#আজল
#পর্ব-পনেরো
২৯.
প্রিয়তা আজকাল অবিশ্বাস এর ঘোরে ডুবে থাকে। হবে নাই বা কেন? তানভীর এর কাজগুলো আজকাল বড্ড গোলমেলে ঠেকছে প্রিয়তার কাছে। প্রায় প্রতিদিনই হাতে ফুল নিয়ে ঘরে ঢোকে। তাও আবার প্রিয়তার পচ্ছন্দের ফুল। একদিন হঠাৎ তানভীর বিকেলের দিকেই বাসায় ফিরলো। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাদা ফুলের স্টিক হাতে। প্রিয়তাকে দিয়ে বললো-
“আজ হঠাৎ রাস্তায় চোখে পড়লো তাই নিয়ে এলাম। আর ফুল কেনার সময় আমার মনে হলো তোমার কি ফুল পচ্ছন্দ, আমি তাই জানিনা। এজন্য সবগুলোই ক’টা ক’টা করে এনেছি। তুমি রাগ করলে নাতো?”
প্রিয়তা অবাক হলে চেয়ে রইলো তানভীর এর দিকে। একেতো আজ তানভীর তারাতাড়ি বাড়িতে এসেছে, হাতে আবার ফুল নিয়ে, তার উপর ওকে বলছে -রাগ করোনিতো?! হজম হচ্ছে না প্রিয়তার। ভয় লাগলো, আজ আবার কিছু উল্টাপাল্টা করবে না তো তানভীর? তানভীর রেগে গেলে খুবই ভিন্ন পন্থায় শাস্তি দেয়। খুব খুব আদর দেয় সারারাত ধরে। প্রিয়তাকেও বাধ্য হয়ে আদর গ্রহন করতে হয়। ঘড়ি ধরে ছয়ঘন্টা একটানা। এক সেকেন্ড ছাড় দেয় না। প্রিয়তার কান্না পায় সে রাতে। কেমন নির্লিপ্ত ধরনের সে ভালোবাসা অথচ সেটাই গ্রহন করতে হবে সারারাত। এর চাইতে কঠিন শাস্তি মনে হয় দুনিয়াতে আর একটাও নেই- প্রিয়তা ভাবে। আজ কি সেই দিন? ভয়ে কুকরে যায় প্রিয়তা। সে একটা শুকনো হাসি দেয় তানভীর এর দিকে তাকিয়ে। তানভীর প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে কোল থেকে প্রিতিকে নেয়। প্রিতি অবশ্য যেতে চাচ্ছিলো না। মেয়েও বাবার এই আদর ভালোবাসা আগে পায়নি, সেও এসবে অভ্যস্ত না। তবে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে অত্যন্ত খুশি হয়ে বাবার সাথে খেলতে লাগলো। প্রিয় তখনে দাঁড়িয়ে আছে এভাবেই।
“কি ব্যাপার এখনো এভাবেই দাঁড়িয়ে আছো? কি হলো তোমার? বিকেলে কি কিছু নাস্তা টাস্তা পাবো আজ?”
প্রিয়তার ঘোর ভাঙে-
“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি নাস্তা বানিয়ে আসছি ততোক্ষণে। ”
হাত বাড়িয়ে প্রিতিকে নিতে চাচ্ছিলো।
“আরে আরে কি করছো? ওকে কেন নিচ্ছো? তুমি কাজ করবে তো ওকে নিচ্ছো কেন? ও থাক আমার কাছেই। আমরা বাবা মেয়ে আজ খেলবো। তাই না মা?”
তানভীর বলে।
প্রিয়তা আরো একবার অবাক হয়েছিলো সেদিন। তারপর নাস্তা বানিয়ে যখন তানভীর কে খেতে ডাকলো, তানভীর ওকেও বসতে বললো-
“তুমিও বসো না? আজ দুজনে একসাথে খাই?” হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয় ওকে।
“আচ্ছা বলোতো তোমার ফেভারিট ফুল কোনটা?”
“কি হয়েছে আপনার? আমি কি কোনো দোষ করেছি? এমন করছেন কেন?”
কেঁদে দেয় প্রিয়। তানভীর ব্যস্ত হয়-
“আরে আরে কাঁদছো ক্যানো? আমি তো কেবল তোমার প্রিয় ফুল কোনটা সেটাই জানতে চাইলাম। ”
নিজের হাতে চোখ মুছে দেয় প্রিয়র।
“আসলে আমি ভাবলাম, বিয়ের চার বছর পার হয়ে গেল অথচ আমরা দুজন দুজনার সম্পর্কে কিছুই জানি না…ব্যাপার টা কেমন না? ভাবলাম সেটা আজ থেকেই শুরু করি? আমি তোমার সম্পর্কে জানবো, তুমি আমার সম্পর্কে জানবে তারপর দুজন দুজনার মনের মতো চলার চেষ্টা করবো। যদিও শুরুটা আমাদের ভালো ছিলো না, তাই বলে শেষ টা যে খারাপ হবে এমন তো নয়? আমরা সেটাকে ভালো করার চেষ্টা করতে পারি তো, তাই না?”
প্রিয় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে। হঠাৎ কানের কাছে সুরসুরি মতোন লাগে-
“আরে বাবা, আজ তোমাকে রাতে কোনো শাস্তি দেবো না যাও। টেনশন করোনা। এখন ফটাফট আমাকে বলোতো, তোমার প্রিয় ফুল কোনটা?”
প্রিয়তা লজ্জায় আরক্ত হয়-
“বেলী আর কাঠালিচাপা। ”
তানভীর লজ্জায় রাঙা প্রিয়র মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। মেকি অভিনয় করতে করতে সে হঠাৎ খেয়াল করছিলো, প্রিয় মেয়েটার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখতে আসলেই সুন্দর লাগছে। ভীষন নিস্পাপ আর পবিত্র একটা ভাব আছে। মেকআপ করা মেয়েদের ফেস দেখতে দেখতে তার নিজের বউয়ের দিকেই ঠিক মতো তাকানো হয়নি কখনো। তানভীরের মনের মধ্যে বেশ একটা খুশির ভাব ছড়িয়ে পরলো। সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে প্রিয়তার সাথে গল্প করতে লাগলো।
সেই যে শুরু,আজ দু মাস ধরে এই চলছে তানভীরের। সেইদিন থেকে তানভীর তাকে একের পর এক সারপ্রাইজ দিয়েই যাচ্ছে। কোনোদিন হয় ওর প্রিয় ফুল দেয় অথবা কোনোদিন ওর পচ্ছন্দের কোনো একটা খাবার কিনে নিয়ে আসছে, কোনোদিন চকলেট নিয়ে আসছে অথবা কোনোদিন একটা শাড়ি বা জামা। এরমধ্যে সে একবারও প্রিয়র সাথে ইন্টিমেট হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। এ যেন এক নতুন তানভীর কে দেখছে সে। আজকাল প্রিয়রও বেশ ভালো লাগে তানভীরের এই নতুন বিহেভিয়ার। ও এনজয় করছে তানভীরের এই নতুন রুপ। ওর নিজেকে এখন বেশ প্রেমিকা প্রেমিকা মনে হয়। মনেহয় জীবনে প্রথম প্রেম করছে তানভীরের সাথে। সব মিলে ওর চেহারার খুশির একটা জেল্লা ফুটে উঠছে। ভাবতে ভাবতে তানভীরের ফোন আসে-
“আমার বউটা কি করছে? ”
“কিছু না।” খুশিতে নেচে ওঠে প্রিয়। ইদানিং তানভীর ওকে বউ বলে ডাকে মাঝে মাঝে। ভীষন ভালো লাগে প্রিয়র। বুকের মধ্যে কেমন একটা ভালোলাগা ছেয়ে যায়। নতুন প্রমিকার মতোই বুকে কাঁপন ধরে।
“বউটার আজ ক্লাস নেই?”
“নাহ।”
“তাহলে কি বউটা আমার সাথে আজ ডিনারে যাবে? সাধারণ একটা সুতি শাড়ি থাকবে পড়নে, চোখে মোটা করে কাজল টানা আর হালকা লিপস্টিক ব্যস আর কিছু না।আর হ্যা চুলটা খোপা করবে বাট সেই খোপায় ফুলের মালাটা আমিই গুজে দেবো। যাবে কি বউটা?”
“হুম। আমি রেডি হচ্ছি তাহলে?”
অদ্ভুত আনন্দে প্রিয়তার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।
“আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। রাত আটটায় ফোর সিজন এ… ঠিক আছে?”
খুশিতে আত্মহারা প্রিয় আলমিরা খুলে একের পর এক শাড়ি বের করে বিছানায় ফেলতে থাকে। আশ্চর্য! ওর একটাও ভালো সুতি শাড়ি নেই? সব ভারি ভারি শাড়ি, এগুলো তো পড়া যাবে না? খুজতে খুজতে শেষ পর্যন্ত একটা অফহোয়াইট সোনালী পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পেয়ে গেলো। বাহ! এটা পড়লে বেশ লাগবে। বিয়ের পর প্রথম এই রকম ডেটে যাচ্ছে প্রিয়তা, বারংবার নিজেকে আয়নায় দেখে যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে। বাহ!ভালোই তো লাগছে আজ! নিজেরই তো চোখ সরছে না, তানভীর কি করবে আজ? ভাবতেই বুকের ভেতর হাজারো জোনাক পোকা দৌড়োদৌড়ি শুরু করলো। মেয়েটাকে আজ সাথে নেবে না ঠিক করল। কাজের মেয়ে আছে আর মেয়ের দাদী ও আছে, আজ মেয়েকে ওদের জিম্মায় রেখে যাবে।
প্রিয়তা যখন গাড়ি থেকে নামছিলো তানভীর পাশ থেকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা লজ্জা পেলো আনকোরা কিশোরী মেয়ের মতো। গাল দুটো লাল হলো লজ্জায়। তানভীর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রিয়র দিকে। ওরা দুজন যখন রেস্টুরেন্ট এর দড়জা দিয়ে ঢুকছিলো অনেকের মুগ্ধ দৃষ্টি টের পাচ্ছিলো প্রিয়। সেটা বুঝেই প্রিয়র মাথা ঝুকে গেল আরেকটু। এতো এ্যাটেনশন পেয়ে সে অভ্যস্ত না। তানভীর ওকে কোনার দিকে একটা টেবিলো নিয়ে গেলো। ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে তানভীর বসলো পাশেই আরেকটা চেয়ার টেনে।
“আজ তোমার কাছ থেকে দূরে বসতে ইচ্ছা করছে না, তাই পাশেই বসলাম।”
তানভীর মুগ্ধ গলায় বললো। প্রিয় একটু লজ্জারাঙা হাসি দিলো।
“বউ তোমাকে আজ ভীষন সুন্দর লাগছে। সাধারনের মধ্যে ও অসাধারণ লাগছে। তবে একটা জিনিস মিসিং আছে?”
“কি?”
প্রিয় অবাক চোখে তাকায়।
প্যাকেট থেকে দুটো বেলি ফুলের মালা বের করে প্রিয়র খোপায় পরিয়ে দিলো তানভীর-
“এবার একেবারে পারফেক্ট লাগছে। এই আমার দিকে তাকাও তো একটু?”
প্রিয় মুখ তুলো তাকাতেই তানভীর পটাপট ওর কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
প্রিয় বাধা দিলো ওকে-” এই, কি হচ্ছে? সবাই দেখছে তো?”
“দেখুক, আমি তো অন্য কারো না আমার বউ এর ছবি তুলেছি।”
“এই তুমি আমার মেয়েটাকে আনলে না কেন? একাই আসলে যে? ওহ! বুঝেছি আমার সাথে একা একা সময় কাটাতে চাচ্ছিলে তাই না?”
প্রিয় কে তানভীর আজকে লজ্জা দিয়েই মারবে মনেহয়? কি সব কথা বলছে? তানভীর মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ইশ! মানুষটা যে কি না? এক্কেবারে খারাপ একটা মানুষ!
“আপনি খুব খারাপ! খুব!”
প্রিয়র কথা শুনে তানভীর হো হে করে হাসছিলো আর প্রিয় মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখছিলো অপলক!!!
৩০.
“আচ্ছা, বিয়েটা আপনি কি ভেবে করেছিলেন, বলুন তো?”
সাঁচির হঠাৎ করা প্রশ্নে নড়েচড়ে বসে ফুয়াদ। কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাঁচি বলে-
“থাক বাদ দিন তো! আমার আর আপনার কোনো কথাই শুনতে ইচ্ছা করে না।”
“প্লিজ সাঁচি!আমার কথাগুলো শেষ করার একটা সুযোগ অন্তত আমাকে দাও। তুমি তো আমার কোনো কথাই শুনছো না। সেদিনের কথাগুলোও তো অসমাপ্ত রয়ে গেল?”
“আপনি শুনেছিলেন? বিয়ের পরের পাঁচটা মাস আমিও তো কত কথা বলতে চেয়েছি আপনি শুনেছিলেন? আপনার কথা শোনার জন্য বসে থেকেছি, আপনি বলছিলেন কিছু? তাহলে আজ আমি কেন শুনবে?”
ফুয়াদ মাথা নিচু করে বসে থাকে। কি বলবে ও? সাঁচির প্রতিটা কথাই তো সত্যি! মনে সাহস জমিয়ে কথাগুলো বলতে বড্ড দেরি করে ফেললো মনে হয়? আরো একটা ভুল! এই ভুলের বোঝা বইবার শক্তি মনে থাকলে হয়?
“যাই হোক, বাবা মা চলে গেলে এবার আমি বাসায় যাবে। অনেকদিন যাওয়া হয় না আর তাছাড়া এই লাস্ট সেমিস্টার টা ওখান থেকেই করবো ভাবছিলাম। এখানে থেকেই বা কি করবো? বরং আপনার খারাপ লাগলে আপনি ওখানে চলে আসবেন মাঝে মাঝে।”
ফুয়াদ দীর্ঘশ্শ্বাস ছাড়ে। সিলেট থেকে আসার পর থেকেই এমন করছে সাঁচি। ওর সাথে আর কথা বলে না। ওর চোখের সেই মুগ্ধতা ও যেন আর নাই। কেমন কঠোর বিহেভ করে? নিজের মনের বোঝা হালকা করতে চেয়েছিলো ফুয়াদ। কিন্তু পারলো না! উল্টো বোঝা বেড়ে গেলো আরো। এর চাইতে সব লুকিয়ে মৃত মন নিয়ে সংসার করলেই ভালো হতো। অন্তত এই মেয়েটা সুখে থাকতো। কেউ না কেউ তো সুখী হতো ওর কারনে!
ফুয়াদের বাবা মা চলে যাওয়ার পরদিনই সাঁচি ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসলো। ফুয়াদই অবশ্য ওকে রেখে গেছে। সাঁচি বলেছিলো-
“আপনিই আমাকে রেখে আসবেন। মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখেও যাবেন। আমি চাই না আব্বু আম্মু এত সহজে কিছু বুঝে যাক। অন্তত আমার পড়ালেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত।”
ফুয়াদ মেনে নিয়েছে সেকথা। আর তাছাড়া ও তো চায় সাঁচিকে নিয়ে সংসার করতে, তাই তো সব সত্যি সাঁচির কাছে বলেছে। মিথ্যা দিয়ে জীবন শুরু করলে সেটাও তো আরেকটা ভুলই হতো। রেহনুমা তার অতীত আর সাঁচি বর্তমান। অতীত কে ঢেকে রেখে বর্তমান নিয়ে চলা যায় না বরং অতীত কে সাথে নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের পথে পা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ। সাঁচি নিশ্চয়ই একদিন সে কথা বুঝবে!
আজকাল বাড়িতে ফিরতে ভীষন ক্লান্তি লাগে ফুয়াদের। ফাঁকা বাড়ি যেন হা করে গিলতে চায় ফুয়াদকে। বিয়ের আগে তো এই বাড়িতেই থাকতো, তখন তো এরকমটা লাগেনি ফুয়াদের? তবে, তবে এখন কেন এমনটা মনে হয়? বিয়ের পরে পরে সাঁচি ওর জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতো, জানে ফুয়াদ। তাই ও অফিস থেকে ফিরলেই ওর আশেপাশেই ঘুরঘুর করতো সাঁচি। চা নাস্তা, এটা ওটা দেবার বাহানায়। মাঝে মাঝে ওকে নিজে থেকেই তো জড়িয়ে ধরতো, চুমুটুমুও দিতো। তখন বিরক্ত লাগলেও আজকাল যেন সেটাই মিস করছে ফুয়াদ। কতবার ফোন দিতে যেয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়েও আবার রেখে দিয়েছে ফুয়াদ। ফোন দিয়ে কি বলবে সেটাই খুঁজে পায়না ফুয়াদ! ক্লান্ত, বিষন্ন ফুয়াদ গোসল না করেই, না খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকে আর মনে মনে বির বির করে-
“তুমি তো বলেছিলে তুমি অন্যরকম। তোমায় বিশ্বাস করতে বলেছিলে। বলেছিলে আমায় ছেড়ে যাবে না কখনোই। তবে কি হলো, সাঁচি? কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলে নাতো? তুমিও তবে আমাকেই দোষী বানালে??”
ওদিকে সাঁচিরও যে দম বন্ধ হয়ে আসে বাবার বাড়িতে। মনের মধ্যে অসহ্য বেদনা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। বাসায় থাকলে তবুও তো ফুয়াদকে এক নজর দেখা যায়? মাঝে মাঝে জোর করে ছুয়েও দেয়া যেত। আর এখন? এখন তো সেই চোখের দেখাটাও দেখা যাচ্ছে না!! ছোয়া তো দূরে থাকুক। এই যে ও এসেছে একমাস হয়ে গেল ফুয়াদ তো একদিন ও এলো না ওকে দেখতে? নিজ ইচ্ছায় একটা বার ফোনও তো দেয় না? নিজেকে কেমন যেন পরিত্যক্ত আসবাবের মতো মনে হয় সাঁচির। গভীর রাতে বুকে হাহাকার হয়, ফাঁকা ফাঁকা লাগে বুকটা। পানির তেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায় সাঁচির। পানি খেয়ে এসে, হাটুতে মুখ গুজে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে সাঁচি। সারারাত না ঘুমিয়ে ছটফট করে সাঁচি। ভোরের দিকে ক্লান্তিতে চোখ ভেঙে ঘুম আসে। এভাবেই প্রতিটা রাত কেঁদে আর প্রতিটা দিন ব্যস্ততার ভান করে কেটে যায় সাঁচির।
অফিসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিলো ফুয়াদ। দুপুরের এই সময়টা খাওয়ার পরে কাজে একটু ঢিলেমি হয়, বেশ একটু ঝিমঝিম ভাব আসে। খাওয়ার পড়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ঝিমোচ্ছিলো ফুয়াদ। তখনই ফোন টা বেজে উঠলো। স্কৃিনে নামটা দেখে হাসি ফুটলো ঠোঁটে, সাঁচি ফোন করেছে।
“হ্যালো!কি ব্যাপার এতোদিনে একবারও এলেন না যে? আমি আপনাকে কি বলেছিলাম মনে নাই? কিছুদিন পরে পরে এসে বাসায় দেখা দিয়ে যেতে? তা আপনি তো একবারও এলেন না! আজব মানুষ তো আপনি! আপনি জানেন বাবা আপনার কথা বলে বলে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে আমার? সামনে পরীক্ষা আমার অথচ আপনার জন্য ঠিকমতো পড়ালেখা করতে পারছি না! আপনি কি কোনোদিনও নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাববেন না?”
একদমে কথাগুলো বলে সাঁচি। ফুয়াদ নিস্তব্ধ থেকে কথা গুলো শুনে যায়। সাঁচি আবার বলে-
“আজ অফিস থেকে সোজা এখানে চলে আসবেন। ঠিক আছে?”
ফুয়াদ ঘার নাড়ে। সাঁচি বলে-
” কি? কথা নেই কেন? আপনি ঘাড় নাড়লে আমি কি দেখতে পাবো? মুখে বলুন।”
ফুয়াদ চমকে ওঠে। সাঁচি কিভাবে বুঝলো ফুয়াদ ঘার নাড়ছে? মেয়েটা কি সবজান্তা নাকি? না দেখে কিভাবে বলে দিলো? ফুয়াদের খুব ভালো লাগে সাঁচির বকাটা। কতোদিন পর তাও তো একটু কথা শুনলো, হোকনা সেটা বকাই। ও হেসে উওর দিলো-
“ঠিক আছে? আসবো।”
সাঁচি আর কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দিলো। ফুয়াদের হঠাৎ করে মনটা ভালো হয়ে গেল। ঠোঁটের কোনো একটা হাসি লেগে রইলো সবসময়ই। ও নিজেই অবাক। সাঁচির একটা ফোন কলে ও এতো খুশি! মেয়েটা কি ওকে জাদু করলো নাকি? গুনগুন করতে করতে কাজে মন দিলো ফুয়াদ।
বিকেলে অফিস থেকে একটি তাড়াতাড়িই বের হলো ফুয়াদ। এতোদিন পর শশুরবাড়ি যাবে? ভালোমন্দ কিছু কিনতে তো হবে? আর তাছাড়া ধানমন্ডি থেকে ওয়ারি বেশ ঝামেলার পথ।যেতেও সময় লাগবে অনেক। ফুয়াদ সাঁচির জন্য ফুল, চকলেট আর কি মনে করে একটা শাড়ি কিনে ফেললো গাড় বেগুনি রং এর সাথে বাড়ির জন্য প্রচুর ফল মিষ্টি সহ হাতের কাছে যা পেল,পচ্ছন্দ হলো সব নিয়ে নিলো। ফুয়াদ যখন সাঁচিদের বাড়ি পৌছোলো তখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুইছুই। ফুয়াদের কেমন বুকটা টিবটিব করছে। আচ্ছা! সাঁচি কি আজকে ওর জন্য ওয়েট করছে? নাকি ক্লাসে গেছে? ইস! আসার আগে ফোন করলেই পারতো? ক্লাসে গেলে ওকে নিয়েই আসতে পারতো? গাড়ি থেকে জিনিসগুলো নামিয়ে দারোয়ান এর হাতে উপরে পাঠিয়ে দিলো। শুধু সাঁচির জিনিসগুলো নিজের হাতে নিলো। লিফ্টে উঠে নিজেকে একটু পরিপাটি করে নিলো। কাপড়চোপড় ঠিকঠাক করে চুলটা হাত দিয়ে ব্যাকব্রাশ করলো। তারপর লিফটের আবছা আয়নায় নিজেকে দেখে হেসে দিলো। কি সব পাগলামি করছে ও? ও কি সাচির প্রেমে পড়ে গেলো? ভাবনাটা মনে আসতেই কেমন অদ্ভুত লাগলো ফুয়াদের! সাঁচিদের দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে ফুয়াদ যখন কলিংবেল দিচ্ছিলো তখন ওর বুকের ভেতর যেন ড্রাম বাজ্জাচ্ছিলো কেউ!!!!!
চলবে—-
©Farhana_Yesmin