এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১০

0
1120

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

“অপূর্ব ভাই, আপনি আমার উপর অভিমান করে থাকতে পারবেন না। আপনার অভিমান ভাঙানোর ওষুধ আমার হাতে।” নিভৃতে যতনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে অগ্ৰসর হলাম অপূর্ব ভাইয়ের কক্ষের দিকে। শান্ত শিষ্ট সবকিছু। তারা ছায়াটিও অনুপস্থিত। গতরাতে গোছানো ট্রাভেলিং ব্যাগ তার জায়গায় অনুপস্থিত। চলে যায় নি তো?

বইখাতা বিছানায় রেখে ছুটে গেলাম বাইরে। উঠানে বসে কথার ঝুলি খুলেছে চার মামি ও নানি মা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “অপূর্ব ভাই কোথায় বড়ো মামি?”

“ও তো চলে গেছে। ঘণ্টা খানেক আগে। পাঁচটায় ট্রেন।” বলেই সবাই খোশগল্পে মেতে উঠল। স্কুল ছুটি হয় চারটা নাগাদ।দ্রুতি গতিতে বাড়িতে ফিরতে সময় লেগেছে মিনিট বিশেক। পাঁচটা বাজতে ঢের বাকি। সবাইকে ফেলে স্টেশনের দিকে ছুটে গেলাম সর্বশক্তিতে। মামি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “আরু, কোথায় যাচ্ছিস? আস্তে মা, পরে যাবি।”

পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “স্টেশনে মামি।”

ছুটে গেলাম স্টেশনের দিকে। মিনিট ত্রিশ লাগল পৌঁছাতে। ভিড় চারিদিকে। ট্রেন এসেছে। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পূর্বে দেওয়া সংক্ষেত বাজছে। যাত্রীরা ব্যস্ত ট্রেনে উঠতে। ছুটে গেলাম দরজার কাছাকাছি। ভিড় ঠেলে উঠে গেলাম ট্রেনে। আশেপাশে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। অপূর্ব ভাই নেই। আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কু সংক্ষেত মনে হানা দিল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার কথা? জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হতবুদ্ধ হলাম তৎক্ষণাৎ। ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। আশেপাশে গাছপালা পিছনের দিকে দৌড়ে চলেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। কী করে ফেলেছি আমি। ভেতর থেকে অশ্রুধারা ঝরে পরল। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আগ বাড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

নুয়ে গেলাম। ভীত হয়ে বললাম, “চাচা ট্রেন থামিয়ে দিন না, আমি ভুলে ট্রেনে উঠে গেছি।”

“ভুলে কেউ ট্রেনে উঠে?”

“অপূর্ব ভাইকে খুঁজতে ট্রেনে উঠেছি। কখন যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।” বলেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। লোকটার আমার প্রতি মায়া বাড়ল বৈ-কি। মাথায় হাত দিয়ে শান্তনার ভঙ্গিতে বললেন, “এখন ট্রেন থামানো সম্ভব। কিন্তু বিপদ বাড়ানো ঠিক হবেনা। ট্রেন থেকে নেমে কোথায় যাবে? ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাত হয়ে যাবে।”

ট্রেনে এক লেখার দিকে নজরবন্দি হলো, ‘অপরিচিত কারো খাবার খাবেন না। কথা বলা, সখ্যতা থেকে বিরত থাকুন। শুভ যাত্রা।’ কিছুটা দূরত্বে লেখা, ‘বিনা টিকেটে ভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ।‌’ নত গলায় বললাম, “তাহলে এখন কী করব?”

তিনি উত্তম সমাধান দিলেন, “ঢাকায় পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কাল ছাড়া আর ট্রেন ছাড়বে না। তুমি আমার সাথে আমার বোনের বাড়িতে চলো। আমি সকালে তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো। চাইলে কয়েক দিন বেড়াতেও পারবে।”

“না। আমি কালকেই ফিরব।”

তার বুকিং করা কেবিনে গেলাম। দুটো বেড ও অগোছালো জিনিস পত্র দিয়ে ভর্তি। বোনের বাড়ি যাচ্ছে বলে কথা। হাঁস মুরগি, শাক সবজি, ডাল, চালতা, কাঠালি কলা ইত্যাদি। আমি বসলাম। হেলান দিয়ে বসলাম। পা’য়ে প্রচুর ব্যথা করছে। চোখের পলক বন্ধ হলো। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম ঘুমে। ঘুম ভাঙল সকালে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম লোকটিকে। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ডাকছেন। ঠান্ডায় নাক‌ আঁটকে রয়েছে। তিনি তাড়া দিয়ে বললেন, “চলো মেয়ে। রাতে ট্রেন স্টেশনে এসেছে। এখন সকাল সবাই নেমে ট্রেন ফাঁকা হয়েছে। কিছুক্ষণের ভেতরে ফিরতি ট্রেন ছেড়ে যাবে। চলো তোমাকে কিছু খাইয়ে দেই। অতঃপর ট্রেনে চড়ে সোজা বাড়িতে যাবে।”

আমিও রাজি হলাম। গতকাল সকালে খেয়েছি। ক্ষুধায় কাতর। বাড়ির সবার কথা মনে পরছে। নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। ল্যান্ড ফোন কিংবা অপূর্ব ভাইয়ের ফোন নাম্বার জানা নেই। মেঘমুক্ত আকাশের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই ঘিরে ধরে। ফিরতি ট্রেনও মিস্ করলাম। উপায়হীন হয়ে চললাম লোকটির সাথে।

সবুজ রঙের তিন চাকা গাড়িতে জীবনে প্রথমবার চড়লাম। পেছনে বড়ো বড়ো করে লেখা সিএনজি। প্রথমবার দেখলাম ভ্যান ছাড়াও গাড়ি আছে। অনেক ধরনের গাড়ি। বড়ো বড়ো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানো। বড়ো বড়ো ইট পাথরের বিল্ডিং। আচ্ছা এগুলো আমার মাথায় ভেঙে পড়বে না-তো? আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে লোকটি বললেন, “মেয়ে তোমার নাম কী?”

“অপরিচিতদের মামি নাম বলতে বারণ করেছে।” কথাটা বলে নিজেই খা/রা/প লাগল। আদৌ তিনি আমার অপরিচিত আছে? এক গাল হেসে বলে, “পাগলী মেয়ের কথা শুনো। তুই করে বলছি। তোর নাহয় নিজের নাম বলতে বারণ আছে। কিন্তু আমার নেই। আমার নাম শুনতে বারণ আছে কি?”

“না।”

“আমার নাম ইমদাদুল হোসেন মৃধা।”

বুকের ভেতরে ধুক করে উঠল। অতি চেনা নাম যে। আমার বাবার নাম। গাড়ি থামল। ভাড়া মিটিয়ে নামলেন তিনি। আমিও নামলাম। এক পা ফেলছি তো অন্য পা পিছিয়ে যাচ্ছে। বড়ো একটা বিল্ডিং। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “আমি যাবো না। বিল্ডিং ভেঙে আমার মাথায় পরলে ম/রেই যাবো। বাড়ির কেউ জানবে না, আরু বিল্ডিং-এ চাপা পরে ম/রেছে।”

তিনি আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। চারপাশে ভিড় জমে গেল। ঘিরে ধরল তাকে। লোকটা কুপোকাত হলো। বলে, “মেয়েটাকে জোর করে কোথায় নিতাছেন ভাই?”

“ভাই দেখুন কী জ্বালা। আমার মেয়ে। প্রথমবার ঢাকায় এসেছে। বিল্ডিং দেখে ভয় পাচ্ছে। যদি ওর মাথায় পরে।” ইমদাদুল সাহেব থামতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। রাগ লাগল শরীরে। ইমদাদুল সাহেবের ব্যাগ নিয়ে বললাম, “আপনি আগে আগে যাবেন, পরে আমি। বিল্ডিং ভেঙে আগে আপনার গায়ে পরুক।”

তিনি হাসলেন। আমি পিছুপিছু অগ্ৰসর হলাম। পেছন থেকে খামচে ধরলাম তার শার্ট। বিল্ডিং ভেঙে তার মাথায় পরুক।
__
গোসল সেরে জানালার পাশে বসলাম। ঠান্ডা লাগছে প্রচুর। গরম পানিতে গোসল সেরেছি। এই বাড়ির সবাই খুব ভালো। ইমদাদুল সাহেবের বোন, স্বামী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। সবার সাথে পরিচয় হলেও ছেলেটির সাথে হলো না। মেয়েটির নাম মিহি। তার ঘরেই বসে আছি। মুখে ক্রিম মাখতে মাখতে বলে, “আরু, চিন্তা করছ কেন?”

শ্বাস নিয়ে বললাম, “বাড়ির সবাই চিন্তা করছে।”

“তবে তুমি চিন্তা কোরো না, কেমন? আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। একটু পর ডাক্তার আসবেন।”

“ফুফুকে সুস্থ দেখেছি। কখন অসুস্থ হয়েছেন?”

“আরে মনের অসুখ। মায়ের মন খা/রা/প থাকে সবসময়। তাই একজন ডাক্তার ঠিক করা আছে। তিনি সপ্তাহে একবার আসেন। গত সপ্তাহে হুট করে গ্ৰামে গেছেন। বলেছেন আজ গ্রাম থেকে ফিরে আসবেন। দেখি আসে কি-না?”

তার কথায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অপূর্ব ভাইও মনের ডাক্তার। তারমানে মনেরও অসুখ হয়। কিন্তু আমাদের গ্ৰামে কারো হয়না। কারণ তারা যৌথ পরিবার ও প্রকৃতির মাঝে বেড়ে উঠে।
টাওয়াল দেখিয়ে বললাম, “কোথায় রোদে দিবো? আমাদের পোশাক ক্ষেতে খড়কুটোতে মেলে দেই। তাছাড়া রসিতে।”

“এসো।” বলে মেয়েকে আমায় নিয়ে গেল ছোটো বারান্দায়। কী সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া! এতক্ষণ ‘এসি’ নামক যন্ত্রের ভেতরে অবস্থান করছিলাম। গ্ৰিল বিহীন বারান্দা দিয়ে উঁকি দিতেই নজরবন্দি হলো ‘মাটি থেকে উপরের দূরত্ব’ – এত উঁচু। লাফ দিয়ে কাঁধে চড়ে গেলাম মিহির। চুলগুলো চেপে ধরে বললাম, “বাঁচাও, পরে গেলাম। ম/রে গেলাম। মামা-মামি..

মিহি ছাড়াতে চেষ্টা করে বলে, “আরে চুল ছাড়ো। ছিঁ/ড়ে যাচ্ছে, ব্যথা পাচ্ছি। আজব তো! নামো। এই মেয়ে।”

ছাড়াতে ছাড়াতে ছিঁ/ড়ল কিছু চুল। দু’জনেই মুখ থুবড়ে নিচে। মেয়েটিকে রেখে ঘরে গেলাম। জানালার গ্ৰিলে উঠে ঝুলে রইলাম টিকটিকির মতো। মনে মনে আওড়ালাম, “মামি, তোমার ছেলেকে কোথায় পাঠিয়েছ? যখন তখন উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এ চাপা পরে প্রাণ চলে যাবে। দশের উপকার করতে গিয়ে নিজের ক্ষ/তি করে ফেলল গো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here