অশান্ত বসন্ত পর্ব-১৯

0
640

#অশান্ত বসন্ত।
(ঊনবিংশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
********************
চা-পর্ব মিটিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বাজার গোছাতে বসে সীমা।সত্যি পল্লবের মতো করে এতো সুন্দর গুছিয়ে বাজার করতে অসীমও পারেনা।কিসের সাথে কি লাগবে বুঝে শুনে নিয়ে আসে ছেলেটা।

সীমা সবজি কেটে দুটো ওভেনেই রান্না চাপিয়ে দিলো।দু’ঘন্টার মধ্যে ভাত,মুসুরির ডাল,উচ্ছে বেগুন ভাজা,ফুলকফির ডালনা,আলু-বরি-ধনেপাতা আর আদা লঙ্কা বাটা দিয়ে হালকা করে কাতলা মাছের ঝোল নামিয়ে আর একবার গা ধুয়ে আসলো।

সাধারণত জার্নির ধকল সামলে কেউ এতো কিছু বানায়না।কিন্তু যতই পরিশ্রান্ত থাকুক না কেন সীমাকে কয়েক পদ বানাতেই হয়।

অসীমের খাওয়ার বায়নাক্কা সামলাতে আজকাল বেশ হাফিয়ে যায় সীমা, হয়তো বিরক্তিও আসে।আসলে বয়েস তো তারও বাড়ছে।আর বয়েস বাড়ার সাথে সাথেই এসেছে এক পাহাড় ক্লান্তি।

তাছাড়া জীবন-সায়াহ্নে এসে বোধহয় সবাই চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটা মিলিয়ে দেখতে বসে।সেক্ষেত্রে সীমার পাওয়ার আঁচলটা শূন্য।অসীম বড্ড আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নিজেরটা ছাড়া আর কারোরটা সেভাবে ভাবে না।সীমার পছন্দ অপছন্দ কোনো কিছুরই বিশেষ মূল্য নেই তার কাছে।

তার ওপর বিয়ের পর থেকেই দেখেছে নাকের ডগায় রাগ থাকে লোকটার।কথায় কথায় মেজাজ।এমনকি আন্ডার গার্মেন্টস না পাওয়া গেলেও সীমার ওপর চোটপাট, যেন সীমা হাতে করে নিয়ে গিয়ে হারিয়ে ফেলে এসেছে।আগে কান্না পেতো সীমার।কতোদিন বাথরুমে গিয়ে সাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে কেঁদেছে। অবশ্য সেসব এখন অতীত।

সীমার শ্বাশুড়ি মা বলতেন,’পুরুষ মানুষের রাগ না থাকলে কি মানায়?তাছাড়া কথায় আছে,সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’।একবার সীমা বলেছিলো,’এর পরের লাইনটা কি জানেন মা?পরের লাইনটা হলো, ‘যদি গুনবান পতি থাকে তার সনে’।কথাটা যে তার শ্বাশুড়ি মায়ের পছন্দ হয়নি সেটা ওনার মুখ বেঁকিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছিলো সীমা।তবে বলতে পেরে একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলো।

তার এই নির্গুণ পতিটি তো ওনারই অংশ।শুধু ছেলে বলেই যাকে মাথায় তুলে নৃত্য করে গেছেন সারাটা জীবন।ছেলেকে মানুষ করেননি পুরুষ করেছেন! তবে সীমার নিজের অংশের প্রতি আস্থা আছে।পল্লবের মতো কেয়ারিং ছেলে যে কোনো মায়ের গর্ব।মেয়েদের সম্মান দিতে জানে তার ছেলে।

এতোদিন তো এই ছেলে-মেয়ে দুটোর মুখ চেয়েই বেঁচেছিলো সীমা।কখন যে এরা বড়ো হয়ে গেলো বুঝতেই পারেনি।এখন দুজনের জন্য সঠিক জীবন সঙ্গী এনে দিতে পারলেই তিনি দায়িত্ব মুক্ত।

ভীষণ রকম ইচ্ছে এই দায়িত্ব গুলো শেষ হলেই নিজের কথা ভাববে সীমা।কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেকে নিয়ে হারিয়ে যাবে অনেক দূরে।আর মনে মনে দূর থেকে অসীমকে বলবে,’ দ্যাখ কেমন লাগে’।যদিও কোথায় যাবে সে বিষয়ে এখনো কিছু ভেবে উঠতে পারেনি সীমা।কিন্তু তাও যাওয়াটা তার ফাইনাল।

‘কী ব্যাপার বলোতো সীমা?সেই যে দুই ভাই বোন বের হলো,না একটা ফোন না মেসেজ, ঘড়ি দেখেছো?সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে’,সীমার ভাবনার জাল ছিঁড়ে অসীমের কথাগুলো কানে এলো।উত্তর দিতে ইচ্ছে না করায় অন্যদিকে পাস ফিরে শুলো সীমা।

‘কি গো কথা কানে যাচ্ছেনা?ছেলে মেয়ে দুটো এখনো কেন বাড়ি ঢুকলোনা?পাখিরাও সন্ধ্যে হলে বাসায় ফেরে’,অসীমের কথায় বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে সীমা।তারপর বিরক্তিটা গিলে স্বাভাবিক গলাতেই বলে,’ওরা যে পাখি নয়,ওরা আজকালকার দিনের শিক্ষিত ছেলে মেয়ে সেটাই মনে থাকেনা তোমার।আর ওদের কি দরকারে লাগবে শুনি?পল্লবের বন্ধুর দিদির অপারেশন চলছে,ওরা হসপিটালে,ফিরতে দেরি হবে’।

কথাটা শুনেই তেলে বেগুনে চটে যায় অসীম।’বাড়ির খেয়ে বোনের মোষ তাড়াতে গেছে,সেটাই বলো’,অসীমের কথায় সীমা গলা নামিয়ে কেটে কেটে বলে, ‘বহুদিন থেকে কিন্তু পল্লব নিজের রোজগারেই খায়।খাওয়ার খোটা দিচ্ছো কাকে?বাড়িতে গেলেও সে নিজেই বাজার করে’।

অসীম রেগে গিয়ে বলে,’তাও বাড়ির মালিক আমি।আমার কথাই শেষ কথা।আমায় না জানিয়ে কি করে এমন অবিবেচকের মতো কাজ করার সাহস পায় তোমার ছেলে?দুদিন বাদে যে মেয়েটার বিয়ে হবে তাকেও নিয়ে হসপিটালে গেছে।উচ্ছন্নে যাচ্ছে সব তোমার শিক্ষায়’।

সীমা কথা গুলোর কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।তবে কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করলো মাথার ভিতর,’আচ্ছা অঞ্জনা ওর ছেলেকে মানুষ বানিয়েছে না পুরুষ বানিয়েছে!?’,এই প্রশ্নটা আপাতত ওকে অস্থির করে দিচ্ছে।

অসীমের ননস্টপ ঘ্যানঘ্যান করা কথা গুলোকে উপেক্ষা করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় সীমা।অঞ্জনাকে মেসেজ করে জানিয়ে দেয় তাদের আসার কথা।অঞ্জনার নেট বন্ধ তাই সিঙ্গেল টিক হয়েই পরে রইলো মেসেজ।

‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে ফোনতো করতে পারো ছেলেকে’,অসীমের কথায় সীমা জানায়, ‘ছেলের নাম্বার তোমার ফোনেও সেভ আছে।চাইলে নিজে ফোন করে নাও’।

মনে মনে ভাবে একটু ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে তাতেও শান্তি নেই,ঠিক খিটমিট করার জন্য পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।মুখটা বেঁকিয়ে দেয় একটু।

হঠাৎ সীমার মোবাইল বেজে ওঠে।স্ত্রিনে পল্লবের ছবি।হেলো বলতেই পল্লব জানায়,’অপারেশন হয়ে গেছে মা।দেড় ঘন্টা বাদে ডাক্তার বাবু আসবেন রাউন্ড দিতে।উনি পেশেন্ট ভিজিট করার পর জানতে পারবো রাতে থাকতে হবে কিনা!থাকতে বললে পিউকে বাড়িতে দিয়ে যাবো’।সীমা চিন্তিত গলায় বললো,’তোরা খেয়েছিস তো?’,পল্লব বলে, ‘পিউকে পাশের রেস্টুরেন্টে থেকে লাঞ্চ করিয়ে দিয়েছি,বিকেলের টিফিন ও কিনে দিয়েছি’।

সীমা বললো,’তারমানে তোর বন্ধু খাবার খায়নি,সেই কারনে তুই নিজেও অভুক্ত তাইতো?’,পল্লব হেসে বলে,’না বলতে কি করে সব বুঝে যাও বলোতো মা?সত্যি ইউ আর গ্রেট’,সীমা বললো,’এটা কিন্তু ঠিক নয়,হসপিটাল মানেই রোগী আর রোগের বাসস্থান,সেখানে কি না খেয়ে এতো সময় থাকতে হয় নাকি?শিগগিরই কিছু খেয়েনে দুজন’।

পল্লব বললো,’আচ্ছা এবার রাখছি মা,ফোনের চার্জ প্রায় শেষ,সুইচ অফ হয়ে যাবে যে কোনো মুহূর্তে।তুমি আর বাবা চা খেয়ে নিও।আর দেখবে মুড়ি আর চানাচুরের প্যাকেট রাখা আছে রান্নাঘরের ওপরের শেলফে,বাই’।

পল্লবের ফোন এসেছে বুঝতে পেরে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল অসীম।সীমা পিছন ঘুরতেই অসীমের সাথে ঢাক্কা।বিরক্ত হয়ে সীমা বলে,’আর পারিনা ভগবান, এবার আমায় তুলে নাও’।

অসীম বলে,’বিরক্তিটা কার ওপর?ছেলে না আমার?’,সীমা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,’নিজেই বুঝে নাও,আমি বলতে পারবোনা’। ‘তাতো পারবেই না,আমি তো চোখের বালি হয়ে গেছি তোমার’।সম্ভবত আরো কিছু বলছিলো অসীম,কিন্তু রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য সেগুলো আর কানে পৌঁছোলো না সীমার।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here