অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ২১

0
592

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২১.

একটি ক্লান্ত দিন, তৃষ্ণার্ত দুপুর, শূন্যতার চাদর জড়িয়ে ডাকছে বিষাদ। সুখ ছেড়ে যাওয়ার গল্প কোথাও লুটিয়ে পড়েছে অবেলায় , কোথাও বা দুঃখরা রূপকথা থেকে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। চারদিকে প্রগাঢ় একাকীত্ব, ভালো না থাকার কবিতা। সূর্য তখন বিমূঢ়, মেঘ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে উদ্দেশ্যহীন। এমন একটা দিনে অলকানন্দা ভারী রকমের মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শ্বশুরবাড়ির বিরাট দালানের ছাঁদে। গরম লাগছে শরীরে তবে তা যেন বাস্তবতার চেয়ে কমই যন্ত্রণা দিচ্ছে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার আজ পঞ্চমতম দিন। শরীরে বৈবাহিক চিহ্ন নির্লজ্জের মতন মাথা তুলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ওরা ভালোবাসার দাগ নয়, ওরা যন্ত্রণার ছোঁয়া। অলকানন্দা তপ্ত শ্বাস ফেলল। সুদূরে তাকাতেই তার দৃষ্টি আনমনা হলো। কিছু একটা পরিচিত দেখতে পেয়েই বক্ষ পিঞ্জিরাবদ্ধ মন পায়রা ছটফটিয়ে উঠলো। অলকানন্দা ছুটে গেলো দ্রুত। মোটা মোটা, ত্রিভুজাকৃতির সিঁড়ি পেরিয়ে সদর দরজার বাহিরে চলে গেল। গেইটে প্রহরী ঝিমুচ্ছে গভীর ক্লান্তিতে। অলকানন্দা সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেল বিশাল লোহার গেইট ছেড়ে। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত কাঙ্খিত পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে পিছ ঘুরে, অলকানন্দা হাঁপিয়ে উঠেছে। কণ্ঠ কাঁপছে, তবুও মেয়েটা ডাক দিল,

“নবনীল…….”

নিঃস্ব চোখে চাইলে পরিচিত পুরুষ। মনে হলো মন পুড়ে যাওয়ার শ্মশানে ভালোবাসার আশায় চেয়ে থাকা যেন কালো কুচকুচে কাকটা। তার চোখে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মরুভূমি। সে শুধালো নরম কণ্ঠে,
“ভালো আছেন, নন্দা?”

অলকানন্দার কি জানি কি হলো! বুক চাপরে কান্নারা হাউমাউ করে ওঠল। কণ্ঠ চাইলো খানিক চিৎকার করতে। সে পারল না সেই চাওয়া পূরণ করতে। কান্না আটকানোর প্রচলিত চেষ্টায় আটকে গেল শ্বাস-প্রশ্বাস। অন্তরটা যেন ছিঁড়ে নিচ্ছে কেউ। কিন্তু তবুও জোর করে উচ্চারণ করল,
“আছি, খুব ভালো-ই আছি।”

নবনীল হাসলো। খুব অদ্ভুত ভাবে এই উত্তপ্ত গরমে লোকটা চাদর জড়িয়ে আছে! কেন আছে? অলকানন্দার মনের মাঝে প্রশ্নরা হামাগুড়ি খেলো কিন্তু তারা উত্তরের আশায় আর বেরিয়ে এলো না। নবনীল থেকে অলকানন্দার দূরত্ব তিন-চার হাত হবে কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের দূরত্ব আকাশ থেকে মাটির দূরত্বের সমান। হাহাকার করে ওঠল চারপাশ। খুব গোপনে অস্বীকার করা অনুভূতিরা যে খুব গোপনেই মারা যাবে তা যে অলকানন্দার অজানা ছিল। কথা বলার প্রবল ইচ্ছে ছোটো মেয়েটাকে চুপ থাকতে দিলনা। কিশোরী মন, উজ্জীবিত আবেগ আর তার সয় না গোপনে। তারা বাহিরে আসতে চায়, সেই চাওয়া নিয়ে চালায় আন্দোলন, হৈ হৈ করে শব্দরা বেরিয়ে আসে,
“আপনি ভালো আছেন, নবনীল?”

নবনীল হো হো করে হেসে উঠলো। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হাসির কথাটা তার সামনে চলে এলো। এমন মধুময় হাসি! যেন চিরজীবন পাড় হবে স্ব আনন্দে এমন হাসির জোরে। অথচ দুর্ভাগ্য দেখো! চিরজীবন তো দূর, কয়েক মিনিটও এই হাসি দেখার সৌভাগ্য নেই অলকানন্দার।

“ভালো থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন, আর ভালো থাকবো না ভেবেছেন?”

বড়ো অমানবিক ঠেকল কথাখানি। যেন এই কথার বিপরীতে থাকা একটা গোপন কথা ডালপালা মেলে বলছে, “অলকানন্দা, তুমি ভালো রাখোনি, ভালো রাখলে না।”

অলকানন্দা হতাশার শ্বাস ফেলল, অসহায় কণ্ঠে বলল,
“সেদিন আপনার অভাবে একটি অলকানন্দা ঝরে গিয়েছিল, আপনি কী তা জানেন, নবনীল?”

“কোন অলকানন্দা ঝরে ছিল সেদিন? শুনি একটু! যে অলকানন্দার কপালে আজ শোভা পাচ্ছে মুগ্ধতা, যে অলকানন্দার শরীর আজ শোভা পাচ্ছে স্বামী প্রীতি, সেই অলকানন্দা বুঝি? শুনেছি ঝরে যাওয়া মানে মৃত্যু, অথচ এই অলকানন্দা সেই প্রচলিত কথা মিথ্যে করে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, ঝরে যাওয়া মানে মুক্তি। অলকানন্দা তার সাদা শাড়ির বাধ্য আস্তরণ থেকে মুক্তি পেয়েছে, অলকানন্দা তার সকল না চাওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে, খাঁচার ভেতর পোষ মানিয়ে রাখতে চাওয়া একটি উড়তে চাওয়া পাখি আজ উড়তে পেরেছে। কোথায় ঝরে গিয়েছেন অলকানন্দা? সব দিকে দেখি আপনার সুখের আগমনী ঢাক বাজছে। কোথায় তবে আপনার বিসর্জনের সুর? চারদিকে গোধূলির আলো, চারদিকে অলকানন্দার ভালো থাকা রঙিন হয়ে ফুটে ওঠেছে। কোথায় তবে অলকানন্দার মূর্ছে যাওয়া?”

নবনীলেন মুখে লেপ্টে আছে বাঁকা হাসির রেখা। যা তীরের মতন বিদ্ধ করেছে অলকানন্দার বক্ষ। সে নিবিড় কণ্ঠে বলল,
“আমার আপনাকে প্রয়োজন ছিল, নবনীল।”

“আফসোস, নন্দা! আমি কেবল আপনার প্রয়োজন হয়েই রইলাম, প্রিয়জন হওয়া- সে তো মোর সাধ্য নহে আর নাহি আছে মোর ভাগ্য। আপনি আমার কাছে সবসময়ের জন্য অপরিচিতই রইলেন।”

অলকানন্দার কান্না পেল। ভীষণ রকমের কান্না। যে কান্না ভাসিয়ে নিয়ে যায় সকল সুখ, সকল শোক। কিন্তু তার আর কান্না করা হলো না। সে বরং কেমন যেন কঠিন হয়ে গেলো। যে মানুষ তার দূর্দশা শুনেও এমন তাচ্ছিল্য ছুড়তে জানে সে মানুষকে কান্না দেখানো কেবল বৃথা কাজ। নবনীল কেমন শান্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো অলকানন্দার দিকে। যেতে যেতে বলল,
“আমি আপনার সাথে আছি, নন্দা। আপনার অমন খারাপ সময়ে হয়তো থাকতে পারিনি, তবুও আমি আছি। আমি আছি তীর্থের কাকের মতন। আমি শেষ বেলাতেও শকুন হয়ে মৃতদেহ থেকে যেমন সে বেঁচে থাকার খাদ্য কুড়িয়ে নেয় আমি আপনার থেকে বেঁচে থাকার কারণ কুড়িয়ে নিব। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেখুন! আমি মানুষ হয়ে একটিবার আপনার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে পারলাম না। আমার মানব জন্ম বৃথা নন্দা, আমার মানব জন্ম বৃথা।”

অলকানন্দা মুখ ঢেকে ফেলে। তুমুল কালো মেঘের পর যেমন বৃষ্টি ঝরে তেমন অলকানন্দার অশ্রুরা বাঁধ ভাঙে। সে-কি হাহাকার! কী যন্ত্রণা! অলকানন্দার বাহুতে তখন দূঢ় ছোঁয়া পায়। অলকানন্দা চমকে উঠে। বিস্ময় নিয়ে পিছে তাকাকেই দৃষ্টিগোচর হয় স্টিফেনের মুখমন্ডল। ফর্সা মুখটা লালাভ হয়ে আছে চোখেমুখে একটা কাঠিন্য ভাব। কণ্ঠ কিছুটা রুক্ষ করে সে প্রশ্ন করল,
“কী সমস্যা, সানশাইন?”

অলকানন্দা তার বাহুতে থাকা হাতটা ঝারা দিয়ে ফেলে দিতে চায় কিন্তু পারেনা। স্টিফেনের ছোঁয়া গভীর হয়। অলকানন্দাকে বুকে জড়িয়ে নেয় জোর করে। আবার প্রশ্ন তুলে,
“কী হইয়াছে তোমার?”

অলকানন্দা জবাব দেয়না, হাসফাস করে কেবল। স্টিফেন শান্ত চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে, কোমল কণ্ঠে বলে,
“কান্নার সময় কারো স্বান্তনা পেলে ভালো লাগে। তুমি তো দেখি তা-ও জানোনা। চলো, ঘরে ফিরিয়া চলো।”

স্টিফেন ‘চলো’ কথাটা মুখেই বলল কিন্তু অলকানন্দার আর হাঁটতে হয়নি। কিছুটা টেনেই সে নিয়ে গেল তাকে।

বন্ধ রুমে অলকানন্দার ক্লান্ত দেহখানি পড়ে আছে বিছানায়। নবনীলের ভাষ্যমতে কপাল জুড়ে থাকা মুগ্ধতা এলোমেলো হয়ে আছে। নবনীলের তাচ্ছিল্যে বলা স্বামী প্রীতি যন্ত্রণার মতন বিঁধে আছে শরীরে। আহা সুখ! নবনীল এমন সুখ দেখলে নিশ্চয় এত গুলো কথা বলতে পারতো না।

স্টিফেন সাহেবী শার্ট-প্যান্ট পড়ে আবার ঘরে প্রবেশ করল। স্টিফেনকে দেখে অলকানন্দা বিপরীত দিকে ফিরে শুলো। তা দেখে হাসলো স্টিফেন। বুটে শব্দ তুলে এগিয়ে এলো। খুব সন্তপর্ণে অলকানন্দার পায়ে হাত দিল। শীতল হাতের স্পর্শ পেতেই মেয়েটা কেঁপে ওঠল। পা-টা টেনে নিতে চাইলেও পুরুষালী শক্তির কাছে সে নেহাৎই তুচ্ছ একটি নারী। স্টিফেনের রাশভারী কণ্ঠে বাক্যের স্রোত,
“হ্যাপি বার্থডে, নন্দা। শুভ জন্মদিন।”

অলকানন্দা দারুণ ভাবে চমকে গেল। অপ্রত্যাশিত কথাটি অনাকাঙ্খিত সময়ে শুনে সে যেন আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে চলে গেলো। অবাক হয়ে বলল,
“আমার আজ জন্মদিন!”

“তুমি জানো না?”

অলকানন্দা ডানে-বামে মাথা নাড়াল। যার অর্থ সে ‘জানেনা’। স্টিফেন স্মিত হাসল। লোকটা যে হাসতেও পারে তা আজ জানল অলকানন্দা। কিন্তু খুব গভীর ভাবে খেয়াল করলে বুঝা যায় মানুষটার হাসি গাঢ় আর কেমন মোহনীয় যেন। ঘোর লেগে যাওয়ার মতন। অলকানন্দা বিছানা ছেড়ে ওঠতে নিলেই রুমঝুম করে ওঠলো তার পায়ের স্বর্ণের মোটা নুপুর জোড়া। অলকানন্দা আরেক দফা বিস্মিত হলো। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আমার নুপুর প্রিয় আপনি জানতেন?”

“ইয়েস মাই সুইটহার্ট, আমি এটাও জানি যে- তোমার নবনীল নামক ছেলেটাও প্রিয়। কেবল প্রিয় নই আমি।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here