এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১০

0
1195

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
সুন্দরবনের ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে গাছের গুড়ির উপর বসে আছে কিছু লোক। তাদের সাথে সুজন, পলাশরাও আছে। এই স্থানে সচরাচর বন্য প্রা’ণীদের আনাগোনা থাকলেও লোকগুলো আ*গু*ন জ্বালিয়ে বসেছে তাস খেলতে। এক লোক বলে ওঠে,

“মেজর মাশরিফকেও বন্ধি করতে হবে। কিন্তু ওর দুর্বলতা কি?”

আরেকজন বলে ওঠে,
“এর মা?”
“আরে মা তো সবারই দুর্বলতা থাকে। তাছাড়া মেজর মাশরিফ তার মাকে নিজের কাছে তখনি আনেন যখন সে ছুটিতে থাকে। কিন্তু এমনিতে মেজর মাশরিফের মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। অন্য উপার খুঁজতে হবে। যেমনটা মেজর রাহানের সাথে করা হয়েছে!”

সুজন নে*শাদ্রব্যে টান দিয়ে বলে,
“ওই মেজর রাহান আছিল একটা ব*ল*দ! ও বিশ্বাস করছে ওর বউ আমার লগে শু*ই*ছে! ওই মেজর মিশনে যাওয়ার দিনই তো তিতির বউভাতের পর বাপের বাড়ি আইছিল। তিতিরের বিয়া ঠিক হইছিল তা তো পরে জানছি। একটা মা*মলার লাইগ্যা পলায় আছিলাম। এলাকায় ফিরার পরেও জানতাম না তিতিরের বিয়ার কথা চলে। জানছি ওর বিয়ার দুইদিন আগে। ওর বিয়ার তিনদিন আগে এই মেজর রাহান এলাকায় আইয়া চায়ের দোকানে আমারে সামনেই জিগায়, ‘তিয়াস আহমেদের পরিবার কেমন? কোনো খারাপ রেকর্ড আছেনি? তার বোইনে কই পড়ে? চলাফেরা কেমুন?’ তহন ওই মেজর আর্মির পোশাকে আছিল বইল্যা মুই মুখে কুলুপ অ্যাইটা আছিলাম। আমার তো তহন অতোকিছু মাতায় আহে নাই। সবার থিকা ভালা শুইনা মেজর আমার পাশে বইসা চা খাইয়া গেছে। তহন যদি জানতাম তয় তহনি কথা লাগায় দিতাম। বিয়া করত না আমার ময়না পাখিডারে। এহন মেজর নাই, ময়না পাখিডারে খাঁচায় বন্ধি কইরাই ছাড়মু।”

টে*রো*রি*স্ট লোকগুলোর মধ্যে একজন বলল,
“তোমরা সাহায্য করাতেই মেজর রাহানকে জালে ফাঁসাতে পেরোছি। এখন মেজর মাশরিফেরটাও খুঁজে বের করো। এভাবে সদস্য কমতে থাকলে কেউ কাজে আগ্রহ পাবে না।”

পলাশ বলে,
“খুঁজতে হইব। মেজর মাশরিফ তো আমাগো এলাকার না
তয় লিংক খুঁজতে হইব। আর সপ্তাহ পর এলাকায় যামু। এহন গেলে ঝামেলায় পরমু। এলাকার এক ছোটোভাই কইল, পু*লিশ নাকি তিন-চার বার খুঁইজা গেছে। তিতির, হিয়াগো বাড়িতে নাকি নিরাপত্তার ব্যাবস্থা লাগায় রাখছে। যে খবর দেয় ওয়ও দিনের বেলা বাড়িততে বাইর হয় না। সন্ধ্যার পর চা-পানের লাইগ্যা দোকানে বইলে নাকি শুনছে।”

আরেকজন টে*রো*রি*স্ট বলল,
“ব্যাপারটা সন্দেহজনক। তিয়াসকে যখন গাড়ি চা*পা দিয়ে মা*র*লে তখনও পু*লি*শ এতোবার আসেনি।”

“এইডাই তো বুঝি না বা*। কেডা এমনে পিছে লাগছে?”

পলাশ কিছুক্ষণ অশ্রাব্য গালিগালাজ করে আবার নে*শা-দ্রব্য সেবনে মন দেয়।

___________

ময়মনসিংহতে তিতিরের থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যাবস্থাও হয়ে গেছে। একদিনেই ব্যাবস্থা হওয়াতে তিতির দারুণ অবাকও হয়েছে। এদিকে বাড়ি বিক্রির প্রসেস প্রায় শেষ। তিতিরের একাউন্টে টাকাও ট্রান্সফার শেষ। তিতির ব্যাংকে গিয়ে মা ও হিয়ার একাউন্টে সমান করে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছে সাথে কিছু টাকা তুলেও নিয়েছে সামনের মাসে যে টিউশন থাকবে না তাই। বাড়ির যেসব জিনিসপত্র ময়মনসিংহ নিবে সেগুলোকে আর্মির ট্রাক দিয়েই সেনানিবাসের ভিতরে রাখা হয়েছে। বাসা ভাড়া পেলেই নিয়ে যাবে। কম তো না! তিনটা খাট, দুইটা আলমারি, সোকেস, ফ্রিজ, সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল, পুরোনো একটা টিভি, তিনটা ওয়ারড্রবের দুইটা নিবে আরেকটা ঘুণে খে’য়ে ফেলেছে তাই নিবে না। প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-পাতিল ও ডিনার সেট নাজমা বেগম ও হিয়া সেদিনই নিয়ে গেছিল। বাকি যেসব নিবে সেসব তিতির নিজের লাগেজে কাপড়ে পেঁচিয়ে নিবে। তিনটা লাগের নিচ্ছে এর জন্য। অন্য শহরে পাড়ি জমাতে এতো ঝামেলা তা এই কদিনে ভালোই বুঝেছে।

আজ শুক্রবার। হাসিব, সাইফ, মৃদুলা, ইতি, রিক্তা সবাই তিতিরকে বিদায় দিতে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের কাছে এসেছে। সবার চোখে পানি। তিতির এই শহরে আর ফিরবে না। তিতির চারদিকে চোখ বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সবটা দেখে নিলো। বন্ধুদের সাথে কতো মন খারাপ, দুষ্টুমি, আনন্দের স্মৃতি এই স্থানটায়। কপোল বেয়ে গড়ানো নোনাজলের ধারাকে দুই হস্তের তালুর দ্বারা অবরুদ্ধ করল। নাক টেনে কণ্ঠে সংক্রিয়তা এনে বলে,

“এই তোরা কাঁদছিস কেনো? আমি এই শহরে ফিরব না বলেছি কিন্তু তোদের সাথে দেখা করতে আসব না তাতো বলিনি। তোরা কেউই তো এই শহরে স্থায়ি না। একদিন এই মেডিকেল প্রাঙ্গণ তো ছাড়তেই হবে। আমি নাহয় একটু আগেই ছাড়লাম।”

ইতি তিতিরকে এসে জাপটে ধরে। মেয়েটা গতকাল রাত থেকেই কাঁদছে। একটু বেশিই আবেগী কী-না! ইতি ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
“অ্যাই উইল মিস ইউ।”
“মিস ইউ ঠু। তোর নাদুসনুদুস গালগুলো আবার কবে টানব এটা তো বিধাতাই জানেন।”

তিতিরের আহ্লাদী সংলাপে ইতি আরও আবেগী হয়ে পড়ে। সাইফ বলে,
“তোরাও কি সাথে বাসস্টপ পর্যন্ত যাবি?”
মৃদুলা চোখের কোণা মোছে ভাঙা কণ্ঠে বলে,
“হুম। আবার কবে দেখা হবে তা তো জানিনা। শেষ পর্যন্ত সাথে যেতে চাই।”

রিক্তা নিজের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে তিতিরের হাতে দিয়ে ঠোঁটকোলে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে,
“পড়াশোনার ব্যাস্ততা ও সংসার চালানোর জন্য হয়তো সবসময় কথা বলার সময় পাবি না। তাই নিজেকে একা লাগলে এই ছোটো ডায়েরিরটা দেখিস। আমাদের এই দুই বছরের অনেক স্মৃতি বন্ধি আছে। আমার খুব যত্নে গড়া। সামলে রাখিস কিন্তু।”

তিতির রিক্তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কান্না সংবরণ করতে পারে না। এই পাঁচজন দুই বছরের সবসময় তার পাশে ছিল। নতুন ক্যাম্পাসে গিয়ে কি এমন কাউকে পাবে? জানা নেই তিতিরের। ওরা বাসস্ট্যান্ডের জন্য রওনা হলো।
তিতিরকে বাসে উঠিয়ে বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিল। বাস ছেড়ে দিলে তিতির বাসের সিটে গা এলিয়ে দেয়। গন্তব্য নতুন। সূচনা কেমন হবে তা নিয়ে সংশয়।

________

মাগরিবের নামাজ পড়ে সেনানিবাসের নিজেদের রুমে এসেছে মাশরিফ ও অভী। হঠাৎ মাশরিফের ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে মা মহিমা বেগমের নাম্বার দেখে মুচকি হাসে সে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,

“কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমি সবসময় ভালো থাকি। তুই মিশন থেকে ফিরে দুইদিন আমার ফোন রিসিভ করিসনি তাই আমি তোকে চার দিন ফোনই করিনি। এখন দেখছি আমার ছেলে আমাকে ভুলতে বসেছে!”

মায়ের অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে মাশরিফ মুচকি হাসে। সে তো মায়ের কাছে গু*লি লাগার বিষয়টা লুকাতে কয়দিন ফোন রিসিভ করেনি। মা তার খুব চিন্তাপ্রিয় মানুষ! মাশরিফ বলে,
“আর তিনদিন পর হাজির হবো। দেখো শুধু। তুমি কি কোয়াটারে আছ তো?”

“তো আর কই থাকব? তুই না থাকলে আমাকে এই ক্যাডেট কলেজের কোয়াটারেই থাকতে হয়। তোর যে কেনো এতো ভয় বুঝি না।”

মহিমা বেগমের অভিমান এখনও কমেনি। মাশরিফ বলে,
“তোমার এতোগুলো ছেলে থাকতে আমার কথা মনে পড়ে? তোমার তো ওদের সারাদিনের এক্টিভিটি দেখতে দেখতেই দিন পেরিয়ে যাওয়ার কথা। বিকেলে বড়ো মাঠটার পাশের রাস্তা দিয়ে সবটা চক্কর দাও তো? তোমার সুগার লেভেল কেমন?”

মহিমা বেগম বলেন,
“দেই তো। কম বড়ো মাঠ ওটা? তুই যে একজনকে আমার উপর নজর রাখতে রেখে গেছিস, ওই ছেলে বিকেল হলেই নিজের খেলাধুলো রেখে আমাকে নিয়ে দুইবার করে মাঠে চক্কর দেয়। কিন্তু বাবু, আমি যে ছেলেদের খেলার মাঝে তোকে খুব করে মিস করি।”

মাশরিফের নিজেরও এবার খারাপ লাগছে। ছোটো থেকে এই ক্যাডেট কলেজের মাঠেই খেলাধুলো করে বেড়ে উঠা তার। মা ওখানকার শিক্ষিকা হওয়াতে আরও সুবিধা হয়েছে। তবে মায়ের চাকুরির আর তিন বছরের মতো আছে। নিজেও তো এই ক্যাডেট কলেজের ছাত্র! অভীর সাথে বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। আগে খুব একটা কথা হতো না অভীর সাথে কিন্তু কলেজ থেকে ফুটবল টিমে দুজনের বন্ধুত্বের শুরু। আরও বন্ধুরা সবাই তো আর্মিতে জয়েন হয়নি।

মাশরিফ আদুরে কণ্ঠে বলল,
“অ্যাই মিস ইউ ঠু, মা। খুব শিঘ্রই দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্‌।”
“ইনশাআল্লাহ্।”

ফোন কে*টে দেওয়ার পর অভীর দিকে তাকালে দেখে অভী এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাশরিফ ইশারাতে সুধালে অভী বলে,
“গু*লি লেগেছে এটা আন্টিকে তুই জানাতে না চাইলেও তুই বাসায় গেলে আন্টি এমনিতেই জানবে। ছুটির পর বাসায় গেলে আন্টি তোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে।”

মাশরিফের ভাবলেশহীন জবাব,
“করুক। সে যা করে শান্তি পায়। আমার সামনে চিন্তা করুক আমি সামলে নিব কিন্তু আমার আড়ালে চিন্তা করে বিপি হাই করে বসে থাকবে তারপর আমার চিন্তা দ্বিগুণ করবে।”

হুট করে অভী হেসে ফেলে মাশরিফও হাসে। অতঃপর দুইজনে ড্রেস বদলে ডাইনিংয়ে যায় সন্ধ্যার নাস্তার জন্য।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here