ইরিনা_ইরিন পর্বঃ৬শেষ পর্ব

0
799

#ইরিনা_ইরিন
পর্ব ঃ- ৬(শেষ পর্ব)

“কেসটা প্রথমদিকে আমার খুব জটিল লাগছিল কিন্তু যখন আপনাদের বাড়ির কাজের মহিলার সাথে কথা বললাম আর রিয়ার থেকে সব কথা উদ্ধার করতে পারলাম তখন সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে আপনিই আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন।”

” কীসব যাতা বলছেন আপনি? আমি কিছু করলে কী সত্যিটা জানার জন্য আপনার কাছে যেতাম। পিয়াসাকে আমি নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসতাম আর এখনো বাসি। আমি আর কখনো বিয়ে করবোনা বলেও ঠিক করেছি। তারপরও আপনি আমাকে হত্যাকারী বলছেন! ”

” মি. রিয়াদ পিয়াসাকে আপনি ভালবাসেন আমি জানি। আমি আপনার ভালবাসাকে অসম্মান করছি না। কিন্তু আপনি হয়তো এটা জানেন না ভালবাসার মানুষের কাছে কোনো কিছু গোপন করতে নেই। একটা সত্যি ঢাকতে গিয়ে আমরা অনেকগুলো মিথ্যার মধ্যে জড়িয়ে পরি। আর তার ফলস্বরূপ কোনো না কোনো অঘটন ঘটে আমাদের জীবনে।”

” আমি আর নিতে পারছি না। আপনি প্লিজ আমাকে সোজাসাপ্টা ভাবে সবকিছু খুলে বলুন।”

” আমি যখন দেখলাম আপনি রিয়াকে আড়াল করছেন আর রিয়াও এসব বিষয়ে কথা বলতে বিরক্তি দেখাচ্ছে তখনি আমার সন্দেহ জাগে। রিয়া অবশ্যই আপনার কোনো দুর্বলতা জানে তাই আপনি দুবছর আগেও রিয়াকে এককথায় সরাতে পারেন নি। বার বার ওকে ফেস করেছেন। নয়তো আপনি রিয়ার ব্যাপার নিয়ে পিয়াসার সাথে কথা বলতে পারতেন নতুবা রিয়াকে ব্লক করে দিতে পারতেন ফোন থেকে। আমি প্রায় জোর করে, সবকিছু ওর স্বামীকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে রিয়ার থেকে সব কথা উদ্ধার করি।”

“কী বলেছে ও আপনাকে?”

” পিয়াসার আগে আপনার আরেকটি সম্পর্ক ছিল এবং তা বেশ ঘনিষ্ঠই ছিল। মেয়েটি অনেক বেশি আধুনিক ও একরোখা ছিল তাই একপর্যায়ে ওকে আপনি আর নিতে পারতেন না। তারপর পিয়াসার সাথে আপনার পরিচয়। তখনো ওই মেয়েটিকে আপনি ছেড়ে দিতে পারেন নি। বিয়ের কিছুদিন আগে ওই মেয়েটি সবকিছু জানতে পেরে আপনাকে গালাগালি করে চলে যায়। কিন্তু সমস্ত ঘটনা আপনি পিয়াসার থেকে আড়াল করে যান। ওই মেয়েটি রিয়ার সাথে পড়তো তাই রিয়া সবকিছু জানতে পারে কিন্তু ও তখন মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় পিয়াসাকে এসব না বলে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। ”

” ওই মেয়েটা একদম আমার কথা শুনতো না অশান্তি করতো। আমি আমার সব ভাললাগা তাই পিয়াসার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম। পিয়াসা একদম আমার মনের মতো ছিল। কিন্তু এসব জানতে পারলে যদি আমার প্রতি ওর বিশ্বাস, ভালবাসা কমে যায় তাই আমি ওকে এসব জানতে দিতে চাই নি।”

” একসময় বিরক্ত হতে হতে আপনি রিয়াকে মেরে ফেলার কথা ভাবলেন। ও যেহেতু রসায়ন নিয়ে থিসিস করছিলো তাই পটাসিয়াম সায়ানাইড আপনিই কিনে আনেন আর তা ওকে খাওয়াতে চান। যাতে বুঝা যায় রিয়া আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পরে আপনার মন বদলে যায় আর এতোবড় অপরাধ নিজের কাধে নিতে চান নি তাই প্ল্যানটা বাদ দিয়ে দেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওই পটাসিয়াম সায়ানাইড আপনার বাসায়ই থেকে যায়। ”

“না না, আমি তো এগুলো সব ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতোকিছু আপনি কীভাবে জানলেন।”

” হাহা, তাহলে আপনি সত্যি টা মানছেন মি. রিয়াদ।
আসলে এগুলো আমি প্রমাণ পাই নি শুধুমাত্র নিজের চিন্তাশক্তি থেকে বললাম। আমি শুধু এটুকু জানতে পারি যে আপনিই পটাশিয়াম সায়ানাইড বাসায় এনেছিলেন।”

“কীভাবে?”

“আপনাদের কাজের মহিলার সাথে কথা বলে। আপনি যখন এটা এনে রাখেন তখন আপনার কাজের মহিলা তা দেখতে পায় এবং আপনাকে জিজ্ঞেস করে এতো অল্প চিনি এনেছেন কেন। তখন আপনি তাকে বলেন এটি একটি বিশেষ ধরনের দামী চিনি এবং তা নিয়ে যান। দুই দিন পর ওই চিনির প্যাকেট কাজের মহিলা বারান্দার এক কোণে পায়, আপনি হয়তো রুম থেকে বাইরে ফেলে দিতে চেয়ে ছুরে মেরেছিলেন কিন্তু তা বাইরে না পরে ভেতরেই আটকে যায়, যা আপনি খেয়াল করেন নি। কাজের খালা ভাবেন হয়তো আপনাদের মেয়ে না বুঝে এখানে ফেলেছে, উনি ওটা নিয়ে রান্নাঘরে রাখেন। এর পরের কিছু দিন উনি কাজে আসেন নি তাই ওই চিনিটার কথাও ভুলে যান। পিয়াসা প্রতিদিন রাতে ঠান্ডা ফলের জুস খেত। কাজের খালা দিনে জুস বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতেন। একদিন জুস বানাতে গিয়ে দেখলেন বাসায় চিনি শেষ। তখন হঠাৎ তার ওই দামী চিনির কথা মনে পড়ে। পিয়াসাকে বললে উনি কেন আগে খেয়াল করেন নি বলে বকাবকি করবে ভেবে কিছু না বলেই ওই চিনি মানে পটাসিয়াম সায়ানাইড দিয়ে উনি জুস বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দেন।” বাকিটা তো আপনি বুঝতেই পারছেন।”

” আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কী বলছেন আপনি এসব। কাজের খালা এতোকিছু আগে বলে নি কেন?”

“উনি ভয় পেয়ে গেছিলেন। আমি অনেক কষ্ট করে উনার কাছ থেকে কিছু কিছু কথা বের করে কাহিনীটা কী হতে পারে সাজিয়েছি। আর এ যুক্তির বাইরে আমি আর কিছু দেখছি না।”

” কিন্তু একটা জিনিস ৬ মাস বাসায় থাকলো আর পিয়াসা কী দেখতে পায় নি। আর পিয়াসা জুসটা খাওয়ার পর ওর অশান্তি করছিলো যখন ও কেন চিৎকার দিল না?”- প্রশ্নগুলো করতে রিয়াদ সাহেবের ঠোঁট কাঁপছিলো।

“আমরা মহিলারা কিচেনের রেকে এতো সব জিনিস রাখি যে সবসময় চিপায় চাপায় কী রাখা আছে খেয়াল করি না। আর অনেক বক্স থাকায় সব খুলেও দেখি না অনেক সময়। তাই এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আর পটাশিয়াম সায়ানাইড শরীরে প্রবেশের পর হাইড্রোসায়ানিক এসিড গঠন করে যা অক্সিজেন ঘাটতি ঘটায় এবং ব্যাক্তিকে অজ্ঞান করে দেয়। অজ্ঞান হওয়ার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে সালফার এন্টিডোট দেওয়া না হলে ব্যাক্তির মৃত্যু ঘটে। ”

” তাহলে জুসের গ্লাস তো পাওয়া যেত।”

” হয়তো উনি একবারে সব জুস খেয়ে গ্লাসটা সাথে সাথে ধুয়ে ফেলেন আর এর মধ্যেই মাথা ঘুরতে শুরু হয় আর দ্রুত রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন কিন্তু আর জেগে উঠা হয় নি। এর চেয়ে ভালো যুক্তি আমি আর চিন্তা করে পাই নি রিয়াদ সাহেব। তাও যদি আপনার বিশ্বাস না হয় আপনি অন্য কোনো গোয়েন্দা অফিসারের কাছে যেতে পারেন। আমি কোনো আইনেত লোক না, আইনের লোক হলে আপনাকে শাস্তি পেতে হতো। আপনি আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন কারণটা আপনাকে জানাই। তা আমি করেছি। তিক্ত হলেও সত্যি টা আপনাকে মেনে নিতে হবে।আমি আসি মি. রিয়াদ। মানুষের জীবনে কতো এক্সিডেন্ট ঘটে। এটাকেও এক্সিডেন্ট ভেবে আপনি আপনার জীবন আবার নতুন করে শুরু করুন।”

মি. রিয়াদ আর কোনো কথা বললেন না। মাথা নিচু করে বসে রইলেন। উনার এখন কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন, তাই আমি বেড়িয়ে এলাম উনার বাসা থেকে।

রাতের বেলা আমার ফোনের বিকাশ নাম্বারে ২৫ হাজার টাকা আসলো। আমার বুঝতে দেরি হলো না যে এটি মি. রিয়াদ পাঠিয়েছেন। টাকাটা একটু বেশীই হয়ে গেছে,,,, উনার থেকে কোনো টাকা নেওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। কাল গিয়ে না হয় কিছু টাকা ফেরত দিয়ে দিব আর উনার অবস্থাও দেখে আসবো ভাবলাম। এই কেসের জন্য ঈশানের ঘটনার বিষয় নিয়েও আর ভাবা হয় নি। আমার এক বাজে অভ্যাস যেকোনো কেস হাতে নিলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে পারি না।

পরের দিন সকাল,
চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছি। হঠাৎ একটি শিরোনামে চোখ আটকে ” স্ত্রীর আত্মহত্যার দুবছর পর স্বামীর আত্মহত্যা ” নিচে মি.রিয়াদের ছবি দেওয়া। এটা কী কাজ করলেন মি. রিয়াদ! আমি দ্রুত উনার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বাসার গেটে দাঁড়াতেই একটি ছোট ছেলে আমার হাতে একটি কাগজ দিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে কাগজটি খুললাম –

” আপনার জন্য আমাকে জীবনে অনেক সাফার করতে হয়েছে, এখন থেকে আপনার সাফারের দিন শুরু। ”

কে লিখলো এমন কথা! আমার জন্য কে এমন সাফার করলো যে সে প্রতিশোধ নিতে চায়! যাক এসব না হয় পড়ে দেখা যাবে। এখন মি. রিয়াদকে দেখে আসি। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন ! কেউ অনিচ্ছায় জীবন হারায় আর কেউ নিজেই ভুল করে আবার নিজেই নিজেকে শেষ করে দেয়!

-সমাপ্ত-

আঁখি দেব তৃপ্তি

[ গল্পটির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। ইরিনা ইরিনকে নিয়ে আবারও অন্য কোনো কেস লিখবো সাথে থাকবে তার নিজের জীবনের গল্পও। তাই গল্পগুলো পেতে আমার পেইজ ফলো করে রাখতে পারেন। ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here