আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
বিভোরের এইসব কথাবার্তা শুনে রুহি শুধু অবাকই হলো। হ্যাঁ না কিছু বললো না। যেন একটা কাঠের পুতুল। যে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে ওকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। রুহিকে নিয়ে বিভোর চলে আসতে চাইলে মাহিম অনেক ঝামেলা করে। বিভোর বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ দেখুন আপনি নিজের বোনের সাথে এমন করতে পারেন না।’
‘ ও আমার নিজের বোন না, সৎ বোন।’
বিভোর অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করে না।
‘ যা-ই হোক, আপনি এমন করতে পারেন না। একটা এডাল্ট মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনোকিছুতে রাজি করানো অপরাধ।’
‘ আপনাকে শিখানো লাগবো না। নিজের চরকায় তেল দেন আর ভাগেন।’
‘ আমিতো বলেছি ওকে সাথে নিয়ে যাবো।’
‘ কে হন আপনি এর? কিছু লাগেন? তাইলে এতো ফাল পারতাসেন কেন?’
‘ আপনাকে সেটার বিচার করতে হবেনা। নিজেকে শোধরান আগে।’
‘ আপনি এরে নিতে পারবেন না।’
‘ তাহলে আমি পুলিশকে সবটা জানাতে বাধ্য হবো!’
মাহিম ভয় পেয়ে যায়। ফাহিমা ওর কানে কানে বলল,
‘ এবার কি হবে?’
‘ বুঝতেসিনা।’
‘ যদি সত্যিই পুলিশ নিয়া আসে?’
‘ হইলেও হইতে পারে। পোশাক আশাক দেইখা তো বড় কিছুই মনে হয়।’
‘ এর সাথে রুহির দেখা হইলো কেমনে?’
‘ কি জানি।’
‘ এহন করবা কী? এদিকে সজীব তো তাড়া দিতাছে।’
‘ হ, এরে সজীবের ঘাড়ে তুইলা দিয়া আমরা জেল খাটুম তাইনা?’
‘ আমি কি সেইটা কইছি?’
‘ তাইলে চুপ থাকো। মাইয়া মানুষের জন্মই চুপ থাহনের লাগি।’
ফাহিমা রাগে গজগজ করতে থাকে। মাহিম সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বিভোরের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ ঠিক আছে। নিয়া যান এরে।’
‘ এবার লাইনে আসছেন।’
‘ তয় আমার বাড়ির ত্রি-সীমানায় যেন এরে না দেহি।’
বিভোর হেসে বললো,
‘ এটা নিশ্চয়ই ওর ও বাড়ি?’
‘ হ। আমাগো বাপে দুই বিয়া করছিল।’
‘ তাহলে ও এই বাড়িতে যখন ইচ্ছা তখনই আসতে পারবে। আপনি বাধা দিতে পারবেন না।’
মাহিম রেগে যায়। কিন্তু কথা বলার সাহস পায়না। বিভোর রুহিকে নিয়ে চলে আসে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় শুধু একবার পেছনে ফিরে তাকায় ও। এখানেই ওর জন্ম, মা-বাবার শেষ চিহ্নটুকুও এখানেই আছে। তবে কেন আজ ওর এমন হাল! নিজের বাড়িতেই চাকরানী হয়ে থাকতো অথচ আজ ভাগ্য ওকে সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিলো।
ছায়াঘেরা মেঠোপথ ধরে গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় রুহির চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে যায়। চেনে না, জানে না কাগজের স্বামীটার সাথে ও অজানা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছে। এমন শুধু সিনেমায় দেখেছে। বাস্তবে ওর সাথে এমন ঘটতে পারে সেটা ভাবনার অন্ত।
রাস্তার দুইপাশে ঘাসফুলের উপর ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে৷ একটা হিন্দুবাড়ির প্রবেশপথের মাথায় সাদা আর লাল রঙের জবা ফুলে গাছ বাতাসে দুলছে। বিভোর সেদিকে এগিয়ে গেলে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলো রুহি। বিভোর হুট করে অনেকগুলো লাল টকটকে ফুল ছিঁড়ে নেয়, সাথে সাদাটিও। কেউ দেখতে পায়নি।
চোরের মতো যে বিভোর ফুল চুরি করতে পারে সেটা দেখেও রুহি বিস্মিত। ডাক্তার দেখি পুরাই অন্যরকম। অথচ রুহি এতোদিন ভাবতো ডাক্তাররা বুঝি খুবই গম্ভীর আর কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বিভোর ওর সব ধ্যানধারণা বদলে দিচ্ছে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরের শেষ আলোর ছটা যখন পথে লুকোচুরি খেলছিলো, বাতাস যখন জোরে হাওয়া দিচ্ছিলো, পৃথিবীটা যখন প্রেমময় হয়ে উঠেছিলো তখনই বিভোর রুহির সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে ফুলের গুচ্ছ। আশ্চর্য রঙিন আলোয় বিভোরকে তখন অদ্ভুত সুন্দর পুরুষ দেখাচ্ছিলো। এতো সুন্দর মানুষ হয়? এই মুহূর্ত কি দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে পারেনা? অচেনা পুরুষটিকে একবারের জন্য হলেও রুহি হঠাৎ ওর প্রেমিক স্বামী ভেবে ফেলতে বাধ্য হয়। প্রেমে পড়তেও বাধ্য হয়। অথচ দুজনের পরিচয় একদিনের।
ভালোবাসা এমন এক জিনিস যে কখন কার প্রতি, আর কীভাবে হয়ে যায় তা মানুষ বুঝতেই পারেনা। বিপরীত প্রান্তের মানুষটি তাঁর চোখে হয়ে ওঠে স্বর্গের ন্যায়। স্বর্গেও কি এতো সুখ থাকে যেমন থাকে ভালোবাসায়? নিশ্চয়ই থাকে! নইলে কি আর স্বর্গকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়? যেখানে সবসুখ একত্রিত হয় তাকেই তো স্বর্গসুখ বলে। আর ভালোবাসা না থাকলে সুখ আসবে কোথা থেকে! সুখ থেকেই তো স্বর্গসুখ!
‘ তোমার চুলগুলো তো দারুণ। খুলে ফেলো।’
রুহি চমকে উঠলো। ধ্যান কাটতেই বুঝতে পারলো তার পুরুষটি এখন ওর সামনে দাঁড়ানো। থতমত খেয়ে বলল,
‘ কেন খুলবো?’
‘ আমি বলেছি তাই।’
‘ পারবো না। আমার অস্বস্তি হয় খোলা চুলে।’
‘ হবেনা।’
‘ আপনি জানেন? চুল ওড়াওড়ি করে আমাকে বিরক্ত করে!’
বিভোর হেসে বললো,
‘ খোলা চুলেই থাকতে ভালো লাগবে তোমার। এখন বকবক কম করে খুলো। নইলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’
রুহি চুলের খোঁপা খুলে দিলেই পিঠ ভাসিয়ে ছড়িয়ে পড়ে চুলের গোছা। খুব যত্নে একটা রক্তজবা রুহির চুলে গুঁজে দেয় বিভোর। বাহ! বেশ দেখাচ্ছে।
বিভোরের ঠোঁটের মৃদু হাসিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রুহি। লোকটা বেশ চমৎকার। এই অভাবনীয় সুন্দর মুহূর্তের রেশ কাটতেই বিভোর হেসে ফেলে।
‘ তোমার নাম যেন কী?’
‘ রুহানি।’
‘ তোমার ভাইটা তো কি যে ডাকছিলো!’
‘ রুহি!’
‘ বাহ, তোমার নাম তো বেশ সুন্দর!’
‘ আমার বাবা রেখেছিলো তো, তাই সুন্দর।’
এরপর আর কথা হয়না দুজনের। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে টিকিট নিয়ে বিভোর রুহিকে নিয়ে রওয়ানা হয় ঢাকার দিকে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ক্লান্ত রুহি বিভোরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ওর ঘুম ভাঙে তখন দেখলো বিভোর রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
গোলগোল চোখে বিভোরকে পরখ করে রুহি বোকা হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘ কী হয়েছে?’
বিভোর কটমট করে বলে,
‘ তুমি এভাবে বাঁকা হয়ে ঘুমালে কেন? মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে অল্প বয়সেই কুঁজো হয়ে যাবার ইচ্ছে জাগছে নাকি! ড্যাম ইট!’
‘ বুঝতে পারিনি।’
‘ বাচ্চা নাকি তুমি? যখন তখন গায়ে এসে পড়ো। আমাকে চিনোনা, জানোনা তাও এমন ভাব করছো যেন আমি তোমার পূর্ব পরিচিত। শুনো, এরকম মানুষদের কখনোই বিশ্বাস করবেনা।’
‘ আপনাকেও নয়?’
‘ আমাকে তো বিশ্বাস করেই বসে আছো। আমি সেটা বলছিনা। মানুষকে বিশ্বাস করার আগে একশোবার তাকে পরখ করে নিবে, যাতে করে তার উদ্দেশ্যে বুঝতে পারো।’
‘ আপনার উদ্দেশ্য কী?’
বিভোর বিরক্ত হয়ে ধমক দিলো। তারপর বলল,
‘ আমরা এসে গেছি ঢাকা। এখন উঠো, নামতে হবে।’
রুহি অবাক হয়ে যায়। ঢাকা, তার স্বপ্নের শহর। জীবনের প্রথম পদার্পণ করছে ঢাকায়। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। খুশি খুশি গলায় বলল,
‘ আমরা এখন কি আপনার বাসায় যাবো?’
‘ তুমি দেখি আমাকে সত্যিই তোমার বর ভেবে বসে আছো।’
রুহি লজ্জ্বা পেয়ে চুপ করে যায়। বিভোর গম্ভীর গলায় বলল,
‘ তোমাকে আমি এই অধিকার কখনো দিতে পারবোনা।
আর অতি দ্রুত এটা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবো।’
রুহি নিচু গলায় বলল,
‘ আমি আপনাকে আমার বর ভাবছিও না।’
‘ তোমাকে আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় দিয়ে আসবো, ও তোমার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিবে।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি কি আমাকে পাচার করে দিবেন?’
বিভোর এ কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে যায়। এসব কি বলে মেয়েটা? সাহায্য করতে নিয়ে এসে এখন নিজেই দেখি বিপদে পড়ে গেলো। রুহিকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এসব কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবেনা কারণ আমি সেরকম মানুষ নই। আর সন্দেহ হলে একলা যাও, যেদিকে চোখ যায়। ওকে?’
‘ আমিতো তেমন কিছু মিন করিনি।’
‘ তোমার মনে ডাউট আছে।’
‘ আমি দুঃখিত।’
বিভোর ওর কান্ড দেখে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো,
‘ ইট’স ওকে। বললাম না, কাউকে এতো সহজে বিশ্বাস করবেনা!’
রুহি বলল,
‘ আমরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো? আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘ এখান থেকে ওর বাসা খুব দূরে নয়। ওখানে সব রেডি আছে।’
রুহি চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
‘ আপনি কি আমাকে ওখানে রেখে চলে যাবেন?’
‘ হুম। বাসার সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। ক্লান্ত আছি, বাসায় গিয়ে ফ্রেশ ঘুম দেবো।’
‘ আপনার সাথে আমার কি আর দেখা হবেনা?’
‘ না।’
বেশ কনফিডেন্সের সাথে বললো বিভোর। রুহির বুকটা কেঁপে উঠলো।
‘ আমি আমার ফ্রেন্ডকে সব বলে দেবো। ও সবকিছু করে দেবে। তোমাকে কলেজে এডমিট করিয়ে দেবে। ভালো করে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সব অন্যায় মাথা পেতে নেবেনা। তুমি একদিন অনেক বড় হবে।’
রুহি শুধু শুনেই যায়। বিভোর গম্ভীর গলায় বলে,
‘ আর আমাদের দেখা হবেনা রক্তজবা। কখনোই না!’
ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।
চলবে… ইনশাআল্লাহ!