ইরিনা_ইরিন পর্বঃ- ০১

0
715

“জীবন্ত লাশ হয়ে বেছে আছি আজ দুবছর হলো। আজ ওর ২য় মৃত্যুবার্ষিকী। আজও জানতে পারলাম না ওর চলে যাওয়ার ঠিক কারণটা কী ছিল! কতো হাসি-খুশি প্রানবন্ত ছিল আমাদের সংসার। এখনো আমি বিশ্বাস করি না ও নিজের ইচ্ছায় আমায় ছেড়ে চলে গেছে। এটা অবশ্যই অন্য কারো কাজ। কিন্তু কে? কে ভেঙে দিল আমার এমন সুন্দর সাজানো সংসার। থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে গোয়েন্দা পর্যন্ত কিছুই বাদ রাখি নি। এখন আপনিই শেষ ভরসা ম্যাডাম। ও কেন চলে গেছে তা না জানা পর্যন্ত আমি কিছুতেই স্বস্তি পাবো না। ”

আমি ইরিনা ইরিন, গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতাম। কিন্তু ওই সেক্টরে মেয়ে বলে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিত না। ভালো ভালো কেস সব চলে যেত অন্যান্যদের হাতে। অথচ ছোটবেলার এক অদ্ভুত ঘটনার জন্য আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল এই গোয়েন্দা বিভাগ। অবশেষে চাকরিটা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে মানুষের লক্ষ্য তাকে এক পথ থেকে সহজেই অন্য পথে সরতে দিতে চায় না। তাই ঘটনাচক্রে একটা জটিল কেস আমার হাতে আসে আমি কোনো আইনের লোক না হওয়া সত্ত্বেও সেই কেস আমি সমাধান করে ফেলি। এরপর থেকে আর কেসের অভাব হয়নি। তবে ইদানীং ভয়ংকর দুনিয়ার রুপগুলো আর ভালো লাগছে না। সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে কিছুদিন থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। যাক আমার কথা না হয় পরে বলা যাবে। এখন আমার বাসায় যে ব্যাক্তি বসে আছেন, উনাকে দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছে। আজকালও এমন পুরুষ হয় নাকি! নিজের স্ত্রীকে ঠিক কতটা ভালোবাসলে পুরো দুইটা বছর এভাবে তার স্মৃতি আকঁড়ে পড়ে থাকা যায় তা আমার জানা নেই। তবে এমন অনেক পুরুষই আমি দেখিছি যারা ১/২ মাস পেরুতেই নতুন বউ ঘরে তোলে।

” আমি আপনার সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে পারি তবে সেক্ষেত্রে আপনার অবদানটাই মূখ্য। আপনি যদি কোনোপ্রকার মিথ্যা কথা না বলে আমার কাজে সাহায্য করেন তবেই হয়তো আমরা সমাধানে পৌঁছাতে পারবো।”-ইরিনা।

“আমি কেন মিথ্যা কথা বলবো?”

“ঠিক মিথ্যা না, কোনো কিছুই আমার থেকে লুকানো যাবে না। ”

“আচ্ছা ম্যাডাম আমি কিছুই আড়াল করবো না। আমি শুধু সত্যি টা জানতে চাই।”

“ও হ্যা, আপনার পরিচয়ই তো জানা হলো না।”

“আমার নাম রিয়াদ খান। আমি একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করি।”

“আজ কী আপনার হাতে সময় আছে আমার সাথে কিছু কথা বলার?”

“হ্যা, অবশ্যই। ”

” আজ আপনি শুধু আমায় সংক্ষেপে আপনাদের পরিচয় থেকে ঘটনার দিন পর্যন্ত কাহিনী বলে যান”

“আমাদের পরিচয় বিয়ের এক বছর আগে হয়। একটা অনুষ্ঠানে আমি ওকে প্রথম দেখি। তারপর ভালোলাগা, কথা বলা, ভালবাসা হয়। আমি তখন চাকরি করতাম তাই বিয়েতে দেরি করি নি। ওর পরিবার ও আমার পরিবার খুব সহজেই আমাদের মেনে নিয়েছিলো। বিয়ের পর আমি ওকে নিয়ে ঢাকায় আসি। আমাদের মূল বাড়ি সিলেট। তারপর খুব ভালোই চলতে শুরু করে আমাদের সংসার। বিয়ের দুবছর পর আমাদের ঘর আলো করে আসে একটি মেয়ে। ও আসার পর আমাদের দিনগুলো আরও ভালো কাটছিল। বিয়ের পাঁচবছর পর সেই কালরাত্রি আসে আমাদের জীবনে। আমি বরাবরের মতো রাতে অফিস থেকে ফিরে বাসার মধ্যে মেয়ের কান্না শুনতে পাই। মেয়ের বয়স তখন তিন বছর। অনেকক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পরও ও দরজা না খুলাতে আমি অনেক ভয় পেয়ে যাই। আমি ওকে ফোন দিতে থাকি কিন্তু ও রিসিভ করেনি। পরে আসেপাশের বাসার লোকজনদের ডেকে আনি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত দেয়। তারপর দরজা ভাঙা হয়। আমি ছুটে যাই আমার রুমে। গিয়ে দেখতে পাই ও,,,,, ” এটুকু বলে রিয়াদ কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

” আপনি নিজেকে শান্ত করুন। তারপর কী দেখেছিলেন?”

“তারপর দেখলাম ও বিছানায় পড়ে আছে। মুখে ফেনা। কী ভয়ংকরই না লাগছিল ওর মায়াবী মুখ তখন। মেয়েটা পাশে বসে কান্না করছিল। আমি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। আমাদের বাসার ফ্ল্যাটে একজন ডাক্তার ছিলেন উনি এসে দেখে বললেন ও আর নেই।”

“তার মানে উনি বিষ খেয়েছিলেন। ”

” ও খায়নি ম্যাডাম। ও কেন বিষ খাবে। ওর তো কোনো সমস্যা ছিল না।”

” বাসার সবগুলো দরজা কী ভিতর থেকে বন্ধ ছিল?”

” হ্যা।”

” তাহলে কে এসে বিষ খাওয়াবে?”

” জানি না ম্যাডাম। আমি এই কারণ টাই জানতে চাই।”

“আপনার মেয়ে তখন কথা বলতো? ”

” হ্যা, আধো আধো কথা বলতো। ও কী কিছু বলতে পেরেছে যে বাসায় কেউ এসেছিলো কিনা?”

” ও ঠিকমতো কিছুই বলতে পারে নি। একবার জিজ্ঞেস করলে হু বলে আবার না বলে।”

” বুঝেছি। ওই দিন কী আপনাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়েছিলো? ”

” না ম্যাডাম। আমাদের ঝগড়া খুব কমই হতো। আর হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না৷ আমরা পরস্পরকে নিয়ে খুবই ভালো ছিলাম।”

” উনি কী চাকরি করতেন?”

” না।”

” আচ্ছা আপনি কী পোস্টমর্টেমসহ সমস্ত রিপোর্ট এনেছেন?”

” জ্বি ম্যাডাম, এই নেন।” বলে একটা ফাইল রিয়াদ সাহেব টেবিলের উপর রাখলেন।

” আচ্ছা আজ তাহলে আপনি আসুন। আপনার এড্রেস, ফোন নাম্বার দিয়ে যান। আমি যোগাযোগ করবো। ”

” এখানে সব আছে ম্যাডাম।”

” আচ্ছা।”

” ম্যাডাম আপনার ফি টা? ”

“আপনি কী জানেন না আমি কেস সমাধান না করতে পারলে কোনো টাকা নেই না।”

” হ্যা ম্যাডাম শুনেছিলাম।”

” তাহলে?”

” আচ্ছা ম্যাডাম আসি। আপনিই আমার শেষ ভরসা ম্যাডাম একটু ভালোভাবে দেখবেন।”

” অবশ্যই। ”

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে সন্ধ্যায় আসা ব্যক্তির ফাইল খুলে বসলাম। প্রথমেই উনার স্ত্রীর ছবি হাতে নিলাম, সত্যিই অনেক মায়াবী একটি মেয়ে। চোখ যেন সরানোই যাচ্ছে না ছবি থেকে। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন! কেউ কতো কষ্ট নিয়ে বাঁচে আর কেউ সুখের সাগরে থেকেও নিজেকে মেরে ফেলে। আপাতপক্ষে ঘটনাটার ব্যাখ্যা খুবই সহজ কিন্তু কারণতো নিশ্চয়ই কিছু না কিছু আছে। সেটা কী? যা জানার জন্য ভদ্রলোক এতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেখি আমি এর শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পারি কিনা।

মেয়েটার নাম পিয়াসা। বয়স হয়েছিল ২৮। বিবিএ নিয়ে লেখাপড়া করেছে। বায়োতে আরও অনেক কিছুই আছে। আমার আগে ইচ্ছে হলো পোস্টমর্ডেম রিপোর্ট দেখার।

পোস্টমর্ডেম রিপোর্ট খুলতেই আমার চোখ এক জায়গায় আটকে গেল। অতি মাত্রায় পটাশিয়াম সায়ানাইড শরীরে প্রবেশের ফলে মৃত্যু ঘটেছে। পটাশিয়াম সায়ানাইড সাধারণত কারো বাসায় থাকার কথা না। তাহলে তা অবশ্যই ইচ্ছাকৃতভাবে আনা হয়েছে। আর এর সম্পর্কে সাইন্সের স্টুডেন্টরাই বেশি জানে। কিন্তু পিয়াসাতো কমার্সের ছাত্রী ছিল!

চলবে,,,

#ইরিনা_ইরিন
পর্বঃ- ০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here