ইফ্রিতে মুসনাত পর্ব ১০

0
359

#ইফ্রিতে_মুসনাত
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আয়ানা একমনে রান্নাঘরে কাজ করছিল, হঠাৎ সাদ এসে পিছন থেকে তার গাল দুটো টেনে দিল। আয়ানা চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে সাদকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল, “আপনি!! এভাবে গাল টানলেন কেন?”
সাদ মুচকি হেসে নাকটা টেনে বলল, ” নিজের বউয়ের নাক-গাল টানলে কোনো কেস খাওয়ার চান্স আছে?” আয়ানা সাদের কথা শুনে অবাক হল। এই ছেলের মাঝে মাঝে কি হয় সে নিজেও বুঝতে পারেনা। এই কাছে টেনে, এই আবার দূরে ঠেলে দেয়। সাদের হাস্যজ্জ্বল চেহারা দেখে আয়ানা আর কিছু বলতে পারেনা।
সাদ আয়ানার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে বলে, “চোখ বড় বড় করে তাকিওনা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।”
এমনসময় জেসমিন রান্নাঘরে আসায় সাদ বেরিয়ে যায়। আয়ানার মাথায় শত চিন্তা ঘুরপাক খায়, এই ছেলের আজ হয়েছেটা কি! সে যাই হোক, আজ সাদকে ও প্রশ্নগুলো করেই ছাড়বে। আজ যদি সাদ উত্তর না দেয় তাহলে আয়ানা তাদের সম্পর্কে ইতি টানবে। এভাবে রোজ রোজ অবহেলা আর হাজারটা কৌতূহল নিয়ে অন্তত ভালোভাবে থাকা যায়না।
সারাদিন সাদ বাসায় ই ছিল, আজ একবারের জন্য ও রুম থেকে বের হয়নি। আয়ানাও সাদের মুখোমুখি হয়নি, সে ঠিক করে নিয়েছে সন্ধ্যায় একেবারে সাদের সামনে গিয়ে তার প্রশ্নগুলো করবে। নিজেকে শক্ত-কঠোর করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সন্ধ্যাবেলা আয়ানা সব কাজ সেরে রুমে ঢুকল। ঢুকে দেখে রুমের আলো নিভানো, ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাদ রুম অন্ধকার করে কি করছে!
আয়ানা কোনোকিছু না বলে হাতড়ে হাতড়ে লাইটের সুইচকর্ণারে দিকে যেতে লাগল, এমনসময় কেউ তার গলায় কিছু একটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
” আলো জ্বালানোর চেষ্টা করবেননা।”
“কে?? সাদ আপনি কোথায়?”
” চুপচাপ এখানে দাড়ান।” আয়ানা আস্ত ঢক গিলে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক তখনি অনেকগুলো মোমবাতি একসাথে জ্বলে উঠল। আয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, পুরো রুম মোম আর লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো।
সাদ আয়ানার সামনে ছুরি ধরে বলল, “ছুরিটা ধরো।”
” অবাকতার পর্ব শেষ করে চলো দুজন একসাথে কেকটা কাটি। আমি এসব কেক কাটায় বিশ্বাসী নয়, কোনো অপসংস্কৃতি উপলক্ষে কেক কাটা হারাম। কিন্তু এটা আমি শুধু তোমাকে একটা সুন্দর মূহুর্ত উপহার দেওয়ার জন্য ই এই আয়োজন।”
আয়ানার সাদের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকাল। ছোট্ট টেবিলটায় একটা সুন্দর কেক রাখা। কেকের উপর চাবাগানের থিম দেওয়া হয়েছে, তাতে একটা চিরকুট “চাবাগানের জ্বীন”। লেখাটা পড়ে আয়ানার হাসি পেল। কিন্তু সাদ কি করে বুঝল আয়ানা তাকে প্রথম দেখায় জ্বীন ভেবেছিল।
আয়ানার হাতে সাদ ছুরিটা ধরিয়ে একসাথে কেকটা কাটল। সাদ কেকের টুকরো আয়ানাকে অল্প খাইয়ে বাকিটা নাকে লাগিয়ে দিল। আয়ানা কিছুটা অভিমান করে বলল, ” সবসময় আপনি আমার নাকের উপর অত্যাচার চালান কেন?”
“নাকের নিচের অংশে এখনো অধিকার পাইনি তো। পেলে ওইটায় চালায়।”
আয়ানা চমকে নিজের ঠোট কামড়ে ধরল। আজকাল ভুতের মুখে রাম নামের মত ব্যাপার হচ্ছে। সাদ শব্দ করে একটু হেসে হা করে রইল। আয়ানা অনেকটা কেক একসাথে নিয়ে সাদের মুখে ঘষে দিল। সাদ মুখটা গম্ভীর করে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। সাদের এমন মুখ দেখে আয়ানা হাসতে লাগল। সাদ আড়চোখে আয়ানার হাসি দেখতে দেখতে বলল, “আবার কামড় খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে নিশ্চয়ই।” আয়ানা মূহুর্তেই হাসি বন্ধ করে টিস্যু দিয়ে সাদের মুখের কেক মুছে দিল। সাদ আয়ানার দুটো হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নরমসুরে বলল,
” আমার উপর খুব রাগ তোমার, তাইনা?”
আয়ানা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। সারাটাদিন অভিমানে নিজেকে কঠোর করার চেষ্টা করেছে শুধু সাদকে আজ প্রশ্নগুলো করবে বলে। কিন্তু সাদের এসব পাগলামী আর নরমকন্ঠের আকুতি শুনে আয়ানার ভিতরটা দূর্বল হয়ে গেছে। সে চাইলেও পারছেনা কঠোরগলায় সাদকে প্রশ্ন করতে। কিন্তু যাই হোক, আজ সাদকে সে প্রশ্নগুলো করেই ছাড়বে।
আয়ানা সাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল, যেগুলোর উত্তর জানা আমার জন্য আবশ্যক। আজ যদি আপনি সেগুলোর উত্তর না দেন তাহলে আমি আপনার সাথে সব সম্পর্কের ইতি টেনে দিব।”
” আজ প্রশ্নগুলো না করলে হয়না?”
“কেন? আজ উত্তর দিতে কি সমস্যা?”
সাদ আয়ানার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল, “আচ্ছা আয়ানা তুমি যদি কখনো কোনো কঠিন সত্যির মুখোমুখি হও, তখন কি আমাকে খুব ঘৃণা করে ছেড়ে যাবে?”
এই প্রশ্নে আয়ানা কেপে উঠল। তবে কি তার সন্দেহ ই সত্যি? সাদের অন্য কোনো গোপন সম্পর্ক আছে যেটা সে জেনে গেলে তাকে ঘৃণা করে ছেড়ে দিবে!
আয়ানা আমতা আমতা করে বলল, “তেমন যদি হয় আপনাকে আমি মুক্তই দিয়ে দিব। যেকোনো কঠিন সত্যির মুখোমুখি হতে আমি প্রস্তুত।”
সাদ আর কিছু না বলে একটা কাজ করে বসল। আয়ানার কপালে গভীর ভাবে তার ঠোটের স্পর্শ দিল। আয়ানা এক দৃষ্টিতে সাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সাদের চোখে সে অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে। সাদ আয়ানাকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরল। আয়ানার চুলে নাক ডুবিয়ে এক হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চুলে বিলি কাটতে লাগল। আয়ানা অবুঝের মত সাদের বুকের উপর পড়ে রইল। আয়ানা গভীর উষ্ণতায় চোখ বুজে রইল।
এমনসময় জেসমিনের ডাক ভেসে এল, “সাদ, এই সাদ। একবার এদিকে এসোতো।” সাদ আয়ানাকে হালকা ভাবে ছেড়ে আয়ানার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এক্ষুণি আসছি।”
সাদ বেরিয়ে যাওয়ার পর আয়ানা বিছানার উপর বসে পড়ল। সে ভাবছে, সত্যটা না জেনে সাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা কি উচিত হবে! তার মনের ভেতরের খুতখুত টা যতক্ষণ না যাচ্ছে, ততক্ষণ সাদ যা ই করুক আয়ানার কাছে সেটা স্বাভাবিক হবেনা। অতএব, সবকিছুকে স্বাভাবিক রুপ দেওয়ার জন্য আয়ানাকে আগে সত্যটা জানতে হবে।
.
আয়ানা নিজেকে প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুত করছে, যাতে সাদের মোলায়েম আকুতি তাকে দমাতে না পারে। রুমের এই মাথা থেকে ও মাথা অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে। এমনসময় ব্যালকুনি থেকে দমকা হাওয়া এসে সবগুলো মোম নিভিয়ে দিল, আয়ানা ব্যালকুনির হালকা আলোটা জ্বালিয়ে দরজা লক করে রুমের সুইচ টিপতে গেলে খুব ঠান্ডা খসখসে একটা হাত তাকে চেপে ধরে। আয়ানা হাতটা অনুসরণ করে তাকাতেই দেখে সেই লালচক্ষুর অবয়বটা তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আয়ানা চিৎকার করে সরে গিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে রুমের দরজা খুলতে চেষ্টা করে। দরজা লক হয়ে আছে কিছুতেই খুলছেনা। এদিকে অবয়বটা এদিকে এগিয়ে তার দিকে ঝাপিয়ে পড়ছে, আয়ানা মূহুর্তে ওখান থেকে সরে যায়। এভাবে কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে দক্ষযজ্ঞ চলে। অবয়বটা খুব ক্ষেপে গেছে আয়ানাকে ধরতে না পেরে, সে ছুটে এসে আয়ানার চুল চেপে ধরে। আয়ানা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সে অবয়বটার দিকে মুখের থু থু মারে।
অবয়বটা রেগে গিয়ে আয়ানার মাথা দেয়ালের সাথে বাড়ি দেয়।
আয়ানা ব্যথা পেয়ে কোকড়িয়ে উঠে, অতঃপর আয়ানাকে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে আয়ানার তলপেটে একটা চাপড় দেয়। আয়ানা এতে বেশী ব্যথা না পেলেও একটু দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু আয়ানা দমে না, অবয়বটা তার কাছে এগিয়ে আসতে গেলে বামপা দিয়ে কষে একটা লাথি দেয়। অবয়বটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খায়। আয়ানা কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায়। অবয়বটা ভয়ানক চিৎকার দেয়, আয়ানা সাথে সাথে কেক থেকে ছুরিটা হাতে তুলে নেয়। তারপর বিসমিল্লাহ পড়ে তেড়ে আসতে থাকা অবয়বটার হাতে একটা গভীর আচড় দিয়ে দেয়।
অবয়বটা ব্যথা পেয়ে আয়ানার কাছ থেকে সরে পালিয়ে যেতে চাইল।
কিন্তু আয়ানা সূরা ফাতিহা পড়তে পড়তে তার পথ আগলে দাড়াল। অবয়বটা আরো ভয়ানক ভয়ানক কন্ঠে আর্তনাদ করতে লাগল। আয়ানা রুমের সুইচ জ্বালাল। আলো জ্বালানোর সাথে আয়ানা অবয়বটার দিকে তাকাল। অবয়বটা তার কিছুক্ষণের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আয়ানা তখনো রাগে-জেদে থরথর করে কাপতে লাগল।
আয়ানা চুপচাপ বিছানার উপর বসে আছে। রুমে শুধু টেবিল ল্যাম্পটাই জ্বলছে। আয়ানার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে, তার মুখ পুরো লাল হয়ে আছে। চুলগুলো অযত্নে বেধে রেখেছে। হালকা ঘৃণা-রাগ তার চোখে ফুটে উঠেছে।
আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে আয়ানা। অনেক সহ্য করেছে সে, আর নয়। এবার যা হবে, তার জন্য আর একবারো ভাববেনা আয়ানা।
এমনসময় সাদ রুমে ঢুকল। আয়ানা একবার চোখ তুলেও দেখলনা। সাদ আয়ানাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আয়ানার কাছে এল। ওর পাশে বসে কাধে হাত রাখতেই আয়ানা তার দিকে তাকাল।
সাদ আয়ানার কান্না দেখে জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে আয়ানা? তুমি কাদছো কেন?”
আয়ানা কিছু না বলে সাদের হাত চেপে ধরে বলল,
” আমাকে একটা সত্যি কথা বলুন।”
” কি সত্যি?”
আয়ানা এক পলক সাদকে দেখে নিয়ে জোরগলায় বলল,
” আমার উপর যে জ্বীনটা চড়াও হয় সেটা আপনি তাওনা?”
সাদ আচমকিত হয়ে আয়ানার দিকে তাকিয়ে রইল। আয়ানা রেগে গিয়ে বলল,
” বলুন সেটা আপনি? আমাকে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেননা।”
সাদ একটু চুপ থেকে ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে নিচুস্বরে বলল,
“হ্যা সেই জ্বীনটা আমি…….”
আয়ানা অবাক না হয়ে প্রচন্ড রাগ নিয়ে সজোরে সাদের গালে একটা চড় বসাল।
(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here