#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#সপ্তম_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা
উশখুশ করতে করতে এক পর্যায়ে শাহনাজ পারভীনকে জিজ্ঞেস করে ফেলল তোহফা,
– “সামির জন্য নতুন টিচার রেখেছ মামী?”
– “হ্যাঁ, এবার একটা বেশ স্ট্রিক্ট টিচার পেয়েছি। ভাবলাম রেখে দেই। কেনো জানি পজিটিভ মনে হচ্ছে আমার সব।”
– “পজিটিভ বলতে?”
– “প্রায় পনেরো দিন হতে চললো কিন্তু এখনও কোনো কমপ্লেইন আসেনি। আর সামিকেও দেখি পড়াশুনা করে, মনে হচ্ছে এই টিচারের সাথে খাপ খেয়ে যাবে।”
শাহনাজ পারভীন এর কথা শুনে চমকে উঠলো তোহফা। পনেরো দিন মানে? তার মানে তানভীর সামিকে পনেরো দিন ধরে পড়ায়? কই সে তো জানল না এতদিন। একটা মানুষ পনেরো দিন ধরে তার বাসায় আসছে অথচ সে জানে না। কিন্তু মুখে বলল,
– “তাহলে তো বেশ ভালো।”
– “হু, ছেলেটা একটু পড়াশোনায় মনোযোগী হলেই হলো।”
– “কোথায় পেলে উনাকে?”
– “তোর মায়ের সাথে একদিন কথা বলছিলাম তখন তোর মাকে বলছিলাম সামির পড়াশোনা টিচার রাখার ব্যাপারটা। তখন তোর মাই তো বলল যে তোর চাচাতো ভাই সাহেলের একটা ফ্রেন্ড ঢাকায় থাকে, যদি সম্ভব হয় সাহেলকে বলে সামির জন্য উনাকে ঠিক করে দেবে। প্রথমে নাকি রাজি হয়নি তানভীর। ফাইনাল ইয়ারে যাবে, পড়াশুনার চাপ আছে। পরে সাহেল যখন ফ্যামিলি ইস্যু বলল তখন আর না করতে পারেনি।”
– “ওহ আচ্ছা আচ্ছা।”
– “ভালো কথা, তানভীর তো বুয়েটে পড়ে। মানে সামির টিচারের নাম তানভীর। সেও তোর ডিপার্টমেন্টে পড়ে। তুই চিনিস?”
– “সাহেল ভাইয়ার ফ্রেন্ড মানে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র। তবে বুয়েটে পড়ে হিসেবে চিনি না। সাকিব ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছিলাম উনাকে। সেভাবে চিনি। উনিও CSE?”
– “জ্বি আমাকে তো CSE বলল। মিথ্যে কেনোই বা বলতে যাবে।”
অনেকটা আনমনা হয়ে জবাব দিল তোহফা,
– “হু, তার মানে অনেক মেধাবী।”
– “হ্যাঁ রে আসলেও ছেলেটা মেধাবী। তুইও তো মেধাবী। একই ডিপার্টমেন্ট। তোর সাহেল ভাইয়াও মেধাবী। ছেলেটার ব্যাড লাক যার কারণে বুয়েটে হল না।”
– “সাহেল ভাইয়া মেধাবী হলেও ফাঁকিবাজ ছিলো, চাচিমনি আমাকে সব বলেছে। সাহেল ভাইয়ার ফাঁকিবাজির জন্য বুয়েটে হয় নাই। এখন মজা বুঝুক। তানভীর ভাই ফাঁকিবাজি করেন না। উনি আড্ডা দেয়া, মজা করা এসব করলেও বেশ পড়ুয়া স্বভাবের ছেলে। সাহেল ভাইয়া এমন হলে ঠিকই বুয়েটে পড়তে পারতো যেমন তানভীর ভাই আর সাকিব ভাইয়া পড়েছে।”
– “সাকিব বুয়েটে পড়াশোনা করেছে?”
– “হ্যাঁ, তুমি জানতে না?”
– “আমি শুধু সাহেল এর ব্যাপারে জানি। তোর আর কোনো কাজিন এর ব্যাপারে জানি না।”
– “সাকিব ভাইয়াও বুয়েটে পড়েছে, EEE তে। সীমান্ত ভাইয়াও বুয়েটে মেকানিক্যাল আর তাইমী আপু সরওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ।”
– “মাশাল্লাহ, সবাই তো বেশ ভালো জায়গায় গিয়েছে। সবার ঢাকা এসে পড়ার সুযোগ হলো, শুধু সাহেল ছেলেটা পারল না।”
সাহেলের জন্য শাহনাজ পারভীন এর অসীম আফসোস দেখে হাসি পেল তোহফার। যেন ব্যাপারটা খুবই মজার। হাসিমুখেই বলল,
– “ফাঁকিবাজির শাস্তি।”
________________________________
বাস স্টপেজে ইরাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো সাহেল। সেদিন আর একা পায়নি ইরাকে। তাই মনের কথাগুলো বলতে পারেনি। আজ ইরাকে একা দেখে সরাসরি যেয়ে ইরার সামনে দাড়ালো সাহেল।
সাহেলকে দেখে প্রথমে চমকে গেলো ইরা। তারপর নিজেকে সামলে নিল কিন্তু কিছু বলল না। শুরুটা সাহেলই করল,
– “সেদিনের জন্য সরি।”
ভ্রু কুঁচকে সাহেলের দিকে তাকাল ইরা।
– “মানে?”
– “আসলে সেদিন করিডোরে ওইসব কথাগুলো আমি মজা করে বলেছিলাম। তুমি কষ্ট পাবে বুঝতে পারিনি। আ’ম সরি।”
ইরা কিছু বলছে না। চুপ করে দাড়িয়ে আছে। কি আর বলবে। আসলেও সেদিন সাহেলের কথাগুলো অনেক বেশি অপমানজনক ছিল। বারবার সেদিনের ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল তার।
ইরাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাহেল করুণ চোখে তাকাল তার দিকে। আবারো বলল,
– “সরি।”
সাহেলের দৃষ্টি দেখে হেসে ফেলল ইরা। বলল,
– “ইটস ওকে।”
সাহেল কিছু বলতে যাবে তখনই আকাশে মেঘের গর্জন উঠল। বর্ষাকাল বরাবরই প্রিয় ইরার। কিন্তু এই মুহূর্তে ভেজার কোনো ইচ্ছে তার নেই। মনে মনে সাহেলের সাথে হেঁটে বাসা পর্যন্ত যাবে ভেবেছিলো যদিও সাহেল রাজি হয় কিনা সে জানে না। কিন্তু এখন এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নিশ্চয় তার সাথে রাস্তায় হাঁটবে না এই ছেলে।
ইরার আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তাঘাটের মানুষ সব দৌঁড়ে ছাউনির নিচে বা দোকানে ঢুকে যাচ্ছে। ইরাও মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল কই যাওয়া যায় ভেবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সাহেল বলল,
– “চল হাঁটি। বৃষ্টিতে তোমার কোনো সমস্যা হবে?”
সাহেলের কথায় যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো ইরা। তারপর ছোট্ট করে বলল,
– “না।”
মুচকি হাসলো সাহেল। তারপরই দুজন একসাথে হাঁটতে শুরু করলো। পুরো রাস্তায় একটা মানুষ নেই, শুধু তারা দুজন। এতো জোরে বৃষ্টি পড়ছে যে রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে অল্প অল্প। এর মাঝেই হাঁটছে দুজন। কেউ কোনো কথা বলছে না। নিরবতা ভেঙে সাহেল বলল,
– “মন ভালো হয়েছে?”
– “মানে?”
– “মন যে খারাপ ছিলো ভালো হয়েছে? ভাবলাম বৃষ্টির পানিতে তোমার মন খারাপ ধুয়ে যাবে। তাই ভিজতে নিয়ে আসলাম।”
সাহেলের কথায় ইরা তার দিকে তাকাল। সাহেল সামনে তাকিয়ে আছে। ইরা মনে মনে ভাবছে,
“আমি কি ভাবলাম আর উনি কি বলল? আমি তো আরো ভাবলাম উনিও আমাকে পছন্দ করেন তাই একসাথে বৃষ্টি বিলাস করতে চাইছেন। কত কাপলই তো হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে ভিজে। কিন্তু এমন কিছু তো মনে হয় না উনার ভাবনাতে আছে। শালা আনরোমান্টিক।”
পরক্ষণেই আবার ভাবলো ইরা,
“উনি তো সম্পর্কে আমার বিয়াইন হয়। তাহলে শালা বললাম কেনো? কথাটা হবে ‘বিয়াইন আনরোমান্টিক’।”
– “কি এতো ভাবছেন বিয়াইন আপা?”
– “আপনি যে পুরোই আনরোমান্টিক সেটা ভাবছিলাম।”
বলেই মুখে হাত চেপে ধরলো ইরা। আয়হায় ভুল মানুষের সামনে ভুল কথা বলে ফেলেছে। বারবার কেনো যে তার এই ছেলের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আল্লাহ ভালো জানেন। এই মুহূর্তে নিজের ভাগ্যকে নিজেরই দোষারোপ করতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ভাগ্যকে বলল,
“উনার সামনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন না করলে হয় না আমাকে? বারবার একই কাজ কেনো করিস তুই?”
কিন্তু ইরার দোষারোপে ভাগ্যর কোনো ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। উল্টো ইরার মনে হলো ভাগ্য তাকে বলছে,
“তুই খুঁজে খুঁজে এই ছেলেটার সামনেই কেনো এমন কান্ড ঘটাস? সাবধানে থাকলেই তো পারিস। কিছু হলেই ভাগ্যের দোষ দেওয়ার বদ অভ্যাসটা এবার ছাড়।”
ইরা যখন নিজের দোষ ভাগ্যের উপর চাপাতে ব্যস্ত তখনই সাহেল বলল,
– “সরি??”
আবারো লজ্জায় কুকড়ে গেলো ইরা। কোনরকম বলল,
– “কককককিছু নননননা।”
– ” কিন্তু আমি তো শুনলাম তুমি আমাকে সরাসরি আনরোমান্টিক বললে। তুমি কিভাবে বুঝলে আমি রোমান্টিক নাকি আনরোমান্টিক?”
– “ককককই নননননা তো। আআআআমি তততততো কককককিছু ববববলললি ননননি।”
– “আশ্চর্য, এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আর এভাবে তোতলাচ্ছ কেনো? বাই এনি চান্স তুমি কি চাচ্ছো আমি রাস্তায় তোমাকে বুঝিয়ে দেই আমি আনরোমান্টিক নাকি রোমান্টিক? এই রাস্তায় নিজেকে রোমান্টিক প্রুভ করতে গেলে মানুষ তাকিয়ে থাকবে আর তুমিও লজ্জা পাবে। তাই কোনো একসময় বুঝিয়ে দেবো আমি আসলে কতোটা রোমান্টিক অর আনরোমান্টিক।”
শেষের কথাগুলো ইরার দিকে ঝুঁকে এসে বলল সাহেল।
সাহেলের এমন কথাবার্তা ইরার কান ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। সে এবার আর মাথা তুলে তাকাতেই পারছে না। তখনই সাহেল আবার বলল,
– “কি হলো ওভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি হাঁটবে? বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই। এই সময় রিকশা পাবে না। হেঁটেই বাসায় যেতে হবে এসো।”
ইরা দেখলো সাহেল তার থেকে কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। কিন্তু সে পুরো ফ্রিজড হয়ে আছে। পা গুলো যেনো কেউ সুপার গ্লু দিয়ে মাটির সাথে আটকে দিয়েছে।
ইরাকে নড়তে না দেখে সাহেল নিজেই পিছিয়ে এল। তারপর ইরার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
ইরা অবাক হয়ে তার পাশে হাঁটতে থাকা সাহেলের দিকে তাকাল। সাহেল সামনে তাকিয়ে হাঁটছে। ইরার দিকে কোনো নজর তার নেই। এতক্ষণে ইরা ভালোমত খেয়াল করল সাহেলকে। সুন্দর বয়কাট স্টাইলে চুল কাটা। বৃষ্টির পানি মাথায় পড়ছে আর চুলের পানিগুলো কপাল বেয়ে গালে পড়ছে। একটা হোয়াইট শার্ট আর ক্রিম কালার গাবার্ডিন পড়েছে। চোখের চশমা বৃষ্টির পানির ফোঁটায় ভরে উঠেছে। সেই পানি আবার চশমার গ্লাস বেয়ে পরে যাচ্ছে। সাহেলকে ইরার এই মুহূর্তে মিল্কি কিটক্যাট মনে হচ্ছে। এত সুন্দর একটা মানুষ কিভাবে হয়? আচ্ছা সাহেল কি তাকে ভালোবাসে? সাহেলের দিকে তাকিয়ে একবার নিজের হাতের দিকে তাকালো ইরা। আবার তার হাত ধরে রাখা সাহেলের হাতের দিকেও তাকালো। সাহেল ফর্সা একটা ছেলে, উজ্জ্বল গায়ের রং। সেই তুলনায় ইরা বেশ খানিকটা কালো বলা যায়। সাহেলের তুলনায় সে অনেকখানি কালো। এতো ফর্সা একটা ছেলে নিশ্চয় তাকে বিয়ে করবে না। তার জন্য হয়তো পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো সুন্দর রমণী অপেক্ষা করে আছে। এতো সুন্দর একটা ছেলে কখনোই সুন্দরী মেয়ে ফেলে তাকে বিয়ে করবে না। হঠাৎ করে সাহেলের অজানা ভবিষ্যৎ স্ত্রীর উপর তার হিংসে হচ্ছে খুব। কেনো জানি কান্না পাচ্ছে ইরার। সাহেলের ভবিষ্যৎ স্ত্রীর জন্য নয়, সাহেলের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার জন্য। সে খুব দ্রুত সাহেলের মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মায়াটা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ সাহেল বলল,
– “আমাকে স্ক্যান করা বাদ দিয়ে সামনে তাকিয়ে হাঁটেন ম্যাডাম। নাহলে পরে পাথরে বা ইটের সাথে হোচট খেয়ে আবারো আমার কোলের উপর পড়বেন।”
সাহেলের কথা শুনে লজ্জায় তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো ইরা। তাকে লজ্জায় না ফেললে যেনো এই ছেলের পেটের ভাত হজম হয় না। যত্তসব।
বাসার সামনে এসেই সাহেল কিছু বলতে যাবে ইরাকে। তার আগেই ইরা তাকে থামিয়ে দিলো। আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
– “এই যে মিস্টার, সমস্যা কি আপনার? আপনার দিকে তাকিয়েছিলাম কারণ আপনার চোখের চশমায় পানি জমছিল আর সেটা আবার গ্লাস বেয়ে নিচে পরে যাচ্ছিলো। ব্যপারটা যদিও সাধারণ তবুও দেখতে সুন্দর লাগছিল তাই দেখছিলাম। সব কিছুর এমন উল্টো মিনিং বের করবেন না নেক্সট টাইম থেকে। হাহ।”
বলেই গটগট করে হেঁটে ভেতরে চলে গেলো ইরা। সাহেল তখনও দাড়িয়ে আছে। বিল্ডিং এর ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরেই সাহেলের মনে পড়ল ইরা একটু আগে কি বলে গেল আর সাথে সাথেই হো হো করে হেসে উঠল সে। আশপাশে কেউ না থাকায় সাহেলের হাসি কেউ দেখল না। প্রচন্ড বৃষ্টির শব্দের সাথে সেই হাসির শব্দও মিলিয়ে গেল অদূরে।
চলবে???