#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৯
সদর দরজায় তৌফিকাকে দেখে খানিকক্ষন তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর। আজকের বিকালটায় পড়ানো নেই। তাই সবে রেডি হয়ে বেরোচ্ছিলো কাচাবাজার যাবে বলে। দরজা খুলতেই দেখে তৌফিকা দাড়িয়ে। ওকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে তৌফিকা ভেতরে উকিঝুকি দিয়ে বললো,
-কি ব্যাপার দোয়া? পথ আগলে দাড়ালে যে? ভেতরে আসতে বলবে না আমাকে?
হুশে ফিরলো দোয়া। তাড়াতাড়ি সরে দাড়াতে দাড়াতে বললো,
-আ্ আপু? আপনি,এ্ এখানে…
ঠোট টিপে হেসে ভেতরে ঢুকলো তৌফিকা। দোয়ার হতভম্ব চেহারাকে পুরোপুরিভাবে ইগ্নোর করে আশপাশটা দেখতে লাগলো ও। পুরোটা একপলক দেখে নিয়ে একটা জোরে শ্বাস ফেলে দোয়ার সামনে দাড়ালো। বললো,
-কোথাও যাচ্ছিলে?
-হ্ হ্যাঁ মানে না,মানে আসলে…
-রিল্যাক্স! এমন অস্বাভাবিক কেনো হচ্ছো তুমি? টুইঙ্কেলের বাবা ফেরেনি এখনো। তাই একটু হাটতে বেরিয়েছিলাম। এই পুরোনো রাজবাড়িটা বেশ লাগছিলো দেখতে। দাড়িয়ে গেলাম,ব্যস দরজা খুলেই তুমি!
ঘটনাক্রম ভেবে দোয়া খুশি হলো। বললো,
-টুইঙ্কেল কোথায়?
-আমি এখানে!
পাশে তাকালো দোয়া। তুলসিতলার স্তম্ভর গায়ে থাকা ইট গুনছে টুইঙ্কেল। ঠিক কখন ভেতরে ঢুকেছে ও চোখেই পরেনি দোয়ার। দুটো লাফ দিয়ে গায়ের জামাটার লেখাটা দেখিয়ে বললো,
-দেখেছো,উইশমাম! সুপারগার্ল! তুমি দেখোই নি কখন এসেছি আমি!
দোয়া হেসে দিলো। টুইঙ্কেল ছুটে ওর কোলে উঠলো। দোয়া ওকে চুমো দিলো। তারপর তৌফিকাকে বললো,
-আপু,আমি তো এখানেই থাকি! চলুন ঘরে চলুন!
-তা তো বুঝতেই পেরেছি। তাই বলতে পারো আরো বেশি কম্ফর্টেবল ফিল করছি। নইলে কাহিনীটা কেমন হতো বলোতো? চেনা নেই জানা নেই,ভেতরে ঢুকে পরলাম!
তৌফিকার মজার স্বরে বলা কথাটায় দোয়া হাসলো। অরুনাভ মুখার্জী চশমা চোখে দিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন,
-কে এসেছে দোয়া?
-উ্ উনি আমার নতুন স্টুডেন্টের মা কাকাবাবু। ডক্টর তৌফিকা আইরাত।
তৌফিকা বেশভুষায় বুঝলো ইনিই দোয়ার কাকাবাবু অরুনাভ মুখার্জী। আরাব বলেছিলো ওকে ওনার কথা। মিষ্টিস্বরে বললো,
-আদাব কাকাবাবু।
অরুনাভ মুখার্জী অতিসুন্দর হাসি উপহার দিলেন ওকে। টুইঙ্কেল দোয়ার কোল থেকে নেমে একদৌড়ে ওনার কাছে গিয়ে বললো,
-এইযে গোপালভাড়! কত্তো খুজেছি তোমাকে জানো? আম্মু তো বলে পাবোই না নাকি তোমাকে! এখানে থাকো তুমি?তোমার মাথার চুল কই? পেট এতো বড় কেনো? তোমার গিন্নি কোথায় গেছে? পুটিদের দেখছি না যে! ওরা সব কই?
বড়বড় চোখে অরুনাভ মুখার্জী টুইঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তৌফিকা যেনো পাথর হয়ে গেছে। দোয়াও বড়বড় করে তাকিয়ে ওর দিকে। টুইঙ্কেল ওর দিক তাকিয়ে ইনোসেন্ট হাসতেই আরাবের কথা মনে পরে গেলো ওর। তৌফিকা গলা ঝেরে বললো,
-টুইঙ্কেল! উনি দাদুভাই হন তোমার!
টুইঙ্কেল গাল ফুলালো। অরুনাভ মুখার্জীর দিকে তাকিয়ে দোয়া ইতস্ততবোধ নিয়ে বললো,
-কাকাবাবু,আসলে পাশেই ওনাদের বাসা। আপু খুব ভালোবাসেন আমাকে। এখান দিয়ে যাওয়ার পথে…
দোয়াকে শেষ না করতে দিয়ে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-আরে ওখানে কেনো দাড়িয়ে উনি? ঘরে নিয়ে যা তোদের! এভাবে সদর দরজার কাছে দাড় করিয়ে রেখেছিস কেনো? আমি এক্খনি বাজারে যাচ্ছি! এতোদিন পর এ চিলেকোঠায় অতিথি এলো বলে কথা! তুই আপাতত চা চুলোয় দে গিয়ে যা! আর এইযে দিদিভাই, এইটাই আমার বাসা! চুল সব শেয়ালে নিয়ে গেছে। আর পুটিদের উপরে পাবে গিয়ে দেখো!
ওনার আন্তরিকতা দেখে খুশি হয়ে গেলো তৌফিকা। হাসিমুখে এগোলো ওনার দিকে। বললো,
-ব্যস্ত হবেন না। আমি শুধু দোয়ার পরিবারের সাথে দেখা করতে এসেছি। একটুপরেই চলে যাবো!
দোয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তৌফিকা এমনভাবে বলছে যেনো যেনেবুঝে,কোনো উদ্দেশ্যে এ বাসায় এসেছে ও। তবুও স্বাভাবিকই রইলো দোয়া। অরুনাভ মুখার্জীও কিঞ্চিত হতবাক চেহারায় একবার দোয়ার দিকে তাকালেন। তারপর জোরপুর্বক হাসি দিলেন একটা। বললেন,
-তা কি করে হয়? তুমি যাও গিয়ে সবার সাথে দেখা করো,আমি এখনি চলে আসবো। যাও যাও! দোয়া? ওকে নিয়ে যা উপরে!
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে সিড়ির দিকে তৌফিকাকে ইশারা করলো দোয়া। আর কিছু বললো না তৌফিকা। অরুনাভ মুখার্জী বেরিয়ে গেলে পুরো বাড়িটায় আরেকবার চোখ বুলালো ও। তারপর দোয়ার সাথে সিড়ি দিয়ে উঠে এলো দোতালায়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দোয়া ডাক লাগালো,
-মা? ও মা? দিয়ান? মা?
সালমা বেগম বিছানার চাদরের ছিড়ে যাওয়া একাংশ সেলাই করছিলেন। মাথা না তুলেই বললেন,
-দিয়ান তৃষার কাছে পড়া বুঝে আসতে গেছে। পেয়েছে না বই! সারাদিন গুনগুন করে পড়তেই দেখছি ওকে! কেনো যে শুধুশুধু টাকাগুলো নষ্ট করলি কে জানে!
তৌফিকা আটকে গেলো দরজাতেই। গোটা ঘরটায় চোখ বুলালো ও। সাধারন গোছানো জীবনধারার ছোয়া কোনায় কোনায়। দোয়ার মায়ের কথাগুলোও একদম ভেতরটায় ফুটেছে ওর। দোয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে সৌজন্যে হেসে বললো,
-আপু? আসুন না ভেতরে!
সালমা বেগম ভ্রু কুচকালেন। এ বাড়িতে আসার মতো দোয়ার চেনাজানা কোনো আপু আছে,জানা ছিলো না তার। মাথা তুলে তৌফিকাকে দেখে সুইসুতো আর ছেড়া চাদরের উপর তাড়াহুড়ো করে ওড়না দিয়ে উঠে দাড়ালেন উনি। বললেন,
-আরে। আসুন? ভেতরে…
-তুমি করেই বলুন না আন্টি! আমি তো আপনার বয়সে ছোট।
তৌফিকার কথায় দোয়ার দিকে তাকালেন সালমা বেগম।ও মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো মাকে। তৌফিকা ভেতরে ঢুকলো। টুইঙ্কেল একদৌড়ে ঘরের মেঝে থেকে উপর পর্যন্ত বড় জানালাটার কাছে গিয়ে বললো,
-আম্মু! এই দেখো মামার পছন্দের বড় জানালা!
অবুঝের মতো তৌফিকার দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া আর সালমা বেগম। তৌফিকা তাদের চাওনি দেখে চোখ বন্ধ করে সামলালো নিজেকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে টুইঙ্কেলের কাছে এগিয়ে বললো,
-তুমি কি একটু চুপ করে থাকবে টুইঙ্কেল? নইলে উইশমামকে কোনোদিনও একেবারে রংধনুতে নিয়ে যাবো না বলে দিলাম!
শেষ কথাটা কড়াভাবে তবে ধীর গলায় বললো তৌফিকা। কানে যায়নি টুইঙ্কেল ছাড়া কারোরই। গাল ফুলিয়ে টুইঙ্কেল দিয়ানের কাছে গিয়ে বললো,
-এই ছেলেটা! কোলে নাও আমাকে!
মা বোনের দিকে তাকালো দিয়ান। তৌফিকা দাতে দাত চেপে বললো,
-উনি তোমার মামা হয় টুইঙ্কেল!
-এতো ছোট মামা নিবো না! আমার আর্…
-আয় মা,তুই আমার কোলে আয়! তোকে আজ অনেকগুলো চকলেট কিনে দেবো বাসায় যাওয়ার সময় ঠিকাছে?
কোনোমতে টুইঙ্কেলের মুখ থেকে আরাব নামটা থামিয়ে দিলো তৌফিকা। ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে মাথা দুলালো টুইঙ্কেল। হাফ ছাড়লো তৌফিকা। এই মেয়ে এতো বেশি দুষ্টোমি করে,প্রতিবার আরাবকে মনেমনে হাজারবার ঝারে ও। সালমা বেগম বললেন,
-দিয়ান? ওকে একটু কোলে নে? তোর কোলে যাবে বললো!
-না আন্টি,থাক। ও এমনি তখন…
-থাকবে কেনো? আসুক একটু আমার কোলে? এসো টুইঙ্কেল! মামা হই তোমার।
দিয়ান হাত বাড়ালো। টুইঙ্কেল স্পষ্টভাবে বললো,
-এতো ছোট মামার কোলে যাইনা আমি!
দিয়ান অসহায়ভাবে দোয়ার দিকে তাকালো। ওর চোখজোড়া বলছে,এ কাকে পড়াস তুই আপুনি? এ তো আমারই ক্লাস নিচ্ছে!
সালমা বেগম পরিস্থিতি সামলাতে বললো,
-দোয়া? ওর জন্য একটু চা নিয়ে আয়? দিয়ান না হয় বিস্কুট আনতে যাক?
-কাকাবাবু গেছেন দোকানে। দিয়ানকে যেতে হবে না! আপু? আপনি বসুন? আমি চা করে আনছি।
তৌফিকা বাধা দিলো না। এটুকো আতিথেয়তা ছেলেপক্ষের প্রাপ্য। যেটা বেশ ভালোমতো এন্জয় করতে চায় ও! একমাত্র ভাইয়ের বউয়ের বাড়িতে এসেছে বলে কথা! অবশ্য সেটা আলাদা কথা,সবটাই একপাক্ষিক! দোয়া বেরিয়ে গেলো। বিছানায় বসে সালমা বেগমের সাথে টুকিটাকি কথা বলতে লাগলো তৌফিকা। দিয়ান টুইঙ্কেলকে ওর পাখি ধরার ফাদ দেখাচ্ছে,বোঝানোর চেষ্টা করছে এটা দিয়ে অনেকগুলো কবুতর ধরেছে ও,পরপরই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কবুতর দেখাতে পারছে না বলে দিয়ানের কথা কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না টুইঙ্কেল। চারপাশ দেখতে দেখতে তৌফিকা বললো,
-বাড়িটা অনেক সুন্দর। একদম রাজবাড়ি।
-আগে রাজবাড়িই ছিলো। এখন পুরোনো চিলেকোঠা বলে সব।
-আপনারা কতোবছর হলো এ বাসায় আছেন?
সালমা বেগম মৃদ্যু হেসে বললেন,
-প্রায় সাড়ে চার বছর।
-এর আগে কোথায় ছিলেন?
-দোয়ার বাবার বাসায়।
-তারমানে দেশের বাড়ি?
-না। দোয়ার বাবা এখনকার স্থানীয় ছিলেন। দোয়ার দাদুভাই নিজস্ব বাসা করেছিলেন এখানেই।
-ওহ্। এই রায়নগরেই?
-না। ঢাকাতে। রওশন প্লাজা।
তৌফিকা তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। ঠিক কোন রওশন প্লাজার কথা বললেন সালমা বেগম বুঝে উঠতে পারলো না ও। কিন্তু ওর চোখে ওর হসপিটালের সামনের বহুতল রাজকীয় বাসাটা ভেসে উঠলো। বললো,
-কোন রওশন প্লাজা?
-রওশন প্লাজার সামনে থাকতাম আমরা।
দরজায় তাকালো তৌফিকা। চা হাতে ঘরে ঢুকেছে দোয়া। সালমা বেগম মৃদ্যু হেসে মাথা নামিয়ে নিলেন। চা এগিয়ে দিয়ে দোয়া বললো,
-টুইঙ্কেল কোথায় আপু?
তৌফিকা বেশ বুঝেছে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছে না দোয়া। সৌজন্য হেসে চা নিয়ে বললো,
-দিয়ান বললো পাশের ঘরে নিয়ে গেছে। তন্নি আপু,তৃষা আপুর কাছে।
-ও। আচ্ছা আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।
এরমাঝেই দিয়ান টুইঙ্কেলকে নিয়ে আসলো।হাসিমুখে আরো কিছুক্ষন আড্ডা দিলো তৌফিকা। কিন্তু মনের ভেতরটায় খুতখুত করছে ওর। এ কয়দিনে এই প্রথমবার ওর মনে হলো,দোয়া হয়তো এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি ওর সাথে। হয়তো এখনো ওই স্টুডেন্টের আম্মু সম্পর্কটাতেই আটকে আছে। কিন্তু পরেরমুহুর্তে দোয়ার বাকিসব ব্যবহারগুলো মনে পরতেই নিজেকে ভুল বলে দাবি করলো ও। এ আড়ালের কারন অন্যকিছুই। অচেনাবোধ নয়!
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২০
এ ব্যস্ত শহরে শুনশান রাত বলে হয়তো কিছুই হয়না। রাতের শহরের গাড়িগুলোর আওয়াজ যেনো আরো বেশি তীব্র শোনা যায়। ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে পৌছালো। ব্যালকনির মেঝেতে বসে সামনের ফুলদানিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে আরাব। মাঝেমধ্যে হাচি দিচ্ছে,নাক ডলছে। দোয়ার নিজহাতে তোলা পদ্মফুল ফুলদানিটাতে। ওই বাচ্চা মেয়েটার কাছ থেকে একহাজার টাকার নোটের বিনিময়ে দোয়ার স্পর্শ লেগে থাকা ফুলগুলো পেয়েছে ও। সে সময়টায় ভিজে একাকার হয়ে থাকা দোয়ার বিম্বটাই ভাসছে ওর চোখের সামনে। বৃষ্টিতে ভেজার দরুন হওয়া হাচিকাশির তোয়াক্কা করার সময় কই ওর?
-পুরোটা বিকেল,সন্ধ্যা নাকি ওভাবেই বসে থেকে কাটিয়ে দিলি তুই আরাব?
তৌফিকার গলার আওয়াজ শুনে আরাব পাশে তাকালো। ও ঘরে ঢুকেছে। আরাব উঠে দাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,
-কখন আসলি? দোয়া কেমন আছে? হাইচ্ছু!
হাচি দিয়ে লাল হয়ে থাকা নাকটা আরো একবার টিস্যুতে ডলা লাগালো আরাব। তৌফিকা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে। ঠান্ডা বাধিয়ে রেস্ট নেওয়া বাদ দিয়ে এই ছেলেটা মেঝেতে বসে ওই ফুল দেখে দেখে গত কয়েকঘন্টা পার করে দিয়েছে। হাতটা আরাবের কপালের দিকে বারিয়ে বললো,
-জ্বর আছে?
-আরেহ্ না! খালি ঠান্ডাটাই! তুই এটা বল, বৃষ্টিতে ভিজে দোয়ার জ্বর হয়েছে নাকি? কেমন দেখে আসলি ওকে?
কপাল থেকে হাত সরালো তৌফিকা। তাপমাত্রা স্বাভাবিক আরাবের। বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো,
-না। ঠিকাছে ও। অসুস্থ্য হয়নি।
শ্বাস ছাড়লো আরাব। ওর ভয় ছিলো ওভাবে বৃষ্টিতে ভিজে,পুকুরে ডুব লাগিয়ে দোয়ার জ্বর না হয়ে যায়। তাই তৌফিকাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এদিকে তৌফিকার তীক্ষ্মদৃষ্টি। নাক প্রচন্ডভাবে চুলকাছে আরাবের। হাচিও আসছে। কিন্তু তৌফিকার সামনে হাচি দিলে ওর তীক্ষ্মদৃষ্টি তীক্ষ্ম কথায় পরিনত হবে ভেবে এদিকওদিক করছে সমানে। আটকে দেওয়ার তীব্র চেষ্টা। তৌফিকা বললো,
-ওষুধ খেয়েছিলি?
-না। ঠান্ডার ওষুধে ঘুম চলে আসে।
-তো? ঘুমাবি! হোয়াটস্ দ্যা প্রবলেম ইন দ্যাট?
সেন্টার টেবিলে থাকা ফাইল হাতে নিয়ে তৌফিকাকে দেখালো আরাব। তৌফিকা কাটকাট গলায় বললো,
-একদম মিথ্যে বলবি না! ওই ফুল দেখতে গিয়ে ওষুধ খাওয়ার কথা ভুলেছিস তুই। অথবা ইচ্ছে করেই টাইমওয়েস্ট হবে বলে ওষুধ খাসনি! খুব ভালোমতো চিনি তোকে আরাব! আজ রাতে তোর ঘুমানোর কোনো ইন্টেশনই নেই,তা বেশ বুঝতে পারছি আমি!
তাড়াতাড়ি ওর সামনে থেকে সরে দাড়ালো আরাব। বললো,
-ত্ তুই রংধনুতে কেনো? দোয়ার খোজ মোবাইলেও নিতে পারতাম আমি!
-আগে বল ওষুধ খাবি কি না?
-এটা বল দিয়ান,কাকাবাবু কেমন আছে? দোয়ার মা,সালমা আন্টি?
আরাবের টপিক পাল্টানোর ধান্দা বুঝে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তৌফিকা। ওষুধের বিষয়ে আর কোনো কথাতেই কান দেবে না আরাব,তা বেশ ভালোমতো জানে ও। আরাব হাচি দিতে দিতে কাবার্ড থেকে কিছু বের করছিলো। একটু চুপ থেকে তৌফিকা বললো,
-দোয়ার মায়ের শরীরটা বেশি ভালো নেই আরাব। বেশ অনেকটাই শ্বাসকষ্ট আছে ওনার।
আরাব চুপ। তৌফিকা ভাইয়ের মন বুঝে বললো,
-আমি জোর করেই কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে এসেছি দোয়াকে। ওগুলো দিলেই ইনশাল্লাহ্ ইম্প্রুভ আশা করা যায় আন্টির।
আরাব মেঝেরদিকে দৃষ্টিস্থির রেখে ধীর গলায় বললো,
-ওষুধগুলোর দাম কেমন হবে আপু?
-হাজার দুই।
….
-ওগুলো আমি দিয়ে আসলে ভালো হতো না?
আরাব হেসে দিলো।মুচকি হেসে বোনের পাশে বিছানায় বসলো ও। বললো,
-দোয়াকে তো দেখলি কিছুদিন। ওকে তোর কেমন মেয়ে বলে মনে হয় আপু? বলতো?
তৌফিকা বুঝেছে আরাবের কথার মানে। তাই বলার কিছুই খুজে পেলো না ও। চুপ করে রইলো। এরমাঝে টুইঙ্কেলকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মিসেস ওয়াহিদ। বললেন,
-দেখেছিস তৌফিকা? কেমন অসুখ বাধিয়েছে তোর ভাই? কি দরকার ছিলো এই অসময়ী বৃষ্টিতে ভেজার? এখন ঠান্ডায় নাকচোখ লাল হয়ে আছে দেখ!
আরাব কিছুই বললো না। দুবার হাচি হলো শুধু ওর। টুইঙ্কেল গুটিগুটি পায়ে ব্যালকনিতে পৌছে গেছে। ওদিকেই তাকিয়ে রইলো ও। তৌফিকা বললো,
-ছাড়ো তো মা ওর কথা! জানোই তো তোমার ছেলে কেমন! আর এটুক ঠান্ডায় কিছু হবে না। তারচেয়ে বড় অসুখ বাধিয়ে রেখেছে তোমার ছেলে!
ছেলেমেয়ের দিকে বিস্ময়ে তাকালেন মিসেস ওয়াহিদ। বললেন,
-মানে? আরাব? কি হয়েছে তোর? এসব কি বলছে তৌফিকা? এজন্যই কি তুই ইদানিং এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস বাবা? কোথায় কষ্ট হয় তোর? আমাকে আগে কেনো বলিস নি? এই তৌফিকা,তুইও বললি না আমাকে। আরাবের কবে থেকে এমন…
-তোমার ছেলে প্রেমে পরেছে মা।
বিস্ফোরিত চোখে আরাবের দিকে তাকালেন মিসেস ওয়াহিদ। ঠোট টিপে হাসছে তৌফিকা। আরাব সকালেই বলেছিলো মাকে জানাবে বিষয়টা। তাই আর দেরি করেনি ও। বিস্ময় কাটিয়ে মিসেস ওয়াহিদ একরাশ উচ্ছাসে বললেন,
-সত্যি?
আরাব ঠোট টিপে হেসে মাকে ধরে বিছানায় বসালো। নিজে মায়ের সামনে মেঝেতে হাটু গেরে বসে বললো,
-শান্ত হও। ভেবেছিলাম একেবারে বিয়ের সময় তোমাকে জানাবো। তারপর ভাবলাম ওই শকটা শুধু বাবার জন্যই থাক!
হাত উঠিয়ে চড় মারার ভঙিমা বোঝালেন মিসেস ওয়াহিদ। হেসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো আরাব। টুইঙ্কেল বারান্দা থেকে বললো,
-এটা কি ফুল আরাব মামা?
আরাব নাক ডলে বললো,
-পদ্ম। তোমার উইশমাম দিয়েছে!
-মেয়েটা…
মিসেস ওয়াহিদ বলার আগেই টুইঙ্কেল বলে উঠলো,
-জানো আম্মু,কিছুদিন আগে আমাদের ক্লাসের এক মেয়ে এইটা ড্রয়িং করে স্কলারশিপ পেয়েছিলো। তখন উইশমাম থাকলে ওইটায় আমিই ফার্স্ট হতাম বলো?
স্কলারশিপ কথাটা শুনে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো আরাব। হাসিমুখে এগিয়ে এসে টুইঙ্কেলকে চুমো দিয়ে বললো,
-তুমি সবসময় মামার এতো হেল্প কেনো করো টুইঙ্কেল? মামা লাভস্ ইউ আ লট!
এই কথাগুলো বলেই আরাব মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে আসলো ওর রুম থেকে। মিসেস ওয়াহিদ আটকাতে চেয়েছিলেন ওকে,তৌফিকা বাধা দিতেই উনি থেমে গেলেন। দুজনের মুখেই প্রসন্নতা,আরাব যা করবে,ভালোর জন্যই করবে। টুইঙ্কেল আস্তেধীরে রুমে ঢুকে দরজায় তাকিয়ে বললো,
-উইশমামকে রংধনুতে এনে দাও মামা। টুইঙ্কেল অলসো লাভস্ ইউ।
•
নতুন একটা দিন। ভার্সিটি থেকে ফিরতে আজও দেরি হয়েছে দোয়ার। বাসায় ফিরে সবকাজ সেরে টিউশনির জন্য দ্রুতপায়ে হাটছে ও। আবাসিক এলাকার এক রাস্তায় অল্পবয়স্ক কিছু ছেলে ব্যাডমিন্টন খেলার দাগ আকছে। দোয়াকে দেখে দুটো ছেলে বাজে আওয়াজ করে ফেলে হঠাৎই। রাগ উঠে গেলো দোয়ার। হাটুরবয়সী বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে ঠাটিয়ে চড় লাগবে বলে হনহনিয়ে পা বারালো ওদের দিকে।
আচমকাই একটা রিকশা অনেক বেশি গতিতে এসে দোয়ার ওড়নায় বাঝিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে না পেরে দুবার ঘুরে উঠে কারো বুকে গিয়ে পরে দোয়া। সে মানুষটা দুহাতে জরিয়ে ধরেছে তাকে। সরে আসতে গেলেই লোকটা একদম শান্তভাবে বললো,
-তোমার গায়ে ওড়না নেই দোয়া।
চেনা স্বর শুনে চমকে উঠলো দোয়া। সরে যেতে পারলে বাচতো ও। কিন্তু ওড়না ছাড়া কিভাবেই বা পাশ ফিরবে? দুহাত বুকে আকড়ে ধরলো। ওর ওটুকো সঞ্চালনে ঠোটে ঠোট চেপে চোখ বন্ধ করে রইলো আরাব। বাইরের স্তব্ধ পরিবেশের উল্টোরুপ,ভেতরে তান্ডব হচ্ছে ওর। তৌফিকা বাসার কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বলেছিলো ওকে। ওগুলো দিয়ে একপলক দোয়াকেও দেখে আসতে পারবে ভেবে বায়োমেডি থেকে সোজা এদিকেই এসেছে ও। ভেবেছিলো দোয়া আগের টিউশনির ওখানে পৌছে গেছে। কিন্তু দেখাটা হয়েই গেলো রাস্তায়। ওকে রাগীভাবে ছেলেগুলোর দিকে এগোতে দেখে বাইক থামাতে বাধ্য হলো একপ্রকার। নেমে হাটা লাগানোর মুহুর্তেই রিকশাটা ওভাবে পাশ কাটিয়ে ওর ওড়না নিয়ে চলে গেলো।
-ওরে মামা! আজকাল আমাদের কলোনিতেও এমন ফিল্মি সিন দেখা যায়!
শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। চোখ মেলে একপলক ছেলেগুলোর দিকে তাকালো আরাব। ওরা বাজেভাবে হেসে রং দিয়ে কোর্ট আকাতে লাগলো। মুখ দিয়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে জ্যাকেটটা খুলে ফেললো আরাব। একটুখানি পিছিয়ে চোখ অন্যদিক রেখে দোয়ার সামনে জ্যাকেটের পিঠের দিকটা তুলে ধরে বললো,
-হাত ঢুকাও।
বিস্ময়চাওনি নিয়ে রোবটের মতো দুহাত সামনে ঢুকিয়ে দিলো দোয়া। আরাব অন্যদিকেই তাকিয়ে। হাত ঢুকানো হলে আবারো ওকে জরিয়ে আরাব জ্যাকেটের পেছনের চেইনটা লাগিয়ে দিলো অতি সন্তর্পনে। দোয়ার গায়ে ওটার সামনের অংশ পেছনে আর পিঠের দিকটা সামনে। বেনুনি করা চুলগুলোও খুলে দিলো আরাব। তারপর অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে ওর ঢেউখেলানো বড়বড় চুলগুলো সামনে দু পাশে দিয়ে দিলো।
দোয়া যেনো পাথর হয়ে গেছে আজ। আরাবের দিক থেকে চোখ সরছেই না ওর আজ। বারবার মনে হচ্ছে,কতোগুলো দিন পর দেখলো ও এই মানুষটাকে। আরাব এখনো অবদি তাকায়নি ওর দিকে। এজন্যই হয়তো ওভাবে দেখে চলেছে ও। জ্যাকেট পরানো,চুল সেট করা শেষে অনেকটা পিছিয়ে দোয়ার দিকে ঠিকঠাকমতো তাকালো আরাব। চোখাচোখি হতেই হুশ ফিরলো দোয়া। নিজেরদিকে তাকিয়ে আরো বড়বড় চোখে তাকালো ও আরাবের দিকে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে পকেটে হাত গুজে দোয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই আরাব ছেলেগুলোর দিকে এগোলো। দম মেরে দাড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে দোয়া। ওর দিক তাকিয়ে থেকেই ঝুকে কোর্ট আকাতে থাকা এক ছেলের কলার ধরে দাড় করালো আরাব। এ গালে,ও গালে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে দিলো ওর। শব্দ শুনে বাকি ছেলেগুলোর মধ্যে দুজনের হাত আপনাআপনিই গালে চলে গেছে। আরাব একহাতে ছেলেটার চুলে আঙুল চালিয়ে মিষ্টিস্বরে বললো,
-দুধদাত পরেনি,এখনি বিষদাত গজিয়েছে দেখছি! সমস্যা নেই,ওমন দু চারটে বিষদাতসহ একেবারে পুরো সর্পকুলকেই উপরে দিতে জানে আরাব! পরেরবার তোদের কোনোটাকেও যদি কর্কটা পাস করো,এই কথা ছাড়া কোনো পথচারীকে অন্য কথা বলতে শুনেছি,একেবারে চান্দামামাকে ডেকে এনে টিপ পরিয়ে দেবো খোকা! মনে থাকে যেনো!
কথা শেষ করে আরেকপলক দোয়ার দিকে তাকালো আরাব। তারপর ছেলেটার কলার ছেড়ে দিয়ে শার্টের হাতা টান মেরে হুইস্টলিং করতে করতে পা চালালো ও। গালে হাত বুলাতে বুলাতে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ছেলেটা। বাকি ছেলেগুলো একবার দোয়ার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি স্থানত্যাগ করতে লাগলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। আরাব আড়াল হলে আস্তেধীরে ঘাড় নামিয়ে গায়ের জ্যাকেটটার দিকে তাকালো একপলক। শীত মোটেও নেই এ সময়। কিন্তু ওই জ্যাকেটটা পরেই যেনো শরীরে অসম্ভব কম্পন অনুভব হচ্ছে ওর। আলাদা এক অনুভুতি! আলাদা এক…শিহরন!
#চলবে…