বাসর ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই অর্কের গলায় ছুড়ি চেপে ধরলাম আমি। রাগে রীতিমতো ফোঁপাচ্ছি। অর্ক আমার স্বামী, অথচ, এই লোকটাকে বিন্দুমাত্রও সহ্য হয় না আমার। অবশ্য লোকটাও আমাকে দেখতে পারে না, দেশে আসার পর থেকে হেনেস্তাই করে যাচ্ছে। তবে কেন এই জোর-জবরদস্তির বিয়ে?
“মন, কী করছো টা কী? ছুড়ি সরাও তাড়াতাড়ি।”
সে বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল। আমার মেজাজ তো এবার তুঙ্গে, এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে আবার আমার সাথেই রাগ দেখাচ্ছে। আজ শুধুমাত্র এর জন্য আমার সব স্বপ্ন, আশা, সম্মান, ভালোবাসা মাটিতে মিশে গেল।
“একদম চুপ! সালা, তুই ভাবোছটা কী নিজেরে, হ্যাঁ! তরে রাইট দিছে কেডায় এই মন রে জোর কইরা বিয়া করবার? একদম ঘেটিডা ধইরা নোলি কাইটা দিমু ফাতর ছেরা!”
রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে আরও চেপে ধরলাম ছুড়িটা তার গলায়। হালকা কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। অর্ক মৃদু আর্তনাদ করে চোখ বুজে নেয়। আমি সাথে সাথে ছুড়িটা সরিয়ে নেই, ওড়নাটা চেপে ধরলাম তার ক্ষতস্থানে।
“দেখলেন তো আমার সাথে নিজেকে জুড়ার নতিজা? তমসাবৃত মেয়েলোক আমি, আমার কাছে আসলেই ধ্বংস জানেন না? জানেন তো আমার ক্রোধানলের রেশ টুকুও ঘাতক! সেখানে আপনি আগে থেকেই আমার অপছন্দের তালিকায় নাম তুলিয়েছেন, এখন তো ঘৃণার তালিকায়ও। সহ্য করতে পারবেন তো মন শিকদারের ঘৃণা বনাম শত্রুতা?”
সে চোখ খুলে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম সহ্য করতে না পেরে। কেন যেন অর্কের এই চাহনি আমার সয় না, অন্যরকম অনুভূতি হয়, যা আমায় জ্বালায়-পোড়ায়।
আমার হাতটা তার ক্ষতস্থানে আরও শক্ত করে চেপে ধরে সে। হিসহিসিয়ে বলে,
“মন শিকদার তার শত্রুকে সাহায্য করছে। ব্যাপারটা ঠিক পাল্লায় আসলো না।”
আমিও ভাবলাম, “সত্যিই তো এই লোকটা রক্তাক্ত হলে আমার কী! আমার মতো ইমোশনলেস মানুষের মানায় না এমন লোকের পরোয়া করা।” পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে কপট রাগ আনলাম চেহারায়।
“মি. অর্ক আজাদ, আমার টেম্পার ইস্যু আছে, আমি অত্যন্ত প্রতিশোধ প্রবণ। কিন্তু মানুষকে রক্তাক্ত করা খুনী কিংবা মারপিট করা গুন্ডা নই। যদিও আপনাকে রাগের মাথায় রক্তাক্ত করে আমি মোটেও অনুতপ্ত নই। কিন্তু ঐ যে শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা। যা সবার থাকে না, এই যেমন আমার আছে, আপনার হয়তো…
থেমে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। মুখে আগের বাঁকা হাসিই। খেয়াল করে দেখি রক্ত ঝরা বন্ধ হয়েছে, অবশ্য কেটেছেই একদম অল্প।
অর্ক এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। তার রাগ বরাবরই অতিরিক্ত, যার জন্য পুরো পরিবারেই তার দুর্নামের শেষ নেই। যদিও দেশে ফেরার পর নিজেকে কপট স্থিরতা ও নম্রতার মাঝে আবদ্ধ করেছে সে। কিন্তু আজ আর রাগকে আয়ত্বে রাখতে পারল না।
আমাকে পিছন ঘুরিয়ে হাত মুচড়ে ধরে সে। আমার পিঠ লেপ্টে থাকে অর্কের বুকে।
“বড্ড বেশিই বকা তুমি। বাট বেবো আই ডোন্ট লাইক ইট।”
পুনরায় ক্ষোভে তেঁতে উঠি আমি।
“আহ্! বান্দির পোলা, ছাড় আমারে কইতাছি।”
অর্কের এক হাত তো আগেই বন্দী রেখেছিল মনের ডান হাত, এবার তার আরেক হাত মনের গাল শক্ত করে চেপে ধরে। এতোটাই যে মনে হচ্ছে তার গাল কেটে দাঁত বেরিয়ে আসছে। “আহ্” মৃদু আর্তনাদ করে উঠে কন্যা।
“এতদিন ধরে আমায় হাস্যরসিক দেখছিস বলে ভাবিস না আমার রাগ নেই। আমার রাগ সহ্য করার ক্ষমতা তোর হয় নাই। আর বিয়ে করসি তোরে আমি, কোনো পাপ করি নাই। আমাকে রাগানোর ফলাফল ভালো হবে না কইতাছি। তুই যদি বুনো ওল হস, আমিও বাঘা তেঁতুল। ব্লাডি হেল!”
বলে ধাক্কা দিয়ে মুক্ত করে দেয় মনকে নিজের দেহের কারাগার থেকে। তার ভাবনা ছিল এবার মেয়ে শান্ত বিড়াল হবে। কিন্তু সে হয়তো ভুলে গেছে এই নারী সাধারণ হলেও তার রাগ হলো হিংস্র হায়নার বংশধর।
ছাড়া পেতেই নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে আকস্মাৎ গলা চেপে ধরি তার। মুখ দিয়ে তো নানা আজেবাজে বকেই যাচ্ছি, রাগের মাথায় আমার মুখে কখনোই ফিল্টার থাকে না।
প্রথমে অর্ক আমাকে সরানোর চেষ্টা করলেও পরে নিজেও রেগে যেয়ে এক হাতে আমার কোমর ধরে আমাকে আরও মিশিয়ে নেয় তার দেহের সাথে।
“চুপ করতে বলছি মন। রাগাস না আমায়।”
তবুও থামার নাম নেই। আমি হার মানি অর্কের দানবীয় শক্তির নিকট, দু’হাত বন্দী করে তার হাতের মাঝে। তারপর পা দিয়ে লাথালাথি করেও যখন হাত খোলা না পাই, তখন জোরেশোরে এক কামড় বসাই অর্কের বুকে।
সে “আহ” বোধক শব্দ করে চোখজোড়া বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। বাট হু কেয়ার্স? সে ক্রোধান্বিত হয়ে আমার হাত ছেড়ে দু হাতে মুখ চেপে ধরে চিবুকে দাঁত বসিয়ে দেয়। শুরু হয় দুই দামড়ার কামড়াকামড়ি, কিল, খামচি; সোজা ভাষায় মারামারি।
নিবিড় ও আনিসা এসেছে এই নববিবাহিতা দম্পতির খাবার দেওয়ার জন্য, বেডরুমের কাছে আসতেই চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে। তাই চমকিত হয়ে দরজায় জোরে নক করতেই ধরাম করে দরজা খুলে যায়।
সম্মুখের দৃশ্য দেখে দুজনেই স্তম্ভিত। আনিসা তো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। নিবিড় নখ কামড়াতে কামড়াতে বিড়বিড়াচ্ছে,
“হে আল্লাহ! এটা বাসরঘর না কি কুস্তীর ময়দান? এমন ম্যারিড কাপেল, আর ফাস্ট নাইট জীবনে প্রথম দেখলাম।”
তারপর আনিসাকে উদ্দেশ্য করে ধমক দিয়ে উঠে,
“এমন হা কইরা কী দেখতাছো? চলো, ছুটাই এদের, নাহলে আজকে ক্রাইম সিন হয়ে যাইব এহানে! মরার কোন দুঃখে যে ঘুরতে আইছিলাম।”
শেষ বাক্যটা কপালে চাপড় মেরে বলে সে। অতঃপর দুজন যেয়ে বহু কষ্ট ছুটাল দুজনকে।
“কী রে! তোমরা কী হত্যাকাণ্ড ঘটাবে না কি? আর অর্ক ভাইয়া তুমি যদি সহ্যই না করতে পারো ওকে, তবে বিয়ে করলে কেন?”
কথাটা শেষ করতেই ঠাশ করে এক চাপড় পড়ল নিবিড়ের মাথায়।
“আরে আমি কি শুরু করসি না কি আগে? আমাকে বলতাসোস কেন খালি? তোর বোনে আমার ফাস্ট নাইটটা শেষ করে দিল একদম। নিজের বোনকেও কিছু বল। বড় ভাই হইসোস কী করতে?”
নিবিড় কথাটা শুনে যেই না “মন” উচ্চারণ করে তখনই এক গাট্টা পড়ে তার ঘাড়ে আমার তরফ থেকে। যদিও সে আমার বড়, কিন্তু পিঠাপিঠি হওয়ায় বড় ভাইয়ের সম্মান পায় না বেচারা। নিবিড়ের মুখটা এবার বিড়াল ছানার ন্যায় অসহায় হয়ে যায়।
“কীয়ের ভাই? তর লাহান ভাই থাকবার চেয়ে ভাই ছাড়া থাহাই বহুত ভালা। পরের পোলার লিগা নিজের বোনের লগে এমন জঘন্য কাজ করছোছ ছেড়া! মনডায় তো চাইতাছে তরে আর ঐ সয়তানডারে ফাতা ফাতা কইরা বুড়িগঙ্গায় ফালায় আইতে৷ ”
“ঐ কী বললি আমারে? আমি শয়তান?”
আরেকদফা তর্কাতর্কি লাগতে নেয় দুজনের মাঝে। আনিসা বহু কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থামায় এবং অর্ককে বাহিরে পাঠায়।
সে রেগেমেগে “ব্লাডি হেল!” বলে বের হয়ে যায়। আমিও পিছন থেকে বিড়বিড়ালাম, “খালি পাইছে একটা, কথায় কথায় ব্লাডি হেল। হুহ!”
নিবিড় অর্কের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“দুইটাই সাইকো, রাগে কন্ট্রোল করতে পারে না। কেউ কাউ রে এক চুল ছাড় দিতে পারে না। এরা সংসার কেমতে করবে? পুরাই #কাঁটাময়_প্রণয়! তার উপর মন কি কোনো দিন মানবে এই জোরজবরদস্তির বিয়ে? আবার বাড়িতে তো কেউই জানে না বিয়ের বিষয়ে। এদের তালাক নিশ্চিত! আর সবাই তো আমারেই ধরবে! চাচা তো আমারে…! আল্লাহ, একখান পথ দেখাও আমি দিন পাঁচেকের জন্য লুকাই।”
___
অর্ক বাহিরে এসে বিয়ার পান করতে করতে মনকে নিয়ে ভাবছে। মানিব্যাগে থাকা মনের ছবিটা একদৃষ্টিতে দেখায় মগ্ন সে, একদম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আবার কখনো নিজের বুকের, কাঁধের কামড়ের দাগে আলতো হাতে স্লাইড করে আনমনেই হাসছে মেয়েটার কথা ভেবে, খাণিক মুহূর্ত আগের কথা ভেবে।
“সবাই বাসর রাতে বউয়ের থেকে লাভ বাইট পায়। আমি বাইট তো পেলাম, লাভ কবে পাব আল্লাহ জানে। সম্পর্ক, প্রেম আমার কাছে একটা খেলার মতোন, কিন্তু মন?
ভালোবাসা নয় শুধু, কাঁটাময় আসক্তি আমার। আমার কাঁটা মুকুট সে। যাকে জ্বালাতে, পোড়াতে তৃপ্তি বোধ হয়, তার কাঁটাতে রক্তাক্ত হলেও আনন্দ লাগে।
কিন্তু ও তো ওর অতীত থেকেই এখনো বের হতে পারেনি আমাকে মেনে নিতে পারবে তো? যাকগে মানুক, না মানুক তার বিষয়। এমনিতেও এখন সে পুরোটাই আমার।”
মন সম্পর্কে অর্কের দুঃসম্পর্কের কাজিন, অবশ্য কাজিনও ঠিক বলা যায় কিনা… মনের মায়ের বান্ধুবীর ছোট ছেলে সে। আবার মনের চাচাতো ভাই মোমিনের সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইন হয় তারা। মোমিনের হবু স্ত্রীর কেমন যেন ভাই এবং পেশাগত দিকে মোমিনের বসের ছেলে এবং নিবিড়ের ভার্সিটি জীবনের বড় ভাই। বেশ প্যাঁচময় ও কাঁটাময় প্রণয় তাদের! ঠিক যেন অর্কের প্রিয় কাঁটা মুকুট ফুল, দেখতে সুন্দর কিন্তু অসংখ্য তীক্ষ্ণ কাঁটায় ভর্তি।
চলবে…
#নতুন_গল্প
#কাঁটা_মুকুট
-ঈপ্সিতা শিকদার