#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
[৩৮]
মন খারাপের দু’মুঠো মেঘ এসে ভরিয়ে দিয়েছে নব্য সুখের বারান্দা। হৃদয়ে থাকা সুখের প্রাচীর এখন প্রায় ধ্বংসাবশেষ বাকি। সদ্য ফোঁটা প্রেমের পদ্মও তুমুল ঢেউয়ে দিকভ্রান্ত। অম্বরের আস্তরণে বিষাদ নেমেছে ধরায়। সেই দিকভ্রান্ত, ধ্বংসাবশেষ, বিষাদ সম্বল করেই নন্দার ভালো থাকার চেষ্টা। ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে সে। শাড়ির প্রান্ত ভাগ উড়ছে বাতাসের তালে তালে।
“এত রাতে ছাঁদে কী করিতেছ, সানশাইন?”
পরিচিত থমথমে পুরুষালী কণ্ঠে নন্দা খানিক চমকালো অতঃপর নিবিড় স্বরে বলল,
“তেমন কিছুই না। চাঁদ দেখছি।”
“অথচ আজ আকাশে মেঘ করিয়াছে। হয়তো বৃষ্টি হইবে। চাঁদ কোথায় দেখিতেছো? নাকি নিজেকে দেখিয়া ভুল করিয়া চাঁদের সাথে গুলিয়ে ফেলিয়াছো? তুমিও তো চাঁদের থেকে কম নও।”
স্টিফেনের কণ্ঠে ঠাট্টার ছাঁপ অথচ নন্দা নিশ্চুপ। তার চোখে বার বার ভেসে বেড়াচ্ছে কিছুক্ষণ আগের সেই নির্মম দৃশ্য। যেই দৃশ্যে একজনের চোখে সে ভালোবাসার নরম চিহ্ন দেখতে পেয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। নন্দা সবসময়ই পাথরকেও হার মানায় তার হৃদয়ের কাঠিন্যতা দিয়ে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। মনের বিশাল তান্ডব মনেই চেপে সে মুচকি হাসল। বলল,
“সব ছেড়ে আমাকেই কেন ভালবাসেন?”
স্টিফেন খানিক অবাক হলো। ভালোবাসা-বাসির নামতা কখনোই নন্দার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়নি। তবে আজ কেন? স্টিফেনের ভ্রু কুঞ্চিত হওয়ার দৃশ্যও দৃষ্টিগোচর হলো নন্দার। সে হাসল,
“প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না বুঝি?”
“তুমি বলো তো, সব ছাড়িয়া ঐ আকাশের নাম কেন আকাশ রাখা হইল?”
নন্দা স্তম্ভিত নয়নে চাইল,
“এটা প্রশ্ন হলো?”
“তোমারটা প্রশ্ন হইলে, আমারটা হইবে না কেন?”
“আপনার প্রশ্নের কোনো বিশ্লেষণ নেই।”
“তোমার প্রশ্নেরও তবে বিশেষত্ব নেই। ভালোবাসার ক্ষেত্রে সকল প্রশ্নই বেমানান। যদি প্রশ্ন মানানসই হয় তবে সে ভালোবাসার জলাঞ্জলি হোক। আমি যে অত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে ভালোবাসি নাই, সানশাইন। তাই বলিয়া কী তুমি আমাকে ব্যর্থ প্রেমিক ঘোষিত করিবে?”
“বাহ্! প্রেম বাক্য তো ভালো জানেন!”
“জানিবো না কেন? প্রেমে পড়িয়াছি আর প্রেম বাক্য জানিব না, তা কেমন করিয়া হয়?”
নন্দা হাসল। খুব করে চেয়েও সে তাচ্ছিল্য করতে পারল না। যে এত ভালবাসতে পারে তার প্রতি তাচ্ছিল্যটা বড্ড বেমানান। তাই চেয়েও সে তাচ্ছিল্য করল না। কেবল বুক ভোরে বেরিয়ে এলো হতাশার দীর্ঘশ্বাস।
“তোমরা কি করছ?”
ভালোবাসার আদান-প্রদান করা দুইজন মানুষের মধ্যিখানে তৃতীয় মানুষের কন্ঠটা সবসময়ই বড়ো খসখসে ঠেকে। আজও ঠেকলো। মেয়েলী রিনরিনে কণ্ঠ। স্টিফেন এবং অলকানন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে চাইল। বিহারিনীর হাস্যজ্জবল মুখটা তাদের দৃষ্টিগোচর হল। গাঢ় অন্ধকারে মেয়েটার মুখটা যেন চাঁদের ন্যায় ঝলমল করছে। নন্দা সেদিকে আড় চোখে চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। থমথমে কণ্ঠে বললো,
“স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকা মানেই অনেক ব্যক্তিগত কথা বলা, ব্যাক্তিগত কাজ করা। সেটা জিজ্ঞেস করা মোটেও বুদ্ধিমতীর লক্ষণ নয়।”
নন্দা ভেবেছিল তার এমন একটা কথার পর বিহারিণী কপাল কুঁচকাবে, মন খারাপ করবে কিংবা কেঁদেও দিবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বিহারিণী হেসে উঠল। কাছে আসতে আসতে বলল,
“আমি তো বুদ্ধিমতী নই, নন্দা।”
বিহারিণীর ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের হাসি। নন্দা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এই বিহারিণীর মুখমন্ডলে কুটিলতা বিরাজমান। আগের মত নিষ্পাপ নিষ্পাপ লাগছে না তাকে। কেমন যেন অচেনা মুখমন্ডল! অপরিচিত মানুষ। যে মানুষ কেবল ধ্বংস আনতে জানে। নন্দার ভাবনার মাঝে ভেসে এলো স্টিফেনের কঠোর কণ্ঠ,
“পাগল কখনো নিজেকে পাগল দাবী করিবে না সেটাই স্বাভাবিক।”
নন্দা এই কঠোর কণ্ঠ চেনে। স্টিফেন সবসময় বাহিরের মানুষের সাথে এভাবেই কথা বলে। সবটা কেমন গোলমেলে লাগল নন্দার। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই যেন বোধগম্য নয় তার।
“ভুল সময়েই এলাম বোধহয়। নাহয় সাহেব এত রেগে কথা বলতো না।”
“আমি তো কখনোই আপনার সাথে ভালো করেও কথা বলিনি। তবে এমন কথার কারণ কী?”
স্টিফেন বিরক্ত যে তা ঢের বুঝা গেল। বিহারিণীও নত মস্তকে বেরিয়ে গেল বিনা বাক্যব্যয়ে। নন্দা ভাবছে, কিন্তু ভাবনার কোনো কূল কিনারা মিলছে না। যার এত কাছাকাছি আসা যায়, যাকে জড়িয়ে ধরা যায়, তার সাথে এত রুক্ষ স্বরে আদৌও কথা বলা যায়! নন্দার ভাবনার মাঝে কোমরে অনুভব করল শীতল ছোঁয়া৷ পুরুষালী হাতের আদুরে ছোঁয়া। যে স্পর্শে কোনো ছলচাতুরী নেই, অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। নন্দার নারী স্বত্তাও উন্মাদ হলো। এই প্রথম কাছে আসার গল্প হলো ভালোবাসার। এই প্রথম চন্দ্র বিহীন অন্তরিক্ষ লিখল কেবল আর কেবল মাত্র ভালোবাসার কাব্য। স্টিফেন ফিসফিস করে বলল,
“আমার সবটুকু খারাপ থাকিবার জীবনে তুমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ ভালো থাকা। মৃত্যুও যদি তুমি হও আমি সেচ্ছায় শ্মশানে যাইতে প্রস্তুত। অমৃত যদি তুমি হও তবে আমি পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করিতে রাজি। সবকিছুর বিনিময়ে কেবল ভালোবাসিলেই হইবে।”
নন্দা কী কাঁদল? কাঁদল বোধহয়। মুক্তোর দানার মতন অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার চক্ষুর আঁধার থেকে। এত ভালোবাসার পৃথিবীতেও নন্দার কেন একা একা লাগে? তবে কী সে ভালোবাসতে বড়ো দেরি করে ফেলছে?
_
কলকাতার শহরে নন্দার ব্যস্ত পদচারণ। মুমিনুল মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। মানুষটা শহুরে একটি পাঠশালায় পড়াচ্ছেন আজকাল। এটার ব্যবস্থাও স্টিফেন করে দিয়েছে। মাস্টারমশাই আজ নন্দাকে দেখে প্রায় কেঁদেই দিয়েছেন। বারংবার নন্দার সৌভাগ্যে যেন নজর না লাগে তাই প্রার্থনা করেছেন। মাস্টারমশাই তো মানুষ চিনতে ভুল করেন না। তবে কী কোথাও একটা খামতি রয়ে গেছে? স্টিফেনের মতন মানুষকেও মাস্টারমশাই আশীর্বাদ করেছেন। নন্দাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে নন্দার অভিশপ্ত জীবনে স্টিফেন আশীর্বাদ। তবে….. এই তবের আর অন্ত খুঁজে পায় না নন্দা। কোথায় গেলে মিলবে উত্তর! কার কাছে গেলে পাবে সে সব উত্তর?
ব্যস্ত পা থেমে গেল পরিচিত কোনো মুখের আদল দেখতে পেতেই। নন্দা বার কয়েক পলক ঝাপটিয়ে বুঝার চেষ্টা করল তার দৃষ্টি কী ভুল দেখছে না সঠিক! যখন বুঝল তার দৃষ্টি সঠিক দেখছে, নন্দা আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। ছুটে গেল পরিচিত মানুষটার দিকে। নন্দাকে দেখে সে মানুষটাও হতবাক। নন্দার দুরু দুরু কাঁপছে বুক। বহু কষ্টে শুধাল,
“একটি সংসার ভেঙে ভালো থাকা যায় কীভাবে, বলবে?”
অপরিচিত রাস্তায় পরিচিত কণ্ঠ পেয়ে সে মানুষও ভড়কালো। তাও আবার এমন প্রশ্ন! নন্দা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল কেউ শুনেছে কি-না এমন সত্য কথাটুকু। যখন দেখল কলকাতার এই ব্যস্ত রাস্তায় এমন সত্যি কথাও শোনার মতন কারো সময় নেই, তখন সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। ততক্ষণে সামনের মানুষটা কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল,
“এটা আবার কেমন কথা?”
“ভুল কিছু কী বলেছি? তরঙ্গিণী দেবীর প্রেমের তরঙ্গে একে একে ভেসে যাচ্ছে সকল সংসার। আমি বলবো না সেটা?”
তরঙ্গিণী ভ্যাবাচেকা খেল। নন্দার চোখ-মুখ শক্ত। কঠিন গলার স্বর। বলল,
“সংসার কেমন কাটছে?”
“তোমার সংসার তো দিব্যি কাটছে, নন্দা। তবে এমন প্রশ্ন কেন?”
নন্দা এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। নাহ্, তরঙ্গিণীর কোথাও তো শঙ্খ-সিঁদুরের চিহ্ন নেই। তবে যে মানুষ বলল সে প্রসাদের সাথে পালিয়েছে! নন্দার এলোমেলো মুখশ্রীর দিকে তাকাল তরঙ্গিণী। জিজ্ঞেস করল,
“এমন কথা বলছ কেন?”
#চলবে
[ছোটো পর্বের জন্য দুঃখীত।]