অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৪০

0
421

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

[৪০]

শীতের গাঢ়তায় জুবুথুবু প্রকৃতি। ঘন কুহেলী রহস্যের ধাঁধা বেঁধেছে অখিলের অস্বচ্ছতায়। একটি অলস দিনের সুপ্রভাতের শুভারম্ভ হয়েছে অমলিন প্রেমের মাধুর্যতায়। স্টিফেনের বিশাল বারান্দার আরাম কেদারায় বসে আছে নন্দা। পড়নে লাল রঙের শাড়ি শোভা পাচ্ছে। বাহু ছুঁইছুঁই কেশ গুচ্ছ ছড়িয়ে আছে পিঠ জুড়ে। কপালে সিঁথির সৌন্দর্যতা বর্ধন করে প্রশস্ত অবস্থানে লেপেছে সিঁদুর। ঘন কাঁজলে মাখামাখি গভীর দিঘির ন্যায় অক্ষি যুগল। বারান্দার বাহিরে থাকা স্বল্প দূরের আঁধার, আবছা বাগনটার দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। বিহারিণীর করুণ পরিণতিতে তার ওষ্ঠ কোণে নব্য জ্যোতি ছড়ানো অংশুমালীর ন্যায় হাসি। যে হাসি পরিচয় দেয় উপহাসের। যে হাসি জানায় তুমুল তাচ্ছিল্য।

“আজ প্রকৃতিও বোধকরি নিজেকে ধন্য মনে করিবে তোমার রূপ দেখিয়া।”

নন্দার মুগ্ধ নেত্রের পল্লব পড়লো। হাসির মায়া লুকায়িত হলো আকস্মিক উচ্চারিত পুরুষালী কণ্ঠে। সে কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সেই কণ্ঠের মালিকের দিকে। স্টিফেনের হাসি হাসি মুখ দৃষ্টিগোচর হলো তৎক্ষণাৎ। সে হাসির বিপরীতে ফিরিয়ে দিলো হাসি। শুধাল,
“সকাল সকাল বের হয়ে যাচ্ছেন! আপনি যন্তর নাকি?”

“যন্তর নয়, সানশাইন। ইহাকে বলা হয় যন্ত্র। উচ্চারণ সঠিক করিবে, কেমন?”

নন্দা মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে ভাব করে জিব কাটল। অতঃপর ফিক করে হেসে বলল,
“ভুল হয়ে গিয়েছে।”

“তোমার মুখে ভুলটাও দারুণ মানায়াছে।”

নন্দা হাসল। লোকটার মুগ্ধ করার পদ্ধতি অনেক জানা আছে। সেই পদ্ধতির সামনে নন্দা খুবই অপটু। ভোরের কুয়াশা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নন্দার শরীর। সেই শীতল শরীরে ভারী সুতোর কাজ করা চাদর আলগোছে জড়িয়ে দিল স্টিফেন খুব যত্নের সঙ্গে। নন্দা চমকালো এবারও। স্টিফেন লোকটা সবসময় তার প্রয়োজন গুলো এত নিখুঁত ভাবে কীভাবে জেনে যায় সে বুঝে উঠতে পারে না। নন্দাকে চাদর জড়িয়ে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটল স্টিফেনের ঠোঁট জুড়ে। নন্দা সে হাসিতে বার কয়েক যেন মুগ্ধ হলো। এত রকমে, এত প্রকারে কেউ ভালোবাসতে পারে, তা স্টিফেনকে না দেখলে সে বুঝত না।

_

স্টিফেনের সাথে নন্দা বেরিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই তার জানা নেই। তবে সে এতটুকু জানে— লোকটা তাকে হয়তো আরেকটা খুশির সান্নিধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটার আর কাজ কী? এক মনে ব্রত হয়ে কেবল নন্দাকে চমকে দেওয়া এবং খুশি করা ছাড়া?

শীতের কুয়াশা ঠেলে নন্দাদের গাড়ি এসে থেমেছে তাদের গ্রামেরই পূর্বদিকের একটি জায়গায়। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, শুধাল,
“এখানে কেন?”

“আরেকটি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে আসিয়াছি আমরা, নন্দা। একসময় তোমার সবটুকু ভালোতে হাসি দিয়া এবং সবটুকু আঘাত থেকে বুক দিয়া যে তোমাকে আগলে রাখিয়াছে তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো আমাদের দায়িত্ব।”

নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে এসেছে তারা। তার মুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। স্টিফেন হাসল। নন্দার হাত ধরে একটি সদ্য উঠা বিরাট দালানের কাছে মাঠে উপস্থিত হলো। সেখানে উপস্থিত হয়েই নন্দার চক্ষু চড়কগাছ। তারা আসার আগ থেকেই এখানে বহুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত। নন্দা কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল। স্টিফেনের মুখে চওড়া হাসি। সে উপস্থিত হতেই উঠে দাঁড়ালো সবাই। স্টিফেন এগিয়ে গেল। মধ্যমনি হয়ে দাঁড়াল সকলের সামনে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নন্দা। যে এখনো এসব বুঝে উঠতে পারছে না। স্টিফেনের কণ্ঠ গম্ভীর হলো, সে সকলের উদ্দেশ্যে ঝঙ্কার তুলে বলল,
“আপনাদের এখানে আসিতে বলিয়াছি একটি বিশেষ দরকারে। আশা রাখি, আমার বিশেষ দরকার আপনারা বিশেষ ভাবেই গ্রহণ করিবেন?”

উপস্থিত জনসমাগম নিশ্চুপ। তাদের নিশ্চুপতায় যেন সকল উত্তর দিল। স্টিফেন সেই উত্তর সাদরে গ্রহণ করে আবার বলতে শুরু করল,
“আমি এখানে একটি বিদ্যালয় করিবার সিদ্ধান্ত নিয়াছি। যেই বিদ্যালয়ে আমাদের প্রতিবেশী গ্রাম এবং এই গ্রামের ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েরা পড়িবে। এই বিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচাবলি আমিই প্রদান করিব। এবং এই বিদ্যালয়ের সকল সিদ্ধান্ত নিবে আমার স্ত্রী, মানে আপনাদের— সাহেব বধূ।”

স্টিফনের কথা থামতেই চারপাশে গুঞ্জন শোনা গেল। হয়তো মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাবা-মায়ের যে কুণ্ঠাবোধ, সেটাই গুঞ্জনের মূল বিষয়বস্তু। স্টিফেনের মুক্ত কণ্ঠ ভাসল,
“সকলের সন্তান বিদ্যালয়ে আসিবে, এটা নির্দেশ। এবং এই নির্দেশ অমান্য করিলে তাকে শাস্তি প্রদান করা হইবে। এবং এই বিদ্যালয়ের পরিচালনার ভার দেওয়া হইয়াছে একজন আর্দশ শিক্ষককে।”

নন্দা চাইল। তার বুকের কম্পন বাড়ছে। আদর্শ শিক্ষককে দেখার আকাঙ্খা তাকে শান্তি দিচ্ছে না। তন্মধ্যে স্টিফেন ঘোষণা করল,
“এই বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক হইলেন শ্রদ্ধেয় মুমিনুল ইসলাম। এবং বিদ্যালয়ের পরিচালনাকারী তিনিই। তিনিই সঠিক ভাবে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করিবেন।”

মুমিনুল ইসলামের নামটি ঘোষণা করতেই কুয়াশার ঘন অবয়ব ভেদ করে একটি বৃদ্ধকে আসতে দেখা গেল। যার ব্যাক্তিত্বের উচ্চতা পাহাড়কেও হার মানায়। যার চোখে হিমালয় হাসে। যার কন্ঠে সমুদ্রের গর্জন। নন্দা অপলক তাকিয়ে থাকলো তার শিক্ষকের দিকে। যেন বহু বছর পর দেখা হচ্ছে তাদের। চোখ দুটো আনন্দে টলমল করে উঠলো। সে ছুটে প্রণাম করতে যাওয়ার জন্য উদত্য হতেই দেখল একটি সুঠামদেহী পুরুষ মুমিনুল ইসলামের পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। নন্দা থামল, চমকালো, বিস্মিত চোখে দেখলো স্টিফেন এই কাজটি করছে। নন্দা আরেক ধাপ মুগ্ধ হলো৷ মুমিনুল ইসলাম দু’হাত ভোরে আশীর্বাদ করছে স্টিফেনকে।

_

নন্দার আজকে আনন্দের সীমা নেই। পুরো গ্রামবাসীর সামনে সে ঘোষণা দিয়েছে মেয়েদের অন্তত পক্ষে দশম শ্রেণী অব্দি পড়াশোনা করতে হবে। এর আগে কোনো মেয়ে বিয়ের আসনে বসতে পারবে না। আর যদি কোনো মেয়ে দশম শ্রেণীর পরও পড়তে চায় কিন্তু তার পরিবার খরচ চালাতে না পারে তবে সেই মেয়ের দায়িত্ব নন্দা নিবে। নন্দার চোখ অশ্রুতে টইটুম্বুর। এইতো, কয়েকমাস আগ অব্দি যে মেয়েটার নিজস্ব কোনো ঠিকানা ছিল না সে মেয়েটাই আজ এত বড়ো বড়ো দায়িত্ব পালন করছে। যার একসময় আশ্রয়স্থলের অভাব ছিল, সে-ই এখন মানুষের আশ্রয় হচ্ছে।

নন্দার ভাবুক চোখের অশ্রু খুব গোপনে একটি পুরুষালী হাত মুছে দিল। নন্দা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল হাসছে স্টিফেন। নন্দার বাহুতে আলতো ছুঁয়ে বলল,
“কাঁদিতেছো কেন, সানশাইন?”

নন্দার অল্প বয়সের কাঠিন্যতা এই মানুষটার কাছে এসে কোমল হয়ে গেলো। হুট করেই জড়িয়ে ধরল মানুষটাকে। অস্ফুটস্বরে বলল,
“আপনি এত ভালো কেন?”

“আমি তো ভালো নই। কেবল তোমায় ভালোবাসি বলিয়া ভালো হইয়া গিয়াছি।”

“কেন এত ভালোবাসলেন বলুন তো?”

“কারণ এই পৃথিবীতে তোমার একজন প্রকৃত ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন ছিল। তবে একজনের জায়গায় দু’জন পাইয়া গিয়াছ, এটা সৌভাগ্য তোমার।”

স্টিফেনের কথায় রহস্যের আভাস। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। বলল,
“দু’জন কীভাবে হলো?”

নন্দার কথা শেষ হতেই গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। স্টিফেন উত্তর না দিয়ে নেমে দাঁড়াল এবং তাকেও নামতে বললো। নন্দা নেমে দাড়ানোর সাথে সাথে গেটের সামনে দাঁড়ানো পাহারাদার নন্দার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিল। নন্দা চিঠির উপর ললিতা নাম দেখতেই থমকে গেল। চিঠি খুলতেই ললিতার সাবধান বাণী চোখে পড়ল,
“নন্দু, দেশ ভালোবাসলে বুকে পাথর বাঁধো,
আর সংসার ভালোবাসলে স্বামীকে আগলো রাখো।”

অন্যদিকে অ্যালেন হন্তদন্ত হয়ে স্টিফেনকে খবর দিল। উপর মহল থেকে খবর এসেছে, কর না নেওয়ার কারণ হিসেবে স্টিফেনকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here