এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ১৭+১৮

0
369

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৭

ভেজা মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো আরাব। বায়োমেডি থেকে ফেরার সময় দোয়ার সাথে দেখা হওয়া নিয়ে মন ভালো আছে ওর। কিন্তু জারাকে বিছানায় বসে থাকতে দেখেই মাথায় রক্ত চরে গেলো ওর। তোয়ালে সোফার উপর ছুড়ে মেরে বললো,

-তুমি আবারো আমার রুমে কেনো জারা?

জারা উঠে দাড়ালো। আরাবের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাতর গলায় বললো,

-সবসময় কেনো এমন করো আরাব? একবারো আমাকে বোঝার চেষ্টা করো না কেনো তুমি? আজ কতোগুলো দিন যাবত দেখিনা তোমাকে। আজ আমার জন্মদিন আরাব। আজ তো অন্তত…

কথা বলতে বলতে আরাবের উন্মুক্ত বুকের দিকে হাত বারিয়েছে জারা। চোয়াল শক্ত করে ওর হাত ধরে ফেললো আরাব। হুট করেই চেহারায় মাত্রাতিরিক্ত রাগ জুরে বসেছে ওর। জারা কিছু বলার আগেই ওকে রুমের বাইরে টেনে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো আরাব। ঠান্ডা গলায় বললো,

-শুধুমাত্র তোমার জন্মদিন বলে কিছু বললাম না জারা। নইলে তোমার ব্যবহারের জন্য আরো বড় অপমান পাওনা ছিলো তোমার।

টপটপ করে পানি পরতে লাগলো জারার চোখ দিয়ে। দরজার বাইরের করিডরে থাকা ফুলদানিটা ফেলে দিয়ে কাদতে কাদতে দৌড় লাগালো ও। ড্রয়িংরুমে টুইঙ্কেলকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আরাবের বাবা মা। জারাকে ওভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে কয়েকবার ডাক লাগালেন তৌফিক ওয়াহিদ। জারা থামেনি। তারপর নিজের মিসেসকে বললেন,

-আরাবকে বোঝাও না কেনো তুমি?

মিসেস ওয়াহিদ টুইঙ্কেলকে বললেন,

-চলো টুইঙ্কেল,মামার কাছে যাই।

-ওকে।

টুইঙ্কেল দৌড়ে চলে গেলো সিড়ি বেয়ে। মিসেস ওয়াহিদ শান্তভাবে বললেন,

-একটা কথা জেনে রাখবেন,আপনার মতো আরাবের উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মন মানসিকতা আমার নেই। জারাকে আমার পছন্দ না,এমন না। কিন্তু আরাবের অপছন্দ হওয়ায় আমি চাইনা জারা আরাবের বউ হয়ে এ বাসায় আসুক। আমাদের ছেলের সারাজীবনের বিষয় এটা। বিজনেসের বাইরে কিছু তো ভাবুন!

মিসেস ওয়াহিদ চলে গেলেন আরাবের রুমের দিকে। বিষয়টা হাতের নাগালে চলে যাচ্ছে এমন ভাবনায় কপালে ভাজ পরলো তৌফিক ওয়াহিদের।

মৃত্তিকাদের বাসা থেকে হাসিমুখে বেরোলো দোয়া। আজকে মৃত্তিকার আম্মু অনেকগুলো কথা শুনিয়েছে ওকে। অবশ্য কারনগুলো ও নিজেই তৈরী করে দিয়েছে। আজ থেকেই টুইঙ্কেলকে পড়াতে যাবে ও। তাই মৃত্তিকার আম্মুকে বলেছে পরের মাস থেকে মৃত্তিকার জন্য নতুন টিউটর খুজতে। এ মাসের বেতনটাও নেবে না ও। ওর মতো সহনশীল টিউটর পাবে না এমনটা বেশ ভালোমতোই জানে মৃত্তিকার আম্মু। প্রথমে ভালোভালো কথায় মানানোর চেষ্টা করেছে দোয়াকে। অতঃপর শুরু তার কটু কথা। দোয়া পড়াতে জানে না,বিহেভ ভালো না,কম পড়ায়,বেতন বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি দোয়া। মৃত্তিকাকে আদর করে বেরিয়ে আসার সময় দরজায় দাড়িয়ে শুধু এটুকো বলেছে,দেয়ালঘড়ির টাইমটা ঠিক করিয়ে নেবেন আন্টি। সবাই তো আর দোয়া না!

দম মেরে দাড়িয়ে ছিলো মহিলা। মুচকি হাসি নিয়ে সিড়িতে আসতেই হৃদস্পন্দন আচমকাই বেড়ে গেলো দোয়ার। ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠেছে। চোখজোড়া নিচদিকে স্থির নেই ওর আজ। বারবার আশেপাশে তাকানোর জন্য বায়না করছে যেনো। দুবার খিচে বন্ধ করেও নিলো চোখ। একসময় ব্যর্থ হয়ে চোরের মতো পাশে,নিচে তারপর উপরে তাকালো। আরাবকে না দেখে জোরে স্বস্তির শ্বাস ফেললো একটা। পরপরই মনে হলো এমন কেনো করছে ও? নিজেকে সামলে পা বাড়ালো টুইঙ্কেলদের বাসার উদ্দেশ্যে।
কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো টুইঙ্কেল। নীল রঙের সুতি ফ্রক পরেছে। মাথায় দুটো ঝুটি করা। ঠোটে মিষ্টি হাসি। দোয়াকে দেখে বলে উঠলো,

-গুড আফটারনুন উইশমাম!

ওর এই উইশমাম ডাকটা বড্ড ভালো লাগে দোয়ার। থুতনি ধরে খানিকটা ঝুকে বললো,

-গুড আফটারনুন টুইঙ্কেল!

ভেতরে ঢুকলো দোয়া। তৌফিকা হাত মুছতে মুছতে বললো,

-দোয়া? এসে গেছো? কেমন আছো বলো?

-এইতো আপু। আলহামদুলিল্লাহ।

-তুমি বসো,আমি আসছি।

মাথা নেড়ে সোফায় বসে গেলো দোয়া। টুইঙ্কেল আগে থেকেই বইখাতা নিয়ে রেখেছে সেন্টার টেবিলে। ওর স্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেখে খুশিমনে পড়াতে শুরু করে দিলো টুইঙ্কেলকে। ফল,বিস্কুট,জুস,নুডুলস্,মিষ্টি ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির তৌফিকা। চোখ কপালে দোয়ার। তৌফিকা আদেশের স্বরে বললো,

-শোনো মেয়ে! আজকে সব খেতে হবে তোমাকে! আগেরদিন কিছুই খাওয়াতে পারিনি!

-ক্ কিন্তু আপু….

-কোনো কিন্তু না! দেখো দোয়া,আমি কিন্তু তোমাকে মেয়ের টিউটর হিসেবে দেখি না। আমার মেয়েকে খুজে দিয়েছো তুমি সেদিন। তুমি না থাকলে হয়তো…তাছাড়া আমাকেও তো আপু বলে ডেকেছো তাইনা?

চোখ ভরে উঠলো দোয়ার। কোনোমতে আটকে দিয়ে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,

-বেশ। তবে এটা শুধু আজই আপু। আমি চাইনা আমাকে নিয়ে আপনার এখানে কোনো অতিরিক্ত আতিথেয়তা হোক। আর পাঁচটা সাধারন টিউটর হিসেবেই আমাকে বিবেচনা করবেন প্লিজ।

দোয়ার স্পষ্টভাষায় মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। টুইঙ্কেলকে পড়ানোর ফাকে ফাকে একটাদুটো কথা বলছিলো দুজনে। আজকে বাসাটা বেশ গোছানো। দোয়ার চোখ আটকালো দেয়ালে থাকা একটা ছবির দিকে। তৌফিকা,মাঝে টুইঙ্কেল সাথে আরেকজন ব্যাক্তি। বুঝতে সময় লাগে নি দোয়ার,ওটা টুইঙ্কেলের বাবা। ওর চোখ অনুসরন করে ছবিটা দেখে তৌফিকা বললো,

-হ্যাঁ,ওটা আমার বর। টুইঙ্কেলের বাবা, ডক্টর সজল ম্….

কলিংবেলের আওয়াজে অপুর্ন রয়ে যায় তৌফিকার কথা। সৌজন্য হেসে উঠে যায় ও। পাশের ফ্লাটের বাসিন্দা এসেছে। দোয়া পড়ানোতে মনোযোগ দিলো। আর কথা হয়নি তৌফিকার সাথে। পড়ানো শেষে চলে আসছিলো দোয়া। তৌফিকা দরজায় দাড়িয়ে ইতস্তত করে বললো,

-দোয়া? এ্ একটা কথা বলবো?

-জ্বী আপু। অবশ্যই। বলুন?

-তুমি কিছু মনে করবে না তো?

-না আপু। বলুন না!

-ত্ তোমার কন্টাক্ট নাম্বার দেওয়া যাবে? জাস্ট খোজখবর নেওয়ার জন্য। আসলে আমার তোমাকে নিয়ে টেনশন হয়। আর আমি…

-জিরো ওয়ান থ্রি ******

পুরো নাম্বারটা বলে দিলো দোয়া। থমকে দাড়িয়ে তৌফিকা। দোয়া মুচকি হেসে বললো,

-আমার আগেরদিনই আপনাকে নাম্বার দেওয়া উচিত ছিলো। সরি ফর দ্যাট!

তৌফিকা হেসে দিলো। দোয়া বললো,

-এটা আমার কাকাবাবুর নাম্বার। আমার কাছে ফোন নেই। তবে ভার্সিটির সময় বাদে কাকাবাবুকে যেকোনো সময় ফোন করলেই আমাকে পাবেন।

ফোন নেই কথাটা কতো হাসিমুখে বলে দিলো দোয়া। মুগ্ধভাবে চেয়ে রইলো তৌফিকা। বললো,

-থ্যাংকস্ দোয়া।

-আসছি।

দোয়া বেরিয়ে গেলো হাসিমুখে। নাম্বারটা সেইভ করে রাখলো তৌফিকা। অরুনাভ মুখার্জীর নাম্বারের বিষয়ে মনে ছিলো না আরাবের। বারবার করে বলে দিয়েছে নাম্বারটা চাইতে। কিন্তু ও আজকে এ বাসায় আসলো না দেখে খানিকটা অবাকই হলো তৌফিকা।

বাগানে বাইক পার্ক করে বিলাসবহুল বাড়িটার দিকে তাকালো আরাব। কোনায় কোনায় মরিচবাতি দিয়ে সাজানো পুরো বাসা। রংধনুর চেয়ে কোনো অংশে কম না জারাদের বাসা। বরং বেশিই। আর এজন্যই ওর বাবা ওকে আর জারাকে নিয়ে আকাশকুসুম ভাবে। তাচ্ছিল্যে হাসলো আরাব। চাবিটা পকেটে পুরে কোটের গুটানো হাতাটা আরেকটু টান মেরে এগোলো ভেতরে।

বাগানের মাঝখানে স্টেজ করা হয়েছে। সেখানেই কেক কাটা হবে। সবাই যার যার মতো আড্ডা দিতে ব্যস্ত। আরাব উকিঝুকি দিয়ে ওর বাবাকে খুজতে লাগলো। কিছুক্ষন আগে তৌফিক ওয়াহিদ ফোন করে জানিয়েছে ওকে আসতে। যেহেতু বিজনেস এখনো ওর নামে,তাই জারার বাবার সাথে করা কোনো ডিলে নাকি ওর উপস্থিতি আবশ্যক। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আসতে বাধ্য হলো ও। এর আগে কোনোদিন এতোটা জোরাজুরি করেনি তৌফিক ওয়াহিদ ওকে। হঠাৎই ওর সামনে উত্তেজিতভাবে এসে দাড়ালো জারা। একপা পিছিয়ে দাড়ালো আরাব। জারার পরনে সাদা ব্যাকলেস গাউন। মাথায় ব্যান্ড পরেছে। খ্রিষ্টান বিয়ের কনের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না ওকে। জারা উৎফুল্লভাবে বললো,

-তুমি এসেছো আরাব?

খানিকটা আশেপাশে তাকিয়ে আরাব শান্তভাবে বললো,

-হুম। হ্যাপি বার্থডে জারা।

-থ্যাংক্….

জারা দুহাত বারিয়ে আরাবকে জরিয়ে ধরতে যাচ্ছিলো। দুপা পিছিয়ে শক্তচোখে তাকালো ওর দিকে আরাব। জারা খানিকটা দমে গেলো ওর চাওনি দেখে। আরাব বললো,

-বাবা কোথায়?

-তৌফিক আঙ্কেল তো ড্যাডের সাথে।

-ওকে থ্যাংকস্।

আরাব ওকে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো। জারা পথ আগলে দিয়ে বললো,

-আমাকে কেমন দেখাচ্ছে আরাব?

-লাইক ফরেইনার।

জারা থেমে গেলো ওর কথায়। বললো,

-আ্ আমি তোমাকে নিয়ে যাই আরাব?

-নো নিড। এন্জয় ইউর মোমেন্ট।

আরাব চলে গেলো। জারার দুটো বান্ধবী এগিয়ে এসে হেসে হেসে বললো,

-কিরে জারা? কার জন্য এতো সাজলি তুই? তোকে তো ঠিকমতো দেখলোও না!

রাগে জামা খামচে ধরলো জারা। চোয়াল শক্ত করে বললো,

-দেখবে দেখবে। ও…আমাকেই দেখবে!

-কিন্তু…

-মম?

জারার মা পাশেই ছিলো। নিজের বান্ধবীদের সাথে সময় কাটাচ্ছিলো সে। তাদেরকে দেখিয়ে হাসিমুখে বললো,

-ওয়েট আ মিনিট বেবি। আসছি। আন্টির সাথে কথা বলছি।

-আই নিড টু টক উইথ ইউ!

-আসছি বেবি। জাস্ট টু মিন্…

-জাস্ট হেয়ার মি আউট ড্যামিট!

জারার চিৎকারে উপস্থিত সবাই খানিকটা থমকে গেছে। স্লো মিউজিক বন্ধ হয়ে গেলো। জারার মা আশেপাশে তাকিয়ে সৌজন্যে হেসে স্বাভাবিক হতে বললেন সবাইকে। তারপর জারার কাছে এসে বিরবিরিয়ে বললো,

-হোয়াটস্ দিজ জারা? এমন বিহেভ করছো কেনো?

জারা অকপট গলায় বললো,

-ড্যাডকে বলো,আমার আর আরাবের এনগেইজমেন্টের এনাউন্সমেন্ট করতে!

-হোয়াট? ক্ কি বলছো তুমি এসব?

-ইয়েস মম। অনেক টলারেট করেছি আরাবের ইগ্নোরেন্স। আর না! ড্যাডকে বলো এবার বার্থডে গিফট হিসেবে আমার আরাব চাই! এন্ড ইটস্ ফাইনাল!

-কিন্তু জারা এভাবে হুট করে…

-দেয়ার ইজ নাথিং লাইক হুট করে। আমার মেয়ে বলে দিয়েছে আজই এনগেইজমেন্ট হবে,তো আজই এনগেইজমেন্ট হবে!

বাবার কথায় বাকা হাসলো জারা। এগিয়ে বাবাকে জরিয়ে ধরে বললো,

-লাভ ইউ ড্যাড! ইউ নো হোয়াট? ইউ আর দ্যা বেস্ট ড্যাড ইন দ্যা ইউনিভার্স!

জারার মা কিঞ্চিত বিস্ময় নিয়ে বললো,

-কি বলছো তুমি? মিস্টার ওয়াহিদ রাজি?

জারার বাবা তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

-তৌফিক? হা হা! ওকেই তো আগে রাজি করিয়ে আসলাম। ওই তো আরাবকে আসতে বলেছে।

-কি বলছো কি তুমি?

-হুম। তৌফিক শুধু টাকা চেনে! টাকা! এখানে যে ডিল করতে এসেছিলো,শুধু বলেছি সেখানে আমি শুধু তখনই ইনভেস্ট করবো যখন আরাবের সাথে জারার এনগেইজমেন্ট হবে। তার আগে না। এন্ড গেইস হোয়াট? হি এগ্রিড! আরাবের সাথে এই নিয়েই কথা বলছে ও।

জারা তো মহাখুশি। বাবার কাছে বরাবরের মতো চাওয়ার সাথে সাথে আরাবকেও পেয়ে যাবে ভেবেই ভেতরে আনন্দঝড় বইছে ওর। একটুপরেই আরাবকে রাগী চেহারায় আসতে দেখলো ওরা। পেছনেই তৌফিক ওয়াহিদ। ওদের আসতে দেখে জারার বাবা বললো,

-ইজ এভরিথিং অলরাইট তৌফিক?

তৌফিক ওয়াহিদ হেসে এগোলেন তার দিকে। বললেন,

-ইয়াহ্! ইউ মে প্রসিড!

হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে আরাব। জারা ওরদিক তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। বেশ বুঝতে পারছে আজকে ওদের আংটিবদল হবেই। ওর বাবা মাইক্রোফোন নিয়ে বলে উঠলো,

-আই হ্যাভ আ এনাউন্সমেন্ট গাইস! এটেনশন প্লিজ!

সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকালো তার দিক। আশপাশটা দেখে হঠাৎই বাকা হাসি ফুটলো আরাবের চেহারায়। পকেটে হাত গুজে দাড়ালো ও। এদিকে ওর চেহারা দেখেই সন্দেহ দানা বাধতে লাগলো জারার মনে। বাবাকে ডেকে আস্তেধীরে বললো,

-ড্যাড? আরাব রাজি তো? কোনো ঝামেলা করবে না তো?

-নো ওয়ে জারা! তৌফিক কনফার্ম করলো তো! ইউ ডোন্ট ওয়ারি!

জারার বাবা আবারো মাইক্রোফোনে বলতে লাগলেন,

-আজকে জারার বার্থডে তে আরো একটা ইভেন্ট আছে আপনাদের জন্য। আমরা ঠিক করেছি যে,জারা আর আরাবের আজই….

-ক্যান্ডেলস্ এ টুয়েন্টি নাইন লেখা কেনো আঙ্কেল?

আরাবের কথায় সবাই ওর দিকে তাকালো। কেকের উপরে থাকা মোমবাতিদুটো তুলে পরখ করতে ব্যস্ত আরাব। সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তৌফিক ওয়াহিদ মুখ খোলার আগেই আরাব টু,সিক্স সংখ্যার আকারের মোমদুটো জারার সামনে ধরে বললো,

-এটা টুয়েন্টি নাইন কেনো জারা?

কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো জারা। ওর মা কড়া গলায় বললো,

-কেমন মানুষ তুমি আরাব? এটুকোও জানো না জারার বিষয়ে? আজকে জারার ছাব্বিশ বছর পুর্ন হলো। তাই এই নাম্বারদুটোকে জ্বালানো হবে। সিক্সকে উল্টো করে নাইন বানিয়ে ধরেছো তুমি!

ঠোট টিপে হাসলো আরাব। এইটাই শুনতে চাইছিলো যেনো ও। তারপর জারাকে বললো,

-তারমানে তোমার বার্থডে নাইন্টিনথ্ নভেম্বর নাইন্টিন্ট নাইন্টি সিক্স?

-আরাব স্টপ ইট।

আরাব বাবার কথায় তারদিকে তাকিয়ে গা ছাড়া ভাবে বললো,

-রিল্যাক্স বাবা। ওর সম্পর্কে এটুকো জানা জরুরি আমার। বলো জারা? তোমার বার্থ ইয়ার তারমানে নাইন্টিন নাইন্টি সিক্স?

জারা অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে বললো,

-হ্যাঁ।

কিছুক্ষন আটকানোর চেষ্টা করে শব্দ করে হেসে দিলো আরাব। সবাই অবাক চোখে ওর হাসিটা দেখে চলেছে। তৌফিক ওয়াহিদ নিজেও কিছুক্ষন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন,

-এসব কি আরাব? এভাবে হাসছো কেনো তুমি?

আরাবের হেরফের নেই। দুহাতে পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে বললো,

-বাবা আগে বলবে তো জারার বার্থ ইয়ার নাইন্টিন নাইন্টি সিক্স! এতোবড় বেয়াদবিটা তাহলে কোনোদিনও করতাম না!

-মানে?

জারার কথায় আরো জোরে হেসে দিলো আরাব। অতিকষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,

-এক্সট্রেমলি সরি। এতোদিন তোমার সাথে,সরি আপনার সাথে এভাবে বেয়াদবি করেছি বলে। আজ থেকে নো বেয়াদবি লাইক দিস।

জারার বাবা দাতে দাত চেপে বললো,

-কি হচ্ছে কি এসব আরাব?

তার কথাকে পাত্তা দিলো না আরাব। বাগানের পাশেই থাকা একটা গাদাফুল ছিড়ে জারার সামনে ধরে বললো,

-সরি বড় আপু! আপনি তো গুনে গুনে চারমাস বারোদিনের সিনিয়র আমার। তৌফিকা আপুকে একদিকে আপু,একদিকে তুই করে বলি। কিন্তু আপনার সাথে তো এতোদিন ভর নাম ধরে ডেকে,তুমি সম্বোধন করে বেয়াদবি করেছি। তার শাস্তিস্বরুপ,আজ থেকে আপনি বলে ডাকবো,বড় আপু বলে ডাকবো। ছোট ভাই ভেবে সমস্ত ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন জারাপু। আসি। শুভ জন্মদিন।

কিছুক্ষন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে হাসিমুখে জারা দিকে তাকিয়ে রইলো আরাব। জারা যেনো পাথর হয়ে আছে। আরেকটা বড়সড় হাসি দিয়ে নখের ডগায় চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে হুইস্টলিং করে ও বাসা থেকে বেরিয়ে এলো ও।

#চলবে…

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৮

-তোমার চেয়ে জারা বয়সে বড় কি করে হয় আরাব?

বাবার উচ্চস্বরে আপেলে কামড় লাগাতে গিয়ে থেমে গেলো আরাব। খাওয়া বাদ দিয়ে ওটা টি টেবিলে রেখে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো ও। টিশার্টটা টেনে ঠিকঠাক করে বাবার চোখের দিকে তাকালো। রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মিসেস ওয়াহিদ। একপলক আরাবের দিকে তাকিয়ে আবার স্বামীর দিকে তাকালেন উনি। তৌফিক ওয়াহিদ রাগে কাপছেন একপ্রকার। মিসেস ওয়াহিদ বললেন,

-কি হয়েছে তৌফিকার বাবা? এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো আপনি?

-সেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করো আজ!

-কি হয়েছে বলবেন তো!

-যেখানে আজ জারার আর ওর এনগেইজমেন্টের বিষয়ে জারার বাবার সাথে কথা হলো আমার,ও ওদের বাসাভর্তি মানুষের সামনে বলে এসেছে জারা নাকি ওর বয়সে বড়!

মিসেস ওয়াহিদ স্বামীর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। আরাব মুচকি হেসে মাকে ইশারায় বুঝালো,চিন্তা করো না,সব ঠিক আছে। একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ছেড়ে ওখান থেকে চলে গেলেন মিসেস ওয়াহিদ। স্বামী কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও আরাবের উপর আস্থা আছে তার। সবদিক সামলে নেবে তার ছেলে। স্ত্রীকে চলে যেতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তৌফিক ওয়াহিদ।কিন্তু আরাব মুখ খুললো এবার। বললো,

-কেনো বাবা? জারার আমার আগে জন্ম নেওয়া বারন? নাকি আমার ওর পরে জন্ম নেওয়া অসম্ভব?

তৌফিক ওয়াহিদ হুংকার ছেড়ে বললেন,

-এনাফ অফ ইউর ননসেন্স! যেসব ফালতু কথা তুমি জারার বার্থডে পার্টিতে বলে এসেছো,এখন আবারো বলে নিজের উপর আয়ত্ব হারাতে আমাকে বাধ্য করো না আরাব!

ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুজে আরো আরাম করে দাড়ালো আরাব। বললো,

-কি কি ফালতু কথা বলে এসেছি আমি বাবা?

-কি কি বলোনি তুমি? এতোটা বাজেভাবে জারাকে অপমাম করে এসে এখনো এতোটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে আছো কিভাবে? ওর বার্থ ইয়ার নাইন্টি সিক্স হলে তুমি কি করে ওর জুনিয়র হও বলতে পারো? হোয়ারএজ,ইউ আর টুইয়েন্টি এইট!

শব্দ করে হেসে দিয়ে বাবাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো আরাব। তৌফিক ওয়াহিদ রাগী আওয়াজেই বললেন,

-আমি তোমার সাথে কথা বলছি আরাব!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাব পিছন ফিরলো। বললো,

-ইউ নো হোয়াট বাবা,তোমার এতো রাগ কেনো হচ্ছে?

-তোমার বাজে বিহেভের জন্য!

-না বাবা,একদমই না! তুমি জানো আমি ঠান্ডা মেজাজের ছেলে। রাগটা সরাসরি দেখাই না কারোর উপর। অপমানের জবাবটা সবসময় মিছরির ছুড়ির মতো ফিরিয়ে দেই। রিয়্যাক্ট করি না। এজন্য তুমিও আমাকে নিয়ে গর্ব করো! আই নো দ্যাট! আমার বিহেভে কোনোদিনও এমন রাগ হবে না তোমার!

চুপ করে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। ব্যবসায়ীক ঝামেলার ভীড়ে নিজের পরিবারকে,আরাবকে মাঝেমধ্যে কেমন যেনো অচেনা লাগে। সেখানে তার মনকে,ভাবনাকে বেশ ভালোমতোই বুঝে নিয়েছে আরাব। আরাবকে সময়টা না দিলেও,ও কখনো তার কথা ভোলেনি। এতোটা জোড় খাটানোর পরও প্রাধান্য দেয় তাকে। বাবাকে চুপ থাকতে দেখে আরাব একপা এগিয়ে বললো,

-শুনতে চাও তোমার রাগ কেনো হচ্ছে বাবা? আ’ল টেল ইউ। তোমার রাগ হচ্ছে এ কারনে নয় যে আমি এসব বলেছি। এনগেইজমেন্টটা হয়নি এ কারনেও নয়। এমনকি তোমার ডিল ক্যান্সেল হয়ে গেছে বলেও তোমার রাগ হচ্ছে না বাবা! তোমার রাগের একমাত্র কারন,তুমি ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলতে পারো নি! ওখানে আমি যখন জারাকে বয়সে বড় বলছিলাম,আমি যে ওর বড় নই,আমার এইজ যে টুয়েন্টি এইট,এই কথাগুলো তুমি তখন বলতে পারোনি! বলতে পারোনি আমি ভুল বলছি! কারন তুমি কনফিউসড্ ছিলে বাবা। আমার এক্সাক্টলি বয়সটা কতো,আমার বার্থ ইয়ার কতো,বয়স নিয়ে আমি মিথ্যা বললেও সত্যিটা কি,এসব তুমি মনে করে উঠতে পারছিলে না! এখন বাসায় ফেরার সময় যখন তোমার অনুভব হয়েছে, নিজের ছেলের বয়স,জন্ম তারিখ,জন্মসাল তোমার তখন মনে পরেনি,এজন্যই এতো রাগ হচ্ছে তোমার! নিজের উপর রাগ হচ্ছে তোমার! শুধুমাত্র এ কারনে! নাথিং এলস্!

হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। আরাব যা যা বললো,অস্বীকার করতে কোনোভাবেই বাধ্য করতে পারছেন উনি নিজেকে। তখন কথাগুলো বলে আরাব থেমেছিলো দুসেকেন্ড জারার সামনে। তৌফিক ওয়াহিদ বলতে চেয়েছিলো আরাব ভুল বলছে,জারা ওর বয়সে বড় না। কিন্তু শুধুমাত্র সঠিকভাবে আরাবের জন্মদিন মনে করতে পারছিলেন না বলেই বলেননি। চোখ ভরে উঠলো তার। ঠিক কোন দুনিয়ায় হারিয়েছেন নিজেকে যে যাদের জন্য সবটা,তাদেরই ভুলতে বসেছেন। বাবাকে দুর্বল হতে দেখেই আরাব গরগর করে বলতে লাগলো,

-জারাপুকে আপু বানানোর কারন এনগেইজমেন্টটা আটকানো। আমি জানতাম ওই সময় সবার মতো তুমিও অধিক শকে পাথর হয়ে যাবে,কিছুই বলবে না! এনিওয়েজ! তোমার এই ডিল ক্যান্সেল হওয়ায় কতোটাকা লস হলো বাবা? আমার বিরুদ্ধে কেসটেস ফাইল করবে না তো আবার এই জন্যে?

-কাল থেকে টেনেহিচড়ে অফিস নিয়ে যাবো তোমাকে!

চড়া গলায় বলে উঠলেন তৌফিক ওয়াহিদ। মোবাইলটা বের করে হনহনিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন উনি। বাবার চলে যাওয়া দেখে ঠোট টিপে হাসলো আরাব। তাকে ওরকম তেজেই মানায়,চুপসানোতে না। তাই ইচ্ছে করেই রাগিয়ে দিলো আবারো। না জানি পরেরদিন নতুন কি কথা তুলে অফিসে নিয়ে যাওয়ার নকশা আকে লোকটা ভেবে একটু হেসে নিলো আরাব।
তারপর এলোমেলো পা ফেলে নিজের রুমে ঢুকলো। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। মনজুড়ে আফসোস,আজ দোয়ার দেখা মেলেনি। কপালের উপর হাত রেখে চোখ সবে বন্ধ করেছে,পরের দু সেকেন্ডেই আবারো চোখ খুলে ফেললো ও। চোখ বন্ধ করতেই ও যেনো স্পষ্ট দেখতে পেলো,মৃত্তিকাদের বাসার সিড়িতে উকিঝুকি দিচ্ছে দোয়া!

“এরকম হলে তো তোর দোয়া লেগে গেছে আরাব! ওই মেয়ে তো তোকেই খুজছিলো! তোকেই দেখতে চাচ্ছিলো! ডুবে ডুবে তোকেই ভালোবাসতে শুরু করেছে আরাব! শি ইজ ইন লাভ উইথ ইউ! তোকে ভালোবাসে!”
শুয়ে থেকেই আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে দুহাত ছড়িয়েছে আরাব। তৎক্ষনাৎ কিছু ভাঙার শব্দ। আচমকা সামলে পাশে তাকাতেই সব আনন্দ মুর্ছা গেলো আরাবের। বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে বসে রইলো দম মেরে। বেডের পাশের টেবিলে থাকা ছোট হার্ট শেইপের কাচের শো পিসটা পরে টুকরোটুকরো হয়ে গেছে। আরাবের মনে হলো,ওর ভাবা কথাগুলোর প্রতিত্তরে ওই শো পিসের প্রতিটা টুকরো যেনো চেচিয়ে বলছে,

“তোর চুরাশি বাই একশো আটাশ বিপিবিশিষ্ট হার্টেরও খুব তাড়াতাড়িই এমন দশা হতে চলেছে সাইকো সাইন্টিস্ট! বেশিই এবড়োথেবড়ো চিন্তা করতে শুরু করেছিস তুই! ও মেয়ে তোর স্বপ্নেই রয়ে যাবে!”

আজকে ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। দুপুরের রান্নাটা সেরে সুইসুতোর গোছা হাতে বারান্দায় আসলো‌ দোয়া। ওর মা গোসলে গেছে। বেরোলে,ও ঢুকবে। বারান্দা থেকে আকাশটা ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। সকাল থেকেই দিনটা মেঘলা। শীতের শুরুর এ সময়টায় অসময়ী বৃষ্টিটা বেশ ভালো একটা সুঘ্রান দিয়ে যায় চারপাশে। তবে সেটা এখন আর ওর কাছে উপভোগ্যের নেই। হাতে সেলাই তুলতে তুলতে বাসার নিচে তাকালো একবার।

সদর দরজার সামনেই এক আট নয় বছরের বাচ্চা মেয়ে দুটো রজনীগন্ধার স্টিক হাতে দাড়িয়ে। বেশভুষায় বোঝা যাচ্ছে,ফুলকুড়োনি। দোয়া রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে দাড়ালো। মেয়েটা এক ভদ্রলোকের কাছে বেশ আকুতিমিনতি করছে। এরইমাঝে গুরুমগুরুম আওয়াজ ডেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। দোয়া ছুট লাগালো ছাদের দিকে। মেলে দেওয়া জামাকাপড় ঘরে আনতে গিয়ে দেখলো তন্নি তৃষাও ছাদের দিকে ছুটছে। বুঝলো, ওরা ভিজবে। মানা করলো না দোয়া। কেনো মানা করবে? বৃষ্টিবিলাস যে জীবনের আনন্দকে সতেজ করে দিয়ে যায়। সে সতেজতার স্পর্শ পাওয়ার অধিকার সবার আছে। যেমনটা ওরও ছিলো। তাই ঠোটে হাসি রেখে কড়া গলায় বললো,

-বেশিক্ষন ভিজবি না তন্নি তৃষা! জ্বর হবে! তখন ক্লাসও মিস পরবে,টিউশনিও! তাড়াতাড়ি চলে আসিস!

তৃষা দোয়ার হাত ধরে আটকে দিয়ে বায়নার স্বরে বললো,

-চলোনা দোয়াপু,আজ একসাথে ভিজি!

তন্নিও বললো,

-হ্যাঁ আপু,আসো? আজকে একটা দিন ভিজি তিনজন একসাথে? দেখবে,সব খারাপ লাগা ধুয়ে যাবে এই বৃষ্টির ফোটাগুলোর সাথে।

কয়েকমুহুর্ত স্থির রইলো দোয়া। তারপর আস্তেকরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-তাড়াতাড়ি আয়।

মাথা নিচু করে মন খারাপ করে পা বাড়ালো তন্নি-তৃষা। ওদেরকে সিড়ি বেয়ে আড়াল হতে দেখলো দোয়া। তাচ্ছিল্যে হেসে জামাগুলো গোছাতে গোছাতে ঘরের দিকে এগোচ্ছিলো। কিন্তু কি মনে করে আরো একবার বাড়ির নিচে উকি দিলো ও।
সেই বাচ্চা মেয়েটা বাসার সামনের স্টলেই দাড়িয়ে। ভিজছে না,তবে মনটা খারাপ করে রেখেছে একদম। আশপাশটা পরখ করার চেষ্টা করলো দোয়া। কেউই নেই তেমন ওখানে। অবস্থার কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। তবুও মেয়েটাকে ওভাবে দেখে স্থির থাকতে পারছে না ও। তাই আর সাতপাচ না ভেবে জামাগুলো ঘরে রেখে দিলো। একটা বড় কাগজ গায়ে জরিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসলো ও। মেয়েটার সামনে দাড়িয়ে বললো,

-কি হয়েছে তোর? বৃষ্টিতে আটকা পরেছিস নাকি?

-উহু।

-তাহলে?

-ইচ্ছা কইরাই এহানে খাড়াইছি।

-কেনো?

-যাওনের জায়গা নাই তাই।

ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো দোয়ার। কোনোমতে বললো,

-যাওয়ার জায়গা নেই মানে? ত্ তোর মা বাবা? পরিবার?

-বাপজানে কামে গেছে। সৎমা কইছে আইজকা আরো পঞ্চাশ টাকা বেশি কামাই না করলে নাকি ঘরে তুলবো না। ছোট বইনটার জামা ছিড়া গেছে। ওর একখান ভালো শীতের জামা কেনোন লাগবো। আইজকার খোটা ফুল বেচছি আগের দামেই। মায়ের ওই পঞ্চাশ টাকা বেশি বেচোনের লাগি ওই বাসা থাইকা দুইটা ফুলও চুরি করছি। হেইডার দাম হইবো বিশ টাকা। তাও কেউ নিলো না! কেউ ওহনো না কিনলে কি আমার দোষ আপা? তুমিই কও? মারে কি কমু? বইনের জামা কোত্তে কিনমু?

তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। এটুকো বয়সে এই বাচ্চা মেয়েটাও অভাবের তাড়না থেকে ছাড় পেলো না। ছলছল চোখ,তবুও ঠোটে হাসি ফুটিয়ে মেয়েটার হাতের স্টিকটা নিয়ে বললো,

-আমি পঞ্চাশ টাকা দেবো এগুলোতে। দিবি?

হাসিমুখে মাথা নাড়লো মেয়েটা। ওই হাসি দেখেই মন ভরে গেছে দোয়ার। পরপরই দমে গেলো ও। মেয়েটা বোনের জন্য জামাও তো কিনতে চেয়েছিলো। একটু মন খারাপ করে হঠাৎই উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো দোয়া। মেয়েটাকে বললো,

-তুই এখানেই থাক! আমি আসছি!

কাগজটা মেয়েটার হাতে গুজে ছাউনির বাইরে বেরোতে যাচ্ছিলো দোয়া। কি মনে করে থেমে গেলো ও। করুনভাবে একটু বৃষ্টির ফোটাগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে পা রাখলো ছাউনির বাইরে। বড়বড় ফোটা গায়ে লাগতেই এক অন্যরকম শিহরন। কতো পুরোনো এক অভিজ্ঞতা! চোখ মেলে উৎফুল্লভাবে দৌড় লাগালো ও। দোয়া দৌড়াচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে,ঠান্ডা বাতাসের বিরুদ্ধে‌ বেরিয়েছে ও। আবারো এতোগুলো দিন পর!

ভিজতে ভিজতে বড় বড় পা ফেলে মুখার্জীবাড়ির পেছনের পুকুরঘাটে এসে দাড়ালো দোয়া। পদ্মফুলের কমতি নেই এ পুকুরে। কেনো থাকবে? অরুনাভ মুখার্জী নিজে এ পুকুরের সবরকম যত্মের দায়িত্বে আছেন যে! পুর্বপুরুষদের প্রতিমা বিসর্জনের এই জায়গার এতোটুকো অযত্ম হতে দেননি উনি। দোয়া ঝাপ দিলো পুকুরে। শব্দ শুনে ছাদ থেকে নিচে তাকালো তন্নি তৃষা। দোয়াকে দেখে পুরোই চমকে গেছে দুজনে। সাতরে দশ বারোটা পদ্ম তুলে নিলো ওখান থেকে দোয়া। তারপর উঠে এসে ওগুলো মেয়েটার হাতে দিয়ে বললো,

-এগুলো দুশোর নিচে বেচবি না বুঝলি? একেকটা বিশ টাকা! অনেক দাম এগুলোর!

-হ্যাঁ,অনেক দাম। আমি তো বলবো,ওগুলো অমুল্য দোয়া। তোমার হাতের স্পর্শ পেয়েছে যে! তোমার ভেজা চুলের সাথে পাপড়ির ছোয়াছুয়ি হয়েছে যে! তোমার শরীরের ঘ্রান নিজেদের মাঝে লুফে নিয়েছে যে! ওরা তো অমুল্য দোয়া! অমুল্য!

মাথার ভেজা চুলগুলো উল্টে দিয়ে বৃষ্টির মাঝেই দাড়িয়ে রইলো আরাব। বাইকটা আজ দুরে পার্ক করে এসেছে ধরা পরার ভয়ে। তবে এখান থেকে ওর কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা দেখতে পারছে,এটাই বা কম কিসে? বাচ্চা মেয়েটার মুখে হাসি ফুটেছে। দোয়াও হাসছে। ওর বৃষ্টিভেজা মুখশ্রীর মায়বী রুপ যেনো আর স্পষ্টতর আজ। কোকড়া চুলগুলো ভিজে খানিকটা সোজা দেখাচ্ছে। কেউকেই গাল,গলায় লেপ্টে আছে। ওর খালি পায়ের তলায় রাস্তায় জমা জলরাশিও আজ চঞ্চল। দোয়ার আনন্দে আজ সতেজ এ বৃষ্টি,সুন্দর এ পদ্ম,সুঘ্রানে ভরপুর…আরাবের চারপাশ।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here