এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৯

0
1216

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৯
সময়ের পরিক্রমায় আরও তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। তিতিরের ট্রান্সফার হয়ে গেছে শুধু এই মাসের আর সপ্তাহ খানেক বাকি বলে মাসটার শেষের দিকে ফরিদপুর ছাড়বে। টিউশনগুলোতেও বলে নিয়েছে। বেশি করে পড়িয়ে নিচ্ছে। মাস শেষ হওয়ার তিন চারদিন আগে তিতির একা ময়মনসিংহ যাবে। আজকে মা ও হিয়াকে ঢাকায় চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেছে। ময়মনসিংহ গিয়ে তো আর কেউ ওদের জন্য বাসা ঠিক করে রাখবে না! যা করার নিজেদের করতে হবে। নিজেদের বাড়িটাও বিক্রি করতে কিছু প্রসেস বাকি। আজ নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হোস্টেলে উঠবে। খুব অনুরোধ করে হোস্টেলে এক সপ্তাহ থাকার অনুমতি নিয়েছে। হোস্টেল সুপার দয়ালু বলা চলে। ময়মনসিংহ বাসা ঠিক করে এই বাড়ির ফার্নিচারগুলো নেওয়া ব্যাবস্থা করবে যার জন্য বন্ধুদের সহোযোগিতা প্রয়োজন।
সবকিছু মনে মনে ঠিক করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে তিতির। ভাগ্যিস পলাশ, সুজনরা এখনও পলাতক! খুবই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই তিন সপ্তাহে পুলিশ চারবার এলাকায় এসে পলাশ, সুজনদের খুঁজে গেছে। অথচ যখন তার ভাই তিয়াস মা*রা যাওয়ার পর পুলিশ একবার কি দুইবার এসে খুঁজে গেছে। ব্যাপারটা বুঝে তিতির তাচ্ছল্য হাসে। উপর মহল থেকে প্রেশার আসাতেই এখন এতো তদারকি। এতে যে আগুন্তকের হাত আছ। বুঝতে বাকি থাকে না। তিতিরের সন্দেহ হয় সেদিনের লোকটার উপর। আগুন্তক ও মাশরিফ ইকবাল কি দুজন ভিন্ন মানুষ নাকি একজনই? সেদিন ঝড়-বৃষ্টির রাতে আলোক স্বল্পতার কারণে মাশরিফ ইকবাল নামে লোকটির মুখশ্রী দর্শণ হয়নি।

মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে তিতিরের। নাজমা বেগম বলেন,
“তোর চাচা বলছে এখনি বের হবেন। তোরও তো যাওয়ার সময় হয়েছে।”
“হুম। বেরোও তোমরা। আমি কাল রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। বেরোব আমিও।”

তিতিরকে এবার নাজমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“এতোদিনের জমানো হাঁড়ি-পাতিল ওসব কি করব? কতোসব তো পুরোই নতুন।”
“জানিনা। যতটুকু প্রয়োজন ততোটুকু রাখব। বাকিসব সাইফ, হাসিব ব্যাবস্থা করবে।”
“আচ্ছ্। সাবধানে থাকিস মা।”
মায়ের চিন্তামিশ্রিত বুলিতে হালকা হাসল তিতির। অতঃপর বাড়ি তালা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।

_______

মিশন শেষে দুইদিন আগে মেজর ও সৈনিকরা সেনানিবাসে পৌঁছেছে। জেনারেল মিরাজ এবার এক সপ্তাহের আগে কাউকে বের হতে দিবেন না। এবার তিনজন টে*রো*রি-স্ট ধরা পরেছে। কিন্তু এতোকিছু করেও লিডারকে ধরতে পারছে না। ধরাটা অবশ্য সহজও না কারণ ওদের মূল ঘাঁটিতো এই দেশে না।

সকাল সকাল মাশরিফ সেনানিবাসের পুরো মাঠটা চারবার চক্কর দিয়ে এখন কফি হাতে মাঠে বেরিয়েছে। কয়েকজন এখনও চক্কর দিচ্ছে। অন্যান্য শরীরচর্চা আজ কেউ করবে না। মেজর M.I. মানে মেজর মাশরিফ ইকবাল। মাশরিফ মাঠের ঘাসের উপর বসল। এক ধ্যানে পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্যের দিকে চেয়ে আছে। এক সপ্তাহ ধরে কোনো কালোমেঘ-বৃষ্টির দেখা নেই। পরিষ্কার নীল অন্তরিক্ষে শরতের শুভ্র মেঘের আনাগোনা। রোদের প্রাণোচ্ছলতায় পুলকিত নভোমণ্ডল। মাশরিফও মিষ্টি হাসল।

মাঠের মাঝে বসে মাশরিফকে হাসতে দেখে দৌঁড়ে এলো অভী। সে ইতোমধ্যে আটবারের মতো চক্কর দিয়ে ফেলেছে। আজ এতটুকুই। কাল ও আজ একটু করে করে শুরু করেছে। আগামীকাল আবার পুরোদ্দমে শুরু করবে। অভী মাশরিফের পাশে বসে চোখের সামনে হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,

“মেজর মাশরিফ ইকবাল, কোথায় হারালেন?”

মাশরিফ আলতো হাসল। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
“প্রেয়সীর অনন্ত মায়ায় এই প্রকৃতি আমায় বারংবার প্রেমময় ডাক দেয়। কী করব বলেন?”

অভী মাশরিফের বাম হাতের বাহুতে চা*টা মে*রে বলে,
“তুই শেষ ভাই। পুরাই পা*গ*ল মজনু হয়ে ডুবে গেছিস।”
“আসলেই আমি শেষ। কোন জায়গায় মে*রেছিস খেয়াল আছে? আহ্!”
অভী খানিক দূরে সরে গিয়ে বলল,
“সরি দোস্ত। আমার মনে ছিল না। তোর তো বাম হাতের বাহুতে গু*লি লেগেছিল। বেশি ব্যাথা করছে?”

মাশরিফ আগের মতো বসে বলল,
“বেশি না। ঘা শুকানো ধরেছে। সাত-আটদিন তো হয়ে গেল। তবে দৌঁড়ানোর সময় একটু লাগে। তাই ট্রেইনার আমার এক্সারসাইজ কমিয়ে দিয়েছে। কাল তোরা পুরোদ্দমে শুরু করবি আর আমি আরও দুই তিন দিন পর।”

অভী বলল,
“ভাগ্যিস গু*লিটা একটু সাইড দিয়ে গিয়েছিল বলে। তাই তো রক্ষে। যদি বুকে লাগত তবে? তাও দেখ বাম বাহুতেই। একটু এদিক সেদিক হলেই..!”

মাশরিফ হেসে বলে,
“সোজা হৃৎপিন্ডে!”
“তুই হাসছিস? আমার তখন আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছিল। কলেজ থেকে আমরা একসাথে। একসাথে আর্মি জয়েন করেছি। একসাথে মেজর হয়েছি। নিজের থেকেও তোকে নিয়ে ভয়ে থাকি। আন্টির তো তুইই আছিস। রিতিকা আপু তো স্বামীর বাড়ি।”

অভীর কথায় চিন্তার রেশ।
“আরে তুই বেশি চিন্তা করছিস। তোর যখন গু*লি লাগতে নিয়েছিল, সে সময় তো এতো বিচলিত হোসনি।”
“তুই সবসময় কথা ঘোরাতে ওস্তাদ। তা মেজর রাহানের বাড়িতে খোঁজ নিবি? উনাদের তো চিঠি দিয়ে জানানো হয়নি।”

“কেনো? মেজর রাহানের বোন নাকি ফোন করে তিতিরের কথার সত্যতা যাচাই করেছেন। একজন জানলেই তো হয়।”
“তা ঠিক।”

মাশরিফ হুট করে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়ায় অভীর দিকে। বন্ধুত্বের ডাক গ্রাহ্য করার ক্ষমতা কী আছে? নাহ্। অভীও হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। মাশরিফ বলে,
“চল একটু ঘুরে আসি।”
“আচ্ছা চল।”
মাশরিফ ও অভী আশেপাশে একটু ঘুরতে বেরোল।
________

তিতির টিউশনে আধ ঘণ্টা করে বেশি পড়িয়ে নয়টার দিকে বাড়ি ফিরল। মোট চারটার মতো টিউশন করায় এখন। আগে দুটো ছিল কিন্তু এক মাস ধরে চারটা করায়। দিনে দুটো টিউশনি। নতুন টিউশনে ছাত্রীর মায়ের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। কীই বা করবে? তার আর তো কিছু করার নেই। প্রতিটা টিউশন মেডিকেল কলেজের এড়িয়ার কিছুটা দূরে মাত্র। হোস্টেল থেকে দেরিতে আসার পারমিশন নিয়েছে। মৃদুলা বলে,

“এসেছিস তবে। যা ফ্রেশ হয়ে ওখানে দুইটা সিঙারা রাখা আছে খেয়ে পড়তে বস।”
তিতির বিছানায় গা এলিয়ে বলে,
“টায়ার্ড হয়ে গেছিরে। এখন ঘুমিয়ে ভোর তিনটায় উঠে পড়তে বসব।”
“বস তাহলে। আচ্ছা শোন, ময়মনসিংহতে হোস্টেলের জন্য এপ্লাই করেছিস?”

মৃদুলার কথায় তিতির কিঞ্চিত ভাবল। তারপর বলল,
“না। করা হয়নি। এতোকিছুতে ভুলেই গেছি।”

আবারও বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“সব ভুলে যাচ্ছি। এটাই তো ইম্পরট্যান্ট।”
“ব*ল*দিরে, হোস্টেল ঠিক না করলে থাকবি কই?”
ইতিও বলাতে এবার তিতির উঠে গিয়ে সিঙারা দুটো নিয়ে এসে খেতে খেতে বলল,
“মাথা কাজ করছে না। কালকে দেখব। সামনের মাসে কোনো টিউশন থাকবে না ভেবেই আরও অস্থীর লাগছে। বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে কিছু টাকা নিতে হবে। চাচা বললেন ময়মনসিংহতে কোনো ছোটো এক দেড় কাঠার প্লট আছে কীনা খোঁজ নিবেন। যাতে স্থায়ি কিছু হয়। কিন্তু আমার মনে হয় এখন বাড়ি, জায়গক কেনার প্রয়োজোন নাই। আমাদের স্থায়ী ঠিকানা কই হবে তা তো জানিনা।”

রিক্তা সুধায়,
“তিন চারদিনে কোনো বাসা ভাড়া পাবি? আন্টি ও হিয়াকে মাসটা নাহয় ঢাকাতেই রাখ। তবে তোর চাচা রাখবে কীনা তাও প্রশ্ন।”
“চাচা রাখলেও আমি রাখব না। এক রুমের বাসা হলেও উঠে পরব। বাড়ির অনেক জিনিসপত্র অনেক পুরানো হয়েছে। সবতো আর নিবো না। ওগুলোর এখানেই ব্যাবস্থা করে যাব।”

“দেখ তাহলে। এখন যা ফ্রেশ হ। কাল তো সকালের ক্লাসটাতেই কুইজ আছে।”
“হুম”

তিতির ফ্রেশ হতে চলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here