আলোছায়া ১৯

0
448

#আলোছায়া
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব: ১৯

দূর থেকে আযানের সুর ভেসে আসছে। মাথার উপরে ফ‍্যান চলছে রুমে এসি আছে বন্ধ আছে। শীতশীত করছে তাই এসি বন্ধ রাখা হয়েছে। নিস্তব্ধ রুমে আলো আধারের লুকোচুরি খেলা চলছে। আবছা অন্ধকারের ঘুমন্ত বালকের দিকে একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টির ভাষাতে নাজানি কি আছে। হয়তো অফুরন্ত ভালোবাসা নয়তো ঘৃণা। রক্তাক্ত চোখজোড়া ছেলেটার মাথা থেকে পা পযর্ন্ত বিচরণ করছে। ছেলেটা ঘুমের মধ্যে অস্বস্তিতে ভুগছে বেশ ভালো করে বোঝা যাচ্ছে। বারবার সে মুভমেন্ট পরিবর্তন করছে।

আযান শেষ জুনায়েদের ঘুম ভেঙে গেলো। মাথাটা কেমন টাল হয়ে আছে। গতকাল কিভাবে ঘুমিয়ে প ড়েছে কিছুই মনে পড়ছে না। ও নড়াচড়া করে উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না নীলুওর বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে। জুনায়েদ এই মেয়েটার কাজকর্মকে চমকে উঠছে। এতোদিন তো ধারেকাছেও আসতো না হঠাৎ এর কি হলো আল্লাহ্ জানেন। নীলুর চুলগুলো ওর মুখের উপরে ছড়িয়ে আছে দেখে জুনায়েদ আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। ড্রিম লাইটের আলোতে মেয়েটার মুখটা খুব শুভ্র লাগছে। এতোটা মায়া আছে এই মুখটাতে কখনও এভাবে অনুভব করা হয়নি। কথাটা ভেবে ও নীলুর কপালে চুমু দিয়ে ওকে পাশে রেখে উঠে বসলো। সারারাত বেঘোরে ঘুমিয়েছে এখন আর ঘুম আসবে না। নামাজ পড়ে অফিসের কাজগুলো শেষ করতে হবে। গতকাল কাজ করতে করতে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে কি অদ্ভুত। সেই স্মৃতিটুকু মস্তিষ্ক থেকে বিলীন হয়ে গেছে। জুনায়েদ বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নামাজ পড়ে ল‍্যাপটপ নিয়ে বসলো। নীলু এখনো ঘুমিয়ে আছে। অসুস্থতার জন্য ওর ঘুমের প্রয়োজন।

কাজ করতে করতে চার‍দিক আলোকিত হয়ে উঠেছে। জুনায়েদ ল‍্যাপটপ নিয়ে ডাইনিং রুমে কাজ করছে। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। হঠাৎ মুখের সামনে চা দেখে ও উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো নীলু মিষ্টি হেসে ওর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। ও চায়ের কাপে মুখ ডুবিয়ে নিয়ে বলল,
> মহারানির ঘুম তাহলে ভেঙেছে?
নীলু ওর পাশে বসতে বসতে বলল,
> একদম। আজকের ঘুমটা দারুন হয়েছে। একটা কথা বলবো?
> হুম বলো।
> আম্মুদের কাছে ফিরে যায় চলুন। এখানে একা লাগে।
> আমি থাকতেও একা? আচ্ছা গতকাল আমি কখন ঘুমিয়েছি তোমার কিছু মনে আছে?
> আপনি বললেন শরীর খারাপ করছে একটু ঘুমানোর দরকার। কথাটা বলেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। যাইহোক ছাড়ুন ক্লাস আছে আমার। ও বাড়িতে ফিরে চলুন।
> আচ্ছা তুমি গিয়ে রেডি হয়ে নাও।
জুনায়েদ তর্ক করলো না। দ্রুত নিজের কাজ শেষ করে ফেলল। আনোয়ার চাচাকে কিছু টাকা দিয়ে ওরা বাড়ির পথে রওনা দিলো। বাবা টেক্সট করেছে শুভ্রর বিয়ে নিয়ে কথা চলছে। পাত্রী দেখা শেষ তবুও একবার স্বপরিবারে একদিন গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসতে হবে। গাড়িতে বসে নীলু বাইরে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদের গলাতে কেমন ব‍্যাথা করছে হঠাৎ। হয়তো ঘুমের জন্য এমন হয়েছে ভেবে নীলুকে ডেকে বলল,
> বাইরে তাকিয়ে কি দেখো? এদিকে তোমার বর যন্ত্রণা পাচ্ছে।
নীলু বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
> এক মিনিট।
নীলু জুনায়েদ একদম কাছে এসলো। জুনায়েদ ওর এমন আচরণের সঙ্গে পরিচিত না। ও হতভম্ব হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> কি করছো?
> নীলু উত্তর করার বিনিময়ে শুধু হাসলো। তারপর নিজের দুহাতে ওর সার্টের কলার কাছে টেনে নিয়ে নিজের ঠোঁটটা ওর গলাতে বসিয়ে দিলো। জুনায়েদের শরীর ফ্রিজ হয়ে গেছে। ও হুটকরে গাড়ি থামিয়ে ফেলল। এই মেয়েটা ওকে মেরে ফেলবে। জুনায়েদ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না ততক্ষণে নীলু ওকে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে বসেছে। মনে হচ্ছে কিছুই ঘটেনি। জুনায়েদ চোখ বড় বড় করে বলল,
> আন্টি আন্টি টাইপের ভাবতাম তোমাকে। কিন্তু তোমার পেটে পেটে এতো?
জুনায়েদের এমন কথা নীলু কিছুটা রেখে গেলো। ও চোখ পাকিয়ে প্রতিবাদের সুরে বলল,
> আপনাকেও দেখলে হিরো হিরো আর রোমান্টিক টাইপের লাগলেও আসলেই আপনি আঙ্কেল টাইপ। তাই চেহারা দেখে না মানুষ বিচার করতে আসবেন না।
> আমি আঙ্কেল টাইপের?
জুনায়েদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
> তুমি জানো কত মেয়ে আমার জন্য পাগল? আমিতো রাস্তায় বের হতে পারিনা মেয়েদের যন্ত্রণায়। আর আমাকে বলছো আমি আঙ্কেল টাইপ। তোমাকে এবার চোখের ডাক্তার দেখাবো বুঝলে?
> চাপাবাজির একটা লিমিট থাকে আপনি ক্রস করে ফেলেছেন। চুপচাপ বাড়িতে চলুন। একটা চুমু দিয়ে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছি।
জুনায়েদ উত্তর করলো না তবে মুখে তৃপ্তির হাসি খেলা করছে। আগে কখনও এমন অনুভূতি হয়নি। একটা একান্ত নিজের মানুষ থাকা সত্যি দরকার। বাকি রাস্তা ওদের আর কথা হলো না। জুনায়েদ ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলো।

নীলু বাড়িতে ফিরে আসার জন্য পারভীন বেগম বেজায় খুশী। উনি বারবার জিঞ্জাসা করছেন কোনো অসুবিধা হয়েছে কি। নীলু কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। ওর গায়ে গতকাল আগুনের যে ফোসকা পড়েছিল সব মিলিয়ে গেছে তাই ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সারাদিন নীলুর বাড়িতেই পার হলো। সন্ধ্যায় মেয়েদের বাড়িতে যাবার জন্য নীলু তৈরী হয়ে বাইরে আসলো। জুনায়েদ অফিসের কাজ শেষ করে আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যার বিয়ে তার খোঁজ নেই। একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে সে আটকে গেছে। এখন কিছুতেই আসা হবে না। রাত আটটার পরে ফ্রি হবে। পারভীন বেগম আক্রশে ফেটে পড়ছেন। এই ছেলে যে এমন করবে এটা উনার আজানা ছিল না শুধু দেখার বাকি ছিল। উনি সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে অযথাই ঝগড়া করছেন। জুনায়েদ বারবার শুভ্রকে ফোন করে যখন পেলো না তখন সবাই মিলে মেয়েদের বাড়িতে চলে গেলো। শুভ্রর সময় মতো সেখানে চলে যাবে।

মেয়ের বাবা আমিরু ইসলাম পেশায় একজন ডাক্তার। নিজস্ব ক্লিনিক আছে। মেয়ে আরিয়া ইসলাম নিজেও স‍দ‍্য পাশ করা ডাক্তার। আমিরুল ইসলামের সঙ্গে সৈয়দ সাহেবের বহুকালের বন্ধুত্ব। উনি সৈয়দ সাহেবকে নিজেই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন তাই উনি আর না করতে পারেননি। তাছাড়া শুভ্রর বাবার উপরে যথেষ্ট ভরসা আছে।

আমিরুল ইসলামের ডাইনিং রুমে জুনায়েদ স্বপরিবার নিয়ে বসে আছে। নীলুর শাড়ি পড়তে মানা। ভেবেছিল এখানে শাড়ি পড়েই আসবে কিন্তু জুনায়েদ ওর সব শাড়ি আলমারিতে লক করে রেখেছে তাই বাধ্য হয়ে গোলাপি রঙের গাউন পড়েছে আজ। যদিও রঙটা একটু বেশিই ঝলক দিচ্ছে। আনোয়ার সাহেব ঘনঘন নীলুর দিকে দেখছেন। উনি জানতেন না জুনায়েদের বিয়ের সম্পর্কে। উনি বুঝতে পারছেন না অল্প বয়সী এই সুন্দর মেয়েটার পরিচয় কী। ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুজতে খুজতে হাপিয়ে উঠেছেন। আগে জানলে মেয়ের বিয়ের আগে ছেলের জন্য সৈয়দ কে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন তবুও মনের মধ্যে একটা সুপ্ত আশার রেখার দিশা পাওয়া যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই উনি জিঞ্জাসা করলেন,
> ভাই এই মেয়েটাকে তো ঠিক চিনতে পারছিনা। মেয়েটা তো ভারি মিষ্টি।
> আমার মেয়ে বলতে পারিস। মা নীলু আঙ্কেলকে সালাম করো।
নীলু সালাম দিয়ে মিষ্টি হেসে দিলো। আমিরুল ইসলামের মনে হলো হাসলে মেয়েটার সৌন্দর্য্য আরও বেড়ে যায়। তাই উনি অপেক্ষা করলেন না বলে ফেললেন,
> মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দে ভাই। আমার মেয়ে নিয়ে যাচ্ছিস ভালো কথা এখন তোর মেয়েকেও আমাকে দিতে হবে। আমার ছেলেকে তো চিনিস? দুজনকে ভীষণ মানাবে।
আমিরুল সাহেবের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হতাশ। জুনায়েদ রেগেমেগে আগুন। এই লোকটার চাইতে নিজের বাবার উপরে বেশি রাগ হচ্ছে। কি দরকার ছিল আদেক্ষেতা করে মেয়ে বলার। ওর এখন রাগ হচ্ছে। ওকে এভাবে কটমট করে রেগে যেতে দেখাই পারভীন বেগম বুঝিয়ে বললেন। সব শুনি আমিরুল সাহেব দুঃখ প্রকাশ করলেন। উনি বুঝতে পারেননি বারবার করে বললেন। বড়দের মধ্যে বসতে অসুবিধা হবে দেখে কয়েকজন মেয়ে জুনায়েদকে রেখে নীলুকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নীলু ভেতরের রুমে গিয়ে দেখলো এখানে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আছে। আর একজনের দিকে তাকিয়ে ওর চোখ চমকে গেলো। ডাক্তার তীব্র বসে আছেন। ছেলেটা অতিরিক্ত ফর্সার জন্য ঠোঁট লাল হয়ে থাকে। তবে সব থেকে ভয়ানক লাগে ওর চোখ দুটো। নীলুকে দেখে ছেলেটা এগিয়ে এসে আলাপ করলো। নীলু শুধু উত্তর করছে। হঠাৎ তীব্র ওকে ছাদে যাওয়ার অনুরোধ করলো। নীলু যেতে চাইছে না তবুও রিকুয়েস্টের জন্য ওকে যেতে হলো। অনেকক্ষণ নীলুকে না দেখে জুনায়েদও উঠে আসলো। ও রুমের মধ্যে উকি দিয়ে কাউকে না পেয়ে আনমনে ছাদে উঠে গেলো। কিন্তু ছাদে গিয়ে দেখলো তীব্র নীলুর হাত ধরে কিছু মানানোর চেষ্টা করছে আর নীলু মানতে চাইছে না বলে পিছিয়ে যাচ্ছে। জুনায়েদ কিছু না বুঝেছি হন্তদন্ত হয়ে নীলুর সামনে গিয়ে ডাক্তার তীব্রকে বলল,
> ডাক্তার আপনি নীলুকে কিসের জন্য রিকুয়েস্ট করছেন? সব আমাকে বলুন।
নীলু ঢোক গিলছে ও জুনায়েদকে এখানে আশা করেনি। তবে ডাক্তার সাহেবের মুখটা স্বাভাবিক। নীলু জুনায়েদের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল,
> উনি সেদিনের আগুনের বর্ণনা করছিলেন আমি ভয় পেয়ে গেছি। তাই উনি হাত ধরে বলছিলেন ভয়ের কিছু নেই।
জুনায়েদ ওর কথা বিশ্বাস করলো কি বোঝা গেলো না তবে ও তীব্র কে বলল,
> আমার স্ত্রীকে সব বলার হলে আমি নিজেই বলতাম। আপনি ডাক্তার হয়ে রুগীকে ভয় দেখাচ্ছেন? নীলুর জন্য আমি আছি। আপনি দয়াকরে ওর থেকে দূরে থাকুন।
জুনায়েদের মজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল তারপর আবার তীব্রর এমন কাণ্ডে আরও খারাপ হচ্ছে। ও যথেষ্ট ভদ্রভাবে কথা বলার চেষ্টা করে নীলুকে টেনে নিচে নিয়ে গেলো। নীলুর হাতে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে পুড়ে গেছে সেদিকে ওর খেয়াল নেই।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here