অসময়ের বৃষ্টিফোটা পর্ব ১

0
1584

বাম হাতের কব্জিতে হঠাৎ টান পড়ায় পেছনে ঘুরার চেষ্টা করলো তোহফা। কিন্তু তার আগেই কেউ তাকে টেনে নিয়ে গেলো কমিউনিটি সেন্টারের পেছন দিকটায়। হল ভর্তি মানুষজনের মাঝে অপরিচিত কোনো মানুষের এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত হলো সে। একে তো অনেকক্ষণ যাবৎ খেয়াল করছে তার লেহেঙ্গার টপসের পেছনের চেইন অল্প নেমে গিয়েছে কিন্তু এত মানুষের মাঝে কাওকে বলতেও পারছে না, তার উপর কেউ তাকে এভাবে আড়ালে নিয়ে এলো সব মিলিয়ে মেজাজ তুঙ্গে ওঠে গেলো তোহফার। এসে থামতেই তোহফা মনে মনে ভেবে নিলো কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেবে। যখনই শাসানোর জন্য সামনে ফিরলো তখনই থমকে গেলো সে।
নেভি ব্লু পাঞ্জাবি আর ব্ল্যাক জিন্স পরিহিত একটি ছেলে তার সামনে দাড়িয়ে আছে। ছেলেটিকে সে খুব ভালো করেই চিনে কিন্তু নাম জানে না। কোনো পরিচয়ও জানে না। শুধু জানে তার বড় চাচ্চুর ছোট ছেলে সাহেল ভাইয়ার ফ্রেন্ড। এছাড়া আর কিছু জানে না সে।

তোহফার পুরো নাম তাহরীমা নাজনীন তোহফা। গতমাসে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখন অ্যাডমিশন এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবা মা চট্টগ্রামেই থাকে। সেও চট্টগ্রামেই কলেজ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে তবে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। ইচ্ছে আছে বুয়েটে পড়ার। তাই ঢাকায় অ্যাডমিশন এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার বড় চাচ্চুর বড় ছেলে সাকিব ভাইয়ার বিয়ে আজ। সাকিব আর সাহেল দুই ভাই। দুজনই সম্পর্কে তোহফার কাজিন। সাকিব ভাইয়ার বিয়েতেই মূলত চট্টগ্রাম আসা তার। আর এসেই এমন বি শ্রী একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো সে।

শাসানোর জন্য ছেলেটার দিকে তুলে নেওয়া আঙ্গুল সাথে সাথে নামিয়ে ফেললো তোহফা। বড় ভাইয়ের ফ্রেন্ডের সাথে এমন বিহেভ তো করা যায় না। কিন্তু বড় ভাইয়ের ফ্রেন্ড তার সাথে যেই বিহেভ করেছে সেটাও তো কোনো ভদ্র মানুষের আচরণের মধ্যে পড়ে না। এতো মানুষের মাঝে এভাবে হাত ধরে টেনে পেছনে নিয়ে আসার অধিকার উনার নেই। আবারো কিছু বলতে যাবে তখনই ছেলেটা তার ওড়না পেছন থেকে এনে সামনের গলায় ঝুলিয়ে দিলো। আকস্মিক এমন হওয়ায় কিছুটা ভড়কে গেল তোহফা কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। ভড়কানোর চেয়ে এবার রাগটাই যেনো বেশি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তার। রাগ দেখিয়েই ঝাঁঝালো কণ্ঠে তোহফা বললো,
– “How dare you? একটা ছেলে হয়ে এতগুলো মানুষের সামনে একটা মেয়েকে নির্জন জায়গায় নিয়ে এলেন আপনার একটুও লজ্জা করছে না? তার উপর আবার ওড়না ধরে টান দিয়েছেন। সাহস হয় কিভাবে আমার গায়ে হাত দেওয়ার? নাকি মেয়ে দেখলেই নিজেদের ঠিক রাখতে পারেন না? ছেলে মানুষ সব….”
আর কিছু বলতে পারলো না তোহফা। তার আগে সামনের ছেলেটা চড় বসিয়ে দিলো তার গালে। চড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে সামনে তাকালো সে। শান্ত দৃষ্টিতে তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। চোখে মুখে হালকা রাগ ফুটে উঠলেও শান্ত ভাবটাই যেনো বেশি তার।
– “ওড়না যদি ফ্যাশন করে সাইডেই পড়তে হয় তাহলে একেবারে খুলে ফেললেও পারো। পড়ার দরকার নেই তো। এই সাইড ওড়না দিয়ে কি হবে এর চেয়ে পড়ারই দরকার নেই।বিয়ে বাড়ির ছেলেরা যে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে? থাকবে কেনো? ফ্যাশনই তো এখন মুখ্য উদ্দেশ্য। আমি যেভাবে ওড়না গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি এর যদি কোনো নড়চড় হয় তাহলে থাপ্পড় মেরে বাম পাশের দাঁত ডানপাশে আর ডান পাশের গুলো বাম পাশে পাঠিয়ে দেবো। মাইন্ড ইট।”
তারপরই গটগট করে বেরিয়ে গেলো ছেলেটি। তোহফা তখনও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না তার। কিন্তু ‘ছেলেরা চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে’ ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ওড়না ঠিকঠাকভাবে গায়ে জড়ালো সে, পেছনে হাত দিয়ে চেইন ভালোমতো লাগিয়ে নিলো। তারপর আবার ফিরে গেলো কমিউনিটি সেন্টারে।
বিয়ের কার্যক্রম শেষে কনে বিদায়ের আগেই সিদ্ধান্ত হলো সাকিব, ইশা (সাকিবের বউ), তোহফা, ইরা (ইশার ছোট বোন), আর সাহেল বরের সঙ্গে যাবে এক গাড়িতে। কিন্তু দেখা গেলো পেছনে চারজনের জায়গা হবে না। তাই তোহফা সিদ্ধান্ত নিলো মাইক্রো বাসে যাবে। কিন্তু যেহেতু আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিলো তাই মাইক্রো বাস সব রওনা দিয়ে ফেলেছে অলরেডী। যখনই এমন দোটানায় পড়লো তারা তখনই তোহফা দেখলো তখনের ছেলেটি বাইক স্টার্ট দিচ্ছে। সে সাহেলকে বললো,
– “তুমি ওই ভাইয়ার সাথে মোটর সাইকেলে চলে যাও। তাহলে হয়ে যাবে না?”
– “আমি নাহয় গেলাম। তুই কি সামনে ড্রাইভারের সাথে বসবি?”
এবার চিন্তায় পড়ে গেলো তোহফা। ড্রাইভারটাকে প্রথম থেকেই দেখে এসেছে সে। কেমন অদ্ভুত চাহনিতে তার আর ইরার দিকে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। আসার সময়ও বরের গাড়িতে এসেছিলো। তখনও একই কেস। তাই এবার চিন্তায় পড়ে গেলো তোহফা। তাহলে কি সিএনজি নিয়ে রওনা দেবে? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় বারোটা বাজতে চললো। এতো রাতে এতগুলো পথ একা পাড়ি দেওয়া ঠিক হবে না। তারপর হঠাৎই আবার চোখ মুখ উজ্জ্বল করে সাহেল কে বললো,
– “তাহলে ঐ ভাইয়াকে তোমার জায়গায় বসিয়ে তুমি আর আমি বাইক নিয়ে চলে যাই। সবাই তো একই জায়গায় যাবো।”
– “এটা ভালো বুদ্ধি কিন্তু আমি তো বাইক রাইড করতে পারি না।”
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো তোহফার। রাগ নিয়েই বললো,
– “কি পারো তুমি? খাইতে পারো?”
এমন কথা শুনে হেসে ফেললো সাহেল। তোহফার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
– “সব সমস্যারই একটা সমাধান আছে।”
হঠাৎ পাশে এসে একটা বাইক থামলো। এক পলক তোহফার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি সাহেলকে বললো,
– “দাড়িয়ে আছিস কেনো? কোনো সমস্যা?”
– “গাড়িতে জায়গা হচ্ছে না।”
তারপরই কিছু একটা ভেবে আবার সাহেল বললো,
– ” তানভীর? এক কাজ করলে কেমন হয়?তুই নাহয় কষ্ট করে তোহফাকে তোর সাথে নিয়ে যা। একই জায়গায়ই তো যাচ্ছি। সমস্যা হবে না”
সাহেলের এমন কথায় রেগে গেলো তোহফা। এমন ফালতু একটা ছেলের সাথে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সেও ভেবেছিলো তানভীর ছেলেটিও নাকচ করে দেবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তার ভাবনার মাঝেই তুড়ি বাজিয়ে তানভীর বললো,
– “এই যে মিস? রাত বারোটা বাজতে চললো। এখনও দাড়িয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন নাকি আমার সাথে উঠবেন?”
তোহফা রাগ নিয়ে একবার তাকালো সাহেলের দিকে। সাহেল হেসে বললো,
– “সমস্যা নেই। ও আমার অনেক ছোট বেলার ফ্রেন্ড বলতে পারিস বেস্ট ফ্রেন্ড। ওই ড্রাইভারের পাশে বসার চেয়ে তানভীরের সাথে যাওয়া সেফ।”
তারপর চলে গেলো গাড়িতে। তোহফাও আর এতো রাতে জেদ না দেখিয়ে বাইকে উঠে পড়লো। এখন বাসায় যাওয়া দরকার। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তার।

বাইক স্টার্ট দিতে নেওয়ার সময়ই ঝাকি খেলো তোহফা। তানভীর এটা দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তারপর হাসি থামিয়ে গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর করে বললো,
– “আমাকে ধরে বসো। নাহলে মাঝ রাস্তায় দেখা যাবে ছিটকে দূরে পরে আছো আর আমি বাইক নিয়ে চলে গেলাম।”
– “আপনাকে ধরে বসা অসম্ভব। আমি পর পুরুষের শরীরে হাত দেই না।”
– “ঠিক আছে।”
তোহফার অস্বস্তি বুঝতে পেরেই ধীরে ধীরে বাইক স্টার্ট করলো তানভীর। তারপর সেভাবেই টানতে লাগলো। কিন্তু তোহফা বসে থাকতে পারলো না কিছু ধরা ছাড়া। অগত্যা নিজের রাগ, অস্বস্তি সব ঝেড়ে ফেলতে হলো তার। আস্তে করে তানভীরের কাধে হাত রাখলো সে। তারপর রাতের নির্জন চট্টগ্রাম শহর উপভোগ করতে লাগলো।

কাধে হাত দেওয়াতে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটে উঠলো তানভীরের। মেয়েটা শেষমেশ জেদের কাছে হার মেনে নিলো। পরক্ষণেই আবার গম্ভীর মুখে বাইক চালানোয় মনোযোগ দিলো সে।

চলবে??

বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন

#অসময়ের_বৃষ্টিফোটা
সূচনা পর্ব
© মাহজাবীন তোহা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here