অবেলার পুষ্প পর্ব ১

0
1107

#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_১

বাস থেকে নামতেই একটা মেয়ে সোজা ধেয়ে এলো আমার দিকে।

আর কোনো শব্দ মাথায় আসছে না। সে একেবারেই ধেয়েই এলো। আমি দিকজ্ঞান হারিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। চেনা বলে তো মনে হচ্ছে না! অথচ মেয়েটার হাবভাবে মনে হচ্ছে সে যেন আমাকে ভালোমতোই চেনে। শুধু তাই না, আমাকে যেন কয়েকদিন ধরে খুঁজছে।

বাসস্টপেজে গোটা কয়েক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তরুণ আর মাঝবয়সী কয়েকজন। তাদের কেউ মোবাইল টিপছে, কেউবা উদাস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে দুই একজন মাথা তুলে দেখল। তারপর আপনা থেকেই আমার দিকে চোখ ফেরালো। কাজেই আমি ভুল দেখছি না। মেয়েটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।

কাছে এসেই কটমট করে তাকিয়ে একেবারে পরিচিত মানুষের ভঙ্গিতে মেয়েটা বলল, ‘এটা আপনার কেমন বিবেচনা সজল ভাই? আমরা সবাই সেই কখন থেকে আপনার জন্য ওয়েট করে বসে আছি! আর আপনি এই মাত্র এলেন! কেন গতকাল কি কোনো বাস ছিল না? জানেন এই এতগুলো দিন আমরা রোজ একবার করে এখানে এসে খোঁজ নিয়ে গেছি যে আপনি এসেছেন কী না!’

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেয়েটার কথাগুলো শুনলাম।

আমরা বলতে কাদের বোঝাতে চাইল তা ঠিক বুঝলাম না। কারণ মেয়েটার আশেপাশে কাউকে দেখা গেল না। সে একাই রাজহংসীর মতো গলা উঁচিয়ে একেবারে ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়ে এসে জুটেছে আমার সামনে।
আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটা ভুল করছে। কারণ আমার নাম সজল না। আমি মাহমুদ। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে এসেছি বন্ধু রায়হানের বিয়ে উপলক্ষে। এই অঞ্চলের আর কারও সাথেই আমার পরিচয় নেই।

বন্ধু একটা ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘বাস স্টপেজে নেমে একটা ইজিবাইকে চেপে বসবি। চৌধুরী ভিলা, বাহাদিয়া বাজার বললেই সোজা এসে জায়গামত নামিয়ে দেবে। এখানেকার সবাই কমবেশি জায়গাটা চেনে।’

রায়হানের কথামত বাস থেকে নেমে ইজিবাইক খুঁজতে যাব, এমন সময়েই তো এই বিপত্তি! বলা নেই কওয়া নেই, একেবারে সোজা ঘাড়ে এসে জুটেছে যেন। আমি মাহমুদুল রেজা, দেশের নামকরা এক মোবাইল কোম্পানির ডেপুটি ডিরেকটর… আমি কী না এক মেয়ের সামনে এমন ক্যালাসের মতো দাঁড়িয়ে আছি!

কথাগুলো মনে হতেই সম্বিত ফিরে পেলাম যেন। চোখেমুখে চকিত স্মার্টনেস ফুটিয়ে তুলে সহাস্যে বললাম, ‘আপনি ভুল করেছেন সম্ভবত। আমার নাম সজল না। আমি মাহমুদ, ঢাকা থেকে আসছি। আমার বন্ধুর…।’

‘আপনি সজল ভাইয়া না? ওমা! এটা আগে বলবেন না? আমি এতক্ষণ কী না সজল ভাইয়া মনে করে…’

মেয়েটা আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাসের অন্য যাত্রীদের দিকে মুখ ফেরালো। তরুণ যাত্রীদের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে চাইল যেন। তাকে খুবই আশাহত মনে হলো। তরুণ যাত্রীরা কেউই তাকে দেখে এগিয়ে এলো না কিংবা মেয়েটিও হয়ত বর্ণনামত কারও সাথে মিল খুঁজে পেল না। ঠোট বাঁকিয়ে খুবই চিন্তিত ভঙ্গিতে এদিকে সেদিকে তাকাতে লাগল সে।

আমি ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যাওয়াতে ইজি বাইক খোঁজার দিকে মন দিলাম। দুই একটাকে ইতিমধ্যে পাশ কাটাতেও দেখেছি। কিন্তু মেয়েটির সাথে এই বাগবিতণ্ডার কারণে সেগুলোকে থামাতে পারিনি। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটাকে এদিকে ছুটে আসতে দেখা গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাত নাড়িয়ে সেটাকে থামিয়েই বন্ধু রায়হানের দেওয়া ঠিকানাতে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম।

ইতিমধ্যে মেয়েটির কিছু সঙ্গী সাথী এসে জুটেছে। তারই বয়সী তিন চারটি ছেলেমেয়ে পেছন থেকে এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ্যাই রানু! অমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলি কেন? সজল ভাইয়ের দেখা পাওয়া গেল?’
রানু নামের মেয়েটি আমাকে দেখিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সম্ভবত। ইজি বাইকের চালককে আমার দেওয়া ঠিকানাটা শুনতে পেয়েই আবার তেড়ে এলো আমার দিকে।

‘এই যে! আপনি নাকি সজল ভাই না? তাহলে চৌধুরী বাড়ি, বাহাদিয়া বাজার যাচ্ছেন যে?’

আমি আবার হোঁচট খেলাম। কী কেলো রে বাবা! এই মেয়ে দেখি জোঁকের মতো পিছে লেগে গেল! বিরক্তি চেপে রেখে বললাম, ‘কেন? ঐ অঞ্চলে কি সজল ছাড়া অন্য কেউ যেতে পারে না?’

মেয়েটি চোখ পাঁকাল। অন্তত আমার কাছে তো সেইরকমই মনে হলো। বেশ লম্বা ঘন পল্লবঘেরা কাজল টানা চোখ। এতক্ষণে একটু ভালমত দেখার সুযোগ পেলাম। আহা যে মেয়ের চোখে এত মায়া তার কণ্ঠ এত কর্কশ কেন? সারাক্ষণ কেমন যেন ঝগড়া লাগানোর সুযোগ খুঁজছে।

‘আমি কি তাই বলেছি যে সজল ছাড়া অন্য কেউ ঐ জায়গায় যায় না? আমরা যাকে খুঁজতে এসেছি তারও সেখানেই যাওয়ার কথা! বুঝতে পেরেছেন?’

‘ওহ আচ্ছা তাই নাকি? তাহলে হতে পারে একই নামে হয়ত দুটো জায়গা আছে।’
‘না নেই! এই জায়গার খবর কি আপনার চেয়ে আমরা কম জানি?’

মেয়েটা সারাক্ষণ আমরা আমরা করছে। অথচ ঝগড়া করছে সে একা। অন্যরা মনোযোগী শ্রোতার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু শুনছে। আমি রণেভঙ্গ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘না আমি এই এলাকার খবর অনেক জানি তা বলছি না। কিন্তু আপনি যাকে খুঁজতে এখানে এসেছেন তিনি আমি নই!’
‘আপনি বাহাদিয়া বাজারের চৌধুরী ভিলাতে যাবেন?’
‘জি!’
‘আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন?’
‘জি। এটাও ঠিক আছে।’
‘আপনি বিয়ে খেতে এসেছেন?’

এবারে আমি অবাক। এ কী! সবকিছুই তো মিলে যাচ্ছে! বললাম, ‘জি আমি আমার বন্ধুর বিয়ে খেতে এখানে এসেছি। কিন্তু…আপনারা সেই কথা জানলেন কীভাবে?’
মেয়েটি বলল, ‘কারণ আমরা যার খোঁজে এখানে এসেছি, উনিও তার বন্ধুর বিয়ে খেতেই এখানে আসছেন। আর তার নাম হচ্ছে সজল। অথচ আপনি বলছেন আপনি সজল ভাই না!’
‘আরে! কী মুশকিল! আমি সজল হলে তো বলব তাই না? শুধু শুধু মিছে কথা বলতে যাব কেন?’

এবারে একটি ছেলে এগিয়ে এলো। এই ছেলেটি রানু মেয়েটার প্রায় সমবয়সীই বলা চলে।

ছেলেটি বলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমরা একটা অসুবিধায় পড়েছি। আমরা একজনকে খুঁজছি। উনার নাম সজল, ঢাকা থেকেই আসার কথা। উনি বলছিলেন এই সময়ের দিকেই আসবেন। তারিখ বলেননি ঠিকমত। তাই আমরা গত কয়েকদিন ধরেই বাস স্টপেজে এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছি। একটু বিশেষ দরকারেই আমরা নিয়মিত উনার খোঁজ নিচ্ছি। উনি না এলে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে। আপনি ইজি বাইক ওয়ালাকে যেই ঠিকানা দিলেন, আমরা সেই ঠিকানা থেকেই আসছি। কী জানি, কোনো ভুল হচ্ছে কী না কে জানে! এমনও তো হতে পারে আমরা যাকে খুঁজতে এসেছি আপনি সেই ব্যক্তিই! হয়ত নামে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। আমরা একটা গাড়ি নিয়ে এসেছি। আপনি চাইলে আমাদের সাথেও যেতে পারেন। অবশ্য আমরা জোর করব না কোনো।‘

এ কেমন অদুভত আবদার! চেনা নাই জানা নাই, আমি হুট করে কিছু অপরিচিত ছেলেপুলের সাথে চলে যাব? এরা যে আমাকে কোনো ফাঁদে ফেলছে না তাই বা কে জানে! সেই কথাই একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললাম। ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে ভদ্রঘরেরই মনে হয়। তবু বলা যায় না। আজকাল প্রতারকদের কত হাজার রকম হুলিয়া বের হয়েছে! মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠিক বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই দুই কূল বাঁচিয়ে বললাম,

‘কিন্তু আমি তো এই জায়গায় নতুন। তোমাদের চিনি না জানি না। তোমরা যে সত্যি কথা বলছ তার প্রমাণ কী?’

ছেলেটি আবার বললো, ‘বেশ তাহলে আপনি না হয় আমাদের সাথে নাই এলেন! এই ইজিবাইকেই করে আসুন। আমরা আপনার পিছনে পিছনে আসি। এতে আপনি রাজি তো?’

আমার আরও নানারকম কথা মাথায় ঘুরছিল। এই ইজিবাইক ওয়ালাই যে এদের সাথে জুড়ে নাই তাই বা কে জানে! মোবাইল কোম্পানিতে চাকরী করি। নানারকম প্রতারণার ব্যাপারে আমরাই ক্লায়েন্টদের সতর্ক করে থাকি। সেখানে নিজেই ভিন্ন শহরে এসে কোনও বড় ফাঁদে না জড়িয়ে যাই!

তবু এই তরুণ মুখগুলো দেখে কেন জানি অন্য কিছু ভাবতে মন চাইল না। একটু দোনোমোনো করেই বললাম, ‘কোথায় তোমাদের গাড়ি? চলো তোমাদের সাথেই যাওয়া যাক!’

সব কটি মুখ একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারা খুশিতে আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে চলল নিজেরাই। তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, যে মানুষকে তারা খুঁজতে এসেছে সে মানুষটি আমিই। আমি নিজেও ইতিমধ্যে কেমন যেন দোটানায় পড়ে গেছি।

দেখি যাওয়াই যাক এদের সাথে! গেলেই বোঝা যাবে ঘটনা কী! (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here