#উত্তরণ
পর্ব_১৭
পুরো রাস্তায় হিয়া প্রয়োজনের বেশি একটাও কথা বলেনি, যদি আবার উজান রেগে গিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসে বা হিয়াকেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়. উজানের পক্ষে সব সম্ভব. শুধু মাঝখানে হিয়া একবার গাড়ি দাঁড় করতে বলেছিলো একটু ফুল কিনবে বলে. উজান বিনা বাক্য ব্যয়ে হিয়ার কথা মেনেছিলো. হিয়া বিভিন্ন রং এর অর্কিড কিনছিলো কিন্তু উজান সেগুলো বাদ দিয়ে এক গুচ্ছ সাদা টিউলিপ কেনে. হিয়া বেশ অভিভূত হয় উজানের পছন্দ দেখে, এই ধরণের পছন্দের বেশ একটা আভিজাত্য আছে. ফুল কেনা হয়ে গেলে সেগুলো হিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় উজান তারপর আবার গাড়িতে বসে স্টিয়ারিং এ হাত রাখে.
উজানের জাগুয়ার এসে দাঁড়ায় এয়ারপোর্ট অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া এর হাউসিং কমপ্লেক্সে. যেখানে যাবে সেটা হইলি সিকিউরড জোন. হিয়া গাড়ি থেকে নেমে সিকিউরিটি কে সব ডিটেলস দিয়ে গেট পাস নিয়ে আবার গাড়িতে এসে বসে, তারপর উজান কে ডিরেকশন দিতে থাকে. উজানও হিয়ার কথা মতো গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়.
ওদের গাড়ি থামে একটা বাংলোর সামনে. বাংলোর সামনে ফলকে নাম আর ডেসিগন্যাশন লেখা, সেখানেও সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে. হিয়া মুখ বাড়াতেই সিকিউরিটি হাসে কিন্তু পরক্ষনেই উজানের দিকে চোখ পড়তেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে হিয়ার দিকে তাকায়. হিয়া উজানের পরিচয় দেয়. উজান বোঝে হিয়ার এই বাড়িতে যথেষ্ট যাতায়াত আছে তাই সিকিউরিটিও হিয়া কে চেনে. উজান ওর গাড়িটা পার্ক করে. ওর বুকের মধ্যে তখন হাজারটা দামামা এক সাথে বাজছে.
গাড়ি থেকে নেমে উজান দাঁড়িয়ে থাকে, হিয়া ততক্ষনে কিছুটা এগিয়ে গেছে. সে ফিরে উজান কে ডাকে কিন্তু উজানের কানে হিয়ার ডাক পৌঁছোয়না. তার পা গুলো যেন মাটিতে আটকে গেছে. শত চেষ্টা করেও ও নড়তে পারছেনা. এতো অসহায় ওর নিজেকে আগে কখনো লাগেনি. ভিতরে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে সেটার দুশ্চিন্তা উজানকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে তুলছে.
হিয়ার খুব অবাক লাগে উজানের ব্যবহারে. হিয়া ফিরে আসে উজানের কাছে. উজানকে আবার ডাকে কিন্তু উজান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে হিয়ার দিকে. হিয়া কয়েক সেকেন্ড নেয় ভাবতে, তারপর উজানের হাতটা ধরে. উজান অবাক দৃষ্টি তে একবার হিয়ার দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে থাকা হিয়ার হাতের দিকে তাকায়. কেমন যেন একটা ভরসার পরশ হিয়ার ছোঁয়ার মধ্যে. হিয়া উজানের হাত ধরে সামনে এগিয়ে যায় আর উজান মন্ত্র মুগ্ধের মতো হিয়াকে অনুসরণ করে.
হিয়ারা দরজার সামনে পৌঁছলে হিয়া উজানের হাত ছেড়ে দিয়ে বেল বাজায়. কলিং বেলের সুমধুর আওয়াজ ওরা বাইরে থেকেই শুনতে পায়. কিছুক্ষন পর দরজা খুলে যায়. চৌকাঠের ওপারে যিনি দাঁড়িয়ে তাকে দেখে উজানের হৃৎপিণ্ড টা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, একদৃষ্টিতে ও তাকিয়ে থাকে সেই প্রৌঢ়ার দিকে.
উজান: (মনে মনে: ঠাম্মি?)
হিয়া ইতিমধ্যে ঘরের ভিতর ঢুকে গায়েত্রী দেবী কে জড়িয়ে ধরে.
গায়েত্রী দেবী: সময় হলো তোর এই বুড়ি কে দেখতে আসার? (গলায় অনুযোগ)
হিয়া তখনো গায়েত্রী দেবীকে জড়িয়ে ধরে আছে: একটু ব্যস্ত ছিলাম ডার্লিং, আর কে বুড়ি শুনি۔۔۔ তুমি তো সুইট সিক্সটিন. দেখো কাকে এনেছি. তোমার পছন্দ না হয়ে উপায়ই নেই (বলেই হিয়া জোরে হেসে ওঠে).
এরপরই হিয়া খেয়াল করে উজান এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে. এগিয়ে আসে উজানের দিকে.
হিয়া ও ঠাম্মির অনুরোধে উজান ভেতরে আসে কাঁপা কাঁপা পায়ে. হিয়া আলাপ করিয়ে দেয়۔۔
হিয়া: ইনি ঠাম্মি, মিসেস গায়েত্রী চ্যাটার্জী, সমরেশ স্যারের মা. আর ঠাম্মি ইনি হলে ক্যাপ্টেন উজান চ্যাটার্জি, কয়েক মাস হলো জয়েন করেছেন.
গায়েত্রী দেবীও “উজান চ্যাটার্জী” নাম টা শুনে এক অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকেন. উজান এগিয়ে এসে প্রণাম করে ঠাম্মি কে. গায়েত্রী দেবীও উজানের মাথায় হাত রেখে বলেন: অনেক বড় হও, দীর্ঘজীবী হও, সুখে থাকো۔۔
বলতে বলতে গায়েত্রী দেবীর গলা টা কেঁপে ওঠে যেটা উজান বা হিয়া কারোরই শুনতে ভুল হয়না. উজান একদলা কান্না কোনো রকমে গিলে নেয়. নিজেকে প্রাণপনে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ও, কিছুতেই কাউকে জানতে দেওয়া যাবেনা ও কে.
সবাই ড্রয়িং রুমে এসে বসলে হিয়া জিজ্ঞাসা করে সমরেশের কথা.
ঠাম্মি: ঘরেই আছে, আসছে۔۔
বলেই ঠাম্মি একজন পরিচারিকা কে বলেন সমরেশ কে ডেকে দেওয়ার জন্য.
উজান: আপনি আর স্যার ছাড়া আর কে কে থাকেন. মানে এতো বড় বাংলোতে নিশ্চই আপনারা দুজন মাত্র থাকেন না.
উজান ওর দুশ্চিন্তা থেকে বেরোতে পারেনা. ওর মা এর জায়গাটা কি এখনো ওর মায়ের ই আছে, নাকি۔۔۔۔???
ঠাম্মি: আছে তো.
উজানের পৃথিবী টা টোলে যায়۔۔۔
ঠাম্মি: বসুন্ধরা আছে, ছবিলাল আছে, আর অনন্ত আছে۔۔۔ থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ۔۔۔(বলেই জোরে হেসে ওঠেন)
এদেরকে উজান চেনে সেই ছোট্ট বেলা থেকে. বসুন্ধরা মাসি ঠাম্মির দেখাশোনা করতো, ছবিলাল কাকু বাড়ির দেখাশোনা করে, বাজারহাট করে, আর অনন্ত কাকুর হাতের রান্না উজান এখনো ভুলতে পারেনি. উজানের পৃথিবী টা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে যেন রক্ষা পায়. তাও আরো নিশ্চিত হতে হবে ওকে–
উজান: আর কেউ থাকেনা?
গায়েত্রী দেবী : কাদের কথা বলছো?
উজান: স্যারের ফ্যামিলি?
ঠাম্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলে: যাদের থাকার কথা ছিল তারাই তাে চলে গেছে এই বুড়িটা কে ফেলে. আর কেউ নেই. (এক ফোঁটা জল ঠাম্মির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লে উনি সন্তর্পনে সেটা মুছে নেন)
উজান আজ বড় নিশ্চিন্ত হয়. এখানে আসার সময় থেকে বুকের ওপর যে ভারী জগদ্দল পাথর টা চেপে ছিল, সেটা সরে যায়. মাথাটা হালকা হয়ে যায়, একবার জোরে শ্বাস নেয় উজান.
কেউ হিয়াকে লক্ষ্য না করলেও, হিয়া নিঃশব্দে সব কিছুই লক্ষ্য করে. উজানের গোপন করার শত প্রয়াস সত্তেও ওর প্রতিটা অভিব্যক্তি হিয়া পড়ে ফেলে অনায়াসে. ওর মন বলে অনেক কিছুই ওর অজানা, কিন্তু ওর কাছে এতো সময় আছে কি?
কিছুক্ষনের মধ্যেই সমরেশ আসে, এসে উজান কে দেখে অবাক হয়.
সমরেশ: ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী?
উজান উঠে দাঁড়ায়: ইয়েস স্যার۔۔۔۔ হ্যাপি বার্থডে স্যার.
সমরেশ: থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন, প্লিজ বি সিটেড. আর হিয়া۔۔۔۔۔۔ কেমন আছো?
হিয়া: খুব ভালো স্যার. সরি, অনেক লেট হয়ে গেলো এবার. (বলে ফুল গুলো সমরেশের হাতে দেয়)
সমরেশ সাদা টিউলিপ দেখে বেশ চমৎকৃত হয় : হিয়া তুমি জানলে কি করে যে আমার সাদা টিউলিপ খুব পছন্দের?
হিয়া আবারো অবাক হয়. আড় চোখে উজানকে একবার দেখে নিয়ে বলে: না স্যার আমি না, এটা উজান স্যার পছন্দ করে কিনলেন.
সমরেশ উজানের দিকে তাকায় আর মনে মনে বলে: তুমি কি সত্যি আমার রাজা নও, তাহলে কেন তোমাকে দেখলে রাজার কথা মনে পড়ে? শুধুই কি নামের মিল, আর কিছুনা?
যদিও মুখে সমরেশ কিছুই বলে না উজান কে.
উজান ও এই প্রসঙ্গ টা এড়িয়ে যেতে চায় তাই বলে: এবার আমি আসি স্যার.
সমরেশ উত্তর দেবার আগেই গায়েত্রী দেবী বলেন: বললেই হলো নাকি? দুপুর বেলায় এসেছো, খেয়ে যেতে হবে. এটা ঠাম্মির হুকুম. তাছাড়া অনন্তর হাতের রান্না অসাধারণ۔۔۔۔۔খেয়ে যাও.
উজান কিছু বলতে গেলে হিয়া উজানের কাছে গিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে: স্যার সত্যিই কি সম্ভব নয়? তাছাড়া দুপুরে তো খাওয়াটাই হলোনা.
উজান: সে তো আপনার জন্য.
হিয়া করুন মুখে বলে: প্লিজ۔۔۔۔۔আসলে এখানে কেও আসেনা, ঠাম্মিও তাই খুব খুশি হন কেউ এলে. আপনি থাকুন না আর একটু সময়, সবাই খুব খুশি হবেন.
উজানের নিজেরও ইচ্ছে করে ওর নিজের লোকেদের সাথে আরো একটু সময় থাকতে. মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়. হিয়ার মুখটা খুশিতে ভোরে ওঠে, সাথে সমরেশ আর ঠাম্মির মুখও খুশিতে ঝলমল করে ওঠে۔۔۔
দেখা যাক হিয়ার মাধ্যমে উজানের হঠাৎ ফিরে পাওয়া এই অতীত সম্পর্ক–কীভাবে আবার নতুনভাবে বর্তমান সম্পর্কের পরিণতি পাই—-!!!