#উত্তরণ
পর্ব_৪৬
কিছুক্ষন পর একে একে চারটে স্করপিও বেড়িয়ে যায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে. ওখান থেকে এক একটা টিম নিজের নিজের গন্তব্যের পথে রওনা দেবে۔۔
উজানের কথা মতো হিয়াকে ওর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেওয়া হয়. অনেক দিন পর হিয়াকে পেয়ে সুষমা খুব খুশি, কি কি রান্না করবে সেটা ঠিকই করে উঠতে পারছেনা. হিয়া নিজের ঘরে বসে উজানের সাথে কাটানো শেষ সময়টুকুর কথা ভাবছিলো, ওইটুকুই এখন হিয়ার পাথেয়. এমন সময় গায়েত্রী দেবী কল করেন. হিয়া নিজেকে উজানের ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফোন রিসিভ করে۔۔
হিয়া: ঠাম্মি۔۔۔۔কেমন আছো? আমি তোমাকে ফোন করতাম. খুব জরুরি কথা আছে তোমার সাথে.
গায়েত্রী দেবী: আমারো তোর সাথে অনেক কথা আছে. সমু আমাকে সব বলেছে. আমি যে কি খুশি তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা. এখন আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুঝতে পারি.
হিয়া: ঠাম্মি۔۔۔۔আবার বাজে কথা বলছো?
গায়েত্রী দেবী হাসেন: আচ্ছা আর বলবোনা. এবার বল তোর জরুরি কথা.
হিয়া গায়েত্রী দেবীকে ওর প্ল্যান বলে, তারপর দুজনে মিলে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে. গায়েত্রী দেবী ফোন রাখলে হিয়া সুষমাকে ডাকে, প্ল্যান সাকসেসফুল করার জন্য সুষমাকে দলে দরকার. সুষমাকে সবটা বুঝিয়ে বলে কি করতে হবে. তারপর দুজনে মিলে বেশ কয়েকবার রিহার্সাল দিয়ে নেই যাতে ভুলচুক না হয়. এবার মনে মনে ভগবানকে শরণ করে বাসবীকে ফোনটা করে হিয়া۔۔
হিয়া: হ্যালো۔۔۔۔কাকিমা۔۔۔۔আমি হিয়া বলছি, হিয়া মিত্র۔۔ মনে আছে?
বাসবী: আরে হিয়া۔۔۔۔۔কেমন আছো?
হিয়া: আমি ভালো আছি. স্যারের থেকে জোর করে আপনার নম্বরটা জোগাড় করেছি. আপনি কেমন আছেন?
দুজনের সাধারণ কথোপকথন চলতে থাকে এমন সময় সুষমা রুমে আসে. হিয়ার ইশারা পেয়ে বেশ জোরে বলতে শুরু করে যাতে বাসবীর কানে যায়۔۔
সুষমা: হিয়া দিদি তুমি ফোনে ব্যস্ত, ওদিকে তোমাকে না পেয়ে তোমার ঠাম্মি আমাকে ফোন করেছেন. ওনার শরীরটা মনে হয় আবার খারাপ করছে গো. একা বয়স্ক মানুষটাকে একলা রেখে যায় কেউ? তোমাকেও বললাম যে ওনাকে এখানে নিয়ে এসো কিন্তু তুমি শুনলে না. এখন মানুষটার কি হবে বলোতো?
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে হিয়াকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করে সব ঠিক আছে কিনা. হিয়া মাথা নেড়ে জানায় “ঠিক আছে”. এবার এই অভিনয়ে হিয়ার অংশগ্রহনের পালা۔۔
হিয়া: কি বলছো? ঠাম্মি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে?
সুষমা: মুখে কি আর বলবে ওই মানুষটা?
হিয়া: তাহলে তো এখনই একবার যেতে হয়. দাঁড়াও আমি গিয়ে ঠাম্মিকে একবার দেখে আসি. সেদিন কতবার বললাম আমার সাথে আসতে, কিছুতেই আসলেন না. বললেন আমার কেউ নেই, সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমি বাঁচি মরি কারো কিছু যায় আসে না. (আড় চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে বোঝে ফোনের ওপারে এখনো বাসবী আছে)
হিয়া বাসবী কে উদ্দেশ্য করে বলে: কাকিমা এখন রাখি, ঠাম্মির শরীরটা বোধহয় খারাপ করছে আবার, একটু দেখে আসি۔۔
বাসবী: হ্যাঁ হ্যাঁ হিয়া তুমি যাও, আর পারলে তোমার ঠাম্মি কে বুঝিয়ে তোমার কাছে নিয়ে এসো. তুমি ছাড়া ওনার আর কে আছে বলো?
হিয়া: না কাকিমা, উনি আমার নিজের ঠাম্মি না. আমি ডাকি ঠাম্মি বলে. উনি আসলে আমাদের সিনিয়র অথোরিটি ক্যাপ্টেন সমরেশ চ্যাটার্জীর মা. একবার অলরেডি সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, আবার কিছু হলে আর বাঁচানো যাবে না. এই একা অসুস্থ মানুষটা কে নিয়ে কি করি বলুনতো? যাইহোক আমি এখন রাখি কাকিমা۔۔
সমরেশের নাম বাসবীকে কিছুক্ষনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে۔۔ কোনোক্রমে সামলে বলে : শোনো হিয়া۔۔۔۔তোমার স্যার কোথায়? মানে ওনার তো এখন নিজের মায়ের কাছেই থাকার কথা۔۔۔۔۔۔তাই বললাম আর কি?? (বাসবী খুব সাবধানে কথা বললেও গলার কম্পন সম্পূর্ণরূপে আড়াল করতে সক্ষম হয় না)
হিয়া : আসলে স্যার তো সপ্তাহ খানেকের জন্য বাইরে গেছেন অফিসিয়াল টুরে. স্যার যথেষ্টই কেয়ার করেন ঠাম্মির কিন্তু অফিস কি সব সময় শুনবে বলুন? তাই তো স্যার আমাকে বলে গিয়েছেন ঠাম্মির একটু খোঁজ রাখতে. এদিকে স্যারেরও তো বয়স হচ্ছে, উনি একা কত কি করবেন? ঠাম্মিকে দেখবেন না নিজেকে দেখবেন? নিজের প্রতি অযত্ন করতে করতে এখন তো স্যার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন. কাকিমা এখন রাখছি কেমন? পরে ফোন করছি۔۔
হিয়া ফোন রেখে দেয়. সুষমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে হিয়া বুড়ো আঙ্গুল তুলে থাম্পস আপ দেখায়. হিয়ার মুখে হাসি. হিয়া বম্বটা সঠিক জায়গায় ফেলে দিয়েছে, এখন শুধু পরিকল্পনা সফল হওয়ার অপেক্ষা. বম্বের কথা ভাবতেই আবার “উজান” ভিড় করে আসে ওর মন জুড়ে۔۔
অন্যদিকে ফোন ছেড়ে দেবার পরও বাসবী সেই হিয়ার কথাতেই আটকে আছে۔۔
বাসবী: কি বললো হিয়া? মা অসুস্থ? সমরেশ ট্যুরে গেছে? আর কি যেন বললো, সমরেশও অসুস্থ হয়ে পড়ছে? সমরেশ না আজও সেই একই রকম রয়ে গেছে. হিয়া বললো না যে সমরেশ একা কত কি করবে? তার মানে সমরেশ একা আছে আজও۔۔۔۔
কিছুক্ষনের জন্য থমকে যায় বাসবী. সমরেশকে বাসবী যতটা চেনে, ও জানে সমরেশের পক্ষে একা থাকাই স্বাভাবিক. আজ অনেকদিন পর ও মুখে সমরেশের নাম নিলো. মনে মনে প্রতি নিয়তই সমরেশের কথা ভাবে কিন্তু মুখে ওই নাম বিগত পঁচিশ বছরে একদিনও নেয়নি. ভাবে বাসবী, কি করা উচিৎ ওর, একবার কি যাবে কলকাতায়? উজানও তো বলছিলো যেতে, কিন্তু ও তো ট্রেনিং এ গেছে. কিন্তু উজানের অপেক্ষায় থাকলে এদিকে দেরি হয়ে যাবে না তো? এখন গেলে অন্তত সমরেশের সাথে দেখা হবার সম্ভবনা নেই. তাহলে কি একবার গিয়ে মাকে দেখে আসবে?
মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে আজ মন বারবার ধরা পরে মস্তিষ্কের কাছে. মস্তিষ্ক প্রশ্ন রাখে মনের কাছে۔۔۔۔ এটা বাসবীর কলকাতা যাবার বাহানা নয় তো? এতো বছরে গায়েত্রী দেবী কি প্রথমবার অসুস্থ হলেন? হিয়া তো বলল গায়েত্রী দেবীর এর আগেও একবার সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, তাহলে যখন আগে খোঁজ রাখেনি এখন রাখার দরকার টা কি? নাকি বাসবী এবার নিজের স্বার্থেই কলকাতায় ফিরতে চায়, গায়েত্রী দেবী শুধুমাত্র একটা বাহানা. নিজের সাথে নিজেরই লড়াই চলতে থাকে বাসবীর, যদিও মনের পাল্লা ভারি۔۔
উজানরা এয়ারপোর্ট থেকে চার্টার প্লেনে করে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে যায়۔۔
উজান আর ওর টিম প্রথমে মাদুরাই পৌঁছোয়. যেখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করে NIA ফোর্সের একটা অংশ সাথে তামিলনাড়ু আর্মড পুলিশের একটা ভাগ. ওরা ওদের বেসে পৌঁছে পরবর্তী কোর্স অফ অ্যাকশন নিয়ে আলোচনা করে তারপর ছোটো ছোটো টিমে ভাগ হয়ে যে যার কাজে লেগে পড়ে. উজান ওর বাকি ছয় টিমের সাথে কথা বলে তাদের অবস্থানও জেনে নেয়. আরোহী আর স্নাইপার ইকবাল উজানের টিমে আছে۔۔
উজানের কথা মতো ওর টিম অন্নপূর্ণা এই দুদিনে চেক ইন করা হোটেলের সমস্ত গেস্টদের, সাথে আগামী দুদিনের বুকিং এর ডিটেলস চেক করে. যাদের সন্দেহ হয় তাদের উপর নজর রাখা শুরু হয়۔۔
প্রায় সন্ধ্যের দিকে উজানের টিম খবর আনে. খবর শুনে উজানের মুখে হাসি ফোটে. একে একে সব টিম বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাঠাতে থাকে তাদের প্ল্যানিং এর. এখনো পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক চলছে. হাতে আর মাত্র দুদিন. কালকে এখানের ঝামেলা মিটিয়ে লখনৌ পৌঁছতে হবে۔۔
সকালে হিয়ার তন্দ্রা ভাঙে ফোনের রিংটোনে. হিয়া দেখে বাসবীর কল۔۔
বাসবী: হিয়া আমি আজ কলকাতায় আসছি۔۔
হিয়া: কিন্তু স্যার তো এখন নেই তাহলে?
বাসবী: ওর ফ্ল্যাটের চাবি পেয়ে যাবো۔۔
হিয়া: বলছি কাকিমা অসুবিধা না হলে আমার কাছে থাকলে হতো না?
আরো কিছুক্ষন কথাবার্তার পর বাসবী হিয়ার কাছে থাকতে রাজি হয়. বাসবীর ফ্লাইট ডিটেলস নিয়ে সংকল্প সেন কে ফোন করে সব কিছু জানিয়ে দেয় হিয়া۔۔۔۔
দেখা যাক কোন পরিস্থিতির মাধ্যমে বদলে যাবে উজান-হিয়া দুজনের জীবন—!!
(কপিবাজদের জন্য সুখবর আগমী চার পর্বে মাঝেই শেষ হবে #উত্তরণ।আর পাঠকগণ আপনারা #উত্তরণ হওয়া নিয়ে নিজেদের অনুভূতি কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানিয়ে দিন???)