আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ১৪

0
269

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৪
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)

রাত্রির ক্রমশ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এখন আদীর সাথে তর্ক করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই অগত্যা সে ইনবক্সে চোখ বুলিয়ে আদীকে বলল,

—দেখেছি।

—কেমন?

—খুব ভালো।

—এইত্ত, তা বুঝলা ছবিডা?

—না।

রাত্রি গম্ভীর গলায় একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। এর বেশি কোনো প্রতিক্রিয়া তার গলার স্বরে ভাসছে না। এদিকে আদী নেশায় বিভোর হয়ে ক্ষণে হাসছে তো ক্ষণে রেগে কথা বলছে। তার কণ্ঠস্বর নেশায় গাঢ় হয়ে ওঠছে।

—গাঁ””জা। নাম শুনছ তো না কি? আজকেই প্রথম খাইলাম। ভালোই নেশা নেশা লাগতাছে। তবে এহন অন্য নেশায়ও টানতাছে।

এ বলে আদী একটুখানি চুপ থেকে রাত্রিকে ডাকল,

—রাত্রি?

—হুঁ।

—হুঁ কী? সুন্দর কইরা উত্তর দিতে পারো না?

—পারলে তো তোমাকে উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ দিতাম না।

—পারো না কেরে? তুমি বুঝো না এখন আমার অন্য কিছু মন চাইতাছে? তোমার কণ্ঠ শুনে আমার নেশা গাঢ় হচ্ছে। এই রাত্রি, আমার বউ হবে? আমি তোমার কোমল হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের হাতের আঙুল মিলিয়ে নিতে চাই। এরপর বলো তো কী করব?

আদী কথা শুনে রাত্রি অবাক আর ভয় পেয়ে রীতিমতো কাঁপছে। নেশা করলে মানুষের আচরণের বিশ্রী হয়ে যায়। কিন্তু আদীকে এমন অবস্থায় দেখবে তা সে জীবনেও ভাবেনি। রাত্রির মনে হচ্ছে এসবই স্বপ্ন আর একটু বাদেই ঘুম ভেঙে যাবে। সে মনে মনে খুব চাইছে এসব যেন স্বপ্ন হয়।

—এই রাত্রি, শোনা না। এই আমার প্রেমিকা। এই এই আমার মুখভার করা বউ।

—আদী, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কাকে কী বলছ তা হয়তো তুমি বুঝতে পারছ না।

আদী অট্টহাসি দিয়ে বলল,

—বুঝতে পারছি কাকে কী বলছি। যার হাতে চুড়ি পরিয়ে টুক করে হাতের উলটো পিঠে প্রেম এঁকে দিবো, যার মাথায় ঘোমটা টেনে তারই কপালের মাঠে আমি প্রেমের লাঙ্গল চালাব, যার হরিণী চোখে নিজ হাতে কাজল পরিয়ে আমার নিকোটিনে জ্বলা ওষ্ঠ ছোঁয়াব; তাকে এসব বলতে নতুন করে কী বুঝতে হবে?

এক মুহূর্তের জন্য রাত্রি হিম হয়ে গেল। তার সমস্ত শরীরের ক্রিয়াকলাপ যেন নিমিষেই স্থির হয়ে গেল। সারা মস্তিষ্ক জুড়ে বিস্ময়ের ঢেউ খেলে গেল আর হৃৎপিণ্ড নামক জিনিসে ক্রমাগত ছন্দপাত শুরু হলো। এ অস্বাভাবিক ছন্দপতনেও রাত্রিকে এক ভয় ঘিরে ধরল আর সে ভয়ের ঘোরেই ঠোঁট নাড়াল,

—আমি এখন ফোন রাখতে চাই।

—আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার প্রেমিকাকে আমি এসবই করতে চাই। করব এখন? ছুটে আসব তোমার কাছে?

—আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো আদী। আমি তোমার পায়ে পড়ছি। তোমার দিকবিদিকশুন্য অবস্থা এখন। নেশা করে নিজের মস্তিষ্ক তুমি বিকিয়ে এসেছ। তাই এমন কথা বলে নিজের আত্মসম্মান আমার কাছে ক্ষয় করছ।

রাত্রি প্রতিবাদ করল; তীব্র প্রতিবাদ। কিন্তু এসব যেন আদীর কানেই যাচ্ছে না। তার নেশা ক্রমাগত তীব্র হচ্ছে। চোখ জুড়ে ঘুম আসছে আর এক অজানা ঘোরে আদী এখন সুর করে গাইছে,

কি নেশা ছড়ালে!
কি মায়ায় জড়ালে?… বালামের এ গান রাত্রি বহুবার শুনেছে। কিন্তু আজকের মতো এত বিশ্রী অনুভূতি তার কখনো হয়নি। রাত্রির ইচ্ছে করছে এ গানটিকে সাবান সোডা দিয়ে ধুয়ে দিতে সাথে আদীকেও। প্রথমে আদীর কথাগুলো রাত্রির কানে অন্যরকম ঠেকেছিল, কিন্তু এখন মনে পড়তেই ঘা ঘিনঘিন করছে তার। চোখও ঝাপসা হয়ে আসছে। তাই বিনা নোটিশে কল কেটে রাত্রি দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠল সাথে সাথেই বজ্রপাত হলো।

*

বাইরে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। একমনে সে শব্দ শুনে যাচ্ছে আদী৷ তার মন আজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এ অট্টালিকায় আসতে গিয়ে সে একদম ভিজে গেছে। বৃষ্টিতে ভেজার মতো অদ্ভুত এবং অকাজ কখনোই আদী পছন্দ করে না। এসব নেকামি ছাড়া অন্য কিছু তার মনেও হয় না। কিন্তু আজ সে ইচ্ছেমতো ভিজেছে। সে জানে এতে তার অসুস্থ শরীর আরও অসুস্থ হতে পারে। জেনেও এমন করেছে কারণ আজ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। যে রাত্রিকে এত দিন ধরে ২৪ ঘণ্টার জন্য গার্লফ্রেন্ড হিসাবে চাওয়া সুপ্ত বাসনা মনে লুকিয়ে রেখেছিল আজ তা পূরণ হয়েছে। কিন্তু আদী এ বিশাল প্রাপ্তিতেও খুশি হতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে কিছু করার আগেই একটু একটু করে জমানো সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।

শার্ট আর প্যান্ট বদলে আদী এখন টাউজার আর টিশার্ট পরেছে। এ বাড়িতে আদী আজ তিন দিন ধরেই আছে। ফলে তার পোশাকআশাক সব এখানে মজুদ করা আছে। বাড়ির মালিক আর কেউ নয়, তার পুলিশ বন্ধু সাজ্জাদ। ধনসম্পদে সাজ্জাদের অবস্থা সম্পর্কে আদী অবগত নয়। তবে এ বাড়ি দেখে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,

—এ বাড়ি তোর?

জবাব সাজ্জাদ কেবল মিটমিট করে হেসেছিল। এ বিষয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে সাজ্জাদ বলেছিল,

—তোর একটি ফাঁকা বাড়ি প্রয়োজন। এখন এটি কাজে লাগা। বাড়ি আমার না কার তা দিয়ে তোর কাজ কী? কাজ ঠিকমতো করিস।

আদী জবাব দেয়নি৷ সাজ্জাদকে সে রাত্রির বিষয়ে বললেও খোলাসা করে কিছু বলেনি। আদী বসার ঘরে কিছু প্যাকেট নাড়াচাড়া করছে। হঠাৎ পায়ের শব্দ হতেই ধীরে ধীরে তাকাল। চোখ মেলে সে যা দেখল, তাতে তার বিশ্বজোড়া নড়েচড়ে ওঠল। চোখের সামনে এক রমণীকে দেখছে সে যার পরনে খয়েরী রঙের শাড়ি। এলোমেলো ভেজা চুল পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। গৌর মুখে গম্ভীরতা কী নিপুণ ভাবে লেপ্টে আছে! চোখে লজ্জা আর নাকের ডগায় রাগ যেন লুকোচুরি খেলছে। এমন রূপে রাত্রিকে আগে কখনো দেখেনি আদী। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে আদী বেশ কিছু সময় ব্যয় করে ফেলল। হয়তো এখনো তাকিয়ে থাকত যদি না মেঘ গর্জে আদীর ধ্যান ভঙ্গ করত।

—সোফায় বোসো।

মাত্র দু’টি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে আদী টের পেল তার বুকের ভেতরের ছোট্ট যন্ত্রে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু সেটি হলেও কি প্রকাশ করা এখন উচিত হবে? এ চিন্তা মাথায় আসতেই আদী প্রাণপণে নিজেকে শক্ত করে হাতের প্যাকেট নিয়ে নিজের জন্য নির্ধারণ করা একটি রুমে ঢুকে গেল। এরপর মিনিট পাঁচেক ব্যয় করে যখন ফিরল, তখন দেখল রাত্রি চুপচাপ সোফায় বসে আছে। আজকে রাত্রির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই রাত্রি কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। অবাক, রাগ, কান্না তার চোখে মুখে ভাসলেও রাত্রি মুখ ফুটে কিচ্ছু বলছে না আদীকে। আদী বুঝতে পারছে রাত্রি তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। এটি ভাবতে গিয়ে আদী নিজের মাঝে ভালো লাগা অনুভব করলেও পরক্ষণেই তার মনে হচ্ছে সে যেন এক স্বার্থপর এবং লোভী মানুষ। যে জোর করে তার পাওয়া আদায় করছে।

—চুল মোছার গামছা কি ছিল না?

রাত্রির ভেজা চুল চুইয়ে পানি পড়ছে বিধায় আদী জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু রাত্রি চুপ করে বসে আছে। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বা আগ্রহ কোনো কিছুই সে প্রকাশ করল না।

রুম থেকে আসার সময় আদী গামছা আর কিছু জিনিস সাথে করে নিয়ে এসেছে। এখন সে গামছা দিয়ে রাত্রির ভেজা চুলে চালিয়ে যাচ্ছে। বলছে,

—আজ তোমাকে নিজ হাতে সাজাব। ভেবেছিলাম চুলও বেঁধে দিবো। ইউটিউবে বেনী করা শিখেছিলাম। কিন্তু খোলা চুলেই তোমাকে মানিয়েছে। তাই আর কষ্ট করার ইচ্ছে নেই।

রাত্রি আগের মতোই চুপ করে আছে। আদী চুল মোছা শেষ করে এবার রাত্রির পাশে এসে বসল। রাত্রির বাম হাত টেনে নিয়ে যখন এক এক চুড়ি পরাতে শুরু করল, তখন রাত্রির মাথায় সে রাতের কথাগুলো ক্রমাগত ঘুরতে শুরু করল,

—যার হাতে চুড়ি পরিয়ে টুক করে হাতের উলটো পিঠে প্রেম এঁকে দিবো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here