কাছে কিবা দূরে পর্ব ১৯

0
1268

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব_১৯
#সাবিকুন_নাহার_নিপা

কয়েক দিন ধরে তানি খুব অসুস্থ। হঠাৎই টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ক’টা দিন হাসপাতালেও কাটিয়ে এসেছে। বাসায় ফেরার পরও প্রায় বেহুশ, কিছু খেতেও পারছে না। মাঝেমধ্যে একটু চোখ মেলে চাইলে মাহফুজা জোর করে কিছু একটা খাইয়ে দেয়। তানিও যন্ত্রের মতো চোখ, নাক বুঝে খাবার গিলে আবারও বিছানায় পড়ে থাকে। মাহফুজা দুদিন স্কুল কামাই করলেও তৃতীয় দিনে আর সম্ভব হলো না। স্কুলে ফার্স্ট টার্ম এক্সাম শুরু হয়েছে তাই বাধ্য হয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। তবে ভরসার কথা হলো কাজ কর্ম ছেড়ে ইরা এসে তানির দেখভাল করছে। আনিকারও ইউনিভার্সিটির এডমিশন কোচিং শুরু হয়েছে। তাই তাকেও ছুটতে হচ্ছে কোচিং এ। ইরার মা সালমা সুলতানাও এসে মাঝেমধ্যে দেখে যায়। তানিকে তার ও ভীষণ পছন্দ। তাই ইরার অনেক টা সময় থাকা নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই।

শুভ্র এই সময়টা’তে তানির আশেপাশে কেবল তখনই ঘুরঘুর করে, যখন তানি ঘুমিয়ে থাকে। জেগে থাকা অবস্থায় ওর সাহস হয় না তানির মুখোমুখি হবার। তাই তানি যখন ই চোখ মেলে তাকায় শুভ্র তখনই পালিয়ে যায়। এই ক’দিনে শুভ্র এক ফোটাও ঘুমাতে পারে নি। সারারাত বিছানায় এপাশ, ওপাশ করে কাটিয়েছে। ভিতরের যন্ত্রনা না পারছে কাউকে বলতে, আর না পারছে সইতে। একেকবার ইচ্ছে হয় কিছুক্ষন চিৎকার করে কাঁদতে, কিন্তু তাও পারছে না।

অভ্র বলেছে, ভাইয়া ভাবী সুস্থ হলে আমরা তাকে বুঝিয়ে সব টা বলব। তুমি এতো ভেবো না। কিন্তু শুভ্র ভরসা করতে পারে নি। শুভ্র যে ভরসা করতে পারে নি, সেটা অভ্র’ও বুঝেছে। শুভ্র’র চোখের নিচে কালি জমেছে, শেভ না করার কারনে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বড় হয়ে গেছে। রাতে ঘুম না হওয়ার কারনে চোখও রক্তবর্ণ আকার ধারণ করেছে। মাহফুজা প্রথম কয়েকটা দিন ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলেও তারপর আর পারে নি। মমতার কাছে হেরে গেলেও শুভ্র’কে ক্ষমা করতে পারে নি।

যা যা ঘটেছে তার জন্য মাহফুজা নিজেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। শুভ্র অনেকবার ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করতে পারে নি। এর আগে শুভ্র অবন্তীর ভুল, বেহায়াপনা প্রশ্রয় দিয়েছে অথচ এতো ভালো মেয়েটার ব্যাপারে যাচাই না করেই এরকম একটা কথা কিভাবে বলল এটা ভেবেই মাহফুজার রাগ হয়। ছেলের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলছে না। কিন্তু পরে দেখলো যে শুভ্র নিজেই ঠিক নেই তখন আর রাগ ধরে রাখতে পারে নি। মনে মনে আল্লাহ কে বলেছে, হে আল্লাহ এই অবুঝ ছেলেমেয়ে দুটো’কে তুমি বুঝ দিও৷

*****

গত কয়েকদিনে শুভ্র, তানির চক্করে অভ্র’র ও ভালো ঘুম হয় নি। নিজের ভাইয়ের নির্বুদ্ধিতায় হতভম্ব হয়েছে। শুভ্র’র মতো এতো বুদ্ধিমান মানুষ এরকম একটা কাজ করলো! অন্তত ওকে যদি বলতো তবে পরিস্থিতি এতো বিগড়ে যেত না। অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবাই শুভ্র’কে ভুল বুঝলেও ও তা পারেনি। বরং ওর শুভ্র’র জন্যই মায়া বেশী হয়। খেতে বসে এক রাতে দেখলো শুভ্র ডালের বদলে ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে নিয়ে খেতে শুরু করেছে। ঠিকঠাক ঘুমায় ও না। প্রায় রাতেই ওর কাছে সিগারেট নিতে আসে, কিছুক্ষণ বসে থেকে সিগারেট ছাড়াই চলে যায়। এসব দেখতে অভ্র’র ভালো লাগে না। ইচ্ছে হয় কিছু একটা করে দুজনের সব দুঃখ, কষ্ট মুছে দিতে।

চেয়ারে হেলান দিয়ে এসব ভাবছিলো তখনই ইরা ফোন করলো। অভ্র ফোন ধরে বলল,

“হ্যালো! ভাবী ঠিক আছে তো।”

ইরা চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে, জ্বর নেই।

“তাহলে এই সময় ফোন করলে যে?”

“তোমাকে একটা কথা জানানোর জন্য। ”

“কী?”

“ভাইয়া প্রায় ই দরজার সামনে ঘুরঘুর করে। মাঝেমধ্যে ভিতরে এসে একটু বসে। ভাবীর নড়াচড়া টের পেলে উঠে চলে যায়। ভাইয়া’কে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। ”

অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর নিজের কী ভালো লাগছে এসব দেখতে।

ইরা আবারও বলল, তবুও ভাবীর দিক টা’ও আমাদের চিন্তা করতে হবে। ভাবীও তো বিনাদোষে কষ্ট পেল।

“হু।”

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ইরা আবারও বলল, আমার কী মনে হয় জানো?

“কী মনে হয়?”

“ভাইয়া ভাবীকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে। ”

অভ্র কিছু বলল না। সেটা ও নিজেও জানে। কিন্তু জানলে লাভ কী! তানি কী সেটা আর বিশ্বাস করবে! তানি তো বলবে যে, ভালোবাসার এই নমুনা।

ফোনের ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে ইরা বলল, আচ্ছা রাখছি। তুমি এতো ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

“তাই যেন হয়। ”

ফোন রেখে আবারও চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলো অভ্র। মনে মনে ভাবলো, তানি সুস্থ হলে ওকে হাতজোড় করে বলবে, ভাবী তোমাদের কারও অতীত ই মসৃন ছিলো না, হ্যাঁ ভাইয়ার দোষ ও আছে তবুও তাকে বড় কোনো শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেও সেই শাস্তির ভাগিদার হইয়ো না।

*****
দুপুরবেলা শুভ্র তানির খোঁজ নিতে গেল। তানি ঘুমিয়ে আছে। ইরা পাশে বসে গান শুনছিলো। শুভ্র’কে দেখে বলল,

“কিছু বলবে ভাইয়া? ”

শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, না মানে ও কিছু খেয়েছে কী না!

ইরা বলল, না। ভাবীকে কয়েকবার ডেকেছি কিন্তু সাড়াশব্দ নেই।

শুভ্র চিন্তিত গলায় বলল, অনেক টা সময় হয়ে গেছে। এখন তো ওর ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুই ওকে ডেকে দে।

শুভ্র’র কথামতো ইরা তানিকে ডেকে তুলল৷ তানি চোখে খুলে তাকাতেই শুভ্র’কে দেখতে পেল। শুভ্র চট করে সরে গেল। ইরা তানিকে বালিশ উঁচু করে হেলান দিয়ে খাওয়াতে লাগলো। তানি চিকেন স্যুপ গিলছে আর বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। দেখার চেষ্টা করছে শুভ্র আছে কী না। ইরা বুঝতে পেরে বলল, ভাবী ভাইয়াকে ডেকে দেব?

তানি ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, না।

খাওয়ার পর্ব শেষ করে তানি আবারও শুয়ে পড়লো। ইরা রান্নাঘরে খুটখাট করছে সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তানির চোখে পানি এসে গেল। শেষকালে এসে এমন নিষ্ঠুর মানুষ কে জানপ্রান উজাড় করে ভালোবাসতে গেল! অসুস্থ হয়ে এতোদিন বিছানায় পড়ে ছিলো অথচ দেখতে এসেছে কেবল আজ ই। প্রতিদিন ই তানি ভাবতো চোখ খুলে হয়তো শুভ্র’কে দেখতে পাবে। পাশে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। যা কিছুই হোক, বউ তো! তাছাড়া ভুল যখন করেছে ক্ষমা চাইবে তো অন্তত। সেইটুকু ভদ্রতাটুকু নেই। অথচ বিয়ের পর কতো ভদ্রতা দেখালো। তানি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুস্থ হয়েই সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবে। তাছাড়া ও এসব কী ভাবছে! শুভ্র’র কাছেই বা কেন এতোকিছু আশা করছে! যে ছেলে পরের কথায় নিজের বউকে ক্যারেক্টারলেস বলেছে সে চূড়ান্ত অসভ্য একটা ছেলে। তাকে ক্ষমা করার প্রশ্ন ই আসে না। একটু হাটাচলা করতে পারলেই এই বাড়ি ছেড়ে যাবে। দুইবেলা আধপেটা খেয়ে, ভাইয়ের বউয়ের খোঁচা সহ্য করে থাকবে তবুও চরিত্রহীনা তকমা গায়ে লাগিয়ে এ বাড়িতে থাকবে না।

একটা চূড়ান্ত অসভ্য লোককে ভালোবাসার জন্য তানি হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো।

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সেই অসভ্য লোকটার’ও তখন তানির কান্না দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here