#উত্তরণ
পর্ব_৫০
লখনৌ এর এই নামজাদা বেসরকারি হসপিটাল আজ নিশ্ছিদ্র সুরক্ষায় মোড়া. যে ফ্লোরে উজানের অপারেশন হচ্ছে সেই ফ্লোরে হসপিটালের প্রয়োজনীয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য একটি প্রাণীরও প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ. হসপিটালের ডিরেক্টর ডাক্তার হওয়ায় তিনিও অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছে গেছেন.
সমরেশ বাসবীকে সামলাতে ব্যস্ত তো অন্য দিকে হিয়া গায়েত্রী দেবীকে. সমরেশ এতদিন জীবন-মৃত্যুর মাঝে থেকে জীবন অতিবাহিত করেছে কিন্তু নিজের আত্মজর এই অবস্থা তার মেরুদণ্ডের দৃঢ়তার পতন ঘটিয়েছে অনেক আগেই. হিয়া ভিতরে ভিতরে প্রত্যেক মুহূর্তে কণায় কণায় ভাঙছে, কিন্তু ওই যে ও কথা দিয়েছিলো ওর উজান স্যারকে যে সবাইকে দেখবে, তাই বোধহয় ওর অন্তরের অবস্থার প্রতিফলন ওর চেহারায় যাতে না পড়ে তার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে۔۔
উজানের ক্ষত গভীর না হলেও বেশ গুরুতর ছিলো. অনেকটা সময় অতিবাহিত হয় অপারেশন টেবিলে. শেষ পর্যন্ত সবটা ঠিক হয়ে অপারেশন থিয়েটারের লাল আলো নিভতে প্রায় ঘন্টা পাঁচেক সময় লাগে. বাইরে সবাই এতক্ষন শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করছিলো. উজানকে ICU স্পেশাল কেবিনে দেওয়া হয়. জ্ঞান ফিরতে এখনো ঘন্টা দুয়েক লাগবে. একজন নার্সকে নির্দিষ্ট ভাবে উজানের কেবিনে দেওয়া হয়, সে প্রতি মুহূর্তে উজানের অবস্থার পর্যবেক্ষণ করে চলেছে. ভয়ের কিছু নেই বলেই জানিয়েছেন সার্জেন. সার্জেনের কথায় দুশ্চিন্তা কিছুটা কাটলেও উজানের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারছেনা কেউই۔۔
উজানের জ্ঞান সময়ের একটু আগেই ফেরে. চোখ খুলে তাকাতেই সামনে বাসবীকে দেখতে পায়. ওই অবস্থাতেও ওর মনে ভীতির সঞ্চার হয়, তাহলে কি আর বাসবীর থেকে লুকিয়ে রাখা গেলোনা? বাসবী উজানকে চোখ খুলতে দেখে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে ছেলের মাথায়. স্নেহের স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে উজানকে, সাথে স্নেহের অনুযোগেও. বাসবীর সাথে কথা বলে উজান বোঝে বাসবী সমরেশের সত্যিটা জানলেও ওর সত্যিটা এখনো জানেনা. বাসবীকে জানানো হয়েছে ট্রেনিং চলাকালীন উজান এক্সিডেন্ট করে. ধীরে ধীরে উজানের মনের ভয় কেটে যেতে থাকে. হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখে কেবিনের দরজায় সমরেশ আর গায়েত্রী দেবী. আবার চমকে ওঠে উজান, তারমানে۔۔۔۔۔۔۔۔۔হিয়া ওর কথা রেখেছে, কিন্তু সে কোথায়?
সমরেশ এগিয়ে এসে উজানের অন্যপাশে দাঁড়ায়. আজ পঁচিশ বছর পর উজানের মাথায় একসাথে সমরেশ আর বাসবী হাত রাখে. মন্ত্রবলে সময়টা যেন একধাক্কায় পঁচিশ বছর পিছিয়ে যায়. উজান শত চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে পারেনা. মনে মনে কৃতজ্ঞতায় হিয়ার কাছে মাথা নিচু হয়ে আসে ওর. গায়েত্রী দেবী এসে উজানের মুখটা নিজের দুহাতের মধ্যে তুলে ধরে ওর চোখের জল মুছিয়ে দেন۔۔
গায়েত্রী দেবী: আমার রাজা সোনা তো দেখছি সেই ছোট্টটিই রয়ে গেছে, যার ব্যথা পেলে সবার কাছে গিয়ে আলাদা আলাদা করে আদর না খেলে ব্যথাই কমতো না۔۔
উজান চোখে জল নিয়েও হেসে ফেলে۔۔
গায়েত্রী দেবী: শুনেছি সমুর কাছে۔۔۔এখানে তো সম্ভব না۔۔۔۔۔বাড়ি ফিরে চল তারপর বানিয়ে দেব চালতার চাটনি. বাপ বেটা দুজনেরই ফেভরিট. তুই যাবার পর আর কোনোদিন রান্না হয়নি ওটা. সমু কোনোদিন মুখে দেয়নি. একসাথেই খাস۔۔
একনাগাড়ে কথা বলতে বলতে একটুক্ষণ থামেন۔۔
গায়েত্রী দেবী: তা হ্যাঁ রে۔۔۔۔۔۔এবার আমাদের কাছেই থাকবি তো, নাকি আবার একা থাকার প্ল্যান করছিস? দেখ বাপু অনেকদিন একা থাকলাম আর পারছিনা. বাসবীকে বলে দিয়েছি নৈনিতালের পাট চুকিয়ে ও এখানেই চলে আসবে. আর আমার মনে হয় হিয়ারও আমাদের সাথে থাকতে অসুবিধে হবেনা۔۔
হঠাৎ করে সবার সামনে গায়েত্রী দেবী এভাবে হিয়ার কথা বলায় উজান একটু অপ্রস্তুত হয়. অস্বস্তি একটু কাটলে ভাবে, তাই তো, হিয়া কোথায়? কি করছে ইডিয়ট টা? এখনো আসার সময় হলোনা?
সমরেশ আর বাসবী এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক. যেটুকু আড়ষ্টতা ছিলো সেটাও উজানকে OT তে নিয়ে যাবার সাথে সাথেই চলে গেছে. তখন বাসবীর কাছে সমরেশের থেকে আপন আর কাউকেই মনে হয়নি. উজান মনে মনে ভাবে ভাগ্গিস আজ ও এতো বড় বিপদের মধ্যে পড়েছিল, নাহলে এইভাবে বাসবী আর সমরেশকে পেতে আরো অনেকদিন লেগে যেত۔۔۔۔۔۔ বা হয়তো এজীবনে আর এটা ওর পাওয়াই হতোনা۔۔
বেশি কথা বলার মতো অবস্থায় কেউই নেই. সৌজন্য মূলক কথাবার্তার মাঝেই সার্জেন আর এনাস্থেজিওলজিস্ট তাদের দলবল নিয়ে হাজির হন. বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওনারা সবাইকে আস্বস্ত করেন. ডাক্তাররা চলে গেলে সমরেশ বাসবীকে ইশারা করে বাইরে আসতে বলে. ইশারার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে বাসবীরও দেরি হয়না. গায়েত্রী দেবীকে নিয়ে বাসবী আর সমরেশ কেবিনের বাইরে আসে۔۔
উজান জানে ওরা কেন বাইরে গেলো, অপেক্ষায় প্রহর কাটতে থাকে উজানের. কিছুক্ষন পর হিয়া কেবিনে এলে দুপক্ষেরই অপেক্ষার অবসান ঘটে. গভীর দুচোখ আকুলতায় ভরে হিয়া ধীর পায়ে উজানের কাছে এসে দাঁড়ায়. উজান দুচোখ ভরে হিয়াকে দেখে বেশ কিছুক্ষন, কি চেহেরা হয়েছে দুশ্চিন্তায় ভুগে ভুগে. তারপর আলতো করে হিয়ার হাত ধরে. এতক্ষন বাইরের যে শক্ত আবরণে হিয়া নিজের ভগ্নদশা লুকিয়ে রেখেছিলো সেটা উজানের স্পর্শে ভেঙে পড়ে. যখন থেকে উজানের খবর পেয়েছে তখন থেকে এখনো পর্যন্ত সমস্ত দুশ্চিন্তা, কষ্ট, উষ্ণ উত্তাল স্রোত হয়ে হিয়ার দুগাল বেয়ে নেমে আসে. ওর জন্য হিয়ার এই আকুলতা উজানের খুব ভালো লাগে. ধরে থাকা হিয়ার হাতটা হালকা টেনে হিয়াকে আরেকটু কাছে নিয়ে এসে নিজের হাতেই চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে۔۔
উজান: আমি কিন্তু কথা রেখেছি, ফিরে এসেছি۔۔
হিয়া: আসেননি۔۔۔۔۔বলুন ফিরিয়ে আনা হয়েছে
তখনও হিয়া কেঁদে চলেছে যদিও বেগ কিছুটা কম۔۔
উজান: কি করছেন কি? থামুন এবার. অসুস্থ মানুষের সামনে এইভাবে কেউ কাঁদে নাকি? ইডিয়ট কি এমনি এমনি বলি?
হিয়া বেড সাইড টেবিল থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে চোখের জল মোছে۔۔
উজান: আমার জন্য আপনাকে এইভাবে কাঁদতে দেখলে তার কি হবে?
হিয়া ভ্রু কুঁচকে: কার কথা বলছেন?
উজান নির্লিপ্তভাবে: ওই যে۔۔۔۔۔۔আপনার পছন্দের বন্ধু۔۔۔۔۔۔উদ্দীপ্ত?
উজানের কথায় বিরক্ত হিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে, কিন্তু উজানের হাতের শক্ত মুঠো থেকে নিজের বন্দিত্ব ঘোচাতে সক্ষম হয়না۔۔
উজান: চটছেন কেন?
হিয়া: ছাড়ুন আমাকে. আর উদ্দীপ্ত আমার পছন্দের মানুষ কেন হতে যাবে শুনি? জ্ঞান ফিরেই যতসব ভুলভাল কথা শুরু করে দিয়েছেন? এনাস্থেসিয়ার ইফেক্ট এখনো কাটেনি মনে হচ্ছে۔۔
উজান: আচ্ছা বেশ۔۔۔۔۔۔যদি উদ্দীপ্ত আপনার পছন্দের মানুষ না হয় তাহলে কে? কোনো বদরাগী, বদমেজাজী, খিটখিটে, বদ্ধ উন্মাদ কেউ? বাকি সম্ভাষণগুলো অবশ্য এখন ঠিক মনে পড়ছেনা۔۔
হিয়ার একহাত এখনো উজানের মুঠো বন্দি. এতক্ষন বাদে ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে. কিছু না বলে মাথা নিচু করে অন্য হাতে ধরে থাকা টিস্যু পেপারটা দলা পাকাতে থাকে۔۔
উজান হিয়াকে আড় চোখে দেখতে দেখতে বলে: কি হলো۔۔۔۔۔۔কিছু জিজ্ঞাসা করলাম তো? তবে উত্তরটা দেবার আগে একটু ভেবে নেবেন মিস মিত্র. এই কয়েকদিন আপনার যে মানসিক চাপের মধ্যে কেটেছে সেটা কিন্তু আপনার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে. আমার কাজ সম্পর্কে তো আপনি সবটা জেনেই গেছেন۔۔
হিয়ার অন্তরে এতদিন যে চোরা স্রোত বইছিল, উজানের কথায় সেটা জলোচ্ছাসে রূপান্তরিত হয়. আজ এই হসপিটালের কেবিনে সম্পূর্ণ এক অন্য স্তরে ওদের সম্পর্কের উত্তরণ ঘটে, যেটা হয়তো কয়েকমাস আগে পর্যন্ত ওরা কেউই ভাবেনি. উজান জানে হিয়া ওর এই স্বীকারোক্তির অপেক্ষায় ছিলো. মনের ভাষারা যতই তাৎপর্যপূর্ণ হোকনা কেন মুখের ভাষার গুরুত্ব এতোটুকু ক্ষীণ হয়না۔۔
হিয়া একটু সরে আসে উজানের কাছে. নিজের অপর হাত উজানের মুঠোবদ্ধ হাতের উপর রেখে লাজুক সুরে বলে۔۔
হিয়া: এখনো মিস মিত্র?
উজান ভ্রু কুঁচকে বলে: আমার কাছে অবশ্য আরেকটা অপশনও আছে۔۔
হিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়: কি?
উজান: What about Mrs. Chatterjee? (একটু থেমে স্মিত হেসে)۔۔۔۔۔۔ এটা চলবে?
হিয়ার মুখে মুহূর্তে কে যেন একমুঠো লাল আবির ছড়িয়ে দেয়. উজানের ধরে থাকা হাতটা আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে: দৌড়োবে….
(সমাপ্ত)
(আজকে #উত্তরণের ৫০তম পর্ব সম্পূর্ণ হলো–সাথেই ৫০তম পর্বই হলো #উত্তরণের অন্তিম পর্ব!!পাঠকগণ আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ–#বেখেয়ালী_কলমের পাশে থাকার জন্য।আশা করি আগামী দিনেও আপনারা #বেখেয়ালী_কলমের এভাবেই থাকবেন???।আর আজকের পর্বটি আপনাদের কেমন লাগলো অবশ্যই এ ব্যাপারে কমেন্ট বক্সে নিজেদের মতামত জানাতে ভুলবেন না???।)