অবেলার পুষ্প শেষ পর্ব

0
761

#উপন্যাসিকা
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_১০_শেষ_পর্ব

নবম পর্বের পরে…

চাচি যখন আমাকে এই গল্প বলছিল, তখন মাঝখানে দুই একবার শাকিল ‘একটু আসছি’ বলে উঠে গিয়েছিল। ফিরে এসেছে গোমড়ামুখে। কোথায় চলে গিয়েছিল জানি না। আমি তখন গল্পের মধ্যে ডুবে আছি আর আকাশপাতাল ভেবে চলেছি।

সব কথা শেষ হওয়ার পরে অনেকটা সময় পর আমি নিজেই উদ্যোগী হয়ে নীরবতা ভাঙলাম। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘ভালোই হয়েছে। ভাইয়া সবকিছু নিয়ে সুখে থাকুক। একেকজন মানুষের সুখ একেক জিনিসে। আমি আমার মতো সুখি আছি। শুধু ভাইয়া যদি একবার আমাকে সব কথা খুলে বলত, আমি নিজেই খুশিমনে সব দাবি ছেড়ে দিতাম! এমনও তো হতে পারে, ভাইয়ার অনেক টাকার দরকার ছিল!’

চাচি বলল, ‘তোমার বুঝি টাকার দরকার ছিল না? টাকা এমনই এক জিনিস যার প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তোমার তো আরও বেশি দরকার ছিল। কারণ তোমার বয়স কম, মাথার ওপরে ছাদ নেই… পায়ের নিচে মাটি নেই!’ বলতে বলতেই চাচি একটু কেমন জানি আনমনা হয়ে পড়ল। আমার এই গুমোট পরিবেশে দম আটকে আসতে চাইছে। তাই আবারও গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় চাচি জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা মাহমুদ, তোমার পড়ালেখার খরচ তোমার ভাইয়া ঠিকমত দিত কি? মানে কীভাবে দিত?’

‘আমি যে স্কুলে পড়তাম সেটা ছিল একটি আবাসিক স্কুল এন্ড কলেজ। ভাইয়া প্রিন্সিপালের সাথে কী নিয়ম সেট করেছিল আমি ঠিক জানতাম না। কিন্তু আমার বেতন বা অন্যান্য কোনোকিছুর ব্যাপারেই কখনো কোনও অসুবিধা হয়নি। মাসে মাসে আমি একটা হাতখরচের টাকা পেতাম প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে। ধরে নিয়েছিলাম সেটা হয়ত ভাইয়াই ঠিক করে দিয়ে গেছে।
ভার্সিটির কোচিং নিয়েও ভাবতে হয়নি আমাকে। যে কয়দিন কোচিং করেছি আমি সেই স্কুল কাম কলেজের হোস্টেলেই ছিলাম। পরে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পরে হোস্টেল ছেড়ে চলে আসি। ওহ হ্যাঁ, আসার আগে আমার একাউন্টে প্রিন্সিপাল স্যারই কিছু টাকা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সম্ভবত এই টাকাটা ভাইয়া আগে দিয়ে গিয়েছিল উনাকে। আমি স্যারকে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতাম। উনি কিছু বলতে পারতেন না। ভাইয়া ততদিনে আমার সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।’

‘ভার্সিটিতে কীভাবে খরচ চালাতে? মাত্র ঐ কয়েকটা টাকায় নিশ্চয়ই চলত না তোমার!’

‘আমি ততদিনে নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছি! কয়েকটা টিউশনি করতাম। আর পাশ করেই চাকরিও ফট করেই জুটে গেল। আমরা ছিলাম কম্পিউটার সায়েন্সের প্রথমদিকের ব্যাচ। তাই চাকরি পেতে বেশি ঝামেলা হয়নি। ভাইয়া নিজেকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। আমিও তাই অনেকটা অভিমান করেই ভাইয়ার কাছে থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছি। কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে তার সাথে যোগাযোগ রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু ভাইয়ার সাথে তার যোগাযোগ থাকতে পারে ভেবে আমি এই কাজটাও করিনি। কেমন জানি একটা অভিমান জন্মে গিয়েছিল মনের মধ্যে। এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে যোগাযোগ না রেখে! কী হতো আর?’

শাকিল উশখুশ করে বলল, ‘ইয়ে গল্পসল্প তো হলো। এবারে চা খাওয়া যেতে পারে। কী বলো মা?’

আমি বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। শাকিল সেটা লক্ষ করে বলল, ‘কী তুমি কি কোথায় যাবা নাকি? চাইলে আজকে রাতটা এখানে থেকে যেতে পারো!’

আমি একটু অবাক হয়েই ওর দিকে তাকালাম। আজকের রাতটা এখানে থেকে যাব এটা কি এখনও বোঝাতে পারিনি নাকি? এতদিন পরে নিজের দাদাবাড়িতে নাটকীয় ভাবে হাজির হয়েছি। একটা রাত থেকে যাওয়ারও কি অধিকার নেই আমার? নাকি আমার মৃত দাদা কবর থেকে উঠে এসে আমাকে থাকতে দেওয়ার অপরাধে আমার চাচার বংশধরদের ত্যজ্য করবে? মনটা কেন যেন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। চিন্তা করলাম, রায়হান চলে এলেই আমিও খুব তাড়াতাড়িই এই বাড়ি ছাড়ব। কী দরকার শুধু শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে বসে থাকার?

তবেঁ আমাকে কিছু বলতে হলো না। চাচিই মুখ খুললেন। শাকিলের কথার সুর ধরে অবাক গলায় বললেন, ‘ওমা সে কী কথা? আজ থেকে যাবে মানে? আজকে তো থাকবেই! আর ওর বন্ধু… মানে তোর বন্ধু সজল আসছে না? আচ্ছা ভালো কথা। একজন মানুষের দুটো নাম কীভাবে হয়?’

আমি কিছু বললাম না। এই ধাঁধা তো রায়হান ছাড়া কেউ সমাধান করতে পারবে না। কাজেই চুপ থাকাই ভালো।

বৈকালিক আড্ডা শেষে চাচী এই বিশাল বাড়ি ঘুরে দেখাতে চাইলেন। আমার কিছু ভালো লাগছিল না। এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। চাচি বুঝতে পেরে আমাকে কাছে টেনে বললেন, ‘পিতৃপুরুষের ওপরে রাগ ধরে রেখে কী করবে? তাদের হিসাবনিকাশ তারা বুঝবে। তুমি বরং দেখো, কোথায় তোমার বাবা থাকতেন। কোন ঘরে পড়ালেখা করতেন।
বলতে বলতেই ঘরগুলো ঘুরে দেখাতে শুরু করেছেন তিনি। আমিও একসময় নিজের পিতৃপুরুষদের অতীত দিনগুলোর মধ্যে কখন যেন ঢুকে পড়েছি! একসময় এই বিশাল বাড়িতে আমারও পদচিহ্ন থাকতে পারত… মনে মনে এসব কথা ভাবছি আর তিনতলার করিডোর দিয়ে হেঁটে চলেছি। চাচী আপনমনে প্রতিটা ঘরের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। কোন ঘরে কে থাকত… আমার সেইসব চাচা ফুপুরা এখন কে কোথায় আছেন, এইসব। শুনতে শুনতে একটু যেন বর্তমান থেকে সরেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর যেন ভেসে এলো বাতাসে। আমি এদিকে সেদিকে তাকাতেই দেখি, নীচে সদর দরজার বাইরে শাকিল আর রায়হান কথা বলছে। চাচী যখন আমাকে ওপরে নিয়ে এসেছেন, শাকিল কোন ফাঁকে যে অন্যখানে সরে গেছে বুঝতে পারিনি। রায়হানকে দেখে খুশি হয়ে উঠে ডাকতে যাব, হঠাৎ কী ভেবে একটু থমকে গেলাম!

রায়হান আর শাকিলকে একটু যেন উষ্ণ মনে হচ্ছে। দুজনের মধ্যে খুব যেন একটা মধুর বাক্য যে বিনিময় হচ্ছে না সেটা দূর থেকেই বুঝতে পারছি। আমি নিজের অজান্তেই চুপ করে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি চাচি তখনো আপনমনেই আমার পূর্বপুরুষদের নানারকম গল্প বয়ান করে চলেছেন। আমার চোখের দৃষ্টির ওঠানামা তার নজরে আসেনি দেখে স্বস্তি পেলাম। চাচী মানুষটাকে আমার বেশ ভালো লেগে গেছে। ভদ্রমহিলার ভেতরটা যেন স্বচ্ছ এক স্ফটিকবাড়ি। বাহির থেকেই তার সবটুকু শুদ্ধতা চোখে পড়ে।

আমি মনে মনে অন্য এক অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করলাম। কখন রায়হানের সাথে কথা বলে এই ধাঁধার সমাধান করব, সেই অপেক্ষায় বসে আছি কখন থেকে। এখন চোখের সামনে ওকে দেখে আমার আর পূর্বপুরুষের গল্পগাঁথা কান দিয়ে ঢুকতে পারছে না।

হঠাৎ নীচের আওয়াজটা বেশ জোরে শোনা গেল। এতটাই জোরে যে, চাচীও বারান্দার রেলিং এর কাছে এসে নীচে তাকালেন। শাকিল আর রায়হানকে দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটাই কি তোমার বন্ধু সেই রায়হান ছেলেটা নাকি? আমি তো ওকে এই বাসায় দেখেছি বলে মনে পড়ছে না! শাকিল নীচে কী করছে? ওকে ওপরে কেন নিয়ে আসছে না?’

এই বলে চাচি বেশ জোরে করে এক হাঁকই দিয়ে বসলেন। ‘এ্যাই শাকিল, তোরা নীচে কী করছিস? ওকে ওপরে নিয়ে আয়!’

শাকিল আর রায়হান চমকে ওপরে তাকালো। দূর থেকেও বুঝতে পারলাম, শাকিলের মুখ কেমন জানি থমথম করছে। রায়হানের অভিব্যক্তি ভালো বুঝতে পারলাম না। রায়হান আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। আমিও হাত নাড়লাম। মনে মনে তখন নানারকম হিসাবনিকাশ করে চলেছি। শাকিল এত গম্ভীর হয়ে গেল কেন রায়হানকে দেখে? ব্যাপারটা কী?

ওদের দুজনকে ড্রইংরুমের দিকে এগুতে দেখে আমরাও সেইদিকেই হাঁটতে লাগলাম।
চাচীর সাথে রায়হানের আলাপ পর্ব শেষ হওয়ার পরে অবশেষে আমি রায়হানের মুখোমুখি হওয়ার প্রথম সুযোগেই বললাম, ‘কী ব্যাপার বলো দেখি রায়হান! তুমি তো আমাকে বেশ একটা নাটকের মধ্যে এনে ফেলে দিয়েছ?’

রায়হানের মুখে অল্প অল্প হাসি। পাশে তাকিয়ে দেখি শাকিল তখনো কেমন জানি থম মেরে আছে। আমি ঘটনার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। চাচীও অবাকচোখে নিজের ছেলের ভাবসাব লক্ষ করছেন। মায়ের কাছে থেকে তো ছেলের মনের ভাব লুকানো এত সহজ ব্যাপার না। কিছু একটা ঝড়ের পূর্বাভাষ বুঝি পেয়েই গেলেন তিনি।

রায়হান মুখের হাসি হাসি ভাব না লুকিয়ে বলল, ‘পুরো নাটকের জন্য তোমার যতটা হেনস্থা হতে হলো এর জন্য আমিইই দায়ই। কাজেই প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি করজোড়ে। আর তোমার জন্য আমি রায়হান হলেও বন্ধু শাকিলের কাছে আমি হচ্ছি সজল। এটা খুব জটিল রহস্য নয়। শাকিল আমার ভার্সিটি জীবনের বন্ধু আর তুমি কর্মক্ষেত্রের। ভার্সিটির বন্ধুর কাছে আমার ডাক নামটাই বেশি প্রচলিত। আমার পুরো নাম রায়হানুল মাসুদ সজল।‘

এমনটাই আমার কাছেও মনে হয়েছিল। আচ্ছা সে যাক। নামে কী বা আসে যায়! বললাম, ‘এখন শিগগির বলো, নিজের বিয়ের দাওয়াতের কথা বলে আমার চাচাত ভাইয়ের বিয়েতে কেন হাজির করলা আমাকে? তোমার উদ্দেশ্যটা কী?’

‘উদ্দেশ্য বড় নেক বন্ধু। তোমাকে বিপদে ফেলার কোনও ইরাদাই আমার নাই!’ রায়হান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল। বললাম, ‘বেশ সেই নেক ইরাদার গল্পটাই শুনি তবে!’

শাকিলের দিকে একটা কটাক্ষ হেনে রায়হান বলল, ‘কী বলব নাকি শাকিল?’

প্রশ্নটা শুনে শাকিল কেমন জানি অপ্রস্তুত হয়ে গেল একেবারে। আমিও রীতিমত অপ্রস্তুত। চাচীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনিও কী ঘটছে আগামাথা বুঝতে পারছেন না।

রায়হান বলতে শুরু করল, ‘প্রথমেই আমি খালাম্মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। হয়ত যা বলব, আপনার শুনে খারাপ লাগবে। কারণ আমি জানতাম, যা এখন বলব আপনি সেসবের কিছু জানেন না।

শাকিল আর আমি ইউনিভার্সিটির বন্ধু আগেই বলেছি। শাকিল মানিকগঞ্জেই এটাসেটা ব্যবসাপাতি করতে লাগল। আর আমি ওদিকে ঢাকায় চাকরি করি। সেখানেই আমার মাহমুদের সাথে দেখা হয়, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মাহমুদের সাথে আমার পরিচয় বছরখানেকের বেশি না। আমি ওর ব্যাপারে তেমন বেশি কিছু জানতাম না। ধীরে ধীরে আমরা অনেক কিছু গল্প করলেও কেন যেন নিজের পরিবার নিয়ে মাহমুদ বেশি কিছু বলত না। একদিন মাহমুদ অফিসে এসেছিল না। শুনলাম ওর জ্বর হয়েছে। আমি ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার আশায় কী মনে ওর বাসায় গিয়ে ঢুঁ মারি। দেখলাম ছোট্ট বাসা। বাসায় আর কেউ নেই। ওর ছোট্ট বেডরুমের সাইড টেবিলে কয়েকটা ছবি দেখলাম। ফটোস্ট্যান্ডে রাখা। মাহমুদ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ওর জগতে এদেরই একসময় অস্তিত্ব ছিল। একটা ছবিতে মাহমুদ বেশ ছোট, ওর ভাইয়ের সাথে। বাকি দুটো ছবিতে মাহমুদ একেবারেই নাবালক শিশু। সাথে ওর মা-বাবা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আর সেদিন থেকে নিজেরই অজান্তে মাহমুদের প্রতি আরও বেশী মমতা অনুভব করতে শুরু করলাম।

ওদিকে শাকিলের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত তেমন একটা না হলেও ফোনে আমাদের প্রায়ই কথাবার্তা হতো। ওর ব্যবসাবাণিজ্যের খবর নিতাম। শাকিল আশার কথা বলত না। ওর কাছে শুনতাম ব্যবসায় খালি মন্দাই যাচ্ছে। কিছুতেই সুবিধা করে উঠতে পারছে না। মানিকগঞ্জে ওদের মস্ত বাড়ির খবর জানতাম আমি। শাকিলই আমাকে বলেছিল। সেই বাড়ির প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলেই আরও বেশি নিরাশা দেখাত সবসময়। বলত, দূর কীসের বাড়ি! নামেই মহল! এদিকে এদিক ওদিক থেকে চুন সুরকি খসে খসে পড়ছে। এই বাড়ি নিলামে তুললেও দুই তিন লাখ পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ!

গত জুনে আমাদের একটা গেট টুগেদার হয় ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের। সেখানেই বহুদিন পরে শাকিলের সাথে আবার দেখা হয়। তারপর ঘটনাচক্রে গত পাঁচ মাসে আমাদের আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে। একেবারে কাকতালীয় না সেই দেখা হওয়াটা। আর সেটাই হচ্ছে মূল গল্প।’

এই পর্যন্ত বলে রায়হান থামল। ঘরের মধ্যে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। শাকিলের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চাচীর মুখেও কিছু একটা আশংকার ছায়া। মায়ের মন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা অমংগলের আভাষ পেয়ে গেছে। একমাত্র আমিই গল্পের শেষটুকু জানার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করে মরছি। এই সামান্য বিরতিটুকুও আমার সইলো না। অধীর হয়ে বললাম, ‘আহা তারপর কী হলো বলো শিগগির!’

‘বলছি বলছি। শাকিলের সাথে গেট টুগেদারের পরের মাসেই দেখা হয় আবার। ও ফোন করে আমার বাসার ঠিকানা নেয়। বলে, এক রাত থাকতে চায় আমার বাসায়। বন্ধু থাকবে শুনে খুশিমনেই রাজি হলাম। সেই রাতে দুই বন্ধু অনেক রাত জেগে গল্পগুজব করলাম। শাকিল ওর দাদাবাড়ির গল্প একটু একটু করে প্রায় পুরোটাই আমাকে শোনালো। জানতে পারলাম ওর এক কীর্তিমান চাচার গল্প, যার আবিষ্কারের পেটেন্ট কিনে নিয়েছে আমেরিকান একটা ইন্সটিটিউট। এটা শুনে খুব ভালো লাগল। এমন একটা গৌরবের বিষয় তো জনে জনে বলে বেড়াবার মতো জিনিস।

শাকিল জানালো তার চাচার এই পেটেন্ট বিক্রির অর্থ তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে প্রতিমাসে চলে যায়। কিন্তু এই মাস থেকে সেটি আর যাবে না। কারণ চাচাত ভাই নাকি সেই অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অস্বীকৃতি জানিয়ে একটা চিঠি এই মানিকগঞ্জের ঠিকানাতে পাঠিইয়েছে তার চাচাতো ভাই। কিন্তু সেই চিঠি অন্য কারও হাতে আসার আগেই শাকিলের হস্তগত হয়েছে এবং সে ঐ চিঠির কথা বেমালুম চেপে গেছে সবার কাছে।’

‘কী বলছ তুমি এসব?’ এবারে মুখ খুললেন চাচী স্বয়ং। আমি উত্তেজনায় নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছি যেন।
রায়হান বলে চললো, ‘হ্যাঁ খালাম্মা আমি একটুও মিথ্যে কথা বলছি না। চিঠিটা শাকিল আমাকে পড়তেও দিয়েছিল। সেই চিঠি পড়ে জানতে পেরেছি, তার চাচাতো ভাই যিনি এখন কুয়েতে থাকেন তার গত দুইমাস আগে হার্টের অসুখ ধরা পড়ে। প্রায় নব্বই ভাগ ব্লকেজ। সেই দেশে তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। অনেক টাকা পয়সা বেরিয়ে গেলেও তার মধ্যে নিজের অতীত পাপের জন্য অনুশোচনা জেগে ওঠে। তিনি নিজের ছোটভাইকে বঞ্চিত করে যে অর্থ নিজে এতদিন ধরে ভোগ করে আসছেন, সেই অর্থ তিনি এখন থেকে তার ভাইয়ের জন্য দিতে চান। কিন্তু অভিমানী ভাই তার সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে আর সেটার জন্যও নাকি তিনিই দায়ী। টাকা আত্মসাৎ করার জন্য তিনিই ভাইয়ের সাথে প্রথমে যোগাযোগ বন্ধ করেছিলেন। এখন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগের সবরকম সূত্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এজন্যই চিঠিটা তিনি মানিকগঞ্জের ঠিকানাতে পাঠিয়েছেন যাতে তার চাচা চাচি বিষয়টা জানতে পারেন এবং সম্ভব হলে তার ছোটভাইকে খোঁজ করে তার প্রাপ্য অংশ তাকে যেন বুঝে দেয়। এই ভার তিনি নাকি আর বহন করতে পারছেন না। নিজের অসুস্থতার জন্যও তিনি এই পাপকেই মনে মনে দায়ী করছেন।

চিঠির সাথে একটা ছবি ছিল। ঠিক এই ছবিটাই। আমি সেই ছবি দেখে একেবারে আমূল চমকে উঠি। আরে এই ছবিই তো আমার বন্ধু মাহমুদের বাসাতে দেখেছিলাম! কিন্তু আমি বিষয়টা শাকিলকে বুঝতে দিই না।

শাকিল প্রতিমাসে ঢাকায় এসে পেটেন্ট বিক্রির টাকা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। আমার সাথে মাঝে মাঝে দেখা করে। খুব ফুরফুরে দেখি শাকিলকে। এদিকে আমি মাহমুদকেও কিছুই বলতে পারি না। কারণ কী বলব, কীভাবে বলব …মনে মনে ভেবেই কূলকিনারা করে উঠতে পারি না।

এর মাঝেই একদিন সুযোগ এসে যায়। শাকিল ফোন করে জানায় সে বিয়ে করছে। আমিও মনে মনে এই নীলনকশা এঁকে ফেলি। কোনোভাবে খোদ মাহমুদকেই এখানে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও সময়মত হাজির হয়ে যাব। তারপর সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ সবকিছু কবুল করানো হয়ে যাবে। আর ওহ হ্যাঁ, খালাম্মার ব্যাপারে শাকিলই আমাকে আগে থেকে জানিয়েছিল। আপনি যে অনেক সৎ আর উদার একজন মানুষ এটা নিয়ে শাকিলের খেদের অন্ত নাই। আপনি জানতে পারলে যে শাকিলের এই কুৎসিত প্ল্যান কামিয়াব হবে না এটা সে ভালোমতোই জানত।

আমি জানতাম মাহমুদ এখানে এলে কোনো না কোনভাবে জানতে পারত সবকিছু। শাকিল বলেছিল, চিঠির সাথে জুড়ে দেওয়া ওই ছবিটা ওদের বাসাতেও আছে। শাকিলের বাবাই নাকি ছবিটা তুলেছিলেন। কাজেই একবার এই ছবি সামনে এলেই সত্যিও আপনাআপনি সামনে চলে আসতে বাধ্য! তাই এই ছোট্ট নাটকটুকু করেছিলাম। নইলে এভাবে হয়ত মাহমুদকে এখানে আনতে পারতাম না আমি!’

রায়হান থামল। আমার মনে হলো একটা দমকা বাতাস যেন শো শো শব্দে প্রবাহিত হয়ে সবকিছু একেবারে এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল।

চাচির দিকে তাকাতে পারছি না। ছেলের কুকীর্তি জানতে পেরে বেচারি একেবারে চুপসে গেছে রীতিমত। আর শাকিল মুখেচোখে ক্রুদ্ধ একটা ভাব ফুটিয়ে তুলেছে এবারে। দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, ‘তোর কথার কী প্রমাণ আছে? তুই যে সত্য বলছিস এই কথা কে বিশ্বাস করবে?’

চাচী এবারে একইরকম ভাবে গর্জন করে উঠলেন।
‘মুখ সামলে কথা বল শাকিল! আমি ভাবতে পারছি না আমি তোকে জন্ম দিয়েছি! কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম, বংশের ধারা যাবে কোথায়? টাকার লোভ তোর বাবা হয়ত বহুকষ্টে ছেড়েছিলেন! কিন্তু তুই পারলি না! নিজের পুর্বপুরুষের নাম উজ্জ্বল করেই ছাড়লি!’

এরপরের গল্প আর সবিস্তারে না বলি। আমি আর রায়হান দুজনেই তখন ঐ বাসা ছাড়তে পারলে বেঁচে যাই। চাচী অনেক বলে কয়ে রাতটুকু থাকতে রাজি করাতে পারলেন। সকাল হতেই দুই বন্ধু ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চৌধুরী ভিলা ছাড়লাম। রাতেই চাচি শাকিলকে দিয়ে আমার বাবার আবিষ্কারের পেটেন্ট বিক্রির সব কাগজপত্র আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। বারবার আমার হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন আর নিজের ছেলেকে ক্ষমা করতে বললেন। চাচিকে আশ্বস্ত করলাম। তবে শাকিল কিন্তু একবারও নিজের ট্যাবু ভেঙে আমার কাছে ক্ষমা চাইল না।

না চাইলে না চাক। আমি অনেকদিন পরে নিজের বড়ভাইকে ফিরে পেয়ে মহাখুশি। কে জানে ফাহাদ দাদা কেমন আছে এখন? বাসে উঠে বললাম, ‘এই রে একটা ভুল হয়ে গেল রায়হান! ফাহাদদার ঠিকানাটা তো নেওয়া হলো না!’

রায়হান হাসিমুখে বলল, ‘ও নিয়ে ভেবো না তুমি! আমি সেটা আগেই নিয়ে রেখেছি শাকিলের কাছ থেকে। ঢাকায় গিয়েই যোগাযোগ করো ভাইয়ের সাথে।’

খুশিতে মনটা ভরে গেল। জীবন থেকে কত কিছুই তো হারিয়ে ফেলেছি! তবু কতকিছুই তো না চাইতেই পেয়েও গেছি! সেই প্রাপ্তির হিসেবটুকু করেছি কি কখনও? কে জানত রায়হানের মতো এমন একজন বন্ধু জুটে যাবে জীবনে! অবহেলায় অতি অনাদরে লালিত একটি সাদামাটা বন্ধুত্ব আমার জীবনের মোড়কে এভাবে ঘুরিয়ে দিবে এটা কি কখনও কল্পনা করতে পেরেছিলাম?

আমার অজান্তেই এসব প্রাপ্তি কখন জানি চুপিসারে জমা হয়েছে মুঠোতে। অবেলার পুষ্প হয়ে তারা ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাবে বাকীটা জীবন! (সমাপ্ত)

#ফাহ্‌মিদা_বার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here