আজল পর্ব-১৩

0
1403

#আজল
#পর্ব-তেরো

২৭.

“তারপর?” বেশ অনেকক্ষণ পরে সাঁচি কথা বলে।
ফুয়াদ চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিলো। মুখটা শুকিয়ে গেছে, ঠান্ডা কফিতেই চুমুক দিলো একটু।
“আমি সেদিন দুটো ক্লাস এ্যাটেন্ড করেই বেরিয়ে আসি। একেতো মনটা ছটফট করছিলো, তার উপর একটু নার্ভাস লাগছিলো। এতদিন একরকম ঘোরের মাঝে ছিলাম, কিন্তু সেদিন লজ্জা লাগছিলো খুব। একদিনের পরিচয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করা, ব্যাপারটা তখন নিজেরই হজম হচ্ছিল না। যাইহোক, রেহনুমার ক্লাস ছিলো আড়াইটা পর্যন্ত। আমি তার আগেই ওর কলেজের সামনে পৌছে গেলাম। ওকে ম্যাসেজ করে দিলাম যে, আমি ওর কলেজের সামনে দারিয়ে আছি। পৌনে একঘন্টা দারিয়ে থাকার পর ও আসলো। আমি ঠিক অপজিটের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও হেলেদুলে হেঁটে আসছিলো। আমি দূর থেকে দেখে হাত নাড়লাম। ওকে গতবারের তুলনায় আরো শীর্ন দেখাচ্ছিলো। স্বাস্থ্য আরেকটু কমেছে। ও আমার সামনে এসে সালাম দিলো। দুজনাই কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ আমিই বললাম, কোথাও বসার কথা। রেহনুমা বললো সামনে একটা ভালো ফাস্টফুডের দোকান আছে। আমরা হেঁটে সামনে গেলাম। রেস্টুরেন্টে বসে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কিছু খাবে কিনা? ও মাথা নাড়লো। আমি তবুও জোর করে দুটো বার্গার আর কফি অর্ডার করলাম। জানি সারাদিন না খেয়ে ক্লাস করছে, আর তাছারা আমারও খাওয়া হয়নি সারাদিন। কিছুসময় পর ও নিরবতা ভঙ্গ করলো-
” কেন ডেকেছেন, ভাইয়া? আপনি যদি আপুর কথা না বলতেন তাহলে কিন্তু আমি কখনোই দেখা করতে আসতাম না!”
“কেন? তুমি কি ওকে ভয় পাও?”
“ভাইয়া, এই মুহুর্তে আমি সবাইকে ভয় পাই। যার বাবা মা থেকেও থাকে না তাকে সবাই ঢোল এর মতো বাজাতে চায়। আর সেখানে আমি আপুদের বাড়ির আশ্রিতা। নেহাত মিলি আপুর বাবা মানে আমার মামা ভালো মানুষ তাই থাকছি। আপুও ভালো,ঐ বাড়িতে একমাত্র আপুই খাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে আমি খেয়েছি কিনা? কিন্তু ঐ যে বললাম, আমি বাবা মা থেকেও এতিম, তাই ভয়ে ভয়ে থাকি। আমাকে এতো সহজে কি সবাই ভালোবাসবে? ”
“যদি বলি বাসবে? কেউ যদি তোমাকে ভালোবাসতে চায়, তোমার কেয়ার করতে চায়, তোমাকে জীবনের সব সুখ দিতে চায়, তাহলে কি তুমি তাকে সুযোগ দেবে?”
“নাহ! কখনোই না। আপনি যে ভালোবাসার কথা বলছেন সে সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না।” মাথা নাড়লো রেহনুমা।
“কারন আমি জানি ওগুলো সবই টাইম পাস হবে। কে আমার মতো চালচুলোহীন কে বাড়ির বউ বানাবে? আর তাছারা আমি স্বইচ্ছায় কারো কাঁধে বোঝা হতে চাই না। আবার ফ্যামিলির কারো কথার অমান্য করতেও চাই না। এমনিতেও মায়ের কাজের জন্য কম কথা তো শুনিনি জীবনে? ফ্যামিলির বিপক্ষে যাওয়ার মতো সাহস আমার নাই।”
“কে তোমাকে বলেছে বিপক্ষে যেতে? তুমি তোমার মতই থাকো না। রেহনুমা, তোমাকে কিছু বলতে চাই? বলতে চাই এই কারনে যে, না বলতে পারলে আমি মারা যাবো মনে হয়।”
“এমন কিছু বলবেন না যেটা অসম্ভব। আমি স্বপ্ন দেখে কষ্ট পেতে চাই না।”
“প্লিজ,একটু শোনো মন দিয়ে।আমি…আমি আসলে জানি না আমার কি হয়েছে…যেদিন থেকে তোমাকে দেখেছি…কি যে হয়েছে…আমি পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছি। না ঠিক মতো পড়ালেখা করতে পারছি, না খাওয়া, না ঘুম!কিচ্ছু ঠিক নেই। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে যাওয়ার বাট পাড়ছিনা। জীবনে এই প্রথম এরকম ফিলিংস এর সাথে পরিচয় হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না কি করলে ভালো লাগবে। এই যে তোমার সাথে দেখা করলাম মনের মধ্যে অনেক শান্তি লাগছে। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, তোমার সাথে আজ দেখা হবে এই খুশিতে এতদিন পর গত রাতেরই প্রথম আমি একটু পড়তে পেরেছি। মাঝখানে সব পরীক্ষায় লাড্ডু পেয়েছি, জানো?”
রেহনুমা আমার কথা শুনে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিল ও আসলেই একটা বাচ্চা। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে ও আবার গম্ভীর হয়ে গেল।
“শোনেন, এই যে যেগুলা বললেন, মানে জানেন?”
আমি বোকার মতো মাথা নাড়ি।
“আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন, বুঝলেন? বাট লাভ নাই, এই প্রেম ভালোবাসার কোনো মুল্য নাই, বুঝলেন। আমার বাবা মাও প্রেম করে বিয়ে করছিলো, তার হাল তো দেখছেনই।”
নিজের দিকে ইশারা করলো রেহনুমা। আমার একটু রাগ হলো-
“সব সম্পর্ক যে একই রকম হবে তার কি গ্যারান্টি, বলোতো? ”
“ঘুরে ফিরে ঐ একই হবে। আচ্ছা আপনি এই যে এতো কথা আমাকে বুঝাচ্ছেন, আপনি কি আপনার বাসায় আমার কথা বলতে পারবেন?”
“পড়ালেখা শেষ করে বলবো?”
“মানে পাঁচ বছর পরে?”
“হ্যা”
“ততোদিন প্রেম করলে তো আমরা ভাইবোন হয়ে যাবো? নিজেদের মধ্যে কথাবলার কিছুই খুজে পাবো না। আমার ভাই আপনার বোন হওয়ার শখ নাই। আপনি আপনার রাস্তা মাপেন। আমার পিছে আইসেন না। ”
“রেহনুমা, কি বলো এইগুলা? প্লিজ, ফাজলামো কইরো না?”
আমি অসহায় হয়ে বলি।
“আপনি ফাজলামো করতেছেন। জেনেশুনে আমার জীবনটা তেজপাতা বানাতে চাচ্ছেন। আমাকে অবলা পেয়ে আপনিও সুযোগ নিবেন নাকি?”
রেগে উঠে গেল রেহনুমা।
“আমার পিছে যেন আবার না আসেন?” বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম এই মেয়ে সহজ না। সহজে হার মানবে না। এত অলপ বয়সে এতো কঠোরতা কিভাবে পেলো?আর কি অবলীলায় বলে দিলো যে, আমি ওর প্রেমে পড়েছি? আমারও যেন জেদ চেপে গেলো। ওকে রাজি করানোর জেদ। আমি ভুলে গেছিলাম, বাবা ঠিক এই কথাগুলো বলেই আমাকে সাবধান করেছিলো। বাবা আমার কাছ থেকে কথা আদায় করেছিলো সে কথাও আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। মাথার মধ্যে তখন শুধুই ওকে রাজি করানোর নানা রকম বুদ্ধি ঘুরছিলো।

পরদিন আবার গেলাম ওর কলেজের সামনে। ও আর আমাকে দেখে এগিয়ে আসে না। আমি পিছন পিছন গেলেও আমাকে না দেখার ভান করলো। একটা কথাও বললো না আমার সাথে। আমিও হার মানার ছেলে না….প্রতিদিন যেতে লাগলাম ওর কলেজে। কোনো কোনো দিন এমন হতো যে দু’ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি ওর দেখা নাই। হয়তো নিজেকে ভীরের মধ্যে লুকিয়ে চলে যেত, এমন ও হতো কোনো কোনো দিন ও আসেনি। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে ওকে ফোন দিতাম। ও ফোন ধরতো না। এভাবে প্রায় একমাস কেটে গেলো। একদিন হঠাৎ রেহনুমার ম্যাসেজ আসলো-“আপনার না পরীক্ষা সামনে? আপনি এইভাবে আমার পিছনে সময় নষ্ট করছেন কেন? মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিন। আর আসবেন না, কেমন? পরীক্ষা শেষে কথা বলবো।”
ম্যাসেজ দেখে আমি তো মহা খুশি। যাক বাবা, তাওতো কিছু রেসপন্স পাওয়া গেল। কিন্তু আমার পরীক্ষা সেটা ও জানলো কিভাবে? তখন মনে পড়লো হয়তো মিলির কাছে শুনেছে। যাইহোক, ওর ম্যাসেজে আশ্বস্ত হয়ে এবার আমি পড়ালেখা শুরু করলাম। কিন্তু এতোদিনের গ্যাপ কি এই কদিনের পড়াশোনায় পূরন করা সম্ভব? ফলাফল, কোনোরকমে পরীক্ষা গুলো দিলাম। টেনেটুনে পাশ হবে হয়তো! পরীক্ষার পরদিনই আমি ছুটলাম রেহনুমার সাথে দেখা করতে। ওকে আগেই ম্যাসেজ করেছিলাম। কলেজ থেকে বের হয়েই ও আমার দিকে এগিয়ে এলো,বললো-
“চলুন, একটু দূরে কোথাও বসি। এখানে বসলে পরিচিত কেউ দেখে ফেলতে পারে।”
“ভার্সিটি এলাকায় যাবা?”
“নাহ,ওখানে আপনার ফ্রেন্ডরা আছে না?অন্য কোথাও।”
“সব জায়গায় ওরা থাকে নাকি? চলো কার্জন যাই।”
কিছুক্ষণ ভেবে রেহনুমা মাথা নাড়লো –
“নাহ, যাবো না। চলেন এই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলি। কেউ দেখলে দেখুক”
কিছুক্ষণ হাঁটার পর রেহনুমা বললো-
“আচ্ছা আপনি এইরকম পাগলামি কেন করতেছেন? কোনো ভবিষ্যৎ আছে এর?”
“কেন থাকবে না? তুমি চাইলেই ভবিষ্যৎ হবে।”
“দেখেন,আপনি বাচ্চা না আমি? কেন শুধু শুধু জেদ করতেছেন? আমি কোনোদিনও এই সম্পর্কে যাবো না।”
“প্লিজ তুমি আমাকে একবার সুযোগ দাও,তোমার জন্য কিছু করার। আমি শুধু তোমাকে একটু খুশি দিতে চাই, সুখী দেখতে চাই।”
“আমি তো সুখী হতে চাচ্ছি না? কেন আপনি জোর করতেছেন? আপনি আর আসবেন না প্লিজ! আমার কষ্ট হয়!”
কান্না করতে লাগলো রেহনুমা। আমার প্রচন্ড কষ্ট হলো। আরে, আমি তো কেবল ওকে একটু সুখ দিতে চাই, আমি তো ওর কান্নার কারন হতে চাই না। আমিতো তো ভেবেছিলাম, ও আজকে পজিটিভ কিছু বলবে? কিন্তু আমি কি করবো? ওকে না দেখলেও যে আমার ভালোলাগে না। আমি ওর দু গালে হাত দিয়ে চোখ মুছে দিতেই ও ছিটকে দূরে সরে গেল-
“কি করছেন টা কি? এই দুঃসাহস আপনাকে কে দিলো?”
“সরি,তুমি কাঁদছিলো তাই…”
“প্লিজ কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ…”
নিজেই হাত দিয়ে নিজের কান্না ভেজা মুখটা মুছলো।
“আচ্ছা, তুমি তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট, তাই না?”
“হ্যা,তো?”
“আচ্ছা, আমি তবে তোমাকে টিউশন দেই। তোমার যে যে সাবজেক্টের সমস্যা থাকবে আমি দেখিয়ে দেবো। আসলে তোমাকে একবারে না দেখতে পারলে আমি থাকতে পারবো না, তখন অযথাই তোমাকে বিরক্ত করবো। তুমি নিশ্চয়ই তা চাও না?”
আমি না পারতে অন্য পথ ধরলাম ওর কাছাকাছি থাকার জন্য।
“তো কোথায় পড়াবেন? এই রাস্তায়…..”
“এই ধরো আশেপাশে কোথাও বসে দেখিয়ে দেবো…”
আমি মাথা চুলকাই।
“আপনার মাথা! উনি রাস্তায় বসে আমায় টিউশন দেবেন? আচ্ছা, আমি দেখি আমাদের ক্লাসের কেউ পড়বে কিনা? যদি পড়ে তাহলে কয়েকজন একসাথে ব্যাচ করে পড়বো। আপনারও ইনকাম হবে, আবার আমাকে আপনার দেখার শখও মিটবে?”
ওর কথা শুনে আমি তো মনে মনে রীতিমতো নাচতে শুরু করেছি। ও যে এতো সহজে রাজি হবে আমি ভাবিনি।
“শুনুন,আমি কিন্তু ফ্রি পরবো।আমি তো আপনাকে স্টুডেন্ট জোগার করে দিবো,তাই আমি ফ্রি পড়বো। আর খবরদার মিলি আপু যেন ভুলেও এসব না জানে??”
“কোনোদিনও না।”
আমি খুশি হয়ে বলি।
“আপনি বরং এইফাকে কিছুদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। কোনো ব্যবস্থা হলে আমি জানাবো আপনাকে।”
আমার তো বাড়িতে যাওয়ার এক ফোটাও ইচ্ছা ছিল না। এবার মনে হচ্ছে যেতেই হবে। আমি মাথা নেড়ে চলে এলাম। যাক, যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেটাতেই আমি খুশি। ও যদি পড়ে আমার কাছে তাওতো প্রতিদিন ওকে দেখতে পাবো?

আমি বাড়িতে গেলাম ঠিকই কিন্তু মন পড়ে রইলো ঢাকায়। আমার এই উদাসীন ভাব মায়ের নজর এড়ালো না। মা আমাকে ধরলেন এক বিকেলে-
“কি রে বাবু, তোর কি হয়েছে বল তো? সারাদিন এতো ছটফট করিস কেন?”
“কিছু না মা। এমনিতেই, অনেকদিন পর বাড়ি আসলাম তো তাই।”
“কিছু না হইলেই ভালো, বাপ। মন দিয়ে পড়ালেখা কর। রেজাল্ট খারাপ হইলে কিন্তু তোর বাবা খুব রাগ করবে?”
আমি মনে মনে মাকে বলি, মা তোমার ছেলে তো পড়তেই ভুলে গেছে। আব্বা জানলে কি করবে জানি না তবে যাই করুক আমার মনেহয় আর গায়ে লাগবে না!!
সপ্তাহ খানেক পর রেহনুমা ফোন করলো, চারজন পাওয়া গেছে। ওরা পড়বে, সাথে রেহনুমা। চারজনের কোনো একজনের বাসায় পড়াতে হবে। খবর শুনেই আমার খুশি দেখে কে? খুশির চোটে মাকে ফটাফট কয়েকটা চুমো দিয়ে দিলাম। মাতো অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। বাবার নজর বাঁচিয়ে এক রকম পালিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। পাছে বাবা আবার পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করে?

আমার টিচারের জীবন শুরু হলো। রেহনুমাসহ পাঁচ জন পড়তো ওরা। আমার বেশ মজা লাগছিলো পড়াতে। ওদেরকে বুঝানোর পরে ফাঁকে ফাঁকে যখন টাস্ক করতে দিতাম সেই সময় টুকু আমি রেহনুমা কে দেখতাম। ও তাকালে মাঝে মাঝে আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে যেত। ও লজ্জিত হয়ে চোখ সরিয়ে নিতো আর আমি হাসতাম মিটিমিটি। আমাদের এই লুকোচুরি খেলাতে দিন ভালোই কাটছিলো। আমার নতুন সেমিস্টারের ক্লাসও শুরু হয়েছিল এর মধ্যে। টেনেটুনে পাশ করেছিলাম। নিজের ক্লাস, রেহনুমাদের পড়ানো সবমিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছিলো। এবার আমি একটু স্থির হয়ে নিজেও পড়তে শুরু করলাম। সবকিছুই ঠিক চলছিলো, কিন্তু মাঝে আমি জ্বরে পড়লাম। ভীষণ রকম জ্বর আমাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিলো। তিনদিন কোনো জ্ঞান ছিলো না আমার। কাউকে খবরও দিতে পারিনি। আমার রুমমেটগুলা যথেষ্ট ভালো ছিলো, আমার অসুস্থতায় ওরা অনেক সেবা করেছে আমায়। তিনদিন পরে আমার জ্বর ছাড়লো। বিকেলে আমার এক রুমমেট বললো, ফুয়াদ তোর অনেক ফোন আসছিলো ভাই। তুই কি স্টুডেন্ট পড়াস নাকি, কই কখনো তো বলিস নাই। তোর ছাত্রীরা তো ফোন দিয়ে মাথা নষ্ট করে দিতেছিল তাই বাধ্য হয়ে ফোন বন্ধ করে রাখছিলাম। দয়া করে ফোন টা চালু কর ভাই।

আমি তড়িঘড়ি করে ফোনটা ওপেন করতেই অসংখ্য ম্যাসেজ, একটার পর একটা টুংটাং আওয়াজে আসতেই থাকল। সব একই নাম্বার থেকে, আর আমি বিস্ময়ের সাথে দেখলাম প্রায় সব রেহনুমার ম্যাসেজ। আমি একটা ম্যাসেজ ওপেন করে কেবলই পড়তে শুরু করেছি তখনই রেহনুমার কল-
“হ্যালো”
“এই, কি হইছে আপনার? তিনদিন কোনো খবর নাই, ফোনটাও বন্ধ। আপনি এক্খন আসেন আমি আপনাকে দেখবো।”
“আস্তে রেহনুমা, আস্তে। দম নেও একটু। আরে,জ্বর হইছিলো আমার। এই কেবল একটু আগে জ্বরটা ছাড়লো। ফোনটা বন্ধ হয়েছিলো। কেবল খুললাম।”
“আমি কিছু জানিনা,আপনি এখন আসবেন, আমি আপনাকে দেখবো। নাইলে শান্তি পাবো না।”
“আরে শরীর টা দূর্বল তো, এখন বের হওয়া ঠিক হবে না। আর তাছারা তুমিই বা কি বলবা বাসায়, একটু পরে তো সন্ধ্যা লাগবে।”
“আমি কিছু জানিনা, আমি কিছু একটা বলে বের হবো,আপনি আসেন। আমার কলেজর সামনেই আসেন। আপনার তো কাছে হবে ঐইটা।”
রেহনুমার আচরনে আমি চরম অবাক হলাম। আমি যার পাগল সে আমাকে নিয়ে পাগলামি করতেছে? আমাকে নিয়ে ওর এই রকম পাগলামি করার কারন কি? ও তো এইরকম কখনো করে না? আমি অনেক কষ্টে দূর্বল শরীরে বের হলাম। সেদিনই প্রথম রেহনুমা দেখলাম আমার আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে রিকশা থেকে নামতে দেখে ও নিজেই দৌড়ে আসলো। আমাকে ধরলো দু’হাতে। রিকশা একটু দূরে যেতেই ও আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। আমি বুঝতেই পারলাম না কি হলো তার আগেই ছেড়ে দিলো। লজ্জিত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম বোবা হয়ে। কি বলবো, যার পিছু আট নয় মাস ধরে পড়ে আছি সে আজ নিজের থেকে আমার কাছে ধরা দিচ্ছে? আমি অবিশ্বাস্য ভাবে জিজ্ঞেস করলাম-
” কি হইছে রেহনুমা, তুমি ঠিক আছো তো?”
রেহনুমা এবার চোখ তুলে তাকালো, ওর দুচোখ ভরা জল, সে আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলো তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো-
“নাহ,আমি একদম ঠিক নাই…এই যে তিনদিন আপনার কোনো খবর নাই…জ্বরে পরে আছেন..আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারতেছিলাম না…আমি কিভাবে ঠিক থাকি বলেন তো…আজকে ছয়-সাত মাস যাকে প্রতিদিন দেখি তাকে না দেখলে কি ঠিক থাকা যায়?”
“ওহ! তা এখন তো দেখলা। এখন তো ঠিক থাকবা। আমি যাই তাহলে?”
আমি চলে আসতে নেই, রেহনুমা পেছন থেকে আমার হাত ধরে। আমি বলি-
“কি?”
“ভালোবাসি তো!”
“কাকে?”
রেহনুমা রেগে যায়-
“ঐ রিকশাওয়ালাকে যে আপনাকে নিয়ে আসছে। হইছে?”
আমি হাসি-
“তাহলে এই খানে দাড়ায় আছো ক্যান। যাও বেটাকে খুজো যায়ে।”
রেহনুমা আরে রাগে, আমার দেখতে ভালো লাগে। ও আমার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়-
“আমি গেলাম তাহলে?”
আমি ওর হাত ছাড়ি না, আরো শক্ত করে ধরে বলি-
“পারলে ছাড়াই যাও দেখি?”
রেহনুমা বৃথা চেষ্টা করে হাত ছাড়ানোর, আমি দেখি আর হাসি আর মনে মনে বলি-
” অবশেষে আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম!!!”

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here