কাছে কিবা দূরে শেষ পর্ব

0
2015

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-২৫/শেষ পর্ব
সারারাত তানি নির্ঘুম কাটালো। কেমন যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতায় সারারাত ছটফট করলো। কখন সকাল হবে আর কখন ছুটে যাবে। ভোরের আলো একটু ফুটতেই তানি অভ্রকে ফোন করলো। যতক্ষণ পর্যন্ত অভ্র ট্রেনে না উঠলো ততক্ষণ পর্যন্ত একটানা ফোন করে গেল।

সারাদিন তানি অস্থিরতার মধ্যে কাটালো। একটু পর পর সময় দেখতে লাগলো। শুভ্র’কে এর মধ্যে ফোনও করেছে কয়েকবার কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই। ভিতরে ভিতরে তানি আরও বেশী অস্থির হতে লাগলো। তানির মা টের পেলেন মেয়ের মনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“তোর কী হইছে মা?”

তানি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, কিছু হয় নি তো মা।

“তাহলে এমন করতেছিস ক্যান? জামাইর সাথে কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া হইছে?”

তানি বলল, না না মা সেরকম কিছু না।

“তাইলে কী হইছে।”

তানি আমতা আমতা করে বলল, আসলে মা আমি আজ ঢাকা চলে যাব।

তানির মা অবাক গলায় বলল, কার সাথে যাবি? তুই না বলছিলি কয়টা দিন থাকবি?

“হ্যাঁ কিন্তু যাওয়া দরকার। আবার পরে আসব। অভ্র আমাকে নিতে আসবে।”

তাসলিমা খাতুন মেয়ের মতিগতি কিছুই বুঝলেন না। শুভ্র ঢাকায় থাকবে না তাই ভেবেছিল তানি বেশকিছুদিন থাকবে কিন্তু এখন ফেরার জন্য কেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।

****
রাজশাহী ফিরে আবারও ফিরতি গাড়ি ধরতে হলো অভ্র’কে। তানির ফেরা নিয়ে তাসলিমা ছাড়া আর কেউ কিছু বলে নি। অভ্র গাড়িতে উঠে বলল,
“তোমার না গাড়িতে বমির সমস্যা হয়?”

“আজ দুটো ওষুধ খেয়ে নিয়েছি কোনো সমস্যা হবে না।”

“ভাবী তুমি কী একটু বেশী ব্যস্ত হচ্ছ না! এভাবে হানা দিলে ভাইয়া যদি রেগে যায়? ”

তানি বলল, রাগবে কেন? আমি তো তার গার্লফ্রেন্ড না যে কাজের জায়গায় গেলে রাগ হবে! বউরা কাজের জায়গায় যেতেই পারে।

অভ্র হেসে ফেলল। বলল, তোমাদের দুই রোমিও জুলিয়েটের চক্করে আমি ভাজা ভাজা হয়ে গেলাম।

তানি স্মিত হেসে বলল, আচ্ছা সময় আসলে সব পুষিয়ে দেব। তোমার বিয়ের শেরওয়ানির খরচ আমার। এবার খুশি তো?

অভ্র শব্দ করে হাসলো। তানিও তাল মিলিয়ে হাসলো।

অভ্র বলল, ভাইয়ার সাথে থেকে তুমিও অনেক স্মার্ট হয়ে গেছ।

তানিও মাথানিচু করে শুভ্র’র স্টাইলে বলল, মাই প্লেজার।

অভ্র আবারও হো হো করে হাসলো। সেই হাসির শব্দ শুনে কয়েকজন যাত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকালো। অভ্র হাসি থামিয়ে বলল,

“ভাবী ইউ আর এ বেস্ট সিস্টার ইন ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ”

তানি বলল, ইউ অলসো বেস্ট ব্রাদার ইন ল ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।

তানির খুব আনন্দ লাগছে। এই আনন্দ কে বলে ঈদ ঈদ আনন্দ। ঈদের আগের রাতে সকাল হবার অপেক্ষায় যে আনন্দ অনুভূত হয় সেই আনন্দ। তানি মনে মনে শুভ্র’র অবাক হওয়া মুখ টা দেখতে পেল। হয়তো প্রথমে বিশ্বাস করতে না পেরে চোখ কচলে তাকাবে। তানির খুব মজা লাগলো যে শুভ্র’কে বোকা বানাতে পারবে।

নানানরকম জল্পনা, কল্পনায় জার্নিটুকু কাটালো তানি। বাস থেকে নেমে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেল। আনিকা আর ইরা দৌড়ে এসে তানিকে জড়িয়ে ধরলো। তানির তখনও হতভম্ব ভাব কাটে নি। শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে, মিটিমিটি হাসছে। তানি অভ্র’র দিকে তাকাতে অভ্র বলল, ভাবী আই এম এ বেস্ট ব্রাদার ইন ল ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।

*****
তানি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আপনি আমার সাথে মিথ্যে কথা বলেছেন?

শুভ্র হেসে বলল, হ্যাঁ।

“কেন?”

“তোমার গুনধর দেওর আর তার ক্রাইম পার্টনার বলতে বলেছে তাই।”

তানি অভ্র’র দিলে তাকালো। অভ্র বলল, ভাইয়া এটা কিন্তু আনফেয়ার হয়ে যাচ্ছে।
তারপর তানির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবী আমি সব টা বলছি শোনো, এসব আসলে ভাইয়ার প্ল্যান। কাল এসে আমাদের বলল যেন আমরা মিথ্যে বলি।

শুভ্র হাই তুলে বলল, তোমাকে না জ্বালালে আমার একটুও ভালো লাগে না তো। তাই আর কী!

তানি আরও কিছু বলতে গেলে অভ্র থামিয়ে দিয়ে বলল, ভাবী থামো প্লিজ। এটা পাব্লিক প্লেস তো।

রাত আটটার দিকে সবাই মিলে কমলাপুরের দিকে এলো। তানি অনেকক্ষন গম্ভীর হয়ে থাকলেও একসময় না পেরে ইরাকে বলল,

“কমলাপুরে কেন যাচ্ছি?”

ইরা ফিসফিস করে বলল, হানিমুনে যাচ্ছ তোমরা।

তানি অবাক গলায় বলল, মানে কী?

ইরা মিষ্টি করে হাসলো তানির দিকে তাকিয়ে।

তানি বলল, এই শয়তান লোকটার সাথে আমি কোথাও যাব না। বিশ্ববাটপার একটা। আমাকে কতগুলো মিথ্যে বলল।

“আসলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে তো এইজন্য। তুমি প্লিজ আর ম্যুড অফ করে থেকো না প্লিজ।”

আনিকা বলল, ভাবী আমাদের জন্য যাও প্লিজ।

তানির রাগ উবে গেল। এতো ভালো লাগছে ব্যাপার টা। সারপ্রাইজ দিতে মিথ্যে বললেও এখন ওর কাছে ভালোই লাগছে। তাই আর কিছু বলল না।

রেস্টুরেন্টে সবাই যখন একসাথে খেতে বসলো তখন শুভ্র তানির পাশে বসলো। নিচু গলায় বলল,

“শুনলাম তুমি নাকি স্বামীশোকে পাগল হয়ে গেছ?”

তানি কটমট চোখে কিছু সময় তাকিয়ে দাঁত বের করে বলল, হ্যাঁ। কপাল খারাপ বলে সারাজীবন একটা ড্রেনওয়ালাকে নিয়ে থাকতে হবে তো তাই পাগল হয়েছি।

শুভ্র ঠোঁট টিপে হেসে বলল, আজ তো বৃষ্টি আছে, রাস্তায় পানিও হয়তো আছে। একটা নর্দমা খুঁজে বের করব নাকি?

“প্লিজ করুন। তারপর আমি সেখানে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব। ”

অভ্র বলল, ভাইয়া তোমাদের এসব ঝগড়াঝাটি দেখে আমার আবারও ভয় করছে।

আনিকা বলল, আমারও।

ইরা শুভ্র’কে শাসিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কিন্তু ভাবীকে খুব জালাচ্ছ। ভাবীর কিন্তু কোনো দোষ নেই।

শুভ্র বলল, আমরা ঝগড়াঝাটি করছি তাতে তোদের কী রে?

অভ্র বলল, আগেরবার ঝগড়া করে আমাদের কতগুলো টাকা নষ্ট করেছ।

তানি সায় দিয়ে বলল, ঠিক ই তো। ছোট ভাই বোনদের টাকায় বউকে নিয়ে ঘুরতে যায় একটুও লজ্জা নেই! আবার বড় বড় কথা!

শুভ্র হাই তুলতে তুলতে বলল, ওকে ফাইন। এই প্যারার বিয়ের সব পার্লার খরচ আমার।

ইরা লাজুক গলায় বলল, ঠিক আছে।

আনিকা বলল, ভাইয়া আমারও কন্ট্রিবিউশান ছিলো?

শুভ্র আনিকার গাল ধরে বলল, তোকে আবার আলাদা করে কী দেব? তোর বিয়েতে তো এমনিই যৌতুক দিতে হবে। যৌতুক ছাড়া তোকে কে বিয়ে করবে শুনি?

অভ্র বলল, হ্যাঁ ঠিক ই তো। এক কাপ চা পর্যন্ত বানাতে পারিস না, তোর আবার বিয়ে কিসের।

আনিকা মুখ ফুলিয়ে রইলো। বাকীরা সবাই হেসে ফেলল।

ট্রেনে ওঠার আগে মাহফুজা তানিকে ফোন করলো। বলল,
“রাগ, মান অভিমান যাই থাকুক সব মিটিয়ে আসিস। তোদের ছোট, খাট ঝগড়া দেখতে ভালো লাগে। বড় ঝগড়া হলে টেনশন হয়। তুই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ায় কতো টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম জানিস? ”

তানি নতমুখে বলল, আই এ্যম স্যরি মা।

“উঁহু স্যরি বলতে হবে না। একটা কথা মনে রাখবি, সংসার শুধু ক’টা হাড়ি, পাতিল আর আসবাব পত্র দিয়ে ঘর সাজানো নয়। সংসার মানে দুজনের বোঝাপড়া, সমঝোতা আর অনেকখানি বিশ্বাস আর ভরসা। একজন যখন রেগে থাকে, অন্যজন কে তখন নমনীয় হতে হয়। দুই পক্ষ একসাথে রেগে গেলে জটিলতা বাড়ে। তাছাড়া রাগ কিংবা ঝগড়ার সময় মানুষ যা বলে সেগুলো সবসময় মনের কথা হয় না। তাই সবসময় সেসব ধরতে হয় না।

“বুঝেছি মা। আমি অনেক কিছুই জানি না। সব আস্তে আস্তে আপনার কাছ থেকে শিখে নেব। ”

মাহফুজা হেসে বলল, আচ্ছা যা তোর সময় নষ্ট করছি। আর শোন, আমাদের খুব একটা ফোন করার দরকার নেই।

তানি লজ্জা পেয়ে হাসলো।

****
ট্রেন ছাড়ার আগে অভ্র বলল, ভাবী তোমার বর কিন্তু আমাকেও ম্যাসেঞ্জারে ব্লক দিয়ে রেখেছে।

“কেন?”

“কারণ আমি বলেছিলাম যে, ভাবী রাগ করে গেছে যাক তাতে সমস্যা কী। এতো রাগ ভাঙানোর কী দরকার। ”

তানি হেসে ফেলল। অভ্র’ও হাসল। শুভ্র কাছে নেই, আনিকা আর ইরাকে নিয়ে চকলেট কিনতে গেছে।

ট্রেন ছাড়তেই তানি জিজ্ঞেস করলো,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

শুভ্র তানির দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় আবার! এখন বর্ষাকাল, তাই ড্রেন খুঁজতে যাচ্ছি। হিস্ট্রি রিপিট করতে হবে। তাছাড়া তোমারও তো শখ হয়েছে।

তানি হেসে ফেলল। শুভ্র’ও হাসলো।

তানি বলল, আচ্ছা আপনার আর আমার যখন ফার্স্ট দেখা হয়েছিল তখন আপনি আমায় ভালো করে দেখেছিলেন?

“হ্যাঁ অবশ্যই। তুমি চোখের পানি আর নাকের পানি এক করে ফেলেছিলে। ”

তানি শুভ্র’র কাঁধে আলতো করে মারলো।

পরিশিষ্টঃ ওরা যেদিন শ্রীমঙ্গল পৌছালো সেদিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। শ্রাবণের এই বৃষ্টিতে মান, অভিমান সব ধুয়ে মুছে গেল। বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে শুনতে ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিদের নাম ঠিক করে ফেলল। কোন স্কুল কোন কলেজে পড়বে সেগুলোও ঠিক করা হলো। এভাবেই চলতে থাকুক ওদের জীবনের ভালোবাসা আর খুনশুটির গল্পটা।

*****সমাপ্ত*****
(সপ্তাহ খানেক পর ফিরছি নতুন গল্প নিয়ে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here