এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১১

0
452

#এ_মন_মেলুক_পাখনা 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসির রেখা ফুটিয়ে চোখ টিপে দিলাম অভ্র স্যারকে। কিঞ্চিত হেসে বললাম, “ফ্যাশন ডিজাইনিং হলো এক ধরণের আর্ট ফর্ম। বর্তমান সময়ে বিনোদন জগতের রমরমা হুহু করে বেড়ে চলছে, তেমনইভাবে সমানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফ্যাশন জগতের পরিধি। সব্যসাচীর ব্র্যান্ডেড শাড়ি হোক কিংবা প্যারিসের মিলানের ফ্যাশন উইক – কিংবা বলিউড থেকে টলিউড সেলেব্রেটিরা সকলেই মজে আছেন ফ্যাশন জগতে।
যে কারণেই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফ্যাশন ডিসাইনিং বা ফ্যাশন ডিসাইন ইন্ডাস্ট্রি। মূলত, ডিজাইন একই থাকে। একটা স্টাইল কিছু বছর, মাসে, দিনে অর্থাৎ অনির্দিষ্ট সময় পর সেটা ফিরে আসে। ডিজাইন থেমে গেলেও, স্টাইলের পুনরাবৃত্তি ঘটে।”

করতালিতে মুখরিত হলো। আমার জবাবে সন্তুষ্ট হলো সবাই। আমি হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “ধন্যবাদ।”

ঊষাকে উদ্দেশ্য করে অ্যাঙ্কার বলে, “তোমার কাছে ডিজাইন, ফ্যাশন ও স্টাইল মানে কী?”

আমার পানে চেয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলে, “আমার বাবাই।” ঊষার বুঝতে ব্যর্থ হলো সকলে। দুইহাতে দুই মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, “যার বাবাইয়ের হাত ধরে নতুন নতুন ডিজাইন, স্টাইল, ফ্যাশনের জন্ম হয়। মেয়ের কাছে তার বাবাই সব।”

আরও একবার করতালিতে মুখরিত হলো। ধন্যবাদ বলে র‍্যাম্প থেকে নেমে এলাম। অভ্র এসে সামনে দাঁড়ালো। ইতস্তত করে বলে, “একটি কথা বলার ছিল।”

“বলুন।”

“আসলে .। আআসলে, কীভাবে বলব?” অভ্র স্যারের তোতলামিতে বিরক্ত হলাম। নির্জন জায়গা দেখে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ড্রেসটা পরে এতক্ষণ অস্বস্তি না লাগলেও এবার অস্বস্তি লাগল আমার। তার সাথে যুক্ত হয়েছে চেন। হঠাৎ খুলে গেছে। টেনেও লাগাতে পারছি না। জমাট বেঁধে আছে। আমার অস্বস্তির মাত্রা বাড়িয়ে তুলে অগ্নি এলো। বলেন, “তুমি কিন্তু শুধু একজন ডিজাইনার না, পাক্কা মডেল? এত সুন্দর করে হেসে উপস্থিত সবার বুকে ঝড় শুরু করে দিয়েছ?”

“শুধু ঝড়? না-কি বিজলীও?” অগ্নি দৃষ্টিভঙ্গি ভালো ঠেকছে না। আমার অস্বস্তির মাত্রা বাড়ছে, মুখ ফুটে বলার ‘জো’ নেই। তৎক্ষণাৎ আমার লাকি চার্ম হয়ে অভ্র এলেন। অগ্নির প্রত্যুত্তর মুখের আটকে রইল। অগ্নিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? উদিতা আর ঊষা কাছে যা। ঘুম এসেছে, ওরা ঘুমিয়েছে পড়েছে। আমার এখানে থাকা না লাগলে আমিই যেতাম।”

“তুই যা। আমি এখানে আছি। এদিকটা ঠিক সামলে নিবো।” অগ্নির ‘না’বোধক জবাব। অভ্র পুনরায় বলে, “ওরা দু’জনে এখন ঘুমাবে? বাড়িতে যেতে হবে। বাড়িতে গেলে এখান কে সামলাবে।”

“যাচ্ছি।” গম্ভীর গলায় বলে অগ্নি মেকআপ রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল। খোলা পোশাকের গলাটা হাত দিয়ে টেনে একটু উপরের তোলার চেষ্টা করলাম। চেন খোলার দরুন কাঁধ থেকে নেমে যাচ্ছে। অভ্র স্যার দৃষ্টি আড়াল করে বলে, “নিজের অস্বস্তির কথাটা মুখ ফুটে বলবে হবে। পৃথিবীতে তিন ধরনের পুরুষ আছে। কিছু পুরুষ আছে, যারা নারীদের অস্বস্তি ফেলে। জেনে হোক বা না জেনে। আরে ধরনের পুরুষ সেই অস্বস্তির সুযোগ নেই। তারাই মূলত আমাদের সমাজের নি/কৃ/ষ্ট পুরুষ। তৃতীয় শ্রেণির পুরুষ নারীদের সম্মান দেয়।”

‘আপনি সেই কাতারের পুরুষ।’ শব্দহীন স্বরে বললাম, অভ্র স্যারের কর্ণপথে পৌঁছাল না। অভ্র স্যার সামনে অগ্ৰসর হওয়ার‌ প্রচেষ্টা করতেই বললাম, “শুনছেন?”

“বলুন?” পিছু ফিরে।

“আপনার কর্মীরা ভালো ভাবে এই পোশাকটা তৈরি করেনি। যেহুতু এই পোশাকটা ফ্যাশন শো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য বানানো হয়েছে, একটু ভালোভাবে..।”

“বুঝলাম না।” না বোঝার স্বরে অভ্র স্যার বলেন। আমি পেছনে ফিরে এক হাত দিয়ে নিজের কোঁকড়ানো চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। পোশাকের পেছনের চেনটা ভালো হয়নি, খুলে গেছে মাঝপথে। অভ্র স্যার চেন টেনে লাগানোর প্রচেষ্টা করল। পুরুষালি স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। চোখজোড়া বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা করেও যখন নিজ উদ্দেশ্যে ব্যর্থ অভ্র স্যার। তখনই অপ্রত্যাশিত কাজটি করে ফেললেন। চেনটা জোরে টান দিতে ছিঁড়ে হাতে চলে এলো। অভ্র স্যার মাথায় হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে বলে, “ওয়াট দা হেল আর দিস। এত পোশাক থাকতে এই পোশাকটার সাথেই এমন হতে হলো? এক্সটা ড্রেসও আনা হয়নি।”

“আমি মেকআপ রুমে যাচ্ছি।”

“একটু পর সব মডেলদের ডাকা হবে এবং তাদের থেকে সেরা জনকে মুকুট পড়িয়ে দেওয়া হবে।” অভ্র স্যারের কথাতে হাসি পেল। মুখে হাত দিয়ে উট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আমি কোনো জোকস বলেছি। হাসির কি আছে?”

“আপনার মনে হয়, আমি মুকুট পাবো? কিন্তু আমার মনে হয়, দিবা স্বপ্ন।”

আমার হাসিকে বিদ্রুপ করে অভ্র স্যার বললেন, “অভার কনফিডেন্ট, আমি একবারও বলেছি আপনি মুকুট পাবেন। বলেছি থাকতে হবে।
এত কথা প্যাঁচান কেন আপনি?” অতঃপর নিজের ব্লেজারটা খুলে আমার হাতে দিলেন। স্থির না থেকে চুলগুলো পেছন ছড়িয়ে দিলেন। র‍্যাম্পের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “আপাতত র‍্যাম্পে যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই থাকুন।ডাকলে যাবেন। বাড়িতে যাই একবার, কী পোশাক বানিয়েছে অগ্নি? পরীক্ষা করে নেবে না, চেন ভালোটা আছে কি-না? আমার মান সম্মানের পাশাপাশি আপনাকেও একটু হলে অস্বস্তিতে পড়তে হতো।”

অভ্র দাঁড়ালেন না। চঞ্চল পায়ে র‍্যাম্পে উঠে গেলেন। ইতোমধ্যে তৃতীয় রাউন্ড শুরু হয়ে গেছে। এই রাউন্ডে কোম্পানির মালিক তার পোশাকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বললেন। অন্যরা বললেও অভ্র স্যার সংক্ষিপ্ত গলায় বলেন, “এটা আমার কোম্পানির সিক্রেট, আমি প্রকাশ করতে চাই না। এমনকি আমার ফ্যাশন ডিজাইনাররা নিজেও জানে না। কারণ এমন গুরুত্বর ডিজাইন আমি পাঁচজন কিংবা তার অধিক সংখ্যক ডিজাইন দিয়ে করিয়ে সিক্রেট রাখি। সিক্রেট রাখি বলেই ‘শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউস’ রেঙ্কিয়ে সবার উপরে। ধন্যবাদ।”

অভ্র স্যারের বক্তব্য পছন্দ হলো কি-না, জানা নেই। কিন্তু সবাই করতালি দিল। আমিও দিলাম। শেষ হলো প্রতিযোগিতা। গোল টেবিলের আয়োজন। অফিসের কিছু সিনিয়র কর্মীসহ আমি ও অভ্র স্যার বসে আছি। বিচারকেরা নিজেদের ভেতরে আলোচনা করছে।

পেরিয়ে গেল বিষাদময় প্রহর। কোম্পানির মালিকদের ডাকা হলো র‍্যাম্পে। অভ্র স্যার উঠে গেল র‍্যাম্পে। তিন বিচারক সহ মালিকেরা উপস্থিত সেখানে। অপেক্ষা অবসান ঘটিয়ে ঘোষনা করল, “বরাবরের মতো এবারও উইনার শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউস।”

“আমরা আগেই জানতাম, এটাই হবে। মাঝখানে নতুন মডেল দেখে একটু সন্দিহান হয়েছিলাম বটে। কিন্তু রুপ নয়, গুনই সেরা।” আরেকজন বলে। অভ্র স্যারের কাঁধে ব্যাচ পরিয়ে দিলেন। হাতে দিলেন ‘টফি’। সোনালী অক্ষরে লেখা বর্ণগুলো দূর থেকে ঝাপসা। মুখে আমার আনন্দের হাসি। চোখ থেকে ঝরে পড়ল অশ্রু।
পুরস্কার বিতরণীর দ্বিতীয় ধাপে ‘শো টপার’ মুকুট উঠল দুটো ঊষা ও উদিতার মাথায়। বিচারক বললেন, “আমরা জানি, কেন আপনার দুই মেয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। বাবার সম্মান বাঁচাতে। আমাদের মতে, মেয়েরা বাবার জন্য সব করতে প্রস্তুত। তাই আজকের ‘শো টপার’ ঊষা উদিতা।”

“ধন্যবাদ।” অভ্র সৌজন্য হেসে পুরষ্কার গ্ৰহণ করে। অতঃপর বলে, “আমার মেয়েরা খুশি হবে। তবে সব ক্রেডিট আমার ফ্যাশন ডিজাইনারের। শেষ মুহূর্তে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমার সম্মান বাঁচিয়েছে।”

__
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। অভ্র স্যার গাড়ি চালাচ্ছেন। আমি সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি। শরীরে অভ্র স্যারের ব্লেজারটা জড়ানো। কাঁচ খোলা জানালা দিয়ে অবাধ্য হাওয়া এলোমেলো করছে অগোছালো চুলগুলো। চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতেই অভ্র স্যার বললেন, “থ্যাঙ্কিউ আপনাকে। আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল ব্যাপারটা। জিতবো আশাই করিনি।”

“ওয়েলকাম।” জড়ানো গলা।

“আপনি কোনো ভাবে বিরক্ত আছেন আমার উপর? বাই এনি চান্স?”

“না, বিরক্তের কী আছে?”

“আপনার থ্রি পিস খুঁজে পাওয়া গেল না তাই, হয়তো।” অভ্র স্যার বললেন। ড্রেসিং রুমে পাওয়া যায়নি আমার ড্রেস। সৌজন্য হেসে বললাম, “ঐ থ্রি পিসটার সাথে আমার একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💚

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here