একটা সাধারণ গল্প,পর্ব:৩

0
389

#একটা_সাধারণ_গল্প
#পর্ব_তিন
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী

-হ‍্যাঁ স‍্যার ডিমকি লেকে নিয়ে চলুন।
উৎসাহ নিয়ে বললো শুভদ।
-না স‍্যার বিভান পাহাড়ে চলুন।
আরো দুজন প্রস্তাব রাখলো।

-ধুর পিকনিক টিকনিক কিছু হবে না। তোরা প্রথমে বলিস,পরে কেউ যাসনা। সুতরাং আমি কোন প্ল্যান করছি না।
গোঁ ধরে বসলেন রথীন স‍্যার।

-না স‍্যার আপনাকে পিকনিকের প্ল‍্যান করতেই হবে। আমরা যাব যাব।
সমবেতভাবে বলে উঠল ছাত্রছাত্রীরা। ওদের মধ্যে পর্ণার আওয়াজটা ছিল কানে লাগার মতন।

-ঠিক আছে স্যার আপনি শুধুমাত্র রাজি হন, বাকি ব্যবস্থা আমরা ছেলেরা মিলে করে দেবো।আপনি শুধুমাত্র হিসাব রাখলেই হল।
শুভদ প্রস্তাব রাখলো।

-বাহ!শুভদ এই ব্যাপারে তোর কত ইন্টারেস্ট। পড়াশোনার ব্যাপারে তো লবডঙ্কা।পড়াশোনায় নূন্যতম আগ্রহ প্রকাশ করলে আমি ধন্য হতাম।
সুযোগ পেয়ে ঠুকে দিল রথীন স‍্যার।

আজ দমে গেল না শুভ। ররঞ্চ দ্বিগুন উৎসাহের সাথে বত্রিশ পাটি খুলে বলল,
-আরে স‍্যার জায়গাটা আগে ঠিক করুন।

-ঠিক আছে কতজন যাবি আগে ঠিক কর।
আছিস তো তেরো জন তারমধ‍্যেও হয়তো সাতজন যাবে না।
তোরাই বল তখন ছয়জনে কোথায় যাবো?
-না না আমরা যাবো।
আবারো সমবেত স্বর শোনা গেল।
-আমি আর মহিম যাব। আমার মনে হয় পর্ণশ্রী আর মাম্পিও যাবে।কি রে মাম্পি তাই তো!

উদ্দেশ্য মাম্পি থাকলেও পর্ণার অভিমুখে তাকিয়ে বললো শুভ।
-স‍্যার আমাদের সাথে যদি কেউ যেতে চায়,মানে অন‍্য কোনো বন্ধু তাহলে যেতে পারবে?
একটা অনিশ্চয়তা নিয়েই প্রশ্ন করল পর্ণা।

-আরে অবশ্যই পারবি তবেই তো মেম্বার বাড়বে।
তোরা বাড়ির মেম্বারদের নিয়ে যেতে পারিস।
-আমার এক বন্ধু যাবে।
ম্লান হেসে বললো পর্ণা।
-স‍্যার এবার জায়গাটা ঠিক করুন।
-হ‍্যাঁ সেটাই আগে ফাইনাল করি। পার হেড কত পড়বে সেটা হিসেব করতে হবে।

দশদিন পর:
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলো শুভ।
টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিল।
সবে তিনটা বেজে দশ।
ওর তো পাঁচটা ওঠার কথা।আবার চোখ বুজলো ও। সহজে দুচোখে ঘুম নামছে কই!সেই সপ্তদশীর প্রতিবিম্ব চোখে নাচানাচি করছে।
আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা।তারপরই অনেকটা সময় কাছে পাবে ওকে। ওর সান্নিধ্যে থাকতে পারবে। সম্পূর্ণ রূপে না হলেও কাছাকাছি তো বটেই। এই ট্রিপটা ওর কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পর্ণাকে স্মরণ করতে করতে চোখ লেগে গিয়েছিল শুভর। ঘুম ভাঙলো এলার্মের কর্কশ শব্দে।
সর্বনাশ! এত পড়তে যাওয়ার এলার্ম। পাঁচটার অ‍্যর্লাম বাজেনি কেন!
একঘণ্টা লেটে উঠেছে ও। মহিম ডাকতে এল বলে!
পৌষমাসের কোনো শীতলতা ওকে আজ কাবু করতে পারল না।একঝটকায় গায়ের লেপটা খুলে বাথরুমে ছুটল। ওখান সেই মহিমের কন্ঠস্বর শুনতে পেল ও।
মহিমের দাবড়ানি, ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার জন‍্য মায়ের ধমকানি শুনে যখন রথীন স‍্যারের ঘরের দিকে রওনা দিল তখন সময় প্রায় সাড়ে ছয়টা।
মৌনতা অবলম্বন করে বিক্ষিপ্ত মনে সাইকেল চালাচ্ছে শুভ।
সময়ের অভাবে ওর সাজটাই সম্পূর্ণ হল না। চুলে জেল লাগিয়ে স্পাইক করা হল না।ওদিকে মহিম আজ ফুলবাবু সেজে এসেছেন। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো,চোখে সানগ্লাস।ঠান্ডায় কাঁপলেও শরীর থেকে মাফলার উধাও।
রথীন স‍্যারের ঘরে সাইকেল রাখলো শুভ।সেখানে রাখা আরো সাইকেলের মধ‍্যে পর্ণার লেডি বার্ডটা অনুপস্থিত।একটা সংশয় ঘিরে ধরলো ওকে।
পর্ণা আসবে তো!

সাইকেল লক করে ওখানেই দাঁড়িয়েছিল শুভ।
-কিরে কার অপেক্ষা করছিস?সবাই বাসে চেপে গেছে,শুধু তুই নিচে।
সামনে কয়েক পা অগ্রসর হয়েছিল মহিম।পাশে শুভর অনুপস্থিতি দেখে চিৎকার করলো ও।

-শুভদ গাড়িতে ওঠ।কত দেরী করলি তুই।তোকে ছয়টার মধ‍্যে আসতে বল্লাম..
-এলার্মটা সমস্যায় ফেললো। সব হয়ে গেছে স‍্যার?
-এখনো মাংস আসতে বাকি।
-কোথায় মাংস আনতে হবে,গলির দোকানে?
-হ‍্যাঁ রে।
-দেন আমি নিয়ে আসছি।
-এতটা মাংস তুই গুছিয়ে আনতে পারবি।বড় কাউকে পাঠাবো।
-পারবো,মহিমকে নিয়ে আমি যাচ্ছি।টাকাটা বের করুন।
আমি বাসে জায়গা রেখে আসছি।

রথীন স‍্যারে এলেভান-টুয়েলেভ,অর্নাসের সব স্টুন্ডেন্ট কাঁটছাট করেও বাহান্ন জন হয়ে গেল। সেই কারণে
বড় টুরিস্ট বাস করতে হয়েছে।

বাসে উঠেই শুভদের দুচোখ পর্ণাকেই খুঁজছে।
তিনসিটার সিটে আবিস্কার করে ওদের।
উইন্ডো সাইডে একটা ছেলে বসে তারপরে পর্ণা শেষে মাম্পি।
চুল গুলোকে উঁচু করে পরে করে বেঁধেছে,চোখ ঢেকেছে গাঢ় কালো রঙে। ঠোঁটেও আছে বেগুনি প্রলেপ।
এমন সেজে কখনো দেখেনি পর্ণাকে,মানে এই একমাসে আর কি!
সারাবেলা এই প্রতিমাকে দর্শন করে যে ওর দিন কাটবে ভেবে শিহরিত হল শুভ।

-তোরা এখানে বসেছিস কেন, দাঁড়া আমি টুসিটার অরেঞ্জ করে দিচ্ছি।
গদগদ হয়ে বলল শুভ।
-শুভদ ও আমার বন্ধু নিলয়। আমি তিনজন বসার জন্য ইচ্ছা করে এই সিট পছন্দ করেছি।
সজোরে হোঁচট খেলে শুভ। না না পায়ে নয় মনে।
অসহায় দৃষ্টিতে মাম্পির দিকে তাকাতেই চোখ টিপল মাম্পি।
এই তাহলে নিলয়,পর্ণার লাভার।
মাম্পির মুখ থেকে নিলয়ের কথা শুনলেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
এমনি কি পর্ণার পিছু নেওয়ার সময় দেখতেও পাইনি।
পর্ণার কোনো লাভার নেই ভেবে একরকম নিশ্চিত ছিল ও।

হঠাৎ আগত দমকা হাওয়ায় সদ‍্য প্রস্ফটিত প্রেমের কুড়ি মুষড়ে গেল শুভদের। চারিদিকে হৈ হল্লা কিছুই যেন ভালো লাগছে না আর। পালতে চাই,এই কলরব ছেড়ে পালাতে চাই ও।
পিঠের ব‍্যাগটাকে নিয়ে নেমে পড়লো ও। ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল নিজ বাহনের অভিমুখে।

-এই শুভদ,টাকা আর ব‍্যাগটা নিয়ে যা।
একটা ঘোরের মধ্যে ছিল ও।রথীন স‍্যারের কন্ঠে সম্বিৎ ফিরল।
-কিরে তোকে তখন থেকে ডাকছি আসছিলিস না কেন,এদিকে তো সব সিট ভর্তি হয়েছে। আমাদের সেই শেষে বসতে হল।সব তোর জন্য হল।
মহিমের কথার প্রত‍্যুত্তরে কোনো জবাব দিল না।
রথীন স্যারের কাছ থেকে টাকা ব্যাগ নিয়ে সাইকেল চালিয়ে একাই চলে গেল মাংস আনতে।

ফুরফুরে মেজাজের ছেলেটার মুহূর্তে মুড পরিবর্তনের কারণ আন্দাজ করার চেষ্টা করলো মহিম।

-পর্ণার পাশে কে বসে আছে, ওর লাভার?
-মহিম ছাড় না ঐ সব কথা।ভালো লাগে না..
-তোকে মনমরা হতে দেখতে আমার ভালো লাগেনা।
মৌনতা পালন করলো দুইপক্ষই।

বাসের মধ‍্যে গান শুরু হল।যে যার সিট থেকে উঠে ওখানেই নাচতে শুরু করলো।
পর্ণাকেও উঠতে দেখল শুভদ। ও নাচার জন‍্য টেনে তুলল নিলয়কে..

পর্ণার খুশি খুশি মুখটার দিকেই নজর আটকে যাচ্ছে শুভদের।
-জানিস মহিম আমি ভুল ছিলাম। মুখে এতদিন বললেও আমি কখনো সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তি হতে চাই না। ভালো থাক ওরা।
-তুই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস,তাই তুই কষ্টটা পাচ্ছিস।
-আমি যদি নিলয়ের সম্পর্কে নিশ্চিত হতাম তাহলে পিকনিকে আসতাম না রে।
-ঐ দুইদিনের পর্ণা কি তোর কাছে সব হল,বন্ধুদের কোনো দাম নেই তোর কাছে।ওখানে গিয়ে আমরা খুব মজা করব।পকেটে সিগারেট আছে।
মুচকি হাসলো মহিম।

জোর করে চোয়াল খুলল শুভ।তবুও চোখদুখানি বেঈমানি করল।নিজেকে লোকাতে মহিতের কাঁধে মুখ গুঁজলো শুভ।

ঘন্টা দুই পর বাস থামলো ডিমকি লেকে।
সবাই বাস থেকে নেমে গেলেও ধীরে নামল শুভদ।পাশে অবশ্যই মহিম।
-শুভদ তুই কোথায় ছিলিস রে,তোকে দেখতে পাইনি।
শুভদদের সামনে হঠাৎ আবির্ভাব হল পর্ণশ্রী।ওর দুই গজদন্ত আবারো ঝড় তুলল শুভদের অন্তরে।
-না আমি পিছনে ছিলাম..
দায়সারা ভাবে উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল শুভদ।

শুভদের এমন ব‍্যবহারে অবাক হল পর্ণা।বলা ভালো একটু ক্ষুন্ন হলো। এই ব‍্যবহারে ও অভ‍্যস্ত নয়।

পিকনিকের জায়গা নির্ধারন করে বড় চট পেতে বসলো সবাই।
রাঁধুনীরা ততক্ষণে লুচি ভাজতে শুরু করেছে।
মিনিট দশের মধ্যেই গরম গরম লুচি,সাদা আলুর তরকারি ও নলেন গুড়ের রসোগোল্লা পাতে পড়লো।
পর্ণার থেকে অনেকটা তফাতে বসেও শুভদ ওকে নজরবন্দী করে রেখেছে।
নীলয়-পর্ণা এক সাথে খেতে বসলেও হঠাৎ উঠে দ্রুতপায়ে বাসের দিকে গেল নিলয়।
পর্ণাও খাবার ফেলে ছুটল নিলয়ের অভিমুখে।

দৃশ‍্যটা দেখে ভ্রু দুখানি নিকটবর্তী হল শুভদ ঘোষের।

চলবে:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here