আলোছায়া ২০

0
428

#আলোছায়া
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:২০

জুনায়েদ ডাইনিং রুমে নীলুকে নিয়ে বসে আছে। ডাক্তার তীব্র এই বাড়িতে কি করছে ওর জানা নেই। জানতে হলে জিঞ্জাসা করতে হবে। শুভ্র এখনো আসেনি সবাই এটা নিয়ে চিন্তিত। মেয়েকে আংটি পরাতে হবে। রাত বাড়ছে সঙ্গে চাপা টেনশন। পারভীন বেগম রাগে হিসহিস করছেন। এই ছেলেটার সত্যি বিয়ে হওয়া উচিৎ বলে উনার মনে হচ্ছে না।বাড়িতে বউ নিয়ে গিয়ে দায়ভার ছেড়ে অফিসে পড়ে থাকবে। আজ এমন করছে বিয়ের দিন কি করবে এটা ভেবে উনার শরীরের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। যদি সেদিকেও মিটিং রাখে তখন? এসব ভেবে উনি ঘেমেঘেটে একাকার। জুনায়েদ মায়ের পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> তোমার ছেলের মিটিং শেষ হয়নি। এক সঙ্গে নাকি দুটো মিটিংয়ে অংশ নিয়েছে। এটা তোমার ছেলের পক্ষেই সম্ভব। ছোট ছিল তখন কারো সঙ্গে চেঞ্জ করে নিতে আমার মতো।
পারভীন বেগমের টেনশন হচ্ছে তারমধ‍্যে ছেলের এমন মজা নেওয়া সহ‍্য হলো না। ধমক দিয়ে বললেন,

> দুটোই এক, ও খারাপ নিজে খুব ভালো তাইনা? মানুষের পেটে এলিয়েন হয় জানা ছিল না। আগে জানলে সত্যিই চেঞ্জ করতাম। লজ্জা সরম নেই।

> আমি ইনোসেন্ট কিন্তু তোমার ছেলে এলিয়েন। হবু বউয়ের সঙ্গে একটু প্রেম ট্রেম করবে তানা অফিসে পড়ে আছে। বাসর ঘরে দেইখো ল‍্যাপটপ নিয়ে যাবে। আম্মু সময় আছে বিয়ে টিয়ে বাদ দিয়ে বাড়ি চলো।

পারভীন বেগম জুনায়েদের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালেন। এই ছেলেটার লাজ লজ্জা কম এটা উনার অজানা নেই। উনি ধমক দিয়ে উঠে গেলেন। নীলু চুপচাপ জুনায়েদের পাশে বসে আছে। জুনায়েদ বারবার আড়চোখে দেখছে। মেয়েটার মুখের ভাব দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হটাৎ নীলুর পোড়া হাতের দিকে ওর নজর গেলো। রাউন্ড করে লাল হয়ে ফোসকা পয়ে উঠে গেছে। জুনায়েদ আশেপাশে লোকজন ভূলে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,

> তোমার হাতে কি হয়েছে দেখি? এটা কিভাবে হলো?

নীলু চমকে উঠে হাতটা লুকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। ততক্ষণে জুনায়েদ ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। ওকে এভাবে কথা বলতে দেখে সবাই এগিয়ে আসলো। পারভীন বেগমের চোখেমুখে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উনি ভেবে নিয়েছেন এগুলো জুনায়েদ করেছে। উনি উঠে এসে জুনায়েদকে সরিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়লেন। আমিরুম ইসলাম চিন্তিত হয়ে বললেন,

> ভাবি চিন্তা করবেন না। আমি তীব্রকে বলছি ও এসে দেখছে।

উনি তীব্রকে ডাকতেই তীব্র হাজির। ছেলেটা একবারে ওষুধপত্র সঙ্গে এনেছে। হয়তো এটা আগে থেকেই জানতো তাই প্রস্তুত ছিল। জুনায়েদের একবার মনে হলো নীলুকে নিয়ে চলে যেতে তবুও পারলো না। বাবার সম্মান যাবে। ডাক্তার তীব্র নীলুর পাশে এসে বসলো। নীলু রীতিমতো কাপছে তীব্রকে দেখে যেটা জুনায়েদের চোখ এড়াতে পারলো না। ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ব‍্যান্ডেজ করে দিলো। সৈয়দ সাহেব তীব্রকে দেখে বললেন,

> তোমার পরিচয় ঠিক জানতে পারলাম না। কে বাবা তুমি?

তীব্র কথা বলতে গেলো কিন্তু পারল না আমিরুল ইসলাম বলে উঠলেন,

> ও ডাক্তার তীব্র আমাদের ক্লিনিকে জয়েন করেছে কিছুদিন হচ্ছে। ভীষণ দক্ষ আর মেধাবী ছেলে। শহরে নতুন বাবা মা এখানে কেউ নেই। তাই জন্য আমাদের বাড়িতে থাকছে। একদম নিজের ছেলের মতো মিশে গেছে।

জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ফেলল। ভেবেছিল এই বাড়ির কোনো আত্মীয় হবে কিন্তু তেমন কিছুই না। তীব্রর চোখে কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। এখানে এতকিছু হয়ে গেলো কিন্তু সে নির্বাক। কথাবার্তা বলছে না ঠোঁটে বাকা হাসি যা বারবার জুনায়েদের চোখে ধরা পড়ছে। হঠাৎ শুভ্রর আগমনে ওর ধ‍্যান আঙলো। ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত সবাইকে সালাম দিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। নীলুর হাতে ব‍্যান্ডেজ দেখে জিঞ্জাসা করলো। পারভীন বেগম সবটা বললেন। ওর বারবার নীলুর উপরে মায়া হয়। নীলুর এমন ভাগ‍্যের জন্য নিজেকে সামান্য হলেও ও দোষারোপ করে। মেয়েটার উপরে ওর ভালোলাগা আছে। দিন দিন এটা যাতে প্রবল আকার ধারণ না করে তাই এই বিয়ে নামক অধ‍্যায়ের সূচনা। ছোট ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার মতো কুরুচিপূর্ণ স্বভার ওর নেই।

সৈয়দ সাহেব মেয়েকে আনতে বললেন। সবার দৃষ্টি সিঁড়িতে। মেয়েটা ধীরগতিতে নামছে। পরণে কালো রঙের একটা সিল্কের শাড়ি। বেশ মানিয়েছে, শুভ্রর জন্য উপযুক্ত। পারভীন বেগম মেয়েকে নিজের পাশে বসিয়ে নিলেন। শুভ্র জায়গা ছেড়ে জুনায়েদের পাশে গিয়ে বসলো। জুনায়েদ ফিসফিস করে ওর কানে কানে বলল,

> ফোন নাম্বারের ব‍্যবস্থা করছি দুদিনের মধ্যেই প্রেম ট্রেমের পর্ব চুকিয়ে ফেলবি তাহলে আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না।

> তুই বেশি বুঝিস। মাথায় জৈব সারে ভর্তি। চুপচাপ বসে থাকবি।

জুনায়েদ ঝাড়ি শুনে চুপ হয়ে গেলো। মন অশান্ত হয়ে আছে। নীলুকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে। এখান থেকে ফিরতে পারলে স্বস্তি। কথাবার্তা শেষ করে ডিনার করে ফিরতে ফিরতে ওদের রাত বারোটা বেজে গেলো।

রাতে জুনায়েদ চোখের উপরে হাত রেখে শুয়ে আছে। নীলু ওর পাশে বসে আছে। নীরবতা ভেঙে নীলু বলে উঠলো,

> দৃষ্টির অগোচরে এমন কিছু আছে যেগুলোর অস্তিত্ব হঠাৎ প্রকাশ পেয়ে মানুষকে হঠাৎ চমকে দিতে পারে। প্রস্তুত হয়ে থাকতে হয় জানেন?

জুনায়েদ ওর কথায় অর্থ বুঝতে পারলো না। চোখ থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসলো। নীলু এখনো নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদ উত্তর করলো,

> ক্লিয়ার করো আমি বুঝিনি। আচ্ছা তীব্র লোকটাকে তোমার কেমন মনে হয়? লোকটার আচার আচরণে কেমন রহস্য খেলা করে দেখেছো?

তীব্রর কথা বলতেই নীলু তাড়াতাড়ি জুনায়েদকে ঘুমাতে বলে নিজেও শুয়ে পড়লো। মনে হলো কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। জুনায়েদ হতাশ হয়ে লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলো। ভোররাত জুনায়েদের ঘুম ভাঙলো ফিসফিস কথাবলার শব্দ শুনে। বেলকনিতে কেউ আছে। একজন না দুজন মানুষ। তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি চলছে। জুনায়েদ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। জুনায়েদ পাশে নীলুকে না পেয়ে চুপিচুপি বেলকনির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। লোক দুটোর মধ্যে একজন বলছে,

> ওর দিকে তাকালে আমি সব কিছু ধ্বংস করে দিবো। ওকে হত্যার কথা ভাবলে কিভাবে তুমি?

> আমাদের কাজের থেকে একজন সাধারণ মানুষ তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো? তুমি জানো এর পরিণাম কি হতে পারে?

> সব জানি। তুমি আমাকে জ্ঞান দেবার কে? ভুলে যাচ্ছো আমি কে আর আমার পরিচয় কী?

> একদম ভুলিনি। আমার মনে হয় তুমি নিজেই ভুলে যাচ্ছ। আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি নিজের জন্য না। তোমার জন্য।

> তোমার সাহায্য লাগবে না আমার। তুমি আসতে পারো। আমার অনুমতি ছাড়া ওকে তুমি কিছুই করবে না। যদি করো তবে আমাকে হারাবে সঙ্গে তোমাদের অস্তিত্ব।

> নীলিমা একটু বোঝার চেষ্টা করো।

জুনায়েদ এই পযর্ন্ত শুনতে পেলো। হঠাৎ কাশি এসে গেলো তাই হালকা কাশতেই চারদিকে নীরবতাই ছেয়ে গেলো। জুনায়েদ হুট করে বেলকনির দরজা খুঁলে বাইরে গেলো কিন্তু সেখানে কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগে যারা কথা বলছিল তারা এখানে নেই। নীলিমা নাম মনে হতেই ওর সেদিনের সেই মেয়েটার কথা মনে হলো। অতিরিক্ত ভাবনার জন্য এমন হয়েছে নাকি কে জানে। কিন্তু প্রশ্ন জাগলো নীলু কোথায় গেলো এই রাতের বেলা? হঠাৎ বাথরুমের দরজা খট করে খুঁলে গেলো। জুনায়েদ পেছনে ফিরে দেখলো নীলু টাওয়েল হাতে বেরিয়ে আসছে। জুনায়েদ দ্রুত ওর কাছে গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,

> কোথায় ছিলে?

নীলু স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,

> বাথরুমে ছিলাম। তুমি তো নাক ডেকে ঘুমালে। আমার হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছিল তাই হাতে মুখে পানি দিতে গিয়েছিলাম।

ওর শরীর খারাপ দেখে জুনায়েদ আর কথা বলতে পারলো না। ও ব‍্যস্ত হয়ে নীলুকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো। নীলু চুপচাপ ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। জুনায়েদ ওর কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা দেখে হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,

> হাতে ব‍্যাথা আছে?

> না,হয়তো ঠিক হয়ে গেছে।

জুনায়েদ কিছু ভেবে নিয়ে বলল,

> তোমার গায়ে দাগ বসে না এটা খুবই আচর্যের বিষয়। সেদিনের পোড়া দাগগুলো কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মিলিয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা এবারও তাই।

> হতে পারে ছোট থেকেই এমন।

> তোমার হাতটা এভাবে পুড়লো কিভাবে? কেউ থাবা দিয়ে ধরেছিল। হাতের চিহ্ন।

> একদম না। এটা ইলেকট্রিক তারের জন্য হয়েছে। হাতের সঙ্গে পেচিয়ে গিয়েছিল।

জুনায়েদ কথাটা শুনে চমকে উঠলো। কতটা বিপদ্দজনক ইলেকট্রিক তার। ওর ভালো জানা আছে। জুনিয়র নীলুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

> এরকম আর কখনও করবে না। একা কোথাও যাবে না। আমি যা বলবো শুনবে।

নীলু বাধ্য মেয়েদের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। জুনায়েদ ওকে দুহাতে আকড়ে ধরে রেখেছে। নীলু ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

> ঘুম ঘুম পাচ্ছে।

জুনায়েদ মলিন হেসে ওর মাথায় চুমু দিয়ে বলল,

> আচ্ছা ঘুমাও আমি নামাজ পড়ে কাজ করবো।

নীলু চোখ বন্ধ করলো কিন্তু ওকে ছাড়লো না। ও উঠে যাবার জন্য চেষ্টা করলো কিন্তু নীলু খামচে ধরে ঘুমিয়ে গেলো। জুনায়েদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওকে রেখে বাইরে বেরিয়ে গেলো। মনের মধ্যে সন্দেহ বাসা বেঁধেছে। আজ বেলকনি আর ঘরের মধ্যে লুকিয়ে সিসি ক‍্যামেরা লাগিয়ে রাখবে। যেইহোক জুনায়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ না। কথাটা ভেবে ও কাজে মন দিলো। চারদিকে এখনো অন্ধকার। নির্জন পরিবেশ। শুভ্র উঠেছে আগেই কারণ সদর দরজা খোঁলা। হয়তো সে বাগানে দৌড়াদৌড়ি করছে। শরীর ফিট রাখতে তার কোনো ত্রুটি নেই। জুনায়েদের ওসব পছন্দ না। এমনিই দেখতে ও বেশ ফিট। দুমদাম যা ইচ্ছে খেয়ে নিতে ওর অসুবিধা হয়না। খাবারের স্বাদ না নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে স্বাদ নিয়ে মরাও শান্তির।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here