এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ৫

0
443

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫

দেয়ালে তারকাটায় আটকানো ছোট আয়নাটায় তাকিয়ে দোয়া।নিজেকে না,ওতে আটকানো ছোট কালো টিপটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।কতোদিন হয়ে গেলো,চেহারায় প্রসাধনীর প টাও ছোয়ায় নি ও।অবশ্য,ওসব আর মানায় না ওকে।খানিকটা তাচ্ছিল্যে হেসে বিনুনির আগাটা চিরুনি করতে লাগলো।চুলগুলো বেধেই রাখে বেশিরভাগ সময়।ছাড়তে ইচ্ছা করে না ওর।ছাড়লেই যে ওর বাবার কথা মনে পরে যায়।চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বাবার বলা সে কথাগুলো মনে পরে যায়।
“জানিস দোয়া?তোর বর যে হবে,সে তোর এই ঢেউখেলানো চুল দেখেই তোর প্রেমে পরবে দেখিস।বাবার মতোই তোর খোলা চুলগুলো দেখতে ভালোবাসবে।সবসময় চেচামেচি করবে তোর সাথে,চুলের অযত্ম করা নিয়ে।তারপর এগুলোকে অতি সযত্মে আচড়িয়ে দেবে।একদম তোর বাবার মতোই।”
অজান্তেই হেসে দিলো দোয়া।ওর ধারনা,ওর বাবাই সে একমাত্র পুরুষ,যার মতবাদে,চুলের প্রেমে পরা যায়।

-তুই এখনো বেরোস নি আপুনি?

দিয়ানের কথায় বাস্তবে ফিরলো দোয়া।জানালা দিয়ে উকি দিলো।নিচের এক সেলুনে টাঙানো দেয়াল ঘড়িটায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,তিনটে বেজে আটচল্লিশ মিনিট।ওড়নাটা ঠিকঠাক করতে করতে বললো,

-মা কোথায় রে?

-মা তো নিচে গিয়েছিলো,আরাব ভাইয়ার জামাকাপড় দিয়ে আসতে।তুই ওগুলো ধুয়ে বারান্দায় রেখেছিলি না?

ব্যস্ততার মাঝেও মলিনতা আসলো দোয়ার চেহারায়।খাবার পরই আরাবের চলে যাওয়ার কথা।এতোক্ষনে চলে গেছেও হয়তো।জিজ্ঞাসা করলো না দিয়ানকে।পাটের আশ দিয়ে বানানো স্বল্পদামী ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে বললো,

-আমি বেরোচ্ছি।আজকে আসতে দেরি হতে পারে একটু।মাকে বলিস খরবদার যেনো রান্না না চড়ায়।আমি এসেই রান্না করবো।আর তুই!খরবদার লাফালাফি করবি না।ঘরেই থাকবি!মনে থাকবে?

দিয়ান মাথা নেড়ে স্বীকারোক্তি বোঝালো।নিচে নেমে গোটা নিচতলাতেই চোখ বুলালো দোয়া।মেসের লোকগুলো সকাল সাতটায় বেরিয়ে যায়,রাত আটটায় আসে।ওদের রাধুনী সকালে ছটার দিকে এসে রান্না করে দিয়ে যায়।দুপুরেও আসে।দোয়া সকালে বেরোয় দশটায়,ফেরে আযানের পরপরই,বা ক্লাস না থাকলে অনেক আগেই।আবার বিকেলে বেরোয় তিনটায়,বাড়ি ফেরে সাতটায়।কারো সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই।নিচতলা পুরোই ফাকা এখন।অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগানো।আরাব গেছে কি না তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ও।তবে মা যখন জামা দিয়েই গেছে,চলেই গেছে হয়তো।এমনটা ধারনা করে গুটিগুটি পায়ে অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দিকে এগোলো ও।কেনো যেনো ঘরটায় চোখ বুলানোর ইচ্ছা হলো ওর।কেনো আবার?কাকাবাবুর জন্যই।কারনটা আরাব হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ঘরের দরজায় আঙুলের উপরপিঠে টোকা দিতে দিতে ডাক লাগালো,

-কাকাবাবু?ক্ কাকা…

কাঠের দরজা ছেড়ে আঙুলটা গিয়ে কারো মুখে লেগেছে এমনটাই অনুভব হলো দোয়ার।ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় তাকালো ও।আরাব দরজা খুলে দিয়েছে।আর সত্যিই ওর আঙুল আরাবের মুখে লেগেছে।হচকিয়ে গিয়ে হাত নামিয়ে নিলো দোয়া।আরাব বড়সর একটা হাসি দিলো।ওর এই ইনোসেন্ট হাসি দেখে কপালে ভাজ পরলো দোয়ার।পরমুহুর্তেই খেয়াল করলো প্যান্টটা পরে সম্পুর্ন উদোম গায়ে দাড়িয়ে আছে আরাব।তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,

-কাকাবাবু কোথায়?

-তোমার কাকাবাবু মোবাইলটা তার চেম্বারেই রেখে এসেছে।সেটাই আনতে গেছেন।

আচমকা আরাবের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আশ্চর্যের এর অন্য পর্যায়েই চলে গেছে দোয়া।হলো কি এর?তুমি করে কেনো বললো ওকে?কিছুক্ষন আগেই তো ওর ঘর থেকে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে এলো।তখন তো আপনি করেই বলছিলো।ও তো ভেবেছিলো,ওর ব্যবহারে আর হয়তো ওর মুখোপেক্ষী হবে না আরাব।কিন্তু ঘটনা তো পুরো উল্টোটাই ঘটলো।কিন্তু সেটা মানার জন্য বাধ্য নয় ও।আরাব খালি গায়ে আছে বলে চোখ তুলে তাকালো না দোয়া।বললো,

-আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন না!

আরাব ঠোট কামড়ে হাসলো।ইচ্ছে করেই তুমি করে বলেছে ও দোয়াকে।বলবে।তুমি করেই বলবে।যাতে ও তৃপ্ত হয়।আজ প্রথমবার মুখ লুকিয়ে চলে এসেছিলো কারো সামনে থেকে ও।কোনোদিনও যা হয়নি।পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেরানোর ছেলে ও নয়।এ ঘরে এসে কিছুটা সময় ভাবতেই ওর মনে হলো,কেনো চলে আসলো ও দোয়ার ওখান থেকে?পালিয়ে আসলো কেনো?উত্তর পায়নি।তবে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।সব রকমের অনুভুতিকে সামনে থেকে দেখতে চায় ও।যা কোনোদিনও ছিলো না ওর মাঝে,সে নতুন অনুভুতিগুলোকে আরো সুন্দরভাবে অনুভব করতে চায় ও।পালিয়ে বেরানোর বা ভয়ের তো নয় সে অনুভুতি।যদি তা ভালোলাগা হয়,তবে সে ভালোলাগাকে উপভোগ করবে ও।আর যদি ভালোবাসা হয়,আজীবনের তরে আকড়ে ধরবে।ব্যস্!এটুকোই!হাসি কমিয়ে আরাব স্বাভাবিক স্বরে বললো,

-বেশ স্পষ্টবাদী তুমি!যাইহোক,অনেক ভেবে দেখলাম,জানোতো দোয়া?তুমি তো বয়সে ছোট আমার।আপনি কেনো বলবো?তাই এবার থেকে তুমি করেই‌ বলবো তোমাকে!

দোয়া ভেবে পেলো না প্রতিত্তরে কি বলবে।এতোটা স্পষ্টভাবে বলার পরও যদি কেউ জেদ ধরে বসে তুমি করেই বলবে,সেখানে কথা না বাড়ানোই উচিত মনে হলো ওর।নিচু গলায় বললো,

-আপনি এখান থেকে যাননি কেনো এখনো?

-কিভাবে যাবো?বাসায় ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলবো,তখনই তো দেখলাম কাকাবাবুর ফোনটা নেই।তাইতো…যাইহোক,তুমি কোথাও বেরোচ্ছো বুঝি?

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না দোয়া।চলে আসতে যাবে,হঠাৎই ওর বিনুনিটায় টান পরলো।পেছন ফিরে দেখে আরাব দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।আর দরজার দুই পাল্লার মাঝে ওর অর্ধেক বিনুনি আটকা পরে আছে।চোখ কপালে উঠলো ওর একপ্রকার।সর্বশক্তিতে টানাটানি শুরু করে দিলো বিনুনিটা ধরে।

দরজার এপারে বুকে দুহাত গুজে দরজার নড়চড় দেখছে আরাব।ইচ্ছে করেই বিনুনিটা আটকে দিয়েছে।বলা চলে,প্রথমদিন জানালা দিয়ে আসা বাতাসের সাথে চুলগুলোর তরঙ্গের মতো উচ্ছলতা দেখার পর,এই মলিন বিনুনি সহ্য হচ্ছিলো না ওর।ওপার থেকে টানলেও যাতে না বেরোয়,এজন্য দরজায় আরো দুটো আলাদা কাঠ দিয়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে।আওয়াজ এলো,

-মিস্টার আরাব?মিস্টার আরাব?দরজাটা খুলন!এদিকে…মিস্টার আরাব!

আরাব কিছুটা পিছিয়ে উচ্চস্বরে বললো,

-কি হয়েছে দোয়া?এনি প্রবলেম?

-দরজাটা খুলুন!

-কিন্তু এখন তো খোলা যাবে না।আমি আমার ব্যক্তিগত….

-দেখুন,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!

আরাব এগোলো।বিনুনির ব্যান্ড খুলে আস্তেআস্তে খুলে দিতে লাগলো চুলগুলো।অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ওর এতে।দরজার এপারে থাকা সবটুকোর বিনুনি খুলে দিয়ে বললো,

-দরজা খুলতে পারি,এক শর্তে!

-মানে?

-মানে তোমাকে আমার একটা হেল্প করতে হবে।

-দেখুন মিস্টার আরাব!আমি….

-আমাকে হেল্প না করলে আমি কেনো তোমার কথা শুনবো?খুলবো না দরজা!

আরাবের জেদের পরিমাপ সম্পর্কে কিছুটা অনুমান হলো দোয়ার।রাগ,বিরক্তি,হতাশা সবই এক দীর্ঘশ্বাসে বের করে দিয়ে বললো,

-বেশ।করবো হেল্প।খুলুন দরজা।

আরাবের চেহারায় বাকা হাসি।এই‌ মেয়েটা কথার এদিক ওদিক করবে না এটা ওর দৃঢ় বিশ্বাস।দরজা খুললো ও।চুল ছাড়া পেলো দোয়ার।অর্ধেক বিনুনি খোলা দেখে বড়বড় চোখে তাকালো আরাবের দিকে।আরাব খালি গায়ে থাকায় ওর সে দৃষ্টি স্থায়ী হলো না।আরাব ঠোট উল্টে,কাধ উচিয়ে মাটিতে পরে থাকা ব্যান্ড দেখিয়ে বুঝালো,দোয়ার টানাটানিতেই ব্যান্ড,বিনুনি খুলে গেছে।চোখ নামিয়ে রেখেই দোয়া বললো,

-কি সমস্যা?

আরাবের চেহারায় বর্ধিত হাসি।জানতো,দোয়া হেল্প করার কথাটা মাথায় রাখবে।দরজা ছেড়ে দাড়িয়ে হাত ছড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখিয়ে বললো,

-এইযে দেখো।

দোয়া উকিঝুকি দিলো ঘরে।তেমন কিছুই বুঝলো না।আরাবের সাথে কথা বলার ইচ্ছে ওর নেই।তাই ঘরের ভেতরেই ঢুকে দেখার চেষ্টা করলো কি হয়েছে।পেছন থেকে আরাব ওর টিশার্ট হাতে নিয়ে বললো,

-এটা পরিয়ে দাও তো!

পেছন ফিরে চোখ কপালে দোয়ার।হতবিহব্বলের মতো তাকিয়ে রইলো আরাবের দিকে।আরাব ওর সেই বিখ্যাত ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বললো,

-কাটাছেড়ায় টান লাগে।পরতে পারছি না।তুমি তো রাজি হয়ে গেলে হেল্প করার জন্য।পরিয়ে দাও?

-অসম্ভব!

-তুমিই তো বললে হেল্প করবে!

-আমি দিয়ানকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

-ও সবে রুমে গেছে।ওকে এভাবে উপরনিচ করাতে খুব শান্তি লাগবে তোমার?

-কাকাবাবু…

-উনি একদম রেডি হয়ে থাকতে বলেছেন আমাকে।এসে এখনো আমাকে খালি গায়ে দেখলে,তোমাকেই বকবে।আমাকে হেল্প না করার জন্য।

চোয়াল শক্ত করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো দোয়া।আরাব ওর পথ আগলে দাড়ালো।দোয়া কিছুটা চেচিয়ে বললো,

-এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন!

-আমাকে হেল্প না করলে যেতে দিচ্ছি না।তাছাড়া তোমার সমস্যা কোথায়?কাকাবাবু তো বলেছেন আমাকে,আমি যখন সেন্সলেস ছিলাম,তুমিই টিশার্ট খুলে ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়েছিলেন আমার গায়ে।এটা খোলার সময় সমস্যা হয়নি,পরিয়ে দিতে কিসের সমস্যা?

দোয়া এবার অস্বস্তিতে পরে গেছে।এটা সত্যি।ওই সেদিন শার্ট খুলে দিয়েছিলো আরাবের।অরুনাভ মুখার্জী গিয়েছিলেন তার চেম্বারে বাকিসব ওষুধ আনতে।না চাইতেও,ওই ছিলো আরাবের পাশে।কিন্তু কথাগুলো আরাবকে বলার কোনো মানে খুজে পেলো না দোয়া।আরাব গলা ঝেড়ে বললো,

-কি ঠিক করলে?আমি কিন্তু পথ ছাড়ছি না!

আরাবের হাত থেকে শার্টটা নিলো দোয়া।বাধ্য শিশুর মতো এসে বিছানায় বসলো আরাব।একরাশ ইতস্ততবোধ নিয়ে ওকে টিশার্টটা পরিয়ে দেবে বলে এগোলো দোয়া।আরাবের দৃষ্টি আর উদোম দেহদর্শনকে উপেক্ষা করতে অন্যদিক মুখ করে রইলো।দুহাত দুরে থেকে গলাটা ঢুকিয়েই ছিটকে সরে এলো।দম বন্ধ লাগছিলো ওর।আরাব কপাল কুচকে বললো,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড?

-বাকিটা নিজে করে নিন।

আরাব জানতো ওর কাছে আসার মতো অসম্ভব কাজ দোয়া করবে না।তবুও কিয়দাংশ ঘটেছে তার।ওই অল্প সময়টুকোতে দোয়ার অস্বস্তি,ওর চোখের পাপড়ির যে কম্পনের দেখা মিলেছে,তাতেই তৃপ্ত আরাব।কষ্ট হচ্ছিলো জামায় হাত ঢুকানো নিয়ে।তবুও‌ নিজের মতো করে একাএকাই টিশার্টটা পরে নিলো ও।ঘর থেকে বেরিয়ে এলো দোয়া।পেছন থেকে আরাব চেচিয়ে বললো,

-চুলগুলো আচড়িয়ে যাও?খুলে যাও?

দোয়া পেছন ফিরলো।আরাবের কাছে চুলের যত্মের কথা,খুলে রাখার কথা শুনে রাগটা তরতর করে বেড়ে গেলো ওর।ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে,দাতে দাতে চেপে চুল বিনুনি করে নিলো পুরোটা।ব্যান্ড দিয়ে বেধেও‌ নিলো।আরাব তিক্ত মুখ করে দোয়ার বিনুনিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মেয়ে কি সবসময় এভাবেই ওর কথার উল্টোটাই করবে?উল্টোটাই বুঝবে?

-আপুনি?তোর স্প্রে?

উপরে তাকালো দোয়া।বারান্দায় দিয়ান দাড়ানো।হাতে মরিচগুড়ো মেশানো পানির স্প্রে।বাসার বাইরে বেরোলে এটা নিয়েই বেরোয় দোয়া।একমাত্র বান্ধবীর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া একমাত্র জিনিস,স্প্রের খালি বোতল।ওতে দৈনিক একচিমটে মরিচগোলানো পানি পুরে দেয় দিয়ান।আরেকপলক আরাবের দিকে দৃষ্টিতাক করলো দোয়া।এই লোকটার উপর স্প্রে টার প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করতে পারলে মন্দ হতো না।ওর চুল নিয়ে কথা বলার অধিকার কারো নেই।হনহনিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো ও।কিঞ্চিত হা হওয়া মুখ নিয়ে আরাব মাথার উপরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হতবুদ্ধির মতো বললো,

-কিসের স্প্রে?

#চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here