এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১২

0
1150

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১২

“অপূর্ব ভাই, আপনি এসেছেন? কোথায় ছিলেন আপনি?” ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করলাম প্রতিটি বর্ণ। অপূর্ব ভাই কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এই তো আমি। শান্ত হ।”

একটু এগিয়ে ঠেস দিয়ে বসলাম তার বুকের সাথে। যেখান থেকে হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচল শ্রবণ হয়। গলায় হাত বুলিয়ে বললাম, “এখানে খুব ব্যথা করছে অপূর্ব ভাই।”

“বেশ হয়েছে। এসেছিলি কেন?” দৃঢ় কণ্ঠে বললেন অপূর্ব ভাই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরে আসার প্রয়াস করলাম। ওড়না খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। নেই। গাড়ির দরজা ঠেলে নামার প্রচেষ্টা করলাম। দরজাই খুলতে পারছি না। রাগান্বিত গলায় বললাম, “অপূর্ব ভাই ফাঁক কোথায়? আমি নামব।”

“নেমে কী করবি? নড়তেই তো পারছিস না। ছেলেরা ওখানে ওঁত পেতে আছে। যা!”

কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইলাম। ঠান্ডায় ব্লেজার জ্যাকেট খুলে আমার শরীরে পরিয়ে দিলেন। আলতো করে গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বাড়িতে চল। তখন দেখব কোথায় ব্যথা পেয়েছিস।”

আলতো ঝুঁকে এলেন। সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলেন। হৃৎপিণ্ডের থুকপুকানির শব্দ গানের তালে বেজে যাচ্ছে। মৃদু স্বরে বললাম, “অপূর্ব ভাই আপনি তো মনের ডাক্তার। আপনি কাছে এলে হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে না। কেন এমন হয়, বলুন না?”

অপূর্ব ভাই ‘এসির’ মতো যন্ত্রটা চালু করলেন। ঠান্ডায় শরীরের ব্যথায় বরফের মতো কাজ করল। গাড়ি চলল নিজ গতিতে। অপূর্ব ভাই একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলেন, “আল্লাহ আমাদের সবাইকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। আদম (আঃ) থেকে চলছে। আমার পাঁজর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক রমনী। হয়তো সে তুই। তাই এমন অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করিস।”
___

পরণের পোশাক ছিঁড়ে হয়েছে কয়েক টুকরো। জায়গায় জায়গায় ছিঁ/ড়েছে। নড়তে পারছি না ব্যথায়। অপূর্ব ভাই ধূসর রঙের ট্রাউজার ও টি শার্ট এনে দিলেন। বললেন, “পাশের ফ্লাটের আপাকে বলেছি। তিনি তোকে সাহায্য করবে। তাড়াতাড়ি গোসল করে পোশাক পাল্টে নে।”

“না। এই ঠান্ডার ভেতরে গোসল করতে পারব না।”

“তাহলে ঠান্ডার ভেতরে নিচে শুয়ে পড়। শরীরে ময়লা আবর্জনার অন্ত নেই। আমার বিছানা নষ্ট করতে পারব না।”

পাশের ঘর থেকে এক তরুণী ও মধ্য বয়স্ক মহিলা এলো। আমাকে দেখিয়ে অপূর্ব ভাই বললেন, “ও আমার ফুফাতো বোন। গোসল করে একটু শেক দিয়ে দিয়েন।”

দুজন আমাকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সবকিছু নজরবন্দি করলাম। অসম্ভব সুন্দর সবকিছু। সাদা রঙের শক্ত বস্তু দেয়ালে। আঙুলের ইশারায় বললাম, “ওগুলোকে কী বলে?”

“টাইলস।”

সাদা রঙের ডোবার ভেতরে বসতে দিল। পানি গুলো গরম। এমন ডোবায় গরম পানি থাকলে প্রতিদিন গোসল করতাম আমি। বড়ো বড়ো চোখ করে বললাম, “এই ডোবা কোথায় পাওয়া যায়? আমি গ্ৰামে নিবো।”

“এটা ডোবা না, বাথটাব। অপূর্বকে বলো, তোমাকে গ্ৰামে দিয়ে আসবে। আপাতত চুপ থাকো।”
বলেই তারা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। দশ মিনিটে গোসল সেরে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। গরম পানিতে শেক দিলেন। ব্যথা নিমজ্জিত হয়েছে। রাত বাড়ছে। তারা ঘরে গেলেন। অপূর্ব ভাই খাবারের থালা নিয়ে আসলেন। লাল শাক ও ঢেড়স। আমাকে উঠিয়ে নিলেন। পেছনে বালিস রেখে আধশোয়া করে রাখলেন। এক লোকমা মুখে তুলে বললেন, “বিকেলে আমার চেম্বারে গিয়েছিলিস?”

গলা ব্যথায় খাবার গিলতে কষ্ট হলো। দু’হাতে গলা ধরে গরম পানি পান করলাম। অপূর্ব ভাই হট ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললেন গলায় চেপে রাখতেন। মুঠোফোন বেজে উঠল। নাম্বার চেক করে বললেন, “মা ফোন করেছে। তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা নাজেহাল। কথা বলতে দিলে। গোঙানি না করে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবি।”

রিসিভ করে কানে ধরলেন, “আসসালামু আলাইকুম মা।”

ওপাশ থেকে বিচলিত কণ্ঠ শোনা গেল, “বাবা আরুকে এখনো পেলাম না। তোর বাবা চাচারা হৈন্য হয়ে খুঁজে চলেছি। আব্বা তো আমাদের রাগারাগী করেছে। কোথায় পাবো।”

“ঢাকায় আছে। আমার সাথে। সে লম্বা ঘটনা। আপাতত কিছু বলতে পারব না। আরুর সাথে কথা বলো।” অপূর্ব ভাই ফোনটা এগিয়ে দিলেন। ইশারায় হাতে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা আয়ত্বে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, “মা-মি।

“আলহামদুলিল্লাহ। খুঁজে পেয়েছি তোকে। না বলে কেউ এতদূর যায়? অপুর সাথে শহরে যাবি আমাদের বললেই হতো। তোর মামারা প্রচুর রেগে আছে।”

বুলি হারিয়ে ফেললাম। এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলাম। মৃদু স্বরে বললাম, “দুঃখিত মামি। আমি ভুলে ট্রেনে উঠেছিলাম। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল। নামতে পারিনি। তোমাদের ফোন নাম্বার ছিল না যে জানাবো।”

“এখন কী করছিস?”

“খাচ্ছি। রক্ত ও সর্দি দিয়ে। অপূর্ব ভাই নিজে রান্না করে.. বাক্য শেষ করার পূর্বেই ওয়াক ওয়াক থু থু করে উঠলেন অপূর্ব ভাই। ফোন বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে ছুটে গেলেন। এপাশের ঘটনা মামি ওপাশ থেকে অনুমান করতে সক্ষম হলেন। অশান্ত গলায় বললেন, “এখন তুই অপুর কাছে আছিস। উল্টা পাল্টা কথা বলিস না। ও কিন্তু ডাক্তার। মুখ সেলাই করে দিবে।”

মামি লাইন বিচ্ছিন্ন করলেন। জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে ভীত ঢোক গিলে নিলাম। সেলাই করলে রক্ত ঝরবে। অপূর্ব ভাই ততক্ষণে ফিরে এসেছেন। মাথায় পানি দিয়েছেন। বজ্রকণ্ঠে বলেন, “আমি কী রান্না করেছি? রক্ত? তোর রক্ত রান্না করেছি বুঝি? সর্দি? আলু দিয়ে সর্দি। খেয়েছিস কখনো?”

“ওমা! তুমি ধাঁধা জানো না। মামা বাড়িতে গেলাম রক্ত দিয়ে ভাত খেলাম। এই ধাঁধার সমাধান হচ্ছে লাল শাক। মামা বাড়িতে গেলাম সর্দি দিয়ে ভাত খেলাম। এই ধাঁধার সমাধান হচ্ছে ঢেড়স। বাগান থেকে এলো এক তুঁতে, ভাতে দিল মুতে। এই ধাঁধার সমাধান হচ্ছে..

অপূর্ব ভাই হাত দেখিয়ে বলে, “আমার ধাঁধা লাগবে না। তোর জন্য রাতের খাবার আমার জন্য শেষ। পরবর্তীতে লাল শাক, ঢেড়স কিংবা লেবু খাওয়ার আগে এই কথাটা মনে পড়বে।”

গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে গ্ৰামের সূর্য্যি মামা উঁকি দেয়। কিন্তু শহরে দালান কোঠার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। আলোকিত হয় পৃথিবী। হাই তুলে উঠে বসলাম আমি। জানালার পর্দা সরিয়ে অনুমান করলাম সময়। সূর্য মাথার উপরে অবস্থান করছে। অর্থাৎ মধ্যাহ্ন পেরিয়েছে। বিছানার উপরে একটা চিরকুট পেলাম। উড়ে যেতে না পারে সেজন্য বরাদ্দ করা অপূর্ব ভাইয়ের মুঠোফোন। সময় ১২:৪৫। সাদা রঙের চিরকুট হাতে নিলাম। কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং লিখে রেখেছে। অপূর্ব ভাই আমাকে ভেঙায়, অথচ এতবড় ডাক্তার হয়ে সে ভালোভাবে লিখতে পারে না।

টেবিলের উপর দুটো রুটি ও সবজি ভাজি রাখা। সোফায় শুয়ে খেতে আরম্ভ করলাম। টেলিভিশন চালু করলাম। পাশে একটা রিমোট পেলাম। চ্যানেলের নাম ‘এটিএন বাংলা’ বাহ্! বিটিভির বাইরে কোনো চ্যানেল আছে আজ জানলাম। এড শেষ হতেই দেখতে পেলাম ‘আম্মাজান’ সিনেমা চলছে।

খবর সম্প্রচার শুরু হলো। মেয়েটি পড়ছেন,
ঘড়িতে তখন ভোররাত ৪টা ১৭ মিনিট। সীমান্তের দুই দিকে তুরস্ক ও সিরিয়ার বাসিন্দারা ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে ওই জনপদে।

ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ভূমিকম্পের পরে আরও অর্ধশতবার পরাঘাত অনুভূত হয়। ভূমিকম্পে দুই দেশের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। বহু মানুষ নিখোঁজ। অসংখ্য ভবন ও অবকাঠামো ধসে পড়েছে। আহত ব্যক্তিদের আহাজারি চলছে হাসপাতালে।”

দরজায় তালা ঝুলিয়ে বের হলাম। হাতে ফোন আর চিরকুট। উদ্দেশ্য মাঠে যাওয়া। গতকাল আমাকে সাহায্য করেছিল সেই মেয়েটিকে পেলাম। সেঁজুতি নাম মেয়েটির। চৌদ্দ তলা বিল্ডিং-এর পুরোটা সিঁড়ি পেরিয়ে নামা অসম্ভব। সেঁজুতি আমায় লিফটে নিয়ে গেল। উঠলাম লিফ্টে। বাটন ক্লিক করে দাঁড়াল। দরজা বন্ধ হতেই দিল এক কাঁপুনি। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। বসে পড়লাম সেখানে। মাথা ঘুরছে। চিৎকার করে বললাম, “কাঁপা ঘর থেকে আমাকে বের করো। মাথা ঘুরছে। মাগো। ভূমিকম্প হচ্ছে। আমিও মা/রা যাবো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

রেসপন্স করার অনুরোধ রইল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here