কঠিন প্রেমের গল্প
প্রথম পর্ব
আমার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতে পারছি না। ঘরের দরজা দিয়ে নীতুকে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। আজকাল এই হয়েছে সমস্যা। নীতুকে দেখলেই বুকের মধ্যে ধক করে লাগে। গতকাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি। এসে দেখি ড্রয়িংরুমের সোফায় নীতু শুয়ে আছে এলোমেলোভাবে। আমার এতো অস্বস্তি লাগছিলো। আবার সরতেও ইচ্ছা করছিলো না। প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা কিছুটা বিরক্ত হয়ে ডাক দিলেন। নাহলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ নীতুকে দেখা যেতো। বাসায় বাচ্চারা খুব আওয়াজ করছে। আমার দুই ছেলেই সারাদিন আওয়াজ করে। জিনিস ভাঙচুর, হুলুস্থুল কিছু না। সারাদিন শুধু আওয়াজ আর আওয়াজ। মাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা। আমি এতো আওয়াজের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম থেকে উঠে কোন আওয়াজ পেলাম না। তারমানে বাচ্চারা বাসায় নেই। নীতু ওদের নিয়ে চলে যায়নি তো। এই দুশ্চিন্তাতে আমার চোখগুলো স্যাতস্যাতে হয়ে গেলো। নীতু কি আমাকে না বলে চলে যাবে। এইরকম কি হতে পারে! হতেও পারে! অনেককিছুই হতে পারে যা আগে কখনো হয়নি।
আমি আর নীতু বিয়ের আগে থেকে ভালো ভাবে দুইজন দুইজনকে চিনি। বিয়ের পরও একই গতিতে সম্পর্ক চলতে লাগলো। প্রথম বাচ্চা হয়ে দুরত্ব কিছুটা বাড়লো। দ্বিতীয় ছেলে হওয়ার পর নীতু স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সংসারের মাঝে হারিয়ে গেলো। অবশ্য আমাদের আগেও যে অনেক গভীর কোন সম্পর্ক ছিলো তা না। আমরা শুধু দুইজন দুইজনকে চিনতাম। সময়ের সাথে সাথে কেন জানি চেনা জানাটা কমেছে। মাঝখানে আমার কিছুদিন একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক হয়েছিলো। নীতু জানার মতো পর্যায়ে যায়নি সেই সম্পর্ক। এছাড়া সেরকমভাবে খারাপ কোনকিছু করিনি। মন দিয়ে কাজ করেছি, মধ্যবিত্ত ছেলে হিসাবে প্রচুর টাকা ইনকাম করেছি। নীতু, সন্তান, মা-বাবা সবার জন্য দুই হাতে টাকা খরচ করি, শ্বশুর বাড়িতেও কোন অভাব রাখিনি। সবমিলিয়ে আমার নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ মনে হয়।
সমস্যা শুরু হলো করোনার শুরু থেকে। দেশে করোনা আসলো। লকডাউন দিলো। বাসায় বসে আমার অফিসের তেমন কাজ নাই। আরাম করে দিন কাটছে। এরকম সময় একরাতে ঘুম ভেঙে দেখি যে পাশে নীতু নেই। বারান্দার আলো আড়াআড়িভাবে পড়েছে ঘরে। বোঝাই যাচ্ছে যে নীতু বারান্দায় আছে। ঘুমানোর সময় পাশের জনের নড়ানড়ি আমার একেবারেই পছন্দ না। আমি বিরক্ত হয়ে ধমক দেওয়ার জন্য উঠলাম। বারান্দায় ঢুকতে গিয়ে বুকে ধক করে লাগলো। একটা অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। চুলগুলো ছড়ানো কোমর অবধি। শাড়ির আচল ছেড়ে রেখেছে পেছনের দিকে রাখা টবের উপর। মেয়েটির এক হাতে “উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী”র বই আরেক হাতে এক কাপ গ্রীণ টি। গুণে গুণে বিয়ের ১৪ বছর পর আমি নীতুকে এই প্রথম এরকম দেখলাম। আমি খুব আলতো করে বললাম,
” দুধ চা খেলে পারতে।”
নীতু বই থেকে মুখ না তুলে বললো, “আমি গ্রীণ টি আর ব্ল্যাক কফি ছাড়া কিছু খাই না।”
আমি আর বলার কিছু পেলাম না। শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর বারান্দার আলো বন্ধ হয়ে গেলো আর খট করে একটা আওয়াজ হলো। সম্ভবত নীতু টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে।
সেই থেকে আমি গভীরভাবে নীতুর প্রেমে পড়ে গিয়েছি। নীতু ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না আবার চোখের সামনে পড়লে কেমন জানি লজ্জা লাগে। প্রথমে ভাবলাম নীতু ব্যাপারটা বুঝবে কারণ মেয়েরা এসব আগে আগে বুঝে। কিন্তু ওর মধ্যে বোঝার কোন লক্ষণ দেখলাম না। আমি বেশকিছু ইঙ্গিতও দিলাম। যেমন লকডাউনের মধ্যে বহুকষ্টে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে আসলাম। খুব বুদ্ধি করে ওর ফেসওয়াশের পাশে রেখে দিলাম। ফুলটা দুই তিনদিন একই জায়গায় পরে থাকলো। এরপর কেউ একজন ফেলে দিলো। আরেকদিন শাড়ি নিয়ে আসলাম। শাড়িটা দেখে নীতু খুব খুশি হলো। একদিন রাতে পরলো। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি নীতুর জন্য। অনেকক্ষণ খোঁজ না পেয়ে ছেলেদের ঘরে গিয়ে দেখি মা-ছেলে একসাথে ঘুমাচ্ছে। মায়ের পরণে শাড়ি আর ছেলেরা পরেছে পাঞ্জাবি। মনে হচ্ছে কোন হলুদের অনুষ্ঠান থেকে এসেছে। আমি ঘরে এসে বাকিরাত অপেক্ষা করলাম। বারবার একটা ঘটনা মনে পড়লো। আমার বড় ছেলে ধ্রুবের জন্মের পর নীতু খুবই চিৎকার চেচামেচি করতো। দিনরাত অকারণ কথা বলতে চাইতো আর বাসায় ফিরতে দেরি হলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিতো। মূলত এসব কারণেই আমার অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। কেন যেন এতদিন পর আমি বুঝতে পারছি নীতু কি চাইতো। আমিও একই জিনিস চাই কিন্তু চিৎকার চেচামেচির দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে আমার নীতুকে হারানোর ভয় মনে বসে গিয়েছে।
(চলবে)