#উত্তরণ
পর্ব_৪৭
আজ উজানদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন. টিমকে আর একবার প্ল্যান বুঝিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে রওনা দেয় হোটেল অন্নপূর্ণার উদ্দেশ্যে. উজানের চিন্তাধারাকে সঠিক প্রমান করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা মীনাক্ষী দেবীর মন্দিরের কাছেই যে অন্নপূর্ণা হোটেল সেখানে উঠেছে. এই টাউনহল জায়গাটা ভীষণ কোলাহলপূর্ণ, এটাকে মাদুরাই এর ইলেকট্রনিক্স হাব বলা যেতে পারে. তাছাড়া মাদুরাই এর মেন মার্কেটটা এখানেই. সব সময় ভিড় লেগেই থাকে. আর একটা হোটেল মেন টাউনের অনেকটা বাইরে, সেখানে ব্লাস্ট করলে শুধু হোটেলে যে কয়েকজন থাকবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে. কাজেই ওদের টার্গেট যে এই এলাকার অন্নপূর্ণা হোটেলটি সেব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই. উজানরা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে۔۔
বাসবীকে সংকল্পর লোক হিয়ার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেয়. বাসবীর জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা রুমে বাসবী কে নিয়ে যায় হিয়া. “স্বর্গদ্বার” থেকে বেরোনোর পর থেকেই বাসবী যে অসচ্ছন্দ বোধ করছিলো, অদ্ভুতভাবে হিয়ার কাছে পৌঁছনোর পর সেটা কেটে যায়. কলকাতার প্রতি ভীতি তার বরাবরের, যদি সমরেশের সাথে দেখা হয়ে যায়. আজও এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময় ওর চোখ সারাটা রাস্তা শুধু সমরেশকেই খুঁজে গেছে. বাসবী এখনো ধন্দে আছে ও সমরেশ কে কেন খুঁজছিলো? শুধুই কি এড়িয়ে যেতে চায় বলে, নাকি আজও ও শুধু সমরেশকেই দেখতে চায়?
হিয়ার আদর যত্নে কোনো বাড়াবাড়ি নেই, আছে প্রচুর পরিমানে আন্তরিকতা. এই কয়েকদিনের পরিচয় ওর হিয়ার সাথে, এর মধ্যেই এই মেয়েটার প্রতি একটা আলাদা টান অনুভব করে বাসবী. মা হিসেবে বাসবীও চেয়েছে উজানের পরিপূর্ণ জীবন. যদিও উজানের পছন্দই শেষ কথা, তবুও মায়ের চোখ অকারণেই খুঁজে গেছে. রূপে গুনে অনেককেই ওর রাজার সমতুল্য মনে হলেও, চারিত্রিক গঠনের নিরিখে উপযুক্ত মনে হয়নি. হিয়াকেই সেদিক দিয়ে ওর রাজার একমাত্র উপযুক্ত সঙ্গিনী মনে হয়েছে বাসবীর. হিয়া জানে কখন ওকে শক্ত হতে হবে আর কখন নরম, কখন হার স্বীকার করতে হবে আবার কখন আদুরে۔۔
মাদুরাই এ অন্নপূর্ণা হোটেলের বাইরে সাদা পোশাকের পুলিশ পাহারায় রেখে উজান ওর দল নিয়ে ভেতরে ঢোকে. রিসেপশনে দ্বিতীয় যে লোকটি দাঁড়িয়ে, সে সবুজ সঙ্কেত দেয় এগিয়ে যেতে. ওদের পথ দেখিয়ে যে নিয়ে যায় সেও পুলিশেরই লোক, হাতের ট্রেতে বড়া-সাম্বার আর জলের জগ. নির্দিষ্ট রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা. সবাই পজিশন নিয়ে নেয়. তারপর জলের জগটা সরিয়ে রেখে কড়া নাড়ে লোকটা. দরজাটা একটু ফাঁক হয়. কেউ ভাঙা ভাঙা ইংরেজি জিজ্ঞাসা করে জলের কথা. ছেলেটি নির্বিকার মুখে মিথ্যে বলে যে সে আনতে ভুলে গেছে, এক্ষুনি নিয়ে আসছে. একটা হাত বেরিয়ে এসে ট্রেটা নিয়ে ভিতরে অদৃশ্য হলে দরজা বন্ধ হয়ে যায়. ওরা বাইরেই প্রায় মিনিট সাতেক অপেক্ষা করে তারপর আবার কড়া নাড়ে. দরজা আবার একটু ফাঁক হয় কিন্তু সাথে সাথে উজানের টিম ভেতরে প্রবেশ করে. ভেতরে থাকা তিন জন অস্ত্র তোলার আগেই এক এক জনের নাকের সামনে প্রায় তিন থেকে চারটি রিভালভার প্রাদুর্ভাব তাদের হার স্বীকার করতে বাধ্য করে. যদিও তারা সায়ানাইড খাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু NIA এর তীক্ষ্ণ নজর উপেক্ষা করে সেটা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা. বিনা যুদ্ধেই উজানরা জয়লাভ করে মাদুরাইতে۔۔
এদিকে বাসবীর কলকাতায় আগমনে গায়েত্রী দেবী ভীষণ খুশি. উনি নিশ্চিত ওনার ভাঙা পরিবার কে অবশ্য অবশ্যই জোড়া লাগিয়ে দেবে ওই একরত্তি মেয়েটা. বাসবীকে কতদিন দেখেননি. বাসবী যখন চলে যায় তখনকার সেই চেহারাটাই ধরা আছে গায়েত্রী দেবীর মনের মনিকোঠায়. আচ্ছা বাসবীরও কি চুলে পাক ধরেছে, ঠিক যেমনটা সমরেশের ধরেছে? নিজের সংসারের দুই লক্ষীর একসাথে আবাহনের প্রতীক্ষায় গায়েত্রী দেবী, সময় যেন আর কাটতেই চায়না۔۔
মাদুরাই তে উজান আর ওর টিমের কাজ শেষ. বাকি যেটুকু আছে সেটা এখানকার NIA টিম আর লোকাল পুলিশ করবে. ওরা রওনা দেয় ওদের পরবর্তী গন্তব্য লখনৌ এর পথে. উজান জানে লখনৌ এ হয়তো এতো সহজে জিততে পারবেনা. একে একে অন্য টিম গুলোও সাফল্য বার্তা পাঠাতে থাকে. উজানের নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত টিম নিজেদের কাজ শেষ করে লখনৌ এর পথে যাত্রা করে, ওখানেই আবার সবাই একজোট হবে۔۔
এরই মাঝে সংকল্পর ফোন আসে, উজানকে জানায় ভাবনা বেদী কে আরেস্ট করা হয়েছে. ভাবনা বেদী একজন চিফ ফ্লাইট আটেনডেন্ট এবং শত্রু পক্ষের স্পাই. তবে ও একা ছিলোনা, সাথে ছিল একজন ফ্লাইট মেন্টেনেন্স টেকনিসিয়ান, দুজন এয়ারহোস্টেস, একজন গ্রাউন্ড স্টাফ, আর একজন লোক যার টুর অপারেটিং বিজনেস আছে. ভাবনা বেদী এদের নেতৃত্ব দিতো. এরা স্টেশন লিভ করার প্ল্যান করছিলো. ভাবনার ফ্ল্যাটে পুলিশ বেশ কিছু সন্দেহজনক ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস পায় সাথে একটা .36 ক্যালিবারের কোল্ট রিভলভার যেটা শেষ পর্যন্ত ভাবনা ব্যবহারও করেছিল আত্মরক্ষার জন্য. একজন পুলিশ অফিসার আহত হয় এসময়. ভাবনা সায়ানাইড খেতেও গিয়েছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশের তৎপরতায় সে ব্যর্থ হয়. ভাবনাকে জেরা করে বাকিদের হদিস পায় পুলিশ. উপর থেকে যে ইন্সট্রাকশন আসতো, ভাবনা সেগুলো এক্সিকিউট করতো বাকিদের সাহায্যে. তাছাড়া মাঝে মাঝে লোকাল ক্রিমিনালদেরও সাহায্যও নিতো প্রয়োজন মতো. ক্যাপ্টেন কাশ্যপের এক্সিডেন্ট আর হিয়ার উপর আক্রমণ গুলো এদেরই এক্সিকিউশন. পুলিশ ওদের NIA টিমের হাতে তুলে দিয়েছে. উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যাক হিয়া এখন মোটামুটি সুরক্ষিত۔۔
প্ল্যান অনুযায়ী সংকল্পর লোক হিয়া আর বাসবীকে সমরেশের বাংলোয় পৌঁছে দেয়. বাসবী প্রথমে জানতো না কোথায় যাচ্ছে, পরে বাংলোর ফলকে নাম দেখে বোঝে কোথায় এসে পড়েছে ও. ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে বাসবী. হিয়াকে অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতেও পারেনা, ঘামতে থাকে ও. একদিকে গায়েত্রী দেবীকে দেখা করার ইচ্ছে, অন্যদিকে সমরেশের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়, এক অদ্ভুত দোটানায় ভুগতে থাকে বাসবী. হিয়ার হাত ধরে দুরু দুরু বুকে হিয়াকে অনুসরন করে ভিতরে পৌঁছোয় ও۔۔
অপেক্ষারত গায়েত্রী দেবী একপ্রকার কান পেতেই বসেছিলেন, ওরা পৌঁছতেই দরজা খুলে দেন. গায়েত্রী দেবী আর বাসবী আজ মুখোমুখি. এতো আনন্দ গায়েত্রী দেবীর পক্ষে মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়. মাথা ঘুরে পড়ে যাবার আগেই বাসবী আর হিয়া দুদিক থেকে এসে ধরে ফেলে. গায়েত্রী দেবীকে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয় ওরা. একটু সামলে উঠে পর উনি বাসবীকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকেন. এতদিনের জমে থাকা অভিযোগ,অনুযোগ, অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে থাকে দুটি মানুষের۔۔
হিয়া নিঃশব্দে সরে আসে ওখান থেকে. মনে মনে বলে “উইং কমান্ডার উজান চ্যাটার্জী۔۔۔۔۔ আমি আমার কথা রেখেছি. এবার আপনার পালা. ফিরে আসুন তাড়াতাড়ি۔۔۔۔۔আপনার ইডিয়ট আপনার অপেক্ষায় আছে۔۔۔۔۔”.
দেখা যাক উজান কি মিশন শেষ করে ফিরতে পারবে—তার অপেক্ষারত ইডিয়েটের কাছে—!
(কপিবাজ মহান ব্যাক্তিবর্গ চলে আসুন তাড়াতাড়ি আপনাদের কর্ম করতে??)