এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ১৫+১৬

0
360

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৫

ব্রেক কষে কোনোমতে গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বড়সর বিপদ থেকে বেচে যায় নিরব। মাঝরাস্তায় ওর গাড়ির সামনে হুট করেই গাড়ি থামিয়েছে জারা। উদ্দেশ্য,আরাব কোথায় গেছে তার খবর নেওয়া। এ সময় ল্যাবে থাকে বলে সবেমাত্র বায়োমেডি গিয়েছিলো ও। নেই আরাব। বেরিয়েছে। আজ বেশ কিছুদিন হলো দেখাই হয়নি ওর আরাবের সাথে। তাই নিরবকেই ধরতে বাধ্য হলো ও। জারা গটগট করে গাড়ি থেকে নেমে এসে নিরবের গাড়ির জানালায় বারি লাগিয়ে বললো,

-গাড়ি থেকে বেরোও! ফাস্ট!

মাথা চেপে ধরলো নিরব। স্যারের এই চিপকানো গার্লফ্রেন্ড,গার্লফ্রেন্ড বললেও তো ভুল হবে। এই ছেচড়া মেয়েটা ওর জন্য চরম বিরক্তির কারন হয়ে উঠেছে ইদানিং। ব্লক থেকে শুরু করে সিম পাল্টেছে পর্যন্ত। লাভ হয়নি। জারা আবারো ওর গাড়ির কাচে আঙুল ঠুকে বললো,

-আরাব কোথায়?

-আমি জানিনা ম্যাম!

কাচ পুরোপুরিভাবে না তুলে বিরক্তিতে বললো নিরব। সত্যিই জানেনা ও আরাব কোথায়। এদিকে নিরবের কথা বলার ভঙিমা দেখে জারার গায়ে আগুন ধরে গেছে। চেচিয়ে বললো,

-তোমার বিরক্তি দেখতে আসিনি নিরব! নাইবা তোমার মিথ্যে শুনতে এসেছি! আরাব কোথায় সেটা বলো,চলে যাচ্ছি!

-আমি সত্যিই জানিনা স্যার কোথায়। বায়োমেডি থেকে দুপুরেই বেরিয়ে গেছেন উনি!

জারা সরে আসলো। গাড়ি সরিয়ে পথ ছেড়ে দিলো নিরবের। এবার সোজা রংধনু,তারপর তৌফিকার নতুন বাসায় যাবে ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিলো ও।
এদিকে রাগে আর ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছে না নিরবের। গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতে এদিক ওদিক পাইচারি করতে লাগলো ও। হঠাৎই একটা কার্ড একেবারে ওর পায়ের কাছে পরলো ওর। লাভ কার্ড। এতোটাই সুন্দর লাগছিলো দেখতে,তোলার জন্য ঝুকলো নিরব।

-ওটা আমার!

কড়াকন্ঠ শুনে মাথা তুলে তাকালো নিরব। আর দুহাতে হাজারটা শপিং ব্যাগ নিয়ে সরু দৃষ্টিতে নিরবের দিকে তাকিয়ে তাজীন। ওগুলো সামলাতে গিয়েই কার্ড পরে গেছে সেটা বুঝলো নিরব। তাজীন শপিংব্যাগগুলো বগলদাবা করে ঝুকলো কার্ডটা তুলবে বলে। তুলতে গিয়ে আরো দুটো ব্যাগ পরে গেলো ওর হাত থেকে। ব্যাগসহ কার্ডটা তুলে তাজীনের হাতে কোনোমতে গুজে দিলো নিরব। তাজীন বললো,

-আমি তুলতে পারতাম! ওগুলো আমার ব্যক্তিগত জিনিস!

-আমি একবারও বলিনি এগুলো আমার।

নিরবের নম্র কথায় মনোক্ষুন্ন হলো তাজীনের। ওভাবে বলতো না ও কথাটা। কিন্তু ও চায়নি কার্ডটায় ও ছাড়া অন্য কারো ছোয়া থাকুক। না হয় মানুষটার সামনেই পরেছে গিয়ে। লাভ কার্ড দেখেও,অন্যের জিনিস ধরতে যাওয়া কোনো সভ্যতার মধ্যে পরে না। এমনটা ধার্য করে লোকটাকে কড়াভাবে বলেছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে নিরব মুচকি হেসে বললো,

-ইটস্ প্রিটি!

মাথা নিচু করে তাজীন বললো,

-থ্যাংকস্। এন্ড আ্ আ’ম সরি।

-সরি ফর হোয়াট?

-মেবি একটু বেশি রুডলি কথা বলে ফেলেছি আপনার সাথে।

নিরব শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,

-ইটস্ ওকে। আই আন্ডারস্ট্যান্ড! পছন্দের মানুষের থেকে পাওয়া বা তার জন্য নেওয়া জিনিসগুলো নিয়ে সেন্সিটিভ হওয়া দোষের কিছু না! সরি বলার প্রয়োজন নেই।

একটু অবাক হয়ে তাকালো তাজীন। পরপর হেসে বললো,

-এতোটাই বোঝেন,গফের রাগ ভাঙাতে পারলেন না?

নিরব বিস্ময়ে তাকালো। তাজীন বললো,

-আপনার গাড়ি আটকে দেওয়া আপুটা দেখতে অনেক কিউট। বেশ মানাবে আপনাদের।

সেকেন্ডদুই আটকে থেকে পেট চেপে ধরে শব্দ করে হেসে দিলো নিরব। ভাবা যায়? এই মেয়ে জারাকে ওর গার্লফ্রেন্ড ভেবেছে! তাজীন কপাল কুচকে তাকিয়ে ওর হাসিটা দেখলো। নিরব বললো,

-আপনার দুরদর্শীতার তারিফ করতে হয় মিস! এনিওয়েজ,আমি আসি। দোয়া করি এই দুরদর্শীতার জন্যই জীবনে যেনো আপনি অনেক ভালো কিছু গেইন করতে পারেন। কার্ড প্রেরক আর প্রাপক,দুজনের জন্যই অল দ্যা বেস্ট! বাই!

হাসতে হাসতে গাড়ি করে চলে গেলো নিরব। কিছুক্ষন ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো তাজীন। লোকটা ওভাবে হাসলো কেনো? ওর তারিফ করলো? নাকি অপমান? সব ভুলে আবারো কার্ডটা দেখে মৃদ্যু হাসলো ও। এটা তো সত্যি,কার্ড প্রাপকের জন্য ও সেন্সিটিভ। অনেকটা সেন্সিটিভ!

সন্ধ্যে পাঁচটা। মৃত্তিকাদের বাসা থেকে বেরিয়ে সিড়িতে উকিঝুকি দিলো দোয়া।আগেরদিন আরাবের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে বসে গেছে ওর। সিড়ির নিচে কাউকে না দেখে একটা ছোট শ্বাস ফেলে যেইনা নিচে নামতে যাবে,উপরের সিড়িতে মুঠো করা পাঁচআঙুল দুবার ছড়িয়ে,বন্ধ করে হাই বুঝালো আরাব। আঙুলে বাইকের চাবি। গায়ে তখনো এপ্রোন ওর। আইডি কার্ডও ঝুলছে গলায়। দোয়া বেশ বুঝলো,ও ল্যাব থেকেই এখানে এসেছে। ওকে রাগী প্রশ্বাস ছাড়তে দেখেই আরাব ইনোসেন্ট হেসে বললো,

-পাঁচতলায় আমার কলিগ আছে। জয়েন্ট থেসিস বলে গ্রুপ স্টাডি করতে এসেছি।

রাগ নিয়ে গটগট করে নেমে আসলো দোয়া। যে করেই হোক,এই লোকের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য কিছু তো একটা করতেই হবে ওকে। ভাবতে ভাবতেই মুখার্জীবাড়ির গলি ছেড়ে খানিকটা অচেনা রাস্তায় পা বাড়ালো ও। ইতস্ততবোধ নিয়ে পাঁচতলা বাসার সামনে দাড়িয়ে উপরে তাকালো। গন্তব্য,দোতালা। মাহিমের আম্মু নতুন স্টুডেন্টের ঠিকানা তো এটাই দিলো। সিড়ি বেয়ে দোতালার ডানদিকের দরজায় থামলো ও। ইউনিট নাম্বার দেখে আরেকবার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে পরখ করে নিলো। এই বাসাই। কাগজটা ব্যাগে পুরে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে কলিংবেলে চাপ দিলো দোয়া। প্রথমবার কলিং বেল বাজানোর পর দরজা না খোলায় অস্বস্তিটা আরো বেড়ে গেলো দোয়ার। দ্বিতীয়বার বেল বাজাবে,তার আগেই দরজা খুলে গেলো। দরজায় তৌফিকাকে দেখে খানিকটা থমকে গেছে দোয়া। তৌফিকা উল্লাসের স্বরে বললো,

-আরে দোয়া? তুমি?

দোয়ার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। মাহিমের আম্মু ঠিকানা দিয়ে বলেছিলো মেয়ে ক্লাস টু,নাম সুপ্তি। সুপ্তি নামটা চেনাচেনা লাগলেও অতোটা গায়ে মাখেনি ও। তাছাড়া তৌফিকাকে তো ঢাকার ভেবেছিলো দোয়া। ওরা যে রায়নগরের হবে,সেটা ভাবতেও পারে নি। ওর হতভম্ব দশা দেখে তৌফিকাও কোনোমতে নিজেকে সামলালো। সেদিন টুইঙ্কেলের আপু ডাক ঘটনার পর শাস্তিস্বরুপ দুদিন আগে রংধনুর একদম পাশের বাসাটা ছাড়িয়ে এই রায়নগরে সেটেল করে দিয়েছে ওদের। মাহিমের আম্মু থেকে টুইঙ্কেলকে পড়ানোর খবর অবদি সবটাই ওরই কাজ! গত তিনদিনে টোটাল বারোজন লোক লাগিয়ে সমস্ত জিনিসপত্রও শিফট করিয়েছে এ বাসায়। হুট করে এভাবে বাসা পাল্টানোর জন্য মা বাবার কাছে কম কথাও শুনতে হয়নি ওকে। নেহাত মুফতাহির সবটা সামলে নিয়েছিলো। দোয়া অস্বস্তি নিয়ে বললো,

-আ্ আসলে আমি…

-কোনো আসলে ভেজালে না! কথাটা হলো আসলে তুমি? সত্যিই তুমি এসেছো আমার বাসায়?

-না আপু আসলে…

-এসো এসো,আগে ভেতরে এসো! তারপর সব কথা!

দোয়ার হাত ধরে ওকে ভেতরে টেনে নিয়ে গেলো তৌফিকা। টুইঙ্কেল এসে ওর সামনে দাড়িয়ে বললো,

-ওয়েলকাম উইশমাম! কি মজা! আজ থেকে উইশমাম প্রতিদিন আমাকে পড়াতে আসবে! কি মজা!

তৌফিকা বললো,

-হ্যাঁ,মাহিম ভাইয়ার আম্মু তোমাকে পড়ানোর জন্য উইশমামের কথাই বলেছে। কতো ভালো হলো বলো? এবার থেকে কিন্তু আর পড়াশোনায় ফাকিবাজি চলবে না টুইঙ্কেল! দোয়া? তুমি বসো! কি খাবে বলো!

দোয়াকে সোফায় বসিয়ে দিলো তৌফিকা। ব্যস্ত হয়ে পরেছে ও। দোয়া বললো,

-আপু,ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। ম্ মাহিমের আম্মু,মানে নুপুর আন্টি কি টুইঙ্কেলকেই পড়ানো বিষয়ে…

-হ্যাঁ হ্যাঁ,এই পটাকাটাকে পড়াতে হবে তোমার! ওওমা দোয়া,আমি ভাবতেও পারিনি আন্টি তোমাকে ঠিক করবে টুইঙ্কেলের জন্য। খুব ভালো হয়েছে!

একটু অবাক হয়ে বসে থেকে হাসিমুখে টুইঙ্কেলের দিকে তাকালো দোয়া। যাকে সেদিন শপিংমলে হারিয়ে যাওয়ার পর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলো,সে মেয়েটাকেই পড়াতে হবে ওকে। তারচেয়ে বড় কথা তৌফিকার ব্যবহার! এমন একজনের বাসায় পড়াতে আসা মানেই ভালোলাগার একাংশ। মুখার্জীবাড়ি থেকে গলির দুটো মোড় নিয়ে পাঁচমিনিটের পথ এ বাসা। সবমিলিয়ে ওর জন্য বেশ ভালো। এখানে টিউশনি করাতে আপত্তির কোনো জায়গা নেই ওর। ওকে চুপ থাকতে দেখে তৌফিকা বললো,

-এনি প্রবলেম দোয়া? টুইঙ্কেলকে পড়াতে তোমার কি কোনো সমস্যা হবে?

-না না আপু। সেটা কখন বললাম? সমস্যা কেনো হবে?

-তারমানে তুমি আসছো তো?

টুইঙ্কেলকে পড়ালে মৃত্তিকাকে আর পড়াতে যেতে হবে না,আরাবের মুখোমুখি হতে হবে না ভেবে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো দোয়া। খুশি হয়ে গেছে তৌফিকাও। দোয়ার হাতে হাত রেখে বললো,

-থ্যা‌ংকস্ দোয়া। তুমি জানোও না কতোবড় উপকার করলে তুমি আমার!

দোয়া অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো শুধু। থ্যাংকস্ আসলে কার প্রাপ্য? তৌফিকা উঠে দাড়িয়ে বললো,

-তুমি বসো,আমি এখনই আসছি।

দোয়াকে বলার সুযোগ দেয়নি তৌফিকা। ছুটে চলে গেলো। টুইঙ্কেল ঠোট কামড়ে ধরে পাজল ঘোরাতে ব্যস্ত। ওর মনোযোগ দেখে হাসলো দোয়া। চোখ বুলালো ড্রয়িংরুমটায়। সবকোনায় আভিজাত্যের ছোয়া। তবুও একটু অগোছালোই বলে মনে হলো ওর কাছে। টুইঙ্কেলকে বললো,

-বাসায় টুইঙ্কেলের সাথে আর কে কে থাকে?

-আমি,আব্বু আর আম্মু!

টুইঙ্কেল ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললো। ওর কথা বলার ধরনটা বেশ সুন্দর। কিছুক্ষন মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থেকে দোয়া আবারো বললো,

-আর কেউই আসে না এ বাসায়?

-আর কে আসে?

থুতনিতে আঙুল রেখে চিন্তিতমুখ বানালো টুইঙ্কেল। বেডরুমের দরজার কাছ থেকে লাজুক ভঙিমায় মাথাটা চুলকালো আরাব। বাইক নিয়ে দোয়ার আগেই এ বাসায় ঢুকেছে ও। দোয়ার কথায় লাজুক চেহারা বানিয়ে বিরবির করে বললো,

-উইশমাম তোমার মামার কথা জিজ্ঞাসা করছে টুইঙ্কেল! কুছ কুছ হোতা হ্যায়! তুম নেহি সামঝোগে!

-ন্ না মানে,অন্য কেউই আসে না এখানে? তোমার টেককেয়ার করার জন্য? বা তোমার আম্মুর হেল্পিং হ্যান্ড?

যেনো বাজপরা শব্দ শুনলো আরাব। ঠায় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়ার কথা শুনে। পাশ থেকে অতিকষ্টে শব্দযুক্ত হাসি আটকে দিয়ে মুখ চেপে ধরে হেসে তৌফিকা বললো,

-লজ্জা পাওয়া অফ দে আরাব! তোর কথা বলেনি! কাজের লোক আসে কিনা এ বাসায়,সেই খোজ নিচ্ছিলো দোয়া। তোর বিষয়ে জানে ও,যে টুইঙ্কেলের কাছে তোর কথা জিজ্ঞাসা করবে?

ঘটনা বুঝে উঠে আহত দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকেই তাকালো আরাব। ওপারে থাকা মানুষটা প্রতিবার এভাবে কি করে ওর আকাঙ্ক্ষাগুলো চুরমার করে দেয় ভেবে মুর্তিমান হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও।

#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৬

তৌফিকা টুইঙ্কেলকে তৈরী করতে ব্যস্ত। গুনগুন করে গানও‌ গাইছে। আজ বেশ খুশি ও। আজ থেকেই দোয়া টুইঙ্কেলকে পড়াতে আসবে বলে কথা! আগেরদিন দোয়া কনফার্ম করে গেছে সবটা। মুফতাহির কোট হাতে ঝুলিয়ে বললো,

-বেরোবো তৌফিকা।

কাধ ধরে শক্তভাবে টুইঙ্কেলকে দাড় করিয়ে চোখ রাঙালো তৌফিকা। ইশারায় বুঝালো,একচুলও নড়বে না তুমি। মাথা এদিকওদিক নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো টুইঙ্কেল। কিন্তু তৌফিকা ওকে ছেড়ে দিতেই চুলের ব্যান্ডটা খুলে দৌড় লাগিয়ে বললো,

-তুমি যাও আব্বুর টাই ঠিক করো! আজকে আমি একাএকাই চুল বাধবো!

রাগ উঠলেও হেসে দিলো তৌফিকা। মেয়েটা আরাবের সাথে থেকে থেকে বেশিই‌‌ চঞ্চল হয়ে গেছে। তারপর এগিয়ে গেলো মুফতাহিরের দিকে। সে দরজার কাছে দাড়িয়ে মোবাইল দেখছে ওর অপেক্ষাতেই,টাই ঠিক করে‌ দেবে বলে। আগে দুজন একসাথে‌ই বেরোতো,এখন রায়নগর আসার পর মুফতাহিরের গাড়ি আগেই চলে আসে। তৌফিকা বাবার গাড়িতে আগে রংধনু,তারপর হসপিটালে যায়। মুফতাহিরের টাইটা ঠিক করে তৌফিকা আদুরে গলায় বললো,

-টুইঙ্কেলের জন্য এক ম্যাম রেখেছি।

-ওয়াও!

-আজ বিকেল থেকেই পড়াতে আসবে।

-গ্রেট!

তৌফিকা মুফতাহিরের কাধের উপর দিয়ে হাত রেখে বললো,

-বাসা চেইন্জ করেছি বলে কি জনাবের রাগ হয়েছে কোনোমতে?

-এবসুলিউটলি নট। আমি জানি,তৌফিকার ডিসিশন অলওয়েজ পারফেক্ট।

মোবাইলে দৃষ্টি রেখে বললো মুফতাহির। কথাটা তো মন ভরার মতোই ছিলো,কিন্তু মুফতাহিরের অন্যমনস্ক থাকাটায় একটু খারাপ লাগলো তৌফিকার। একটু সরে এসে বললো,

-এপ্রোন নিলে না যে!

-অফিস যাবো! তোমার বাবা…

অফিস যাবে শুনেই মন পুরোটাই বিগড়ে গেলো তৌফিকার। বললো,

-কেনো মুফতাহির? অফিস কেনো যাবে তুমি?

-তৌফিকা ওখানে আজ কিছু মিটিংস্…

-তুমি কোনো অফিসের স্টাফ নও মুফতাহির! যে তোমাকে সব মিটিং এটেন্ড করতে হবে। আমাকে বিয়ে করার সাথে সাথে তৌফিক ওয়াহিদের বিজনেস সামলানোর গুরুভারও নিয়ে নাও নি তুমি! নিজের প্যাশনকে ছেড়ে কেনো বাবার বিজনেসে এতো সময় দিচ্ছো বলোতো? লোকজন এখন তোমাকে ডক্টর মুফতাহির কম,তৌফিক ওয়াহিদের হেল্পিং হ্যান্ড আর উডবি বিজনেস হোল্ডার হিসেবে বেশি চেনে মুফতাহির! কিন্তু তুমি তো তা নও! তুমি তা নও মুফতাহির!

একশ্বাসে রাগী আওয়াজে বললো তৌফিকা। মোবাইল ছেড়ে ওর দিকে তাকালো মুফতাহির। ওর অফিস যাওয়াটা বরাবরই তৌফিকার পছন্দ না। কিন্তু ওর বাবাও এখন এমন হয়েছেন,ওকে ছাড়া তার বেশিরভাগই যেনো অচল। নিজের বলা কথাগুলো আর ভঙিমা মনে পরতেই নিজের উপর রাগ হলো তৌফিকার। চোখ বন্ধ করে একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,

-আ’ম সরি,স্ সরি মুফতাহির! আমি…আমি ওভাবে…

মোবাইল পকেটে পুরে ওর দুগাল ধরলো মুফতাহির। মৃদ্যু হাসি রেখে বললো,

-রিল্যাক্স। নো নিড টু সে সরি। ভুল কিছু বলোনি তুমি।

অসহায়ভাবে তাকালো তৌফিকা। মুফতাহির বললো,

-সি,আমি কেউ নই বাবার বিজনেস ওয়ার্ল্ডে। স্টাফ নই,তোমাকে বিয়ে করে তার বিজনেস সামলানোর গুরুভারও নিয়ে নেইনি। বাট…

-মুফতাহির প্লিজ। আ’ম সরি। আমি ওভাবে কিছু মিন করতে চাইনি। আমি তো…

-লেট মি কমপ্লিট তৌফিকা। আমি জানি তুমি কি মিন করেছো। বাট আই শুড হ্যাভ ক্লিয়ারেন্স! তোমার কাছে তো অবশ্যই! তোমার বাবার বয়স হয়েছে। উনি এতোদিক সামলাতে হিমশিম খাবেন,এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় তৌফিকা। কিন্তু তোমার ভাই,আরাবের অফিসিয়াল বিষয়ে এতোটা গা ছাড়া ভাব,ইটস্ এবনর্মাল! এখন ওর উচিত,বাবাকে সঙ্গ দেওয়া। বায়োমেডি ছেড়ে বাবার বিজনেসে সময় দেওয়া। নয় কি বলো?

একটু চুপ থেকে তৌফিকা বললো,

-হ্যাঁ। কিন্তু তা বলে ও ওর ড্রিমজব ছেড়ে দেবে? এটা কেমন কথা? বাবা এমনটাই চায়!

-সেটা আমি চাইনা তৌফিকা। আরাবের এখনো পুরো লাইফ পরে আছে। তাইতো ওকে জোর করার কোনো কারন নেই। ওর যখন অনুভব হবে ওর বিজনেসে জয়েন করা উচিত,তখনই না হয় জয়েন করবে। এতে কোনো সমস্যাই নেই।

তৌফিকা চুপ করে রইলো। মুফতাহির আবারো বললো,

-তাছাড়া এমন তো নয় যে অফিসে জয়েন করলে ওকে একেবারে বায়োমেডি ছাড়তে হবে! ও না হয় দুটোই কন্টিনিউ করলো। নিজের টাইম আর প্রায়োরিটি বিবেচনায় রেখে।কিন্তু তৌফিকা, টিল দেন,এই এতোবড় ব্যবসাটাকে তো দাড় করিয়ে রাখতে হবে তাইনা? বাবার মেয়ে হয়ে এ দায়িত্বটা কি তোমার নয়? আর তোমার কর্তব্যগুলো কি আমার নয় তৌফিকা?

তৃপ্ত হাসিতে মাথা নাড়লো তৌফিকা। বললো,

-আ’ম সরি মুফতাহির।

মুফতাহির হেসে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো ওকে। বললো,

-বউ আমার এখনো বেশ ইমম্যাচিউর। যাইহোক,আপনি যে বললেন হেল্পিং হ্যান্ড? হ্যাঁ,ওটাই আমার পরিচয়। আপাতত ওই পরিচয়ের দায় কাটাতেই অফিসের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করি? আপনার কি মত?

তৌফিকা ওর বুকে আস্তেকরে কিল বসিয়ে হেসে বললো,

-এসো।

তৌফিকাকে ছেড়ে কোটটা পরে লম্বালম্বা পা ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো মুফতাহির। মুগ্ধভাবে ওর প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলো তৌফিকা।

বেশ রোদ পরেছে আজ। ওড়নায় কপাল আর গলার ঘাম মুছে একবার উজ্জল আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারো হাটা লাগালো দোয়া।লাইব্রেরিতে এক্সট্রা কিছু নোটস্ নিতে গিয়ে ভার্সিটির বাস মিস করেছে ও। একদম ভার্রিটির গেইট থেকে জ্যামের কারনে ভাড়া বেশি নেয়। তাই ভেবেছে ওটুক হেটে খানিকটা এগিয়ে এসে রিকশায় করে চলে যাবে না হয়। কিন্তু আপাতত খালি রিকশা পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পরেছে যেনো। সবগুলো যেদিক থেকেই আসছে,যাত্রীসহ। বেশ অনেকটা দুর আসার পর একটা খালি রিকশা চোখে পরলো ওর। হাক ছাড়লো,

-ও মামা!

-খালি!

পাশে তাকালো দোয়া। প্যান্ট শার্ট,মাস্ক পরিহিত এক লোক। অফ হোয়াইট শার্টের কনুই অবদি হাতা গুটানো,হাতে বেশ দামি ঘড়িও আছে। একসাথে দুজনেই এক রিকশাকে ডাক লাগিয়েছে। অবয়বটা চেনা লাগলেও চোখ নামিয়ে হাটা লাগালো ও। যাবে না ও রিকশায়। হচকিয়ে গেলো আরাব। বাইকটা মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে যাওয়ায় ঠেলেঠুলে ছায়ায় এনে দাড়িয়ে রিকশা খুজছিলো ওউ। দোয়াকে আসতে দেখে খুশি হয়ে যায় প্রচন্ড। বুঝলো ওউ রিকশা খুজছে। ইচ্ছে করেই তাই ডাক লাগিয়েছে। ভেবেছিলো দোয়া কিছু তো বলবে ওকে। কিন্তু চুপচাপ চলে যাওয়াটা ভালো লাগলো না ওর। পেছন থেকে বললো,

-আপনি চলে যেতে পারেন রিকশায়।

দোয়া কিঞ্চিত বিস্ময়ে দাড়ালো। গলাটাও চেনাচেনা। রিকশাওয়ালা কাছে এসে পরেছে ততোক্ষনে। দোয়া বললো,

-স্ সমস্যা নেই। আপনি চলে যান,আমি…

আরাব ওর বাইকটা দেখিয়ে বললো,

-আমি বাইক নিয়ে চলে যাবো,ডোন্ট ওয়ারি।

বাইকটা দেখে রাগ হলো দোয়ার। বাইকের মালিক,শুধুশুধু রিকশা কেনো ডাকলো? রিকশাওয়ালা বললো,

-কেডা যাইবেন? কই যাইবেন?

আরাব দোয়াকে দেখিয়ে বললো,

-উনিই যাবেন মামা।

রিকশাওয়ালা দোয়াকে বললো,

-ওঠো। কই যাইবা?

দোয়া আরাবের বাইকটার দিকে তাকিয়ে। কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। একবার মনে হলো,আরাবের মতোই দেখাচ্ছে অনেকটা। কিন্তু এই বাইকটাই যতো কনফিউশন তৈরী করে দিয়েছে। এমন বাইক না আরাবের। কিন্তু আরো বাইক থাকতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে দোয়া বাইকের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-রায়নগর মুখার্জীবাড়ি।

-ওঠো তাইলে।

-কতো?

-যেইডা ভাড়া,হেইডাই দিও। ওঠো!

-ওখানে পৌছানোর পর কিছুকিছু মামার ভাড়া আর আমার প্রতিদিনের ভাড়ায় অনেক তফাৎ পরে যায়। তাই এখান থেকে আপনার ভাড়াটা জেনেশুনে যাওয়াই ভালো।

আগ্রহ নিয়ে বুকে হাত গুজে দাড়ালো আরাব। বেশ লাগছে ওর দোয়ার কথাগুলো। রিকশাওয়ালা বললো,

-ওইতো,ভাড়া তো বিশ টাকা কইরা।

-এইতো দেখেছেন,ভার্সিটি থেকে রায়নগর পচিশ টাকা ভাড়া। সেখানে জ্যামের রাস্তাটুকো পেরিয়েই এসেছি আমি। সে হিসেবে এখান থেকে ভাড়াটা হয় পনেরো টাকা। আর আপনি বিশ টাকা চাইছেন? তাও ভালো রিকশায় ওঠার আগেই জিজ্ঞাসা করেছি আপনাকে। নয়তো কে জানে,যদি আপনি নামিয়ে দিয়ে পচিশ টাকাই চেয়ে বসতেন?

-না মামা,এইখান থাইকা ভাড়া বিশ টাকাই। আর তোমার জন্যই ওই মামা যাইবো না। হেয় গেলে ঠিক ভাড়াটাই দিতো।

দোয়া একবার আরাব,একবার বাইকের দিকে তাকালো। রিকশাচালায় বলে কি বাইক চোখে পরছে না এনার কে জানে। এখানে ইনি ছিলো বলেই রিকশাওয়ালা ওর কাছে ভাড়া বেশি চাইলো। রাগ প্রকাশ না করে সুন্দরমতো হেসে বললো,

-বেশ! আপনি তবে ওনাকেই নিয়ে যান। আমি বরং আরেকটু এগিয়ে যাই। দেখি ঠিক কোথা থেকে ভাড়াটা পনেরো।

তারপর আরাবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আর আপনি! বাইক ছেড়ে রিকশা ডেকেছেন না? রিকশা করেই চলে যান এবার কেমন?

হাটা লাগালো দোয়া। এতোক্ষন শুধু আগ্রহ ভরে দেখছিলো আরাব। দোয়াকে চলে যেতে‌ দেখে হাসলো ও। পাঁচ টাকার জন্য রিকশাটা ছেড়ে দিলো এই মেয়েটা। পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দশটাকার নোটটা রিকশাওয়ালার দিকে বারিয়ে দিয়ে বললো,

-এখান থেকে পাঁচ টাকা রাখুন আর ওনাকে পনেরো টাকা ভাড়া দিয়েই বাসায় পৌছে দিন।

ভ্রুকুচকে তাকিয়ে রইলো রিকশাওয়ালা। ভেবেছিলো আরাব দোয়ার প্রেমিকটেমিক হবে। বেশি চাইলেও পুরো ভাড়াটাই দিয়ে দেবে। এ তো পুরোটা না দিয়ে দশটাকা ধরিয়ে দিচ্ছে! তার উপর পাঁচটাকা রাখতে বলছে। পকেট থেকে হতভম্বের মতো পাঁচ টাকার কয়েন বের করে আরাবকে দিলো রিকশাওয়ালা। আরাব অদ্ভুতভাবে হেসে কয়েনটা নখের ডগায় নিয়ে টসের মতো ছুড়ে মেরে বললো,

-এতো বেশি ভাবতে নেই মামা। আমি এখনো অবদি ওর কিছু হই না। এখন আমি আপনাকে এক্সট্রা টাকা দিয়ে দেই,আপনি রিকশা চালাতে চালাতে ম্যাডামের সাথে আড্ডা জুড়ে দিয়ে বলে দেবেন,ছেলেটা কি তোমার প্রেমিক? তখন আমার দুইতরফা প্রেম শুরুর আগেই ধুলিস্মাৎ! ওইসব ফাদে আমি পরছি না! আমার জন্যই পাঁচটাকা বেশি চাইলেন না আপনি? ওটা তাই আমিই দিয়ে দিলাম। যান! মেয়েটাকে বাসায় দিয়ে আসেন,আপনার ন্যায্য ভাড়ায়।

কিছু না বুঝে রিকশা নিয়ে দোয়ার দিকে চলে গেলো লোকটা। খানিকটা দুরে দোয়াকে ওই রিকশাতেই উঠতে দেখে হাসলো আরাব। বাইকের দিকে তাকিয়ে বললো,

-থ্যাংকস্ ব্রো,নষ্ট হওয়ার জন্য। দোয়ার দেখা পেলাম। থ্যাংকস্,আজকে তোর উপর নজর আটকানোর জন্য। নইলে আগের বাইকটা দেখলে দোয়া চিনে ফেলতো। হেই! তাহলে তো এবার তোর মাঝেও কিছু নতুনত্ব দরকার!

কথা শেষ করেই আরাব হাতের কয়েনটা দিয়ে বাইকে দুটো স্ক্র্যাচ বসিয়ে দিলো। পেইন্ট ডিজাইনে যদি কিছু চেন্জ করানো যায় এতে। কয়েন বুকপকেটে পুরে পরেরবার যেইনা বাইক ধরতে যাবে,আচমকাই মাটিতে পরে গেলো ওটা। অসহায়ভাবে বাইকটার দিকে তাকালো আরাব। বেচারা যেনো চেচিয়ে বলছে,

“খবরদার‌ ব্রো ডাকবি না আমাকে! খবরদার আমাকে ছুবি না তুই! আমার মতো জড় পদার্থকেও ছাড় দিলি না প্রেমে পরে অপদার্থ হয়ে যাওয়া সাইন্টিস্ট? এটা বল! যার জন্য এতো করছিস,সে কবে বুঝবে তোকে? কবে???”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here