অশান্ত বসন্ত পর্ব-২০

0
678

#অশান্ত বসন্ত
(বিংশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
*********************
পিউকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েই ফিরে যাচ্ছিলো পল্লব।কিন্তু মায়ের কথাতে দাঁড়াতেই হলো ওকে।

সীমা বললো,’এভাবে দোরগোড়ায় এসে বেরিয়ে যাসনা।ঘরে ঢুকে অন্তত স্নানটা সেরে নে,আমি ততোক্ষণে ক’টা পরোটা ভেজে ফেলি’।

পল্লব বললো,’খেতে ইচ্ছে করছেনা মা।তবে ঠিকই বললে স্নানটা সেরে নেওয়া দরকার’।

সীমা বললো,’আর পেটে কিছু ঢোকানোটা?সেটা দরকার নেই বুঝি! ফুলকফির ডালনা আছে,গরম গরম পরোটার সাথে টিফিনবক্সে গুছিয়ে দিচ্ছি,দুই বন্ধু মিলে খেয়ে নিস’।

পল্লব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,’আচ্ছা দিও, আমি স্নানটা সেরে নিচ্ছি’।’

অসীম বাবু পল্লবকে দেখেই বলে উঠলেন,’তা এখনো আগের মতো সেই সমাজসেবা চলছে।নিজের ভালো আর বুঝবে কবে?’,উত্তর না দিতে চাইতেও পল্লব বলে উঠলো,’ যা করছি সব তোমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করছি’।

অসীম বিরক্ত মুখে বলেন,’আমাদের কথা ভেবে করছো মানে?’
পল্লব হেসে বলে,’ভগবানের ঘরে সব হিসেব থাকছে বুঝলে।দেখবে কোনো না কোনো ভাবে সেটা ঠিক রিটার্ণ পেয়ে যাবে’।

অসীম বললো,’কি রিটার্ন পাবো শুনি?’
পল্লব বললো,’আরে এমন তো হতেই পারে যে আমরা বাইরে আর রাত বিরেতে তোমাদের কিছু হলো।তখন তো আমাদের মতো সমাজসেবা করা ছেলেগুলোরই সাহায্য লাগবে’।

অসীম গজগজ করতে করতে পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলো।পল্লব মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে স্নানে ঢুকে গেলো আর সীমা রান্নাঘরে। স্নানটা সেরে চটপট টিশার্ট প্যান্ট পরে নিতেই সীমা এসে টিফিনবক্স ধরালো।

পল্লব মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের গালে চুমু খেলো।সীমা বললো,’ বেডকভার আর হাওয়া বালিশ নিয়ে যা, শুতে পারবি’,পল্লব মায়ের কথা মতো বেডকভার আর হাওয়া বালিশ ভরে নিলো ব্যাগে।

তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো।আজ প্রায় আটঘন্টা ধরে ওটির বাইরে বসেছিলো ওরা।এখন গাড়ি চালাতে গিয়ে পিঠটা ভীষণ টনটন করছে।তবে বোনুকে আজ নতুন রুপে দেখলো পল্লব।পুরো সময়টা জুড়ে বহ্নির পাশে বসে থেকে ওকে সাহস দিয়ে গেছে।

যদিও জোর করে বাড়িতে ফেরত দিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ওকে লাঞ্চ আর টিফিনটা করতে বাধ্য করেছে পল্লব।বহ্নিকে যদিও কিছুই খাওয়াতে পারেনি।সে কারনে নিজেরও কিছু খাওয়া হয়নি।

তবে এই স্নানটা ওর খুব দরকার ছিলো,মায়েরা কি করে যেন সব বুঝতে পারে।

ডাক্তার বলেছে,’ অপারেশন সাকসেসফুল,সম্ভবত আর কোনো অপারেশন এর প্রয়োজন পরবেনা।তবে স্পিচ থেরাপিটা কন্টিনিউ করতে হবে,আর সঙ্গে রুটিন চেক আপটাও ‘।

পল্লব জিজ্ঞেস করেছিলো,’রাতে কি থাকতে হবে?’,উনি বললেন,’আজকের দিনটা থাকুন,কাল থেকে মনে হয়না থাকতে হবে’।

তারপর বহ্নির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,’এই কেসের চ্যালেঞ্জটা নিতে সাহস হচ্ছিলোনা,চান্স একেবারেই ছিলোনা ঠিক হওয়ার।সত্যি বলতে কি এই অপারেশনটা সাকসেস হওয়াটা কিছুটা মিরাকেলের মতো।তবে এখন সাকসেস হওয়াতে নিজেরই ভালো লাগছে’।

বহ্নি কেঁদে ফেলে বলে,’আমি যে কি করে আপনার ঋণ শোধ করবো,আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে আপনার হাত ধরে।আমার ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই’।

ডাক্তার বাবু হেসে বললেন,’ইটস অলরাইট’,তারপর অন্য পেশেন্টপার্টির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

পল্লব দেখলো,পিউয়ের চোখেও জল,ওর নিজের চোখের কোনটাও ভিজে গেছে।বহ্নি পল্লব আর পিউয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,’আজ তোমরা না থাকলে আমি ওই প্রচন্ড টেনশন নিয়ে একা একা এতো সময় কি করে যে কাটাতাম!’।

পিউ চোখ মুছে হেসে বললো,’এবার আমাদের ও ধন্যবাদ দিতে চাইছো তাইতো?ওসব ধন্যবাদে হবেনা।শিখা দিদি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি তো কবজি ডুবিয়ে বিরিয়ানি আর ফিরনি খাবো,খাওয়াবে তো?’,পিউয়ের কথার বহ্নি মাথা নেড়ে হেসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

হসপিটালে ঢোকার আগে গাড়ি থামিয়ে একটা স্প্রাইট কিনে নিয়েছিলো পল্লব।হসপিটালে ঢুকেই বহ্নিকে ফোন করে ওয়েটিং রুমে আসতে বললো।
বহ্নি আসার পর টিফিনবক্সটা বের করে বললো,’এসো খেয়ে নাও।মা পাঠিয়ে দিয়েছে’।

বহ্নি এবার আর কোনো রকম বাহানা না করেই পল্লবের সাথে বসে ওর মায়ের বানানো পরোটা আর ফুলকফির ডালনা তৃপ্তি সহযোগে খেতে থাকলো।কতোদিন পর মায়ের হাতের সাধ পেলো।

পল্লব বললো,’এবার কিন্তু একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে।কাল সারারাত জেগে’।তারপর ব্যাগের থেকে বেডকভার বের করে নিয়ে হাওয়া বালিশটা ফুলিয়ে বহ্নিকে বললো,’আমি শুয়ে পরবো,তুমি ও শিখার কেবিনে গিয়ে শুয়ে পরো।আর স্প্রাইটটা সাথে নিয়ে যাও,ইচ্ছে হলে খেও’।

বহ্নির শরীর সত্যিই আর দিচ্ছিলোনা।তবু মন চাইছিলো কিছুক্ষণ পল্লবের সাথে সময় কাটাতে।কিন্তু পল্লবের কথাতে যেতেই হলো দিদিয়ার কেবিনে।পল্লব বেডকভার দিয়ে নিজেকে রোল করবার আগে পকেট থেকে রোলন বার করে নিজের গায়ে আর বেডকভারে লাগিয়ে দিলো যাতে মশা না কামড়ায়।

বহ্নির যাওয়াতে পল্লব নিশ্চিন্ত হলো।মেয়েটার চোখ মুখ একেবারেই বসে গেছে।ওর ঘুমটা সত্যিই দরকার।পল্লব বুঝতে পারছিলো বহ্নি কিছুসময় ওর সঙ্গে থাকতে চাইছিলো।কিন্তু রক্ত মাংসের মানুষ তো।ভালোবাসার মানুষটি কাছে থাকলে অনেক রকম ইচ্ছে জাগতে পারে।

পল্লব কখনোই চায় না বহ্নি কৃতজ্ঞতার বশে করুনা করে ওর হাত ধরুক।ভালোবাসার বদলে ভালোবাসাই চায় মন।চায় ভালোবাসার মানুষটিকে সব কিছু থেকে আগলে রাখতে।পল্লব ও তাই করার চেষ্টা করছে।এখন বহ্নির পালা।

বহ্নি কেবিনে এসে কিছুক্ষণ দিদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে পাশের বেডে গিয়ে শুয়ে পরলো,ঘুমিয়েও পরলো তাড়াতাড়ি ।হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেলো বহ্নির,কিসের একটা আওয়াজ আসছে!কেবিনের বাইরে গিয়ে বোঝে প্রচন্ড বৃষ্টি পরছে।ঘুমিয়ে নেওয়ার পর ফ্রেস লাগছে অনেকটা।বহ্নি মোবাইলে সময় দেখলো প্রায় পাঁচটা বাজে।

‘পল্লব কি ঘুমিয়ে আছে!’,কথাটা মনে হতেই বহ্নি ওয়েটিং রুমের দিকে পা বাড়ায়।গিয়ে দেখে পল্লবের হাওয়া বালিশ, চাদর সব মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে,আর তারমধ্যেও পল্লব বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।আশেপাশের লোকজন ও ঘুমের দেশে।পল্লবের মাথাটা অর্ধেক ঝুলছে।

বহ্নি চাদরটা তুলে পল্লবের গায়ে জড়িয়ে দেয়।হাওয়া বালিশটা আর তোলেনা।পল্লবের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বসে।

ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে পল্লবের অল্প ফাঁক হওয়া ঠোঁটটায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে।নিজের অজান্তে কখন যেন ভালোবেসে ফেলেছে পল্লবকে।পল্লবের ঘন চুলে পরম মমতায় হাত ডুবিয়ে বিলি কেটে দিতে থাকে বহ্নি।

পল্লবের কপাল,গাল,চিবুকেও বহ্নি হাত বোলায়।একসময় একটু নিচু হয়ে পল্লবের কপালে নিজের ঠোঁট ছোয়ায় বহ্নি।

পল্লব চোখ মেলে পূর্ন দৃষ্টিতে বহ্নির দিকে তাকায়।বহ্নি লজ্জা পেলেও পল্লবের চোখ থেকে নিজের চোখ সরাতে পারেনা।

কানের সামনে মুখটা নিয়ে গিয়ে কানে ঠোঁট ছোয়ায়,তারপর ফিসফিস করে বলে,’ভালোবাসি’।পল্লবের সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়।ঠিক এই কথাটাই তো শুনতে চেয়েছিলো সে বহ্নির থেকে।

পল্লব বলে,’আর একবার বলবে কথাটা,আমি এই মুহূর্তটাকে আরো একবার বাঁচতে চাই’,বহ্নি বলে,’ভালোবাসি,ভীষণ ভীষণ রকম ভালোবাসি তোমায়’।

পল্লব বহ্নির হাত দুটো ধরে চুমু খেয়ে বলে,’ কথা দিচ্ছি সারা জীবন তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দেবো’।ঠিক তখনই এনাউন্সমেন্ট হয়,’১২০ নম্বর বেডের পেশেন্ট পার্টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেবিনে আসুন’।বহ্নি পল্লব দুজনেই কেবিনের দিকে ছোটে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here