এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১১

0
1117

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

ডাক্তার সাহেব এসেছেন। দরজায় করাঘাত দিচ্ছে। মিহি পোশাক ঝেড়ে গেল দরজা খুলতে। পেরিয়ে গেল কিছু মুহুর্ত। পাশের ঘর থেকে অতিপরিচিত কণ্ঠস্বর শ্রবণ হলো কর্ণপথে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নেমে গেলাম গ্রিল হতে। ছোটো ছোটো পা ফেলে অগ্রসর হলাম পাশের ঘরে। দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই একটি ছেলেকে দেখতে পেলাম। হালকা গোলাপি রঙের শার্ট, বলিষ্ঠ পুরুষালি শরীর। মাথায় ওড়না টেনে সরে গেলাম। ছেলেটি বেরিয়ে গেল চঞ্চল পায়ে। চিন্তিত লাগল বেশ। ছুটে গেলাম জানালার নিকট। ভয় এক সেকেন্ডে উধাও হয়েছে। সিএনজি ডেকে উঠে যাওয়ার পূর্বে দেখা গেল তার মুখশ্রীর অংশ বিশেষ। ওষ্ঠদ্বয় মৃদু নাড়িয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই।” পরক্ষণেই উচ্চ স্বরে ডাক দিলাম। ততক্ষণে গতিশীল হয়েছে সিএনজি। আমার নম্র ভদ্র গলার আওয়াজ ছয় তলা হতে নিচ তলায় পৌঁছায়নি। দ্রুত গতিতে ছুটে গেলাম নিচে। সিঁড়ি পেরিয়ে নেমে গেলাম রাস্তায়। সিএনজি অদৃশ্য, বহুদূরে। পুনরায় ছুটে এলাম। সিঁড়ি পেরিয়ে উঠলাম ঘরে। হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “অপূর্ব ভাই এখানে কেন এসেছিলেন?”

মিহি সন্দিহান গলায় বলে, “কোন অপূর্ব ভাই?”

“একটু আগে ফুফুকে দেখল না? ডাক্তার। সে।”

“মাকে দেখতে এসেছে। বলেছিলাম না, ডাক্তার আসবে?”

“আমি তার কাছে যাবো। প্লীজ ঠিকানাটা দিন আমায়।”

মিহি আমার কথায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে বলে, “শান্ত হও। আমাদের ব্যাপারটা খুলে বলো। তুমি যাকে খুঁজতে ট্রেনে উঠেছিল, সেই ডাক্তার অপূর্ব আহসান?”

“হম। আমার অপূর্ব ভাই। ঠিকানাটা দিন প্লীজ।” মিহি আমায় অপূর্ব ভাইয়ের ঠিকানা লিখে দিল। পৌঁছাতে পারব কি-না জিজ্ঞাসা করল। আমি সায় দিলাম। গোসল সেরে মিহি-র পোশাক পরিধান করেছিলাম। পাল্টে নিজের পোশাক পরিধান করলাম। অতঃপর বেরিয়ে গেলাম চেম্বারের উদ্দেশ্য। মিহি কিছু টাকা দিল আমায়।

সিএনজিতে চড়ে কাগজের লেখাটা পড়ে বললাম, “শাপলা চত্বরে হুমাইরা ক্লিনিকে যাবো।”

ড্রাইভার ক্লিনিকের উদ্দেশ্য যাত্রা আরম্ভ করল। উত্তেজিত হয়ে হিম হাত জোড়া ঘসতে ঘসতে উষ্ণ করে ফেললাম। সিটের উপর ‘আর্দশলিপি’ একটি বই পেলাম। আমার শৈশবের প্রথম পড়া শুরু। বইটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বসলাম। গাড়ি থামল দোতলা একটি ক্লিনিকের সামনে। পঞ্চাশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। মধ্য বয়স্ক একজন লোকজন লোক আমার দেখে পথ আটকে দাঁড়ালেন। মাটি রঙের পুলিশি পোশাক পরণে। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে না-তো? থমথমে গলায় বলেন, “কাকে চাই? কোন ডাক্তার?”

হাতের দুপিঠ দেখিয়ে বললাম, “ডাক্তার দেখাতে আসিনি। মনো চিকিৎসক অপূর্ব আহসান আমার ভাই হয়। তার সাথে দেখা করতে এসেছি। একটু বলুন না আমি এসেছি?”

“অপূর্ব স্যার এখানে একা থাকেন। তার পরিবার গ্ৰামে থাকে। আপনি তার সাথে একটা শর্তে দেখা করতে পারবেন। রোগী দেখার সিরিয়াল চলছে। চার্জ দিয়ে সিরিয়াল কে/টে দেখা করতে পারবেন।”

চার্জ? কৌতুহল নিয়ে বললাম, “চার্জ কী?”

“তার ফি। পাঁচশত লাগবে। আছে?” মুঠো করা হাত খুলে দেখলাম। দুটো একশত টাকার কচকচে নোটস। উপরে ব্রীজ। ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন। একবার অপূর্ব ভাইয়ের কাছে পৌঁছাতে পারলেই হয়। সম্মতি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সিটে বসে অতিবাহিত করলাম কিছু মুহুর্ত। অপূর্ব ভাইয়ের চেম্বারের দিকে এক পা এগুলে মহিলারা চ্যাঁচিয়ে বলে, “এই মেয়ে তোমার সিরিয়াল কত? সিরিয়ালে দাঁড়াও। আগে আমার সিরিয়াল?”

কিছুক্ষণ একা একা হাঁটাহাঁটি করে দিলাম এক দৌড়। দরজা খুলে প্রবেশ করলাম ভেতরে। সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিতা একজন ডাক্তার বসা। আমাকে দেখামাত্র বললেন, “বসুন। বলুন আপনার সমস্যা?”

অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি মাথানত করে বলে, “স্যার মেয়েটি সিরিয়াল কা/টে নি। সোজা ঢুকে এসেছে।”

“সিরিয়াল কা/টেননি কেন?”

“ডাক্তার সাহেব-কে আমার অতি প্রয়োজন। কোথায় তিনি?”

ডাক্তার হেসে বললেন, “আমিই ডাক্তার বলুন আপনার সমস্যা। বসুন। আপনার মতো একটা বাচ্চার কাছ থেকে চার্জ নাইবা নিলাম। সমস্যার কথা বলুন।”

হাতে আদর্শলিপি বইটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “আমি আরু অপূর্ব ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। প্লীজ তাকে ডেকে দিন।”

বেজায় বিরক্ত সে। রাগান্বিত হয়ে আদেশ করেন, “আউট। গেট আইট। বের হয়ে যান। দাড়োয়ান-কে বলুন যাকে তাকে ঢুকতে না দেয়”

এসিস্ট্যান্ট আমাকে ধমক দিল, “যান। স্যার রেগে যাচ্ছেন। আপনাকে কিন্তু পুলিশে দিবেন।”

ফিচেল হেসে বেরিয়ে গেলাম। সারিবদ্ধ গাছের নিচে বসে পড়লাম। এশার আযানে মুখরিত চারপাশ। বুকের ভেতরে অনুভব করছি অদৃশ্য ভয়। অন্তরে হাহাকার। তারা কি‌ আমায় ভুল ঠিকানা দিল? না-কি সিএনজি ড্রাইভার দিলেন। মিহিদের বাড়ির ঠিকানাটাও নেই, কোথায় যাবো এতরাতে?

ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি দ্রুত গতিতে অতিক্রম করছে। লোকজন ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছে। আমার খবর নেই কারো। হাঁটা ধরলাম আপন মনে। চোখজোড়া ছলছলিয়ে উঠেছে। নিজেকে অসহায় লাগছে। স্টেশনে যাবো। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধান পেলাম নদীর। লঞ্চ চলাচল করছে। নদীর পাশ ঘেঁষে সরু ব্রীজ। রেলিং-এ উঠে বসলাম। পানির তৃষ্ণা অনুভব করলাম। হাতের করতলে নিয়ে এক ঢোক পান করে তৃষ্ণা মেটালাম। বিকট শব্দ শোনা গেল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ঠকঠক করে কেঁপে উঠলাম। কানে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম, “আহ্!”

নদীর জলে ধপাস করে ফেলল কাউকে। একটি জীবন্ত প্রাণ। ডুবে গেল অবিলম্বে। বেশ কয়েকজন যুবক। আমাকে দেখে হতভম্ব তাঁরা। চ্যাঁচিয়ে বলে, “ধর মেয়েটিকে। তন্ময়-কে মা/রার সাক্ষী মেয়েটি।”

ছুটে এগিয়ে এলো একদল যুবক। আমি দৌড় আরম্ভ করলাম। পায়ে সত্তর টাকা দামের স্যান্ডেল। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই ছিঁ/ড়ে গেল। জুতো জোড়া রাস্তায় ফেলে সালোয়ার উঁচু করে দ্রুত গতিতে ছুটলাম। রাত তখন এগারোটা ছাড়িয়েছে। নির্জন পথঘাট। পেছন থেকে মুঠো করে ধরল চুলের মুঠি। টান দিল। মুখ থুবড়ে গাছের সাথে আঘাত পেলাম। মাথা ঘুরে উঠল। টেনে তুলে দাঁড় করালো। মা/তালদের ন্যায় ভারসাম্য হারিয়ে টলছি। পরপর বসিয়ে দিল দুই চ/ড়। গাছের সাথে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। গাল জোড়া অগ্নিরুদ্ধ। মাটিতে ফেলে এবড়ো থেবড়ো লা/থি দেওয়া শুরু করল। হাতে ছিল মোটা লা/ঠি। বাদ যায়নি দেহ। আ/ঘা/তগুলোতে জর্জরিত দেহ। ব্যথায় গোঙানি শুনতে লাগলাম। শহরের মানুষের মনে দয়া মায়া হয়না? ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল গলা। গলায় হাত দিয়ে কাঁ/টা মুরগির মতো ঝটপট করতে লাগলাম। শ্বাস কষ্ট শুধু হলো। কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো নেত্রযুগল। জীবনের শেষ বুঝি এখানেই।

তীর্যক আলোর রেখা পতিত হলো মুখশ্রীতে। কুঁচকে গেল চোখ মুখ। যুবকেরা ছুটে গেল অদূরে। ঝাঁপসা চোখে অবলোকন করলাম সবকিছু। কাশি উঠল। গাড়িটা চা/পা দিয়ে যাবে বুঝি এক্ষুনি। তেমন কিছু ঘটল না। সামনে থামল, নিকটে এসে। সুদর্শন সুপুরুষ নেমে এলো গাড়ি হতে। মাথাটা আলতো কোলে নিল। উৎকণ্ঠার সাথে প্রকাশ করল, “আরু, তুই? তুই এখানে কী করছিস? বাড়ির সবাই তোর জন্য কত চিন্তা করছে, আর তুই এখানে?”

হাতটা বন্ধনহীন শক্তির চেপে ধরে বললাম, “অ..পূ..র্ব ভা..ই।”

অতঃপর চেতনাশক্তি হ্রাস পেল। পুরোপুরি হারালো না। ক্ষণে ক্ষণে কাশি ছাড়া অপূর্ব ভাই ডেকেও সাড়া পেলেন না আমার। পাঁজাকোলা করে চলল গাড়ির ভেতর। মুখে পানির ঝাপটা দিল। ওষ্ঠদ্বয়ের মধ্যিখান দিয়ে পানি গলিয়ে দিলেন ভেতরে। গালে হাত রেখে উদাসীন হয়ে বললেন, “আরু শুনতে পারছিস? তাকিয়ে দেখ পাখি। এইতো আমি।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

রেসপন্স করার অনুরোধ রইল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here