ইফ্রিতে মুসনাত পর্ব ১

0
1128

#ইফ্রিতে_মুসনাত
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আপত্তিকর স্পর্শে আয়ানার শরীর বারবার কেপে উঠতে লাগল। বরফের ন্যায় ঠান্ডা স্পর্শ আয়ানা তার ঘাড়ে-গলায় অনুভব করছে, তার ঠোটের কাছাকাছি কারো গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। স্পর্শগুলো ধীরে ধীরে নিবিড় হচ্ছে। আয়ানা চোখ মেলতে পারছেনা, নড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। তাও অনেক কষ্টে একপ্রকার জোর করে চোখ মেলে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসল। তাড়াহুড়ো করে টেবিলল্যাম্প জ্বালালো সে, চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে হাপাতে হাপাতে বেডটেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পুরো পানিটা সাবাড় করল।
তার হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ঘাড়ে-গলায় হাত বুলালো আয়ানা। রুমের পরিবেশ একদম স্বাভাবিক, দেয়ালঘড়িটার টিকটিক আওয়াজ টাই নীরবতার পতন ঘটাচ্ছে। আয়ানা ঘড়ির একবার দিকে তাকাল, রাত ৩ টা বেজে ৫০ মিনিট।
জড়োসড়ো হয়ে বসে আয়ানা ফজরের আযানের অপেক্ষা করতে লাগল। আবার ঘুমিয়ে পড়তে তার ভীষণ ভয় করছে, মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলেই আবার তার শরীরে খারাপ স্পর্শগুলোর ছোয়া লাগবে। আয়ানা কাপা কাপা হাতে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে নিয়নের নাম্বারে কল দিল। রিং হচ্ছে, কিন্তু রিসিভ করছেনা। কয়েকবার কল দেওয়ার পরও রিসিভ না হওয়ায় আয়ানা হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দিল। নিয়ন হয়ত এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আয়ানার নিয়নকে ব্যাপারগুলো জানাতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। অবশ্যই ব্যাপারগুলো তার জানানো উচিত। নিয়ন সেসব জানার পর কিভাবে নিবে বা কি বলবে সেটা আয়ানার জানা নেই। পরিবার থেকে তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে, নিয়নকে এসবে ব্যাপারে কিছু না জানাতে। কিন্তু একসময় তো নিয়ন ব্যাপারটা জেনেও যেতে পারে, তখন নিয়নের কাছে সে কতটা ছোট হবে সেটা কেউ ই ভাবছেনা। সবার এক কথা, এর আগেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে কোনোরকম কথাবার্তার প্রয়োজন নেই।
নিয়ন আয়ানার বাগদত্তা। আর ২দিন বাদে নিয়ন এবং আয়ানার বিবাহকার্য সম্পন্ন হবে। কিন্তু আয়ানা বিয়ের ব্যাপারে মনোযোগী হতে পারছেনা। তার মনে গভীর শঙ্কা আর ভয় কাজ করছে। মনে হচ্ছে, তার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ফজরের আযান পড়ে গেল। আয়ানা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দিল। তার মনে হতে লাগল, কেউ তাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। চাপাদৃষ্টিতে তার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে। আয়ানা এসবকে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করে ফ্রেশ হয়ে অযু করে নামায পড়ে নিল। নামায পড়লে তার মনটা হালকা হয়ে যায়, ডিপ্রেশন-খারাপ চিন্তাগুলো দূর হয়ে যায়। যদিও আলসেমির কারণে তার নিয়মিত নামায পড়া হয়না।
সকালের নাস্তা শেষ করে কাজ গুছাতে গুছাতে আয়ানা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ” মা কাল রাতে আবার একই ঘটনা ঘটেছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে।” আয়ানার মা হকচকিয়ে উঠে আয়ানার দিকে তাকাল। তারপর আয়ানা শরীরে ফুকে দিয়ে বললেন, ” এসব নিয়ে চিন্তা করিসনা, ভয়ের কিচ্ছু নেই। আর মাত্র ২ টো দিন, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
” আমার খুব ভয় হয় মা। আমি ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারিনা।”
” আজ থেকে তোর বিয়ের আগ অবধি আমি তোর সাথে ঘুমাব। দেখবি, এরকম আর কিচ্ছু হবেনা। এসব চিন্তা মন থেকে দূর করে দে। বিয়েটা হয়ে গেলে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এখন কেবল নতুন জীবন-সংসার নিয়ে ভাব।”
আয়ানা অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুকনোমুখে হাসি ফুটিয়ে মায়ের পাশ থেকে সরে এল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবল, ” সেটাই যেন হয়। এসব চিন্তায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিয়ে-সংসার নিয়েও ভাবতে পারছেনা।”
হাতের কাজ সেরে শাড়ির আচলে হাত মুছতে মুছতে আয়ানার মা নিজের রুমে চলে এলেন। ঢুকে দেখলেন আয়ানার বাবা আয়মান শাফি বিছানার উপর খাতা-কলম হাতে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। আয়ানার মা নিশ্চুপে গিয়ে তার স্বামীর পাশে বসলেন। আয়মান শাফি কথা শেষ করে আয়ানার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” যার যা কাজ আমি বুঝিয়ে দিয়েছি, বিকেলের মধ্যেই বিয়ের বাজারপত্র সব আসতে শুরু করবে। তুমি সবকিছু দেখে নিও।”
“হুম।”
” কি হয়েছে তোমার?”
“মেয়েটার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কাল নাকি আবার একই ঘটনা ঘটেছে তার সাথে।” কথাটা শুনে আয়মান শাফি সাহেবের চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল।
” দেখো, সালমা। এসবকিছুর জন্য যা যা করা দরকার করেছি এবং করব। তুমি দুশ্চিন্তা করোনা, ইনশা আল্লাহ বিয়েটা মিটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
” মেয়েটা খুব ঘাবড়ে আছে, ভয়ে ঘুমাতেও পারছেনা।
তাই আমি চাচ্ছি বিয়ের আগ অবধি রাতে আয়ানার সাথে ঘুমাতে। তাতে অন্তত মেয়েটা ভয় পাবেনা আর হয়ত তেমন কিছু হবেওনা।
” হুম, ঠিক বলেছো। আমিও ভেবেছি তোমাকে বলব, পরে ভাবলাম নিয়ন ওর সাথে রাতে কথাবার্তা বলে ওদের অসুবিধে হতে পারে। এখন যেহেতু আয়ানা খুব বেশী ই ভয় পাচ্ছে, তুমি এই কয়েকদিন ওর সাথেই থাকো। ভালোই ভালোই বিয়েটা মিটে গেলেই স্বস্তি।”
“সব যেন ভালোই ভালোই মিটে যায়।”
” আয়ানাকে এখন একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দাও তো।”
আয়ানার মা সালমা আরা মাথা নাড়িয়ে আয়ানাকে ডাকতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আয়মান সাহেব হাতের কলমটা নাড়াতে নাড়াতে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন।
আয়মান সাহেব শহরের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ৩ ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে সায়মার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীসহ অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। তার আদরের ছোট মেয়ে আয়ানা। সবে অনার্স পাশ করেছে। আর একটা মাত্র ছেলে আয়াত, ৭ম শ্রেণীতে পড়ছে। আয়মান সাহেব নিজের পছন্দের ছেলের সাথে আয়ানার বিয়ে ঠিক করেছেন। বিয়ের তোড়জোড় নিয়ে অনেক ব্যস্ত, সবদিক একা সামলাতে হচ্ছে। বড় মেয়ে জামাইসহ বিকালের ফ্লাইটেই দেশে আসছে, জামাই আসলে অবশ্য একটু চাপমুক্ত হবেন।
কিন্তু ঝামেলা বাধছে আয়ানাকে নিয়ে, ইদানিং যে মেয়েটার সাথে কি হচ্ছে…….
আয়ানা আয়মান শাফির রুমের সামনে এসে ছোট্ট করে বলল,
“আব্বু!!! আমাকে ডেকেছিলে?”
” হ্যা, মা। আয় ভেতরে আয়।”
আয়ানা এসে আয়মান শাফিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” বলো আব্বু।”
” আমার মায়ের বুঝি খুব মন খারাপ? ২ দিন বাদে বাসা ছেড়ে চলে যাবে বলে।”
” আমি যেতে চাইনা, তুমি ই তো তাড়াতাড়ি করে তাড়িয়ে দিচ্ছো।”
” তাড়িয়ে দিচ্ছিনা রে মা। নিশ্চিন্ত হচ্ছি, আর নিয়ন খুব ভালো ছেলে। ওর মত হিরের টুকরো ছেলেকে হাত ছাড়া করা যায় বল!”
” হুম খুব বুঝেছি। খুব জ্বালাচ্ছি তো তোমাদের তাই আমাকে অন্যের ঘাড়ে তুলে দিতে চাচ্ছো।”
” ঘাড়ে তুলে দিব কেন? আর তুই ঘাড়ে উঠবি ই বা কেন, উঠতে হলে সোজা মাথায় উঠে বসবি। যাতে সারাজীবন মাথায় করে রাখে।”
আয়মান সাহেবের কথা শুনে আয়ানা হাসতে লাগল। আয়মান সাহেব একটু স্বস্তি পেলেন, মেয়েটার খারাপ চিন্তাভাবনা-ভয় গুলো একটু হালকা হবে ভেবে।
” শোন মা, বিকেলে তোর আপু-দুলাভাই আসছে।
ওরা আসলেই তোর মা-আপুকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়িস। গয়নাগাটি সব গড়িয়ে রেখেছি। এর বাহিরে আর যা যা লাগবে কিনে নিস।
ভালো পার্লারের লোকের সাথে কথা বলে হোম সার্ভিসের ব্যাপারটা কনফার্ম করে আসিস।”
” ঠিক আছে আব্বু। আমি তাহলে যাই দেখি তোমার ছোট্ট দুষ্টু টা কই গেলো!”
” আচ্ছা যা মা।”
বিকালের দিকে আয়ানার বড় বোন-দুলাভাই এসে পড়ল। ওরা আসায় বাড়ীটা যেন পরিপূর্ণ রুপ পেল, এদিকে বড় বোনের ছেলে ৪বছরের মায়ানকে পেয়ে আয়ানাও ভীষণ খুশি। যত খারাপ লাগা-দুশ্চিন্তা ছিল সব ভুলে গেছে। আয়ানা এমনিতেও খুব চঞ্চল আর হাসি-খুশি টাইপ মেয়ে। এই কয়েকদিনের দুশ্চিন্তায় কেমন জানি একটু চুপ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েকে আবার আগের মত স্বাভাবিক দেখে সালমা আরা আর আয়মান শাফি দুজনেই খুব আনন্দিত।
পরেরদিন সন্ধ্যায় আয়ানা, মা-বোন মিলে বিয়ের কেনাকাটা করতে বের হল। কেনাকাটার এক পর্যায়ে সেখানে নিয়ন এসে হাজির। সায়মা দুজনকে আলাদা সময় কাটাতে দেওয়ার জন্য মাকে নিয়ে অন্য দিকে কেনাকাটা করতে চলে গেল।
শপিংমলের দোতলার রেলিং ধরে আয়ানা দাঁড়িয়ে রইল, নিয়ন এসে আয়নার হাতের উপর হাত রাখতে আয়ানা চমকে উঠে দ্রুত হাত সরিয়ে নিল।
নিয়ন অবাক হয়ে বলল, ” কি ব্যাপার আয়ানা?”
আয়ানা একটু চুপ হয়ে গেল। আয়ানা নিজেও বুঝতে পারল না সে কেন এভাবে চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিল। কেন জানি ও আচমকা স্পর্শ পেলে আতকে উঠে, মনে হয় এই বুঝি সেই খারাপ স্পর্শটা। নিয়ন কে তো এসব বলা সম্ভব না, তাই কথা ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য আয়ানা বলল,
” এখনি হাত ধরার এত তাড়া কিসের মশাই? হাতে তো আর মাত্র ১ টা দিন।
নাকি ভাবছেন আপনার বউ পালিয়ে যাচ্ছে!”
” আয়ানা তুমি এত মজা করোনা! আচ্ছা বাবা একদম বউ বানিয়ে তবেই তোমার হাত ধরব।”
” এইসময়ে এখানে এলেন যে? মা-আপু কি ভাবল!! ”
” আব্বু ফোন দিয়ে বলল তোমরা শপিং এ এসেছো, ভাবলাম এসে এক ঢিলে দুইপাখি মেরে যাই।”
” তা কোন দুইটা পাখি মেরেছেন?”
” এক. আপনাকে দেখা হলো আর ২. দুজন একসাথে পছন্দ করে বিয়ের শেরওয়ানী কিনব। হবুবউয়ের পছন্দ বলেও একটা ব্যাপার আছে তাইনা।”
” তাহলে চলুন, দেখে আসি।”
নিয়নের সাথে আয়ানা শপিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিয়ন অনেক ভালো মনের একটা ছেলে, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই নিজে থেকে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করেছে। আয়ানা কে মোটামুটি প্রায়োরিটি দিচ্ছে। বলতে গেলে, আয়ানার ও নিয়নের সঙ্গ ভালো লাগতে শুরু করেছে।
কিন্তু একটা জায়গায় আয়ানা আটকে আছে, কিছুতেই নিজের মনে জমে থাকা ভয়ের কথা নিয়নের সাথে শেয়ার করতে পারছেনা। এর জন্য ওর একটু আফসোস কাজ করছে।
.
রাতের বেলা মায়ের সাথে ঘুমাল আয়ানা। কিন্তু মাঝরাতে মনে হল কেউ তার পাশে বসে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আয়ানা চোখ না খুলে পাশ ফিরে তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তাতেও আয়ানার ভয় বা অস্বস্তি কোনোটাই কাটলনা। তার মাথার কাছের জায়গাটা কেমন ভারী মনে হচ্ছে, কেউ পাশে বসে থাকলে যেমন ভারী লাগে ঠিক তেমন।
অনুভব করছে কেউ ওর ঘাড়ের খোলা অংশে আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আয়ানা ভয়ে মাকে আরো জাপটে ধরেছে। সুড়সুড়ি আর সহ্য করতে না পেরে আয়ানা শোয়া থেকে উঠে বসে। এতে তার মায়ের ও ঘুম ভেঙ্গে যায়। সালমা আরা টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করে,
” কি হয়েছে আয়ানা?”
” মা আমার এখনো মনে হচ্ছে আমার মাথার পাশটায় কেউ বসে আছে। তীক্ষ্ম নখওয়ালা আঙ্গুল দিয়ে আমার ঘাড়ে আলতো করে সুড়সুড়ি কাটছে।
সালমা আরা এক নজরে আয়ানার ঘাড়ের খোলা অংশ দেখে নিলেন। সত্যিই আয়ানার ফর্সা ঘাড়ে নখের হালকা আচড়ের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সালমা আরার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে গেল। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে যত দোয়া-দরুদ জানা আছে সব পড়ে ফুকে দিলেন। মেয়েকে কোলে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজে সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিলেন। মেয়েটার সাথে যে কি হচ্ছে উনি নিজেও বুঝতে পারছেননা। শুধু এখন মনে মনে প্রার্থনা করছেন, বিয়েটা যাতে ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।
আয়মান শাফি আর সায়মার স্বামী মাহমুদ বিয়ের বাড়ীর কাজে ছোটাছুটি করছেন। বাড়ীটা ডেকোরেশনের লোক- মেহমানে গমগম করছে। দোতলার বাড়ীটা ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আদরের ছোট মেয়ের বিয়েতে কোনোরকম ক্রুটি রাখতে চাননা আয়মান সাহেব। জামাই মাহমুদ থাকায় অনেকটা নিশ্চিন্ত তিনি। জামাই একাই তার অনেকটা কাজের ভার নিয়ে নিয়েছে। আয়ানাও কাল রাতের ঘটনা মন থেকে ঝেড়ে স্বাভাবিক আছে। হৈ-হুল্লোড়, মাতামাতি করে নিজের বিয়ে বাড়ীটা নিজেই জমিয়ে দিচ্ছে। রাতে মেহেন্দী পরানোর লোক আসল, সুন্দর করে মেহেন্দী পড়িয়ে দিল। কিন্তু বিপত্তি বাধল নিয়নের নামটা লিখতে গিয়ে। যতবার লেখা হচ্ছে, ততবার ই মেহেন্দী লেপ্টে যাচ্ছে। সায়মা এই অবস্থা দেখে বলল,
” সামান্য একটা নাম লিখতে গিয়ে আপনি এতবার লেপ্টে দিচ্ছেন কেন? এমন হলে পুরো মেহেন্দীর নকশা দেখতে বাজে হয়ে যাবে।”
” আপু আমি সুন্দরভাবে লিখতে চাচ্ছি, কিন্তু জানিনা কেন বার বার হাত কেপে কেপে লেপ্টে যাচ্ছে। আমি আবার চেষ্টা করছি।”
” থাক, নাম লিখতে হবেনা। আবার লিখতে গেলে পুরো মেহেন্দীর নকশা বাজে হয়ে যাবে।” মেয়েটা গোমড়ামুখে বলল,
” তবে কি বউয়ের হাতে নাম লিখবনা? এটা কেমন জানি দেখায়!”
” আপনি তো নামটা লিখতে পারছেননা। আর নাম না লিখলে কি হবে?
স্বামী তো স্বামী ই থাকবে।”
আয়ানার চুপ করে একমনে হাতের মেহেন্দীটা দেখতে লাগল। বান্ধবীদের কাছে শুনেছিল, হাতের মধ্যে বরের নাম লেখা থাকলে নাকি দুজনের মহব্বত বাড়ে। এখন লিখতে না পারায় আয়ানার একটু খারাপ লাগছে।
সায়মা সেটা বুঝতে পেরে বলল, ” কাবিননামায় আর মনে নাম লিখিয়ে নে, এটাই যথেষ্ট। তোকে ছেড়ে আর পালানোর কূল পাবেনা। দেখছিসনা, তোর দুলাভাইকে আমি এখনো কেমন আচলে বেধে রেখে দিয়েছি। কোথাও পালাতে পারেনা বেচারা।” মাহমুদ শুনতে পেয়ে বলল,
” শুনো শালিকা, আর যাই করো তোমার বোনের মত হয়োনা। তাহলে ওই বেচারা কেদে কূল পাবেনা।” শুনে আয়ানা হাসতে লাগল। এতকিছুর মধ্যে ওর মন খারাপের লেশমাত্র রইলনা।
পরেরদিন সন্ধ্যার আগে সাজানোর লোক চলে এল। তারা আয়ানাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবাই বিয়ের বাড়ীর কাজে খুব ব্যস্ত। আয়ানা আজ অনেক খুশি, নিয়নের মত একটা ভালো ছেলেকে সে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাচ্ছে। সাজ শেষ হলে আয়ানা আয়নায় নিজেকে ভালোকরে দেখে নিল, সত্যিই ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে। লেহেঙ্গা শাড়ি, শরীরভর্তি ভারী ভারী সোনার গয়নাতে তাকে একদম পারফেক্ট বউ লাগছে। এমনসময় নিয়ন কল দিল।
আয়ানা রিসিভ করতেই নিয়ন বলল, সাজ কমপ্লিট?
“হ্যা।”
“তোমার পাশে কে আছে?”
” কেউ নেই। সবাই নিজ নিজে কাজে ব্যস্ত। আমাকে একা বসিয়ে রেখে গেছে।”
” এটাই চাইছিলাম। একটু ভিডিও কলে আসো তো। তোমায় বউ সাজে দেখি।”
“মোটেও না। একদম এসে দেখবেন। এর আগে এসব দেখাদেখির মধ্যে আমি নেই।” নিয়ন আর কিছু বলার আগেই আয়ানা ফোনটা কেটে দিয়ে হাসতে লাগল। তক্ষুনি ফোনে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল।
” আমি আসছি তোমাকে বউ সাজে বউরুপে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য।
বের হচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।”
আয়ানা মুচকি হেসে নিয়নের ম্যাসেজ টা পড়ে নিল। এমনসময় মনে হল তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ফিরে সে কাউকে দেখতে পেলনা, তবে খুব বিকট আওয়াজে বিচ্ছিরি একটা হাসির শব্দ তার কানে ভেসে আসল। কাপা কাপা কন্ঠে আয়ানা বলতে লাগল,
” কে ওখানে? সামনে এসো বলছি।”
সায়মা রুমের ভেতরে ঢুকে বলল, কাকে খুজছিস? একা একা কার সাথে কথা বলছিস তুই? আয়ানা স্বাভাবিকভাবে বলল,
“না কেউ না তো।”
” মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে আমার বোনটাকে। নিয়ন বরযাত্রী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, কিছুসময়ের মধ্যে এখানে পৌছে যাবে। তৈরী হয়ে যা তাকে নিজের করে নেওয়ার জন্য!”
আয়ানা সায়মার কথা শুনে লজ্জায় মুচকি হাসল।
(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here