ডটা হাতে নেওয়ার আগেই ইফতি ভাইয়া টান দিয়ে নিয়ে বললো,
– ইমন তুমি শুধু এই পেত্নীটাকে খাওয়াবে? আমরা কি নদীর জল থেকে ভেসে এসেছি বলো?(ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার মুখে কি কিছু আটকায় না নাকি? পাব্লিক প্লেসেও পেত্নী আর ডায়নি বলে অপমান করছে। পাশের টেবিলের দুইটা মেয়ে হা হা করে হাসছে ইফতি ভাইয়ার কথায়। ঠিক করে নিয়েছিলাম ইফতি ভাইয়ার সাথে আরেকটা কথাও বলবো না।
ইমন ভাইয়া এবার অনার্স প্রথম বর্ষে। ইফতি ভাইয়ার থেকে ১ বছরের ছোটো এজন্য ইফতি ভাইয়াকে ভাইয়া বলেই ডাকে।
– আরে না না ভাইয়া কি যে বলছেন না আপনি। বলুন কি খাবেন? (ইমন ভাইয়া)
ইমন ভাইয়ার কথায় ইফতি ভাইয়া একটা বাঁকা হাসি দিয়ে এতো এতো খাবার অর্ডার করলো যে খাবারগুলো দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। জীবনে এতো খাবার খেয়েছি কিনা সন্দেহ। আমরা সবাই ইফতি ভাইয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। ইফতি ভাইয়াতো এতো খাবার খায় না। সবসময় তার বডি ফিট নিয়ে কথা বলে।
– চলো শুরু করা যাক তাহলে। ওহ ইমন তুুমি আবার কিছু মনে করো না আসলে অনেকক্ষণ ধরে মারকেটে থাকার কারণে প্রচুর খিদে পেয়েছে আর কি তাই (ইফতি ভাইয়া)
ইমন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারবার ঢোক গিলছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে। হয়তো ভাবছে আজকের এই খাবারের বিল দেওয়ার জন্য তার বাপ-দাদার সম্পত্তিও বিক্রি করতে হবে। ইমন ভাইয়া ইফতি ভাইয়ার খাওয়ার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যে তাকে দেখেই বোঝা যায় তার জীবনে এমন খাদক কখনো দেখে নি। আমরা খাওয়ার সময় একটু পর পর ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখছি কিভাবে খাচ্ছে সে। দেখতে পেটুকের মতো না লাগলেও এতো এতো খাবার খাচ্ছে যে এমন ছেলেকে দেখে যে কেউ পেটুক মনে করবে। আমাদের মতো পাশের টেবিলে বসা ২ টা মেয়েরও চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে ইফতি ভাইয়ার খাওয়া দেখে। খাবার শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইফতি ভাইয়া ইমন ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– খাবার শেষে মিষ্টিমুখ না করলে কেমন জানি খাবারের স্বাদ পাওয়া যায় না। ইমন তুমি একটা কাজ করো তো। রসমালাই আর দই অর্ডার করো (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় প্রত্যেকে ইফতি ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কবে থেকে এই ইফতি ভাইয়া এতো খাদক হলো আল্লাহ জানে। ইমন ভাইয়া ভয়ে ভয়ে ইফতি ভাইয়ার বলা খাবারগুলো অর্ডার করলো। আমরা চুপচাপ ইফতি ভাইয়ার খাওয়া দেখছি। খাওয়া শেষে ইফতি ভাইয়া চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। আর ইমন ভাইয়া মনে মনে আঙ্গুলে নিয়ে কি যেনো হিসেব করছিলো। হয়তো খাবারের বিলগুলোর হিসেব। ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে যে কেউ বলে দিতে পারবে যে অনেক কষ্টে ইফতি ভাইয়া খাবারগুলো খেয়েছে। কিন্তু কেনো কে জানে? দাদুবাড়ি আসার পর থেকেই ইফতি ভাইয়া ইমন ভাইয়ার দিকে কেমন রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। আমাদের সামনে একটা ওয়েটার এসে বলতে লাগলো,,
-স্যার আর কিছু খাবেন? আমাদের এখানে স্পেশাল কিছু পেস্ট্রি আছে। ওগুলো ট্রাই করবেন? (ওয়েটার)
ওয়েটারের কথায় ইফতি ভাইয়া কি যেনো ভাবতে লাগলো। ইমন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি তার অবস্থা যায় যায়। বেচারা এসির মধ্যেও ঘামে একাকার হয়ে গেছে।
– না ধন্যবাদ। আর কিছু খাবো না (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় ইমন ভাইয়া যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।
– ঠিক আছে স্যার তাহলে বিলটা?
(ওয়েটার)
-কত হয়েছে বিল? (ইফতি ভাইয়া)
– ছয় হাজার সাতশ সত্তর টাকা (ওয়েটার)
বিলগুলো শুনে আমাদের পরাণ উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। জানি না ইমন ভাইয়ার মনের অবস্থাটা কি তাহলে? বেচারা আর জীবনে এই ইফতি ভাইয়ার সাথে আর রেস্টুরেন্টে আসবে না।
– ইমন (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার ডাকে ইমন ভাইয়া লাফিয়ে উঠলো। হয়তো ভাবছে আরও কিছু খাওয়ার জন্যই ডেকেছে। ভয়ে ভয়ে ইমন ভাইয়া বললো,,
-জ্বি-জ্বি ভাইয়া (ইমন ভাইয়া)
– ভাই খাবারের বিলগুলো দিয়ে দাও নাহলে কখন জানি এই রেস্টুরেন্টের লোকগুলো ভাববে যে আমরা বিল না দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছি। বায় দ্যা ওয়ে তোমার কাছে টাকা আছে তো?(ইফতি ভাইয়া)
– জ্বি আছে সমস্যা নেই (ইমন ভাইয়া)
-ওহ আচ্ছা তাহলে তো ভালোই। ভাই আফসোস হয় যদি তোমার মতো বড়লোক হতাম তাহলে সবাইকে বলে বলে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে আসতাম আর মার্কেটে নিয়ে গিয়ে কেনাকাটা করাতাম (ইফতি ভাইয়া)
– আরে ভাইয়া কি যে বলেন না (ইমন ভাইয়া)
কথাটা বলে ইমন ভাইয়া মুচকি একটা হাসি দিয়ে বিল পরিশোধ করে দিলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সবাই গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসলো। যখনই আমি আর ইফতি ভাইয়া গাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাবো এমন সময় পাশের টেবিলে বসা সেই মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে এসে বলতে লাগলো,
– এক্সকিউজ মি (মেয়েটি)
মেয়েটির কথায় সকলে মেয়েটির দিকে তাকালাম। হাটু পর্যন্ত একটা টপস আর জিন্স পড়া। চুলগুলো খুলে রাখা। ইফতি ভাইয়া আবার এমন টাইপ মেয়ে মোটেও পছন্দ করে না। তার মতে মেয়েরা নিজেদের সৌন্দর্য্য পরপুরুষকে দেখিয়ে কেনো বেড়াবে? মেয়েরা হলো ফুলের মতো পবিত্র। তাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে এই পবিত্রতা কখনো অপবিত্রতায় পরিণত না হয়ে যায়।
-আমি সুহাসিনী। ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেলের ২য় বর্ষের ছাত্রী । আপনি ইফতি চৌধুরী তাই না ? (সুহাসিনী)
সুহাসিনী মেয়েটি কথাগুলো ইফতি ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি উনি কিভাবে ইফতি ভাইয়ের নাম জানলো।
– জ্বি । কিন্তু দুঃখিত আমি আসলে আপনাকে চিনতে পারলাম না। (ইফতি ভাইয়া)
– আপনার তো আমাকে চেনার কথা। আমি ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেলের প্রফেসর আরিয়ান খানের মেয়ে সুহাসিনী খান। তার সাথে আমি আর আপনি তো একই ক্লাসের। এখন নিশ্চয়ই চিনেছেন? (সুহাসিনী)
ওহ তাহলে এই ব্যাপার। তারমানে মেয়েটা ইফতি ভাইয়ার সাথেই পড়ে।
– দুঃখিত। আমি এখোনো আপনাকে চিনতে পারি নি। আসলে মেডিকেলে আমার কোনো মেয়ে বান্ধবী নেই। তাছাড়া আমি এমনিতেও আজ পর্যন্ত মেয়েদের সাথে কথা বলি নি (ইফতি ভাইয়া)
– সমস্যা নেই। আসলে আমার আপনার সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে ছিল। আপনিতো আবার মেডিকেলের টপার প্লাস সবার ক্রাশ তাই স্বাভাবিক কাউকে পাত্তা না দেওয়াটা ( সুহাসিনী)
সুহাসিনী নামের মেয়েটির কথায় ইফতি ভাইয়া ভ্রু কুচকে বললো,
-এক্সকিউজ মি। আপনি কি বলতে চাইছেন আমি অহংকারী? বাট এটা আমার অহংকার না। আমি মেডিকেলে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য গিয়েছি। আড্ডা দিতে না (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কথাটা বলেই হনহন করে গাড়ির কাছে চলে যেতেই সুহাসিনী নামের মেয়েটি আবার ডাক দিলো,,
-দয়া করে রাগ করবেন না। আমি আসলে তা বুঝাতে চাই নি। সবার মুখে মুখে শুনেছি আপনি কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেন না তাই ভাবলাম আপনি হয়তো মেয়ে মানুষ পছন্দ করেন না (সুহাসিনী)
-কে বলেছে আমি মেয়ে মানুষ পছন্দ করি না? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কথাটা বলেই আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
-এক রমনী আমার হৃদয় দখল করে নিয়েছে। আমার ১৭ বছর জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালেবাসা সে। তার জন্ম হয়েছে আমার জন্য। তার প্রতিটা শ্বাসপ্রশ্বাসে আমি আমার ভালোবাসা খুঁজে পাই। একটা কথা শুনে হয়তো আপনি ভিষণ অবাক হবেন যে তাকে আমি ভালোবাসি তার জন্মের পর থেকেই। তার ওই ছোটো ছোটো আঙ্গুলগুলি ধরে প্রমিজ করেছিলাম আজীবন তার পাশে থাকবো, তাকে ভালোবাসবো। আর আপনি বলছেন যে আমি মেয়ে মানুষ পছন্দ করি না? হাও স্ট্রেন্জ (ইফতি ভাইয়া)
এতোক্ষণ ধরে ইফতি ভাইয়ার প্রেমের কাহিনী শুনছিলাম। তারমানে ইফতি ভাইয়া কাউকে ভালোবাসে। সত্যিই কি তাই? কখনো কল্পনাও করি নি ইফতি ভাইয়া কাউকে ভালোবাসতে পারে। আল্লাহ জানে কার কপালে এই জল্লাদ জুটেছে। বেচারির জন্য তো আমারই কান্না পাচ্ছে আর ছেলে খুঁজে পেলো না। তার সাথে সাথে ইফতি ভাইয়ার গফের কথা শুনে আমারও মুখ পাং সেটে হয়ে গেলো। কেনো জানি না মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সত্যি কারো ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দেই। সুহাসিনী নামের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখটাও চুপসে গেছে।
– বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা যেহেতু আপনি আর আমি একই বর্ষের মেডিকেলে পড়ি তাহলে তো বন্ধুত্ব করাই যায়। কিছু মনে না করলে আপনার নম্বরটা কি দেওয়া যাবে? (সুহাসিনী)
সুহাসিনী নামের মেয়েটার কথা শুনে আমার মেজাজ আরও বিগড়ে গেলো। রেগেমেগে চিৎকার করে বললাম,
-কানে কি কম শুনেন নাকি আপনি হ্যা? দেখছেন না ইফতি ভাই বলছে তার জিএফ আছে তাও পিছে পড়ে কেনো আছেন। ছেঁচড়া মেয়ে কথাকার (আমি)
আমার চিৎকারে গাড়ির ভেতর থেকে সব কাজিনরা নেমে এলো। আশেপাশের সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সেখানে যেনো আমার কোনে খেয়ালই নেই। ইফতি ভাইয়াও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝতে পারে নি আমি এমন বিহেভ করবো। ইফতি ভাইয়া দ্রুত আমার হাত ধরে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। আর সকলেকে আদেশ করলো যেনো তাড়াতাড়ি গাড়িতে ঢুকে পড়ে। সবাই গাড়িতে ঢুকে পড়তেই সুহাসিনী মেয়েটা ইফতি ভাইকে বললো,
-এটা কেমন বেয়াদপ মেয়ে? আপনি বললেন মেয়েটা পেত্নী কিন্তু এ দেখছি এক নম্বরের জল্লাদ একটা। তোমাকে আমি দেখে নিবো (সুহাসিনী)
সুহাসিনী নামের মেয়েটার কথা শুনে ইফতি ভাই তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগলো,
– সেট আপ। এতো ক্ষণ ভালো বিহেভ করলেও ওর ব্যাপারে একটা বাজে কথা বললে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। আমি এই পৃথিবীর সব সহ্য করতে পারি কিন্তু ইভার রাগ ইভার কান্না ইভার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। যদি তোমার কারণে ইভা বিন্দুমাত্র কষ্ট পায় তাহলে আমি তোমাকে খুঁজে বের করে এমন কঠিন শাস্তি দিবো যা তুমি ভাবতেও পারবে না (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়া কথাটা বলেই গাড়ির ভেতরে আমার পাশে বসে পড়লো। এতোক্ষণ ধরে সব কিছু শুনছিলাম আমি আমার পাশের খোলা জানালা দিয়ে। সকলের গাড়ির গ্লাসের জানালা বন্ধ থাকলেও রাগ কমানোর জন্য গ্লাসটা খুলেছিলাম। তখনই ইফতি ভাইয়ার সকল কথা শুনে ফেলি। ইফতি ভাইয়া আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। ইফতি ভাইয়ার নজর কারা চোখে চোখ পড়তেই একরাশ মুগ্ধতা তার চোখে দেখতে পারলাম আর মনে মনে বললাম,

“ওহে পুরুষ
কি চাও তুমি? কেনো বারবার তোমার মুগ্ধতায় ফেলো আমাকে?তুমি তো অন্য কারো তাও কেনো আমায় পাগল করছো তোমার মুগ্ধ নয়নে?”

চলবে,,,,,,,🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here