#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৬
আরফা, মেহরাব আর মুজাহিদ খান বসে আছে অফিসের কনফারেন্স রুমে। তাদের সামনে বসে আছে দেশের বড় বড় সব নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক, নিউজ পেপারের লোকজন আরো অনেকে। আরফা চোখ গোলগোল করে সব দেখছে। এখানে কী হতে চলেছে সে কিছুই জানে না। মেহরাব তাকে সাথে নিয়ে এসেছে আর বলেছে চুপ করে থাকতে যা বলার মেহরাব নিজেই বলবে সে যেনো একটা টু শব্দ না করে। আরফাও তাই বসে আছে পুতুলের মতো। আর সাংবাদিকরা গুনগুন করছে।
নিরবতা ভেঙে মেহরাব বললো, এবার জিজ্ঞেস করুন কার কী প্রশ্ন আছে।
একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলো, স্যার ডক্টর আরফার সাথে আপনার কী সম্পর্ক ?
মেহরাব কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বললো, She is my girlfriend & would be wife also.
মেহরাবের উত্তর শুনে সবার আগে বিস্ফুরিত চোখে তাকালো আরফা। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষ্ময়কর কথা কেবল শুনলো সে। সে কারো প্রেমিকা এবং হবু স্ত্রী এটা সে নিজেই জানে না। মেহরাবের উত্তরে পুরো রুমে হইচই বেঁধে গেছে। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে মনে হচ্ছে।
এর মধ্যে একজন প্রশ্ন করলো, কিন্তু স্যার আপনি তো মাত্র কয়েক দিন মানে এক মাসের মতো হলো এদেশে এসেছেন। সত্যি কী মিস আরফা আপনার হবু স্ত্রী নাকি পরিস্থিতি সামলাতে এটা বলছেন ?
মেহরাব রেগে বললো, এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়িনি যার জন্য আমাকে মিথ্যা বলতে হবে। আরফার সাথে আমার পরিচয় এ দেশে আসার পূর্বে থেকে। মূলত আরফার জন্যই আমি দেশে ফিরেছি। আমার প্রথম উত্তরেই আশা করি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর আপনারা পেয়েছেন। এবার আমি কিছু প্রশ্ন করি আপনাদের তার উত্তর দিন আপনারা।
মেহরাবের এ কথা শুনে সবাই অবাক হলেও কিছু বললো না। মেহরাবের উত্তর শুনে তারা আর কিছু বলারও পাচ্ছে না।
মেহরাব একটা নিউজ পেপার হাতে নিয়ে পড়ে বললো, নিজের ক্যারিয়ার গুছাতে হসপিটালের ওনারের সাথে নিউ ডক্টরের অবৈধ সম্পর্ক।
যে নিউজ ছাপিয়েছে তাকে দাড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে আরফার সাথে আমার অবৈধ সম্পর্কের ?
লোকটা মাথা নিচু করে বললো, নাহ কিন্তু ছবিটা।
মেহরাব এবার ছাপানো ছবির দিকে তাকালো। আরফা অজ্ঞান থাকায় ওকে কোলে করে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলো মেহরাব তখন কেউ তুলেছে আড়াল থেকে।
এটা দেখে মেহরাব ছবিটা সবার দিকে করে বললো, আরফাকে নিয়ে গতকাল লং-ড্রাইভে গিয়েছিলাম। আরফা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরে আর অজ্ঞান হয়ে যায় এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ফার্মহাউস কাছে ছিলো তাই বাধ্য হয়ে ফার্ম হাউসে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর আপনারা নিশ্চয়ই অসুস্থ কোনো মানুষকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবেন না আর সে যদি হবু স্ত্রী হয় তাহলে তো কোনো কথায় থাকে না। এখানে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আরফা সেন্সলেস তবু নেগেটিভ মানে বের করেছেন।
এবার সবাই চুপ করে গেলো। আরফা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেহরাবের দিকে। এতোটাই অবাক হয়েছে কী রিয়াকশন দেবে তাও ভুলে গেছে। মেহরাবের দাদাজানও বেশ অবাক কারণ মেহরাব যেভাবে বলছে মনে হচ্ছে সব সত্যি। যদিও অনেকটাই সত্যি আর কিছুটা মিথ্যা।
হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করলো, মিস আরফা যদি আপনার গার্লফ্রেন্ড এবং হবু স্ত্রী হয় তাহলে আপনার সাথে যাওয়া সত্ত্বেও মিস আরফার মা থানায় মিসিং কমপ্লেইন্ট কেনো করেছেন ?
মেহরাব বললো, একটা বিষয় নিয়ে আরফা গতকাল আমার ওপর রেগে ছিলো। ওর রাগ ভাঙাতেই লং-ড্রাইভে নিয়ে গিয়েছিলাম জোর করে, তাই ওর মাকে জানানোর সুযোগ পায়নি। পরে জানাতে গেলে দেখে ওর ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে আর তারাহুরোয় আমি ফোন হসপিটালে আমার কেবিনে ফেলে এসেছিলাম। বাসায় ফেরার আগেই আরফা অসুস্থ হয়ে পরে তাই জানানোই হয়ে উঠেনি।
মেহরাবকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে যে প্রশ্ন করা হচ্ছে সব প্রশ্নের উত্তর যেনো আগে থেকেই আছে তার কাছে। কোন প্রশ্ন করে সুবিধা করতে পারছে না তারা।
সব প্রশ্নের উত্তর শেষে মেহরাব এবার রেগে বললো, আপনাদের সাহস হলো কীভাবে হলো কোনো রকম প্রমাণ ছাড়া আজেবাজে নিউজ টেলিকাস্ট করার ? সাহস কোথায় পেলেন আপনারা এভাবে আমাদের অপদস্ত করার৷ আমি প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেল এবং নিউজপেপারের নামে মানহানীর মামলা করবো। ভুলভাল নিউজ করে মানুষকে হয়রানি করার সাহস কোথায় পান আমি দেখে নিবো।
এর মধ্যে একজন বললো, আপনার বলা সব যে সত্যি এটা কীভাবে মেনে নিবো ? এখন এসব বলে পরিস্থিতি সামলে হয়তো পরে কোনো ব্রেকাপের নাটক সাজাবেন।
এবার মেহরাব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। রাগে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, দুদিন মাত্র দুদিনের মধ্যে সারাদেশকে জানিয়ে বিয়ে হবে আরফা আর মেহরাবের। তখন বুঝতে পারবেন কী সত্যি আর কী মিথ্যা। কিন্তু আপনারা যা করেছেন তার ফল ভোগ করার জন্য রেডি হন। প্রত্যেকটা কোম্পানির এগেইনস্টে মানহানীর মামলা দায়ের করবো আমি। এখন আপনারা আসতে পারেন আমার অফিস থেকে।
আস্তে আস্তে সব বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। শুধু রয়ে গেলো আরফা, মেহরাব আর মুজাহিদ খান। সে একবার মেহরাবের মাথায় হাত রেখে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।
মেহরাব ক্লান্ত হয়ে টেবিলে মাথা রাখতেই এতোক্ষণ পুতুলের মতো বসে থাকা আরফা বললো, এটা কী করলেন আপনি আর কেনো করলেন ?
মেহরাব আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, যাতে তোমাকে ছাঁদে যেতে না হয় আত্নহত্যা করতে।
আরফা বললো, কিন্তু,,,
মেহরাব উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চলো বাসায় যাবে, তোমার মা চিন্তা করছে তোমার জন্য।
আরফা আর কিছু বলার আগেই মেহরাব বের হয়ে গেলো রুম থেকে।
টিভির সামনে বসে নিজের মাথা চেপে ধরে আছে ইশতিয়াক। মেহরাব খেলা এভাবে পাল্টে দিবে বুঝতেই পারেনি। এসব থেকে বের হতে আরফাকে বিয়ে করে নিবে এমন কিছু ইশতিয়াকের মাথাতেই আসেনি। ও ভেবেছিলো আরফা এসবের পর নিজেকে গুটিয়ে নেবে আর মেহরাব এটা থেকে বের হওয়ার আগেই নতুন কোনো ঝামেলায় ফেলবে তাকে। কিন্তু খেলা পুরো পাল্টে গেলো৷ ইশতিয়াক কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
মেহরাব আরফাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে খান ভিলায় চলে এলো। দাদাজান এখনো আসেনি তার অফিসে কিছু কাজ আছে। ড্রয়িংরুমে যেতেই পা থমকে গেলো মেহরাবের।
অস্ফুটস্বরে মেহরাব বললো, মম ?
ড্রয়িংরুমের সোফায় কপালে হাত রেখে বসে আছে মেহেক। এতোক্ষণ মেহরাবের সাক্ষাৎকার লাইভ টেলিকাস্ট করা হচ্ছিলো সেটাই দেখছিলো। আজ সকালেই বাংলাদেশে এসে পৌছেছে। যখন বাসায় আসে কেউ ছিলো না। কিন্তু এখানে তার জন্য এতোবড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো সে কল্পনাও করতে পারেনি। মেহরাব ধীর পায়ে মমের সামনে গিয়ে দাড়ালো। কারো উপস্থিতি অনুভব করে কপাল থেকে হাত সরিয়ে সামনে তাকালো মেহেক। এতোদিন পর ছেলেকে দেখে অশান্ত মনটা শান্ত হলেও মুখে গম্ভীর ভাব বজায় রাখলো।
মেহরাব বললো, মম তুমি এখানে ?
মেহেক শান্ত স্বরে বললো, অবাক হচ্ছো মনে হচ্ছে ?
মেহরাব সোফায় বসে বললো, তুমি হঠাৎ এখানে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক না কী ?
মেহেক বললো, অবাক তো আমি হচ্ছি। তুমি এখানে এসেছো মাত্র এক মাস হয়েছে আর তার মধ্যেই এতোকিছু ঘটিয়ে বসে আছো। আমি না এলে তো এসব জানতেই পারতাম না।
মেহরাব বললো, মম তুমি পুরোটা না জেনে,,,,
মেহেক মেহরাবের কথা শেষ হওয়ার আগেই বললো, মেয়েটাকে আমি দেখতে চাই। আগামীকাল মেয়েটাকে আমার সামনে নিয়ে আসবে।
মেহরাব বললো, মম আমার কথা,,,
বৌমা,,,,,
কারো আবেগ ভরা কন্ঠে বৌমা ডাক শুনে মেহরাব আর মেহেক দুজনেই সেদিকে ফিরে তাকালো। লাঠি ভড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুজাহিদ খান। চোখের কোণে পানির কণা চিকচিক করছে। এতোবছর পর শশুরকে দেখে মেহেকের চোখেও পানি চলে এলো। কতোই না চেষ্টা করেছে এভাবে একবার বৌমা ডাক শোনার জন্য। কখনো যাকে বৌমা মানেই নি তাকে আবার বৌমা ডাকবে নাকি৷ মুজাহিদ খান কখনো মেহেককে বৌমা বলে ডাকেনি তখন।
মেহেক একটু সময় থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বললো, আসসালামু আলাইকুম বাবা, কেমন আছেন আপনি ?
মুজাহিদ খান বললো, ওয়ালাইকুম আসসালাম।
মেহরাব দাদাজানকে সোফায় বসিয়ে দিলো তাকে দেখতে অনেক ক্লান্ত লাগছে।
সোফায় বসে বললো, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হতে যতটা ভালো থাকা যায় ঠিক ততটা ভালো আছি। এতোগুলো বছর ধরে একটু একটু করে পুড়ছি আমি। তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপরাধে। মাফ করে দে আমাকে মা, নাহলে মরেও যে শান্তি পাবো না।
মেহেক মুজাহিদ খানের সামনে ফ্লোরে বসে তার দু’হাত ধরে বললো, বাবা কখনো সন্তানের কাছে অপরাধী হয় না। ক্ষমা চেয়ে আমাকে অপরাধী বানাবেন না।
মুজাহিদ খান মেহেকের কথা শুনে হুহু করে কান্না করে দিলেন। সে তখন খাঁটি হিরা চিনতে পারেনি। আরো কিছু সময় চললো মান অভিমানের পালা শেষ হতে।
বাসায় ঢুকতেই আরফার গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তাইয়েবা বেগম। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে তার। এতবছর পর মেয়ের গায়ে হাত তুললো তাইয়েবা। আরফা অবাক হয়ে তাকালো মায়ের দিকে।
আরফা বিষ্ময়কর কণ্ঠে বললো, মা তুমি আমাকে মারলে ?
তাইয়েবা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, আজ এই দিন দেখার জন্য তোকে এতো কষ্ট করে মানুষ করেছিলাম আমি ?
আরফা বললো, মা তুমি আমার কথা শুনো।
তাইয়েবা আরফাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, সারাটা রাত আমার কীভাবে কেটেছে জানিস তুই। প্রত্যেকটা মিনিট একটা বছরের মতো মনে হয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত আতংকে কেটেছে আমার মেয়ে ঠিক আছে তো। আর তুই কিনা এসব করে বেড়িয়েছিস।
মা আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিলো। মেহরাব স্যার না বাঁচালে হয়তো এখন আমার লাশ নিয়ে কাঁদতে হতো তোমাকে। আর সে আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য একটা কাল্পনিক কাহিনী বানিয়ে বলেছে সবার কাছে, বিয়ে করতে চেয়েছে।
আরফার কথায় তাইয়েবার কথা বন্ধ হয়ে গেলো। গা থরথর করে কাঁপছে তার। মেয়েটাই যে শেষ সম্বল তার। মেয়ের কিছু হলে সে বাঁচবে কী করে ?
রুমের এক কোণায় হাটু মুড়ে বসে আছে আরফা। মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে তার জীবন আজ কোথা থেকে কোথায় এসে পৌছেছে। কীভাবে স্বামী হিসাবে মেনে নিবে মেহরাবকে ? ওর মনে তো এখনো রুমানের বসবাস। হয়তো রুমানকে কখনো গ্রহণ করতে পারবে না কিন্তু মন থেকেও তো সরাতে পারছে না। আরফার ফোনটা বেজে উঠলে সেদিকে তাকালো।
কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, বলতেই তো পারতে এখন তুমি অন্যকাউকে ভালোবাসো। শুধু শুধু কফিশপে নিয়ে অপমান না করলে হতো না ?
রুমানের গলা কানে আসতেই আরফা নিজের মুখ চেপে ধরলো ওড়না দিয়ে। আজ রুমানকে বলার মতো কোনো উত্তর আরফার কাছে নেই। চাইলে বলতে পারতো কিন্তু বললো না। রুমান আরো অনেক কিছু বলে ফোন রেখে দিলো। এদিকে মেহরাব কল দিয়ে আরফার ফোন বিজি পেলো। এতে মেহরাবের কপাল কুঁচকে গেলো।
মনে মনে ভাবলো, আমি তো এসব করার আগে একবারও আরফাকে জিজ্ঞেস করিনি তার জীবনে কেউ আছে কিনা। যদি আরফার জীবনে কেউ থেকে থাকে তাহলে কী হবে ?
চলবে,,,