আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ১৫

0
296

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৫
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)

রাত্রির ভয় হচ্ছে। মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করছে। আদী উলটো পালটা কিছু করব কিনা তা নিয়ে মস্তিষ্কে ঝড় বইছে। কিন্তু একবার যখন রাজি হয়েছে, তখন মৃত্যু এলেও রাত্রির কিছু বলার থাকবে না। তাই নিজেকে প্রাণপণে সংযত রেখে রাত্রি চোখ নামিয়ে বসে আছে।

—এবার কাজল পরিয়ে দিই?

আদী জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু রাত্রি জবাব দেওয়ার পরিবর্তে একবার চেয়ে দেখে আবারও একই ভঙ্গিতে বসে রইল।

কাজল আর আয়না এগিয়ে দিয়ে আদী বিষাদের হাসি হাসল। বলল,

—তুমি পরে নাও। আমার অভ্যেস নেই।

রাত্রি বাধ্য মেয়ের মতো কাজল পরে নিলো। এটি করতে গিয়ে তার চোখে জল এসেছে যা আদী টের পায়নি৷ এ জল কাজল দিয়ে সৃষ্টি নয় বরং অন্য এক আদীকে দেখতে পেয়ে রাত্রির বুকের কষ্ট কালো হয়ে ওঠছে আর তা চোখের অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে।

একে একে আদী রাত্রির পায়ে নূপুর আর কানে দুল পরিয়ে দিলো। দুল পরানো শেষে আদী অতি যত্নে রাত্রি মুখ দু’হাতে সামনে এনে কপালের মাঠে গাঢ় প্রেম এঁকে দিলো। রাত্রি হতভম্ব হলো, কিন্তু আরও বেশি অবাক হলো যখন আদী তার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে কেঁদে ওঠল। বলল,

—রাত্রি, আমাকে একটু ভালোবাসবে? আমার মতো খারাপ ছেলেকে না কেউ ভালোবাসে না। তুমি… তুমি আমাকে…

আদী কাঁদছে; ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এর আগে রাত্রি কখনো আদীকে এমন করে কাঁদতে দেখেনি। আদী কাঁদত। তবে সামান্য জল এলেই হাতের উলটো পিঠে মুছে ঠিক হয়ে যেত, কিন্তু আজ এমন বুকফাটা কান্নায় কেন ভেঙে পড়েছে আদী? এমন চিন্তায় ব্যস্ত রাত্রি। সে কী করব আর বলব তা চিন্তা করতে করতেই আদী উঠে অন্য রুমে চলে গেল। রাত্রি নির্জীব হয়ে বসে রইল।

*

আকাশে একফালি চাঁদ। আকাশ আজ জ্যোৎস্নায় স্নান করছে অবিরত। মস্ত আকাশের স্নিগ্ধতা পৌছে গেছে বসার ঘরে। যে ঘরে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সোফায় পড়ে আছে রাত্রি। হঠাৎ রাত্রির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সামান্য দ্বিধান্বিত হলো। কিন্তু হঠাৎ ডান পায়ের পাতায় কীসের যেন নাড়াচাড়া অনুভব করল। ভয় পেয়ে আচমকা সোজা হয়ে বসল। সম্মুখে আদীকে দেখতে দেখতে পেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

—আদী… তুমি…

আদী মেঝেতে বসে রাত্রির পায়ের নূপুর নিয়ে খেলছে যেন এ খেলায় সে দারুণ ভাবে মত্ত হয়ে আছে। চোখজোড়া তার রাত্রির পায়ে আবদ্ধ। সমস্ত মুখে ছেয়ে আছে অপরিসীম ক্লান্তি। তবে মুখে কোথাও রাগ ছায়াটিও নেই।

—অবশেষে তোমার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। আজ সারাদিনে আমার সাথে একটি কথাও বলোনি। আপত্তি নেই। যাকে ঘৃণা করো, তার সাথে কথা বলতে তো সমস্যা হতেই পারে, তাই না?

এ বলে আদী তাকাল রাত্রির দিকে। চোখে চোখ পড়তেই রাত্রি তৎক্ষনাৎ নিজের চোখ সরিয়ে নিলো। মুহূর্তেই তার মুখে যেন অভিমানের সাতরং খেলা করে গেল। রাত্রির এমন মুখ দেখে আদী অন্য হাসি হেসে বলল,

চোখে ঘুম নেই আমার
বোধহয় তোমার ছবি অঙ্কিত আছে বলে।
দুই চোখ বুজে দিলে তাই ঘুম নয়,
শয়নেস্বপনে তুমি আসো ক্ষণে ক্ষণে।

শ্রেয়সী, তুমি কি তবে আমার চোখের ঘুম কেঁড়ে নিলে?
বুকের ভেতরে জ্বালা ঢেলে দিলে?
কেন করলে এমন শ্রেয়সী?
তুমি কি জানো না ঘুমহীন মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে না?
এমন সুপরিকল্পিত হ””ত্যা কেন করতে চাইছ শ্রেয়সী?

আমি তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলাম,
শুনিয়েছিলাম বুক পকেটে জমা একগুচ্ছ প্রেমের প্রলাপ,
কিন্তু তুমি হেসে উড়িয়ে দিলে।
আমায় খুব যত্ন করে আঘাত দিলে।
কেন করলে এমন শ্রেয়সী?

শ্রেয়সী, তুমি কি আমার চোখের ঘুম হবে?
তুমি ঘুম হলে আমি যে বেঁচে যেতাম।
নির্ঘুম রাত্রি যে আর করতে পারি না পার।
শ্রেয়সী, হবে কি আমার এক রাত্তির ঘুম?

এসব শুনে রাত্রি অবাক হলো, কিন্তু নিজের পায়ে আদীর টুকরো টুকরো স্পর্শে রাত্রির ভীষণ রাগ হচ্ছে। তাই সে ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু অন্য রুমে প্রবেশ করার আগেই আদীর বাহুডোরে বন্দী হলো। রাত্রি সামান্য চিৎকার করে জানান দিলো তার হাতে সে ব্যথা পেয়েছে। কারণ আদীর বুকে আছড়ে পড়ার মূহুর্তে কাচের চুড়িতে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ব্যথায় কাতর কণ্ঠে নিসৃত হলো যে চিৎকার তা যেন আদী শুনতে পেল না। রাগত স্বরে বলল,

—আমাকে কী ভাবো তুমি?

—কিছুই ভাবি না।

কান্নায় ধরে আসছে রাত্রির গলা তবুও সে রাগ ফুটিয়ে আদীকে জবাব দিলো। এসব নিরপেক্ষতার প্রভাব বিস্তার করে রাত্রি যে জবাব দিলো, তাতে আদীর মনে হিংস্রতা জ্বলে ওঠল,

—তুমি আমাকে নরপিশাচ ভাবো রাত্রি। এমন চিন্তা কেমন করে করলে তুমি? তোমাকে একদিনের জন্য গার্লফ্রেন্ড হিসাবে চাওয়া, ভালোবাসতে চাওয়ার মানে কি আমি তোমায় ভক্ষণ করতাম?

—আমাকে… আমাকে যেতে দাও। আমার হাত জ্বলছে।

—জুলুক তোমার হাত।

আদী চিৎকার করে ওঠল। নিস্তব্ধ রাতে ফাঁকা বাড়িতে আদীর কণ্ঠ ভীষণ ভয়ংকর শোনালো। রাত্রি ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু কী করবে এখন সে?

—তোমারে কইছে আমার লাইগা একদিনের প্রেমিকা হইতে। আরে তোমারে নিয়া যদি আমার অন্য চিন্তা থাকত। তাইলে দেড় বছর আগেই আমি উলটা পালটা কিছু করতে পারতাম। তোমাগো বাড়িতে সেই দিন কেউ আছিল না। সন্ধ্যার পরে আমি তোমার ঘরে ঢুকছিলাম। তুমি ঘুমায় ছিলা। আমার অন্য ফন্দি থাকলে একলা ঘরে তোমার গায়ে কাঁথা টাইনা আমি চইলা যাইতাম না। আমি তোমারে একলা এত দূরে একটা বাড়িত আনছি বইলা তুমি আমারে এইটুকু বিশ্বাস করতে পারলা না?

—আমি… আমি তোমাকে অবিশ্বাস…

—কথা কইয়ো না তুমি। তোমার উস্টা মার্কা কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। আমারে যদি অবিশ্বাস না করতা তাইলে তোমার বান্ধবীরে দিয়া বিষ আনাইছ ক্যা? কোন কারণে আজকা তুমি তোমার লগে বিষ লইয়া আইছ?

রাত্রি চুপ করে আছে। হ্যাঁ, রাত্রি এখানে আসার আগে বিষের ব্যবস্থা করে এসেছে। ভেবেছে আদী যদি মস্তিষ্ক বিকিয়ে কোনো কাজ করে। তবে আব্বা আম্মার সামনে না দাঁড়িয়ে বিষ গলাধঃকরণ করবে। কিন্তু এটি যে আদী টের পেয়ে যাবে তা রাত্রি ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি।

—আমারে ঘৃণা করো— এটা আমু মাইনা নিতাম। কিন্তু এমন চিন্তা কেমনে করলা তুমি? বুশরা তো তোমারে সব কইছে। তাও তুমি এমন চিন্তা করতে পারলে?

রাত্রি শুরু থেকেই আদীর টিশার্ট দু’হাতে খামচে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এখন একের পর এক আদীর বলা কথাগুলো শুনে রাত্রির হাতের মুঠো থেকে টিশার্ট আলগা হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ আদীর বুকের ভেতরকার যে ছন্দপাত রাত্রি ডান হাতে অনুভব করছিল, তা ক্রমশ দূরত্বে চলে যাচ্ছে বলে রাত্রির অজানা কষ্ট হচ্ছে। রাত্রির ইচ্ছে করছে আদীকে চিৎকার করে বলতে,

—আমি তোমাকে নরপিশাচ ভাবিনি আদী। তোমার মন বড়ো বেশি ভালো। কিন্তু নেশা করলে তুমি যা বলো তা আমি সহ্য করতে পারি না। ওই নোংরা কথাগুলো বাস্তবে যদি তোমারই অজান্তে আমার সাথে ঘটে যায়। তাহলে আমার যে মরণ ছাড়া গতি হবে না। আমি তোমাকে দোষ দিতে পারি না অথচ এসব সৃষ্টিকারী তুমি নিশ্চয়ই নির্দোষী হবে না।

—কথা কও না ক্যা? আমি তোমার লগে কী এমন করছি যে তুমি আজকা আমার মনডা এমন কইরা ভাইঙা দিলা? আমার খোয়াব ছিল তোমারে খয়েরি রঙের শাড়িতে দেখমু। তাই কত খোঁজাখুঁজি কইরা নিজে তোমার লাইগা শাড়ি কিনা আনছি। তোমারে নিজ হাতে সাজাইয়া চাইছিলাম তোমার কোলে মাথা দিয়া ঘুমাইতে। তোমার লগে রাত জাইগা চাঁদ দেখতাম। আমার এসব চাওয়ারে তুমি এমন নোংরা কলঙ্ক দিয়া দিলা? আমরা পুরুষ জাত কি এতই খারাপ রাত্রি?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here