এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ২১+২২

0
377

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২১

প্রতিটা স্বাভাবিক দিনের মতো আজও ভার্সিটির ফাকা বাসে চড়ে বসলো দোয়া। পুরো বাসে দুটো ছেলে আর ও সহ তিনটে মেয়ে শুধু। সকালে এই একটাই ট্রিপ যায় এদিক থেকে। সেটাও অনেক বেশি সকালে। লোকাল বাসে,লেগুনায় ভাড়া বিবেচনা করে এ বাসেই যাতায়াত দোয়ার। সকাল সাতটার বাস,ক্লাস সাড়ে নটায়। আধঘন্টার পথ। আগেআগেই তাই ভার্সিটি এসে বসে থাকতে হয় ওকে। ওইতো,লাইব্রেরি,বই। আছে এক সময় কাটানোর জায়গা। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো দোয়া। ড্রাইভার মামা হঠাৎই বলে উঠলো,

-শুনতাছি কাল থাইকা নাকি এইদিকে নয়টায় আরেকটা বাস আইবো ভার্সিটির?

চকচকে চোখে তাকালো দোয়া। নয়টায় ভার্সিটির বাস মানে ওর আরো দুঘন্টা বেচে যাওয়া। আরো দু দুটো টিউশনি! আরো কিছুটা উপার্জন। বাসের আর বাকিসব তেমন আগ্রহ দেখালো না। হয়তো ওদের ক্লাসটাইম সকালেই। বাধ্য হয়ে দোয়াই বললো,

-স্ সত্যি বলছেন মা‌মা? নতুন বাস চালু হবে কাল থেকে?

-হ। ওমনই তো হুনলাম কেরানির কাছে। নতুন কি জানি এক বেসরকারী ফাউন্ডেশন আইবো আজ ভার্সিটিতে। তেনারাই নাকি দুইডা বাস দিবো!

আরো আগ্রহভরে দোয়া জিজ্ঞাসা করলো,

-সে দুইটা কি নয়টায় হবে? এদিকেরই হবে?

-এমনই তো হুনতাছি।

মন ভালো হয়ে গেলো দোয়ার। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনেমনে দোয়া করতে লাগলো,এমনই যেনো হয়। উপরওয়ালা এভাবেই আস্তেআস্তে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাক। ভার্সিটির গেইটে বাস থামলো। বাস থেকে নামতেই চোখ পরলো গেইটের সামনের দিকটা বেশ জাকজমকভাবে সাজানো,বেলুন,ফুল দিয়ে। গুরুত্ব না দিয়ে সোজা ক্লাসে চলে আসলো ও। কিন্তু ক্লাসেও একই অবস্থা। কোনো উৎসবের আমেজ তো আছে সবার মাঝে। এসবের মধ্যে তাজীন নেই বলে চুপচাপ বসে রইলো ও। দুটো ক্লাস শেষে প্রিন্সিপাল স্যার নিজে ঢুকলেন ওদের ক্লাসে। সাথেসাথে দাড়িয়ে গেলো সবাই। স্যার বসতে বললেন ওদের। ওনার সাথে আরো বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক। দোয়ার চোখ আটকালো মাঝের সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া মানুষটার দিকে। সুটবুট পরা লোকটাকে মধ্যবয়স্কের চেয়ে বেশিই মনে হয়। কিন্তু চেহারায় অর্থবিত্তের চাকচিক্য স্পষ্ট। স্যার বললেন,

-আসসালামু আলাইকুম স্টুডেন্টস্। আশা করি ভালোই আছেন সবাই? পরিচয় করিয়ে দেই। উনি বিশিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তৌফিক ওয়াহিদ। আপনারা হয়তো চেনেন ওনাকে বেশিরভাগই। ওনার কোম্পানি,রংধনু গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ সারা বাংলাদেশেই আছে।

বেঞ্চ শক্ত করে ধরলো দোয়া। ইনি আরাবের বাবা,বুঝতে সময় লাগেনি ওর। আগে দেখিনি বলে চিনতে পারেনি। প্রিন্সিপাল বললেন,

-ওনার আজকে আমাদের ভার্সিটিতে আসার কারন,ভার্সিটির দুটো নতুন বাসের ওপেনিং। যেটা ওনারই গ্রান্ট করা। তাছাড়া ভার্সিটির কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ডিপার্টমেন্টগুলো টপ থ্রি স্টুডেন্টসদের এককালীন স্কলারশিপও দেবেন উনি।

হাততালিতে মুখরিত হলো ক্লাসরুম। দোয়া দৃষ্টিনত করলো। টপ থ্রি! তারমানে ওকেও টাকা দেওয়া হবে। মানা করার ইচ্ছে ছিলো,টাকাটা না নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো ওর। তবুও কিছু বললো না। এই টাকা ওর মেধার বিনিময়ে পাওয়া টাকা হতে চলেছে,ওর শত রাতজাগা পরিশ্রমের উপহারস্বরুপ। নইলে কখনোই আরাবের বাবার টাকা নিতো না ও! কখনোই না!

হাতে চকচকে দশটি এক হাজার টাকার নোট নিয়ে রোবটের মতো ভার্সিটি থেকে বেরোলো দোয়া। ওর ভাবনাতেও কুলোচ্ছে না,সব কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ডিপার্টমেন্টে টপ থ্রি স্টুডেন্টসদের দশ হাজার করে টাকা দিতে ঠিক কতোটাকা ফুরিয়েছে তৌফিক ওয়াহিদের। কিন্তু তাতে ওর মতো অনেক স্টুডেন্টেরই অনেকবড় উপকার হয়েছে। গেইট দিয়ে বেরোতেই ওর সামনে ভার্সিটির বাস এসে থামলো। চুপচাপ উঠে পরলো ওতে দোয়া।

খানিকটা দুরে গাড়ির বাইরে দাড়িয়ে দোয়ার হতভম্ব চেহারাটা বেশ উপভোগ করলো আরাব। সারাদিনে হয়তো এই একটা ঘটনাই সবচেয়ে ভালো ঘটলো ওর সাথে। নইলে এই বাস,স্কলারশিপ আবদারের সাথে ওর বাবা যে অফিসে যাওয়া শর্ত জুরেছে,তাতে দিনটা ওর বোরিংই কাটবে। তবুও হাসিমুখে দোয়ার চেহারাতে চোখ আটকালো ও। গাড়ির ভেতর থেকে তৌফিক ওয়াহিদ বাজখাই গলায় বললেন,

-আরাব? চলো অফিস!

আরাব দোয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-যদি না যাই,তুমি এই বাস,এই স্কলারশিপের টাকা ফেরত নিয়ে নেবে বাবা?

ভাষাহীনভাবে আরাবের দিকে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। ও সেই বাসের দিকে তাকিয়েই‌ মিটমিটিয়ে হাসছে। তৌফিক ওয়াহিদ বললেন,

-মানে কি আরাব? একটা প্রশ্ন না করে তোমার কথামতো বাস,স্কলারশিপ গ্রান্ট করেছি এই ভার্সিটিতে। এখন যদি তুমি…

-রিল্যাক্স বাবা! টেক আ চিল পিল! যাচ্ছি তোমার গাড়িতে,তোমার অফিস! চলো!

গাড়িতে উঠে বসলো আরাব। যদি দোয়ার জন্য এটুকো করতে ওকে বায়োমেডি ছেড়ে অফিসে বেশি সময় দিতে হয়,এতোটুকো‌ আফসোস নেই ওর। এতোটুকোও নাহ্!

মাঝে একদিন কেটে গেছে। স্কলারশিপের টাকায় মায়ের ওষুধ বেশ অনেকগুলো কিনে নিয়েছে দোয়া। অরুনাভ মুখার্জীর বাড়িভাড়া,আর বাকিটা দিয়ানের জন্য। সকালে বাসটাইমটা ঠিক হওয়ায় আরো একটা টিউশনি নিয়েছে ও। আজকের ক্লাস শেষ করে ভার্সিটির পাশেরই এক ক্যাফেতে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে দোয়া। আশেপাশে আড়চোখে তাকাচ্ছে একরাশ ইতস্ততবোধ নিয়ে। এসব জায়গায় একদমই বসার অভ্যেস নেই ওর। থাকবেই বা কেনো? এতো দামিদামি খাবার কেনার না আছে সামর্থ্য,না আছে মা ভাইয়ের চিন্তায় ওগুলো মুখে তোলার এতোটুকো ইচ্ছা।

কিন্তু আজ কোনো উপায়ন্তর ছিলো না। তাজীন বারবার করে বলে গেছে ওকে এখানেই‌ বসতে। বেশ কিছুক্ষন লাইব্রেরিতে ছিলো ও। তারপর চলে এলো এ দিকটায়।বেশ অনেকটা সময় একাকী বসে থাকার পর তাজীন হাপাতে হাপাতে এসে ওর পাশে বসলো। দোয়া ওর চোখমুখ দেখে অস্থিরতার কারন বোঝার চেষ্টা করছে। টিস্যুতে চেহারা মুঝে তাজীন গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসে বললো,

-ক্ কি হয়েছে? ওভাবে কেনো তাকিয়ে আছিস?

দোয়া সন্দিহান কন্ঠে বললো,

-তুমি এমন হাপিয়েছো কেনো তাজ?

হচকিয়ে গেলো তাজীন। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,

-ও্ ও কিছু না! বাইরে থেকে আসলাম,ঘেমে তো যাবোই তাইনা?

-হ্যাঁ কিন্তু এতো তাড়াহুড়ো করে আসলে‌ যে!

-তো তোকে এখানে বসিয়ে রেখে আমি কচ্ছপের গতিতে আসবো?

-ন্ না। সেটাও নয়। আমরা লাইব্রেরিতে বসলেই পারতাম। তুমি হুট করে ওভাবে চলে এলে কেনো বলতো? আমরা…

তাজীন জোরে শ্বাস ফেলে ওরদিকে ফিরে বললো,

-এই তোকে ভার্সিটিতে পড়তে বলেছে কে রে? কোনো প্রাইভেট ইনভেস্টিকেটিং গ্রুপে ঢুকে যেতি! যা ক্রসকোশ্শেন করতে পারিস না তুই! সেই একটা বেতনে তোকে রেখে দিতো বড়বড় ইনভেস্টিগেটরস্! তারপর সেখানেই চালাতি তোর যতো কিউ এন্ড এ পর্ব! উফ্!

তাজীনের দম না ফেলা কথাগুলো শুনে আর কিছুই বললো না দোয়া। মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা মোড়কবাধানো বক্স বের করে তাজীনের সামনে ধরলো। তাজীন বিরক্তিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো। ওটা দেখেই বিস্ময়ে কিছু বলার আগে দোয়া বললো,

-হ্যাপি বার্থডে তাজ!

তাজীন মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। গত তিনবছরের ওর প্রতিটা জন্মদিন মনে রেখেছে দোয়া। কোনো ফেসবুক নোটিফিকেশন ছাড়াই প্রতিটা জন্মদিনে ওকে স্পেশাল ফিল করিয়েছে। টিউশনির টাকার একাংশ দিয়ে কখনো চুড়ি,কখনো ওড়না,তো কখনো বই উপহার দিতে ভোলেনি। সে হিসেবে ও কিছুই দিতে পারেনি দোয়াকে। কোনো বিশেষ দিন দোয়ার জন্য ছিলোই না যেনো। জন্মদিন জানার বহু চেষ্টা করেছে,বলেনি। এমনকি সার্টিফিকেটটাও দেখতে দেয়নি দোয়া। দোয়ার সাথে ওর যেনো শুধু নেওয়ার সম্পর্ক। বিনিময়ে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই গ্রহন করেনি দোয়া। তাই এবার তাজীন ভেবেছিলো নিজের জন্মদিনেই কিছুটা সারপ্রাইজ দেবে ওকে। দোয়া বক্সটা নাড়িয়ে বললো,

-নাও? খুলে দেখো?

-এবার একটা শর্তে তোর উপহার আমি নেবো দোয়া!

-কি বলছো তুমি? শর্ত কেনো আসছে আমাদের মাঝে তাজীন?

-আসছে কারন পরেরবছর এই সময়টাতে আমি তোর সাথে দেখা করতে পারবো কিনা জানি না! আজকের দিনটাতে তোকে আমার সাথে খেতে হবে দোয়া,ঘুরতে হবে আমার সাথে। আজকে খাবার তুই বাসায়ও প্যাক করে নিয়ে যাবি। নইলে এবার তোর গিফট আমি নিবো না!

দোয়া বুঝলো,সত্যিই এবারে তাজীনের জন্মদিন পালন,ওরজন্য শেষবার হতে পারে। তাই মুচকি হেসে ওর হাতে বক্সটা গুজে দিয়ে বললো,

-বেশ। আজকে বার্থডে গার্ল যা বলবে,তাই!

তাজীন খুশিমনে জরিয়ে ধরলো দোয়াকে। দোয়া ওকে ছাড়িয়ে বক্সটা খুলে দেখার জন্য ইশারা করলো। তাজীন বক্সটা খুলেই নেতিয়ে গেলো। একবার উপহারটার দিকে,তো একবার দোয়ার দিকে তাকাচ্ছে ও। ভেতরে অনেক দামি একটা ঘড়ি। দোয়া এতো টাকা দিয়ে ওর জন্য উপহার কিনেছে ভেবেই প্রচন্ড অভিমান হলো তাজীনের। অন্যদিক তাকিয়ে বললো,

-এবার এটা কেনো দোয়া?

-এবার তো তোমার প্লানও ভিন্ন তাজীন! মানা করো না প্লিজ। প্রতিবার রাস্তার দোকানগুলো থেকে কমদামী জিনিস দিয়ে উইশ করি তোমাকে। তুমিও হাসিমুখে অভ্যস্ত না হওয়া সত্ত্বেও ওগুলো নিয়ে নাও। কিন্তু সত্যি বলতে,একদমই ভালোলাগতো না আমার তখন। আজকে এটা…

-দোয়া!

-আরে টেনশন কেনো করছো বলোতো? তোমাকে বলেছিলাম না? আগেরদিন যে বেসরকারী ফাউন্ডেশনটা স্কলারশিপের টাকা দিয়ে গেলো আমাকে,মনে নেই তোমার? আমার তো মনে হয় আল্লাহ্তায়ালা জানতেন,আমি কতো করে চাই তোমাকে ভালো কিছু গিফট করতে। এজন্যই স্কলারশিপটা জুটে গেলো বলো?

-কিন্তু…

-কোনো কিন্তু না! ওটা হাতে পরো তুমি! দেখি কেমন লাগছে?

তাজীন আর মানা করলো না। দোয়ার সবকথাতেই ভয় হয় ওর। এই বুঝি হ্যাঁ বলার জন্য ওর আত্মসম্মানে লাগে,এই বুঝি না বলার জন্য ওদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়। ঘড়িটা পরে দোয়াকে দেখালো ও। দোয়া হাসিমুখে বললো,

-খুব সুন্দর মানিয়েছে তোমার হাতে ওটা!

তাজীন মৃদ্যু হাসলো। বললো,

-তোর জন্যও একটা সারপ্রাইজ আছে।

ভ্রুকুচকে তাকালো দোয়া। তাজীন হাসছে শুধু। টেবিলের উপর থাকা তাজীনের মোবাইলটার আলো জ্বলে উঠতেই আরো প্রসারিত হলো ওর হাসি। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে দোয়াকে ক্যাফের দরজায় তাকানোর জন্য ইশারা করলো। দোয়া একবার দরজায় তাকালো। তারপর কিছু বুঝে না উঠে আবারো তাজীনের দিকে তাকালো ও। কপাল চাপড়ে উঠে গেলো তাজীন। দরজার কাছ থেকে এক লোকের হাত জরিয়ে ধরে দোয়াকে দেখিয়ে বললো,

-মিট মাই ফিয়নসে। ডক্টর সজল মুফতাহির। মুফতাহির? ও দোয়া। আমার বেস্টফ্রেন্ড!

লোকটাকে দেখে,তার নাম শুনে দাড়িয়ে গেলো দোয়া। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। ভেতর থেকে তীব্র বিস্ময়ের শ্বাস আটকে গেলো যেনো। পরিশেষে শুধু একটা কথাই গলায় দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো,এ কি করে সম্ভব???

#চলবে…

।#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২২

-ডক্টর সুমন!

দোয়ার আস্তেধীরে করা শব্দদুটোর উচ্চারনে সুমন স্তব্ধ হয়ে রইলো। দোয়াকে এতোগুলো বছর পর দেখে ভুত দেখার মতো ঘটনা ঘটেছে যেনো ওর সাথে। আপাদমস্তক দেখে নিলো দোয়াকে ও। মলিন থ্রিপিস,বিনুনি,কাধে পাটের সাইডব্যাগ,পাতলা চপ্পল,তাকওয়াতুল দোয়ার এইরুপে যে সে অভ্যস্ত নয়। চরম অবিশ্বাসের স্বরে বলে উঠলো,

-দ্ দোয়া? তুমি?

তাজীন কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। কে ডক্টর সুমন? ওর সাথে দাড়ানো মানুষটা তো ডক্টর মুফতাহির। তবে দোয়া ওকে ডক্টর সুমন কেনো বললো? আর মুফতাহির দোয়ার নাম ধরে ডাকলো কেনো? তবে কি সে দোয়াকে চেনে? বিস্ময় বজায় রেখে তাজীন আগে সুমনকে বললো,

-তুমি চেনো দোয়াকে মুফতাহির?

সুমনের কপালের কার্নিশ বেয়ে ঘাম গরাচ্ছে। আর দোয়া শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। যে অতীত থেকে গত চারবছর পালিয়ে বেরিয়েছে ও,তা আবারো এভাবে ওর জীবনে হানা দেবে,কল্পনাতেও ছিলো না ওর। তাজীন দোয়ার দিকে ফিরে বললো,

-দোয়া? তুই চিনিস মুফতাহিরকে? আর ওকে সুমন বলে ডাকছিস কেনো? ওর নাম মুফতাহির। ডক্টর সজল মুফতাহির।

তৌফিকা দ্বিতীয়বার নামটা বলায় দোয়ার হুশ ফিরলো। এই নামটা চেনা ওর। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় শুনেছে ও নামটা। বললো,

-উ্ উনি…

সুমন দোয়ার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,

-আপনি তাকওয়াতুল দোয়া?

-হ্যাঁ। ও তাকওয়াতুল দোয়া। কেনো বলো তো মুফতাহির? তুমি আগে থেকেই চেনো ওকে?

-না! উনি চেনেন না আমাকে!

-কিন্তু…

-কোনো কিন্তু না তাজ! উনি আমাকে চেনেন না!

দোয়ার জবাবে সুমন কিছু বললো না। তাজীন ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,

-ওকে ফাইন। চলো আগে বসি তিনজনে! তারপর কথা হবে না হয়? আমি…

তাজীনের কথা শেষ হবার আগেই সুমন বললো,

-তাজ? তোমার সাথে দরকার আছে আমার! ইটস্ আর্জেন্ট! চলো এখান থেকে! আমি…

তাজীন লাজুক লাজুকভাবে বিরবিরিয়ে বললো,

-এইযে মহাশয়,অতিকষ্টে আপনাকে এনেছি এখানে,দোয়ার সাথে দেখা করাবো বলে। নইলে আপনার সময় কোথায়? এখন এসেই যখন পরেছেন,এতো পালাই পালাই করছেন কেনো বলুনতো? তাছাড়া বিয়েটা এখনো হয়নি। এখনই এমন তাজ,তাজ করলে চলবে? দোয়া কি ভাববে?

তারপর গলা ঝেড়ে দোয়াকে বললো,

-দোয়া? চল বসি। এইযে? আপনিও আসুন!

সুমন দোয়াকে পাশ কাটিয়ে তাজীনের সাথে পা বাড়ালো। বিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। মা,ভাই বাদে ওর জীবনের গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তিটা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন মানুষ হিসেবে এ কাকে বেছেছে? তাজীন যে মনপ্রান দিয়ে সুমনকে ভালোবাসতে শুরু করেছে,তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ওর। কিন্তু এই মানুষটা তো ওর ভালোবাসার যোগ্য নয়! এই মানুষটা তো একটা ঠকবাজ! একটা কার্লপ্রিট! এর সাথে তাজীনকে মানতে পারবে না ও।

কিন্তু ওরই বা করার কি আছে? সুমনের বিরুদ্ধে কোনো প্রমান নেই ওর কাছে। ও এখন কিছু বলতে গেলে,ওর পরিচয় নিয়েও কথা হবে এখানে। যেটা একদমই চায় না ও। সুমনের আসল রুপটা যখন তাজীন জানবে,ওর সমস্ত স্বপ্ন,আশা,আকাঙ্ক্ষা সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু তা বলে চুপ থাকতে পারে না ও। কোনোভাবেই তাজীনকে এর সাথে জরাতে দেওয়া যাবে না। তাতে ওর যতোবড় ক্ষতিই হোক না কেনো! একটা দীর্ঘশ্বাসে নিজেকে বোঝালো দোয়া। তাজীনরা বসে গেছে। দোয়াকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

-কিরে দোয়া? আয়?

দোয়া ধ্যান ছেড়ে এগোলো। আজকে এই পরিস্থিতিকে পাশ কাটানোর সর্বদিক বন্ধ। সুমনের মুখোমুখি মাথা নিচু করে বসে গেলো ও। সুমন চুপচাপ তাকিয়ে ওর দিকে। তাজীন আস্তে করে বললো,

-মুফতাহির? কথা বলো ওর সাথে? শি ইজ ভেরি শাই। তুমি কথা না বলা শুরু করলে ও কথা বাড়াবে না কিন্তু!

সুমন তাজীনের দিকে তাকালো। দোয়া লাজুক,আগবাড়িয়ে কথা বলবে না,কথাগুলো শুনে আটকে রইলো। বারবার মনে হচ্ছে,একই নামের অন্য একটা মানুষের সামনে বসে ও। কিন্তু দোয়ার ব্যবহার,চোখ নামানো ইতস্ততবোধ,ওকে চিনতে পারা,সবটাই ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে,এই সেই তাকওয়াতুল দোয়া। সুমন বললো,

-আপনার পুরোনাম তাকওয়াতুল দোয়া?

দোয়া নিচদিক তাকিয়েই শান্ত গলায় বললো,

-সন্দেহ কেনো রাখছেন মিস্টার মুফতাহির? আপনার পুরোনাম কি ডক্টর সজল মুফতাহির নয়?

সুমন শক্ত চোখে তাকালো এবার দোয়ার দিকে। ওই সেই দোয়া,কোনো সন্দেহ নেই আর তাতে। ভেবেছিলো রওশন পরিবারের ঝামেলা চিরতরে মিটে গেছে। ওদের মুখোমুখি আর হতে হবে না ওকে। কিন্তু আজ এতোগুলো বছর পর সেই দোয়ার সামনেই নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করতে হবে ভাবতেই নিজের উপর চরম রাগ হচ্ছে ওর। জোরপুর্বক হেসে বললো,

-কে বলেছে আপনি লাজুক? লজ্জা পাচ্ছেন! দেখো তাজ,তোমার বান্ধবী কতো সুন্দর কথার জবাবে কথা ফেরত দিতে পারে। মনে হচ্ছে না? এক অন্য দোয়াকেই দেখছো তুমি?

তাজীন হেসে বললো,

-হ্যাঁ তাইতো? আজকে কিন্তু কিছু রেয়ার জিনিস দেখা মিললো আপনার জন্য। জেনারেলি দোয়া এভাবে কথা বলে না!

-অনেকসময় আমাদের চারপাশে এমন অনেক অনাকাক্ষিত ঘটনা ঘটে,যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। রাইট মিস তাকওয়াতুল দোয়া? আপনি কি কল্পনা করেছিলেন,আমার সাথে আপনার দেখা হবে?

দাতে দাত চেপে সুমনের দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। সুমন আবারো বললো,

-আই থিংক সেটা কল্পনা না করলেও,এর ফলাফলটা ঠিক কল্পনা করতে পারছেন রাইট?

দোয়ার ভেতরটা ধক করে উঠলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ও সুমনের দিকে। কোনোভাবে সুমন ওদের বিষয়ে সবটা জেনে যায়নি তো?তাজীন কিঞ্চিত অবাক হয়ে বললো,

-মানে?

-মানে,এর ফল হিসেবে,তোমার আমার বিয়েতে ওনার উপস্থিতি কনফার্ম হলো তাইনা?

সুমনের কথায় তাজীন হাসলো। কিন্তু দোয়া নির্বাক। রাগে চোখ জলে ভরে উঠেছে ওর। বাকা হাসলো সুমন। মেনুকার্ডটা দোয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো,

-অর্ডার প্লিজ? মিস তাকওয়াতুল দোয়া!

সুমনের কাছে বারবার নিজের পুরোনাম শুনে দোয়া নুইয়ে গেলো। দোয়ার উপস্থিতি যে সুমনের মোটেও ভালো লাগে নি,আর ওর খারাপ লাগার বিষয়গুলো সরিয়ে দিতে এতোটুকোও‌ ভাববে না ও,ওর কথায় তা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে তা। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-আ্ আমি এসবে অভ্যস্ত নই। আপনারা যেটা খাবেন,অর্ডার করতে পারেন।

সুমন চেয়ারে হেলান দিয়ে আরো আরাম করে বসলো। দোয়া অন্যদিক ফিরে আছে। তাজীন বললো,

-ওকে,আমিই অর্ডার করছি।

খাবার অর্ডার করলো তাজীন। দোয়া একপলকও আর তাকায়নি সুমনের দিকে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সামলেছে নিজেকে। ওর মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সুমন জেনে গেছে,দোয়া বেচে আছে। জেনে গেছে ওর সত্যিটা জানে,এমন কেউ বেচে আছে। যদিও কোনো প্রমান নেই ওর কাছে। কিন্তু তবুও কি ও চুপ থাকবে? এই নতুন নাম কেনো সুমনের? তাজকে ঠকাবে বলে? ও যতোদুর জানে সুমনের আসল রুপটা এখনো সবার অজানা। তবে কি তাজকে ঠকাবে বলেই এই অন্যনামে গা ঢাকা কেনো দিচ্ছে ও? সুমন খুব স্বাভাবিক ব্যবহার বজায় রাখলো পুরোটা সময়। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে দোয়া উঠে দাড়িয়ে বললো,

-আমি এখন আসি।

তাজীন বললো,

-আরেকটু বসবি না?

-ন্ না তাজ। আজকে আসি। ভালো থেকো।

-কেনো? তা কেনো? সবে আড্ডা দেবো ভাবছি! পরিচিত হবো ভাবছি! আর আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন?

সুমনের কথায় ঘর্মাক্ত হাত ওড়নায় আটকালো দোয়া। বললো,

-আজকে নয়। অ্ অন্যদিন।

-আমারো তীব্র ইচ্ছা রইলো,দ্বিতীয়বার দেখা করার।

দোয়া উঠে দাড়ালো। ভয় বাড়ছে ওর। ওর চোখমুখে দুশ্চিন্তা দেখে ওকে আর আটকালো না তাজীন। বিকেলে দোয়ার টিউশনি আছে,সেটা জানে ও। ওউ উঠে দাড়ালো। ওয়েটারকে ডেকে প্যাক করা খাবারটা ওর হাতে গুজে দিয়ে বললো,

-এগুলো আন্টি আর দিয়ানের।

দোয়া সুমনের দিকে তাকালো। পরিবারের কথা মনে পরায় ভয় আরো বেড়েছে ওর। হাটা লাগালো ও। তাজীন ইশারায় সুমনকে বুঝালো একটু আসছি। নিশ্চিন্তে স্বায় দিলো সুমন। ও জানে,দোয়ার মুখ দিয়ে ওর বিষয়ে আর কোনো কথা বেরোবে না। গেইটের কাছে এসে তাজীন ফিসফিসিয়ে বললো,

-কেমন লাগলো হবু জীজুকে?

উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে এলো দোয়া। কাঠফাটা রোদে বড়রাস্তার ফুটপাত দিয়ে বিদ্ধস্তভাবে ধুকতে ধুকতে হাটা লাগালো ও। জলভরা চোখে আশেপাশে তাকালো একবার। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। অসহায় লাগছে ওর নিজেকে। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। হাতে প্যাক করা খাবারটা দেখে চোখ ফেটে জল গরিয়েই পরলো ওর এবার। সহ্য হলো না আর! মা,ভাইয়ের পর যে মানুষকে ও সবচেয়ে ভালোবেসেছে,এক মুখোশধারী বহুরুপীর জন্য সে যে ঠকে যেতে চলেছে। খুব বাজেভাবে ঠকানো হচ্ছে ওকে। দিশেহারার মতো এদিক ওদিক তাকালো দোয়া। তাজীনের ফিয়ন্সেই যে ওর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ ভাবতেই বারবার আকাশ ভেঙে পরছে ওর মাথায়। কি করবে ও? যাই‌ করুক না কেনো,তার পরিনতি যে হবে হয় তাজীনের নষ্ট জীবন,নয় ওর পুরো পরিবারের জীবনশঙ্কা! কোনদিকে যাবে ও? কি করা উচিত ওর এখন?

অফিসের হিসাবগুলো দেখে চুল উল্টে ধরে বিছানায় বসে আছে আরাব। হিসাবে বেশ অনেকটাই গরমিল। বিশেষ করে ফার্মাকেমিক্যালস্ ব্রাঞ্চে। যেখানে সেটার সর্বাঙ্গীন দায়িত্বে ছিলো মুফতাহির নিজে। এতোগুলো এলোমেলো হিসাবের কোনো কারনই খুজে পাচ্ছে না ও। মুফতাহিরকে প্রশ্নতাক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। তাই ঠিক করলো,কষ্ট করে হলেও সবটা নিজেই কিছুটা খুতিয়ে দেখবে না হয়! ল্যাপটপ কোলে নিয়ে সবে বসেছে এসবের উপরই কিছু কাজ করবে বলে,ফোনটা বেজে উঠলো ওর। বিরক্তি নিয়ে ফোনে তাকালো ঠিকই,কিন্তু নাম্বার দেখে খুশি হয়ে গেলো আরাব। ওটা অরুনাভ মুখার্জীর নাম্বার। ল্যাপটপ ছেড়ে হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো ও। কল রিসিভ করে বললো,

-আদাব কাকাবাবু। কেমন আছেন? এতোদিন পর মনে পরলো আপনার চিলেকোঠার এই অতিথির কথা?

-আপনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে মিস্টার আরাব। দেখা করতে চাই আপনার সাথে।

দোয়ার কন্ঠ শুনে থ‌মকে গেছে আরাব। ফোনটা কান থেকে না‌মিয়ে অবিশ্বাসের চোখে দু দন্ড সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ওপাশ থেকে দোয়া আবারো বললো,

-হ্ হ্যালো? মিস্টার আরাব? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?

আরাব ফোনটা কানে তুলে মৃদ্যুস্বরে বললো,

-দোয়া?

-জ্বী। আমি দোয়া। আপনার সাথে আমার অনেক জরুরি কথা আছে ‌মিস্টার আরাব। প্লিজ কালকে একবার দেখা করতে পারবেন?

একহাতে বুকের বা পাশটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো আরাব। আমি দোয়া,কথাটা ওর সারাদিনের ক্লান্তি গায়েব করে দিয়েছে। ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো ও। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,

-কোথায় দেখা করবে?

-আ্ আপনি যেখানে বলবেন,সেখানেই। কিন্তু সেটা কালকেই। প্লিজ।

-জায়গার নাম টেক্সট করছি তোমাকে।

তৎক্ষনাৎ ফোন কেটে দিলো দোয়া। ডক্টর সজল মুফতাহির নামটায় আরাব জড়িত। সুমনের আসল পরিচয়ের ঘৃন্য রুপটার প্রমান নেই ওর কাছে। কিন্তু এই ভুল পরিচয়টা প্রমান তো ও দিতেই পারে। আর সেটার জন্য মুফতাহির নামের লোকটাকে তাজীনের সামনে আনতে হবে ওকে। বাড়ি ফিরে খুব কষ্টে মনে করেছে ও এই নাম কোথায় শুনেছিলো। হ্যাঁ,এটা আরাবের কাছে শুনেছিলো ও। আরাবের দেওয়া কাগজটা দেখে আরো নিশ্চিত হয়ে যায় ও। পরে ওর সাথে যা হয়,দেখা যাবে। আগে তাজীনের জীবন থেকে সুমনকে সরিয়ে দেবে ও। যেকোনো উপায়ে। আর তাতে যদি আরাবের মুখাপেক্ষী হতে হয় ওকে,তাই হবে ও! দ্বিতীয়বার ভাবার দরকার নেই কোনো!

কল কেটে গেলে ফোন বুকে নিয়ে দুহাতে জরিয়ে রাখা ভানে শুয়ে রইলো আরাব। ভাবতেই খুশিখুশি লাগছে ওর। পরপরই মনে পরলো,কি এমন জরুরি কথা? যার জন্য দোয়া ওকে ফোন করলো? ওকে ফোন করার মতো কি ঘটেছে দোয়ার জীবনে? উঠে বসলো আরাব। ব্যালকনিতে গিয়ে বাইরের রাস্তার নানা আলোতে চোখ আটকালো ও। এবার চিন্তা হচ্ছে,বড্ড চিন্তা হচ্ছে ওর দোয়ার জন্য!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here