অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ৯ +১০

0
476

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-০৯

খোলা আকাশের নিচে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে আয়ন্তিকা। চোখজোড়া বন্ধ তার। অধরের যুগলের মাঝে স্নান হাসি বিদ্যমান। ঠিক এমন এক চমৎকার দেখতে স্থানেই তো আসতে চেয়েছিলো সে! চোখ খুলে সামনে তাকাতে চারিপাশে অন্ধকারে নিমজ্জিত দেখে সে। তবুও যেন এক রকম প্রশান্তি আছে এতে। একমুঠো ভালোলাগা রয়েছে পূর্ণ রূপে।

অহর্নিশ আয়ন্তিকার হতে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। ইহান, সারা, অয়ন, নুশি তার পাশে বসে আড্ডাতে মশগুল। কিন্তু অহর্নিশের সেদিকে কোনো ধ্যান নেই, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে। ইহান তা খেয়াল করা মাত্রই টিটকারি মেরে বলল,

-‘ আমাগো অহর্নিশ যে দিনকে দিন বউ ছাড়া আর কিছুই বুঝতেছে না! কাহিনি কিন্তু ভালা না অয়ন।’

অহর্নিশ এবার সটান হয়ে বসলো।ইহানের বর্তমান বলা কথাটি তার মোটেও ভালো লাগেনি।ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে ও ইহানকে বলল,

-‘ থাপ্পড় চিনোস? ডাইরেক্ট কানের নিচে লাগাবো। ‘

তদ্রুপ অয়ন কথার মধ্যিখানে ফোড়ন কেটে বলল,

-‘ থাপ্পড় কেন? সত্যি কথা কইলেই দোষ না?’
-‘ কোনটা সত্যি কথা?’
-‘ এইযে, পিচ্চি বাচ্চা বউরে ছাড়া যে তুমি আর কিছুই বুঝো না দিন দিন। তা কি সত্যি না?’

ইহান উঠে এসে বসলো অহর্নিশের পাশে।শার্টের কলারে হাত লাগিয়ে নিয়ে একটু আধটু ঠিক করে নিলো। অতঃপর কর্কশ কন্ঠে বলল,

-‘ এই তোর শরম করে নারে? বুড়া হইয়া এতো ছোট মাইয়ারে বিয়া করস। ছিহ্! ‘

নীরবতা ভূমিকা পালন করা সারা এবার প্রশ্নোত্তর সুরে বলল,

-‘ কথা সেটা না গাইজ! কথা হচ্ছে, অহর্নিশ তুই সাফিয়া কে আঁটকে রেখেছিস কেনো? এটা যে মিডিয়া পর্যন্ত চলে গেছে জানিস? কেও যদি জানে তুই ওকে কিডন্যাপ করেছিস তাহলে তোকে ওরা জেলে পাঠাবে। বুঝতে পারছিস? ‘

অহর্নিশ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

-‘ আমাকে জেলে পাঠাবে?লাইক রিয়েলি?হাউ ফানি! সাফিয়া কে আঁটকে রাখার কোনো শখ নেই আমার মধ্যে। ঐ মেয়ে আয়ন্তিকা কে মেরে ফেলার প্লান করছিলো। ইমাজিন করতে পারছিস?জানে মেরে ফেলার ফাঁদ পাতছিলো ও। এতো সহজে ছেড়ে দিই কি করে?অহর্নিশের ব্যাক্তিগত সম্পদে হাত বাড়ানোর সাহস ঘুচিয়ে দিবো। পূর্ণ শাস্তি না দেয়া অব্দি ওকে ছাড়ছিনা আমি। ‘

এবার নুশি কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। হতাশার সুরে ও বলল,

-‘ ব্যাক্তিগত সম্পদ? হাহ্! আয়ন্তিকার প্রতি এতো পিরীতি দেখাইতেছিস যে? ভুলে যাসনা জাষ্ট একটা এগ্রিমেন্ট, একটা মিস্ট্রি সলভের জন্য তুই ওকে বিয়ে করেছিলি। এখন এসব আলগা পিরীতি দেখাস কিভাবে? ‘

সারা, অয়ন ইহান বিস্ফোরিত চাহনি নিয়ে নুশির দিকে দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে। বিষ্নয়কর চাহনি তাদের তিন জনের! একই সাথে তারা বলল, ‘হোয়াট? কি বলিস এসব?’

বন্ধুমহলের আড্ডা ছেড়ে তৎক্ষনাৎ উঠে চলে যায় অহর্নিশ। যাওয়ার আগে কড়া দৃষ্টিপাত সে নুশির দিকে স্থাপন করে গিয়েছে। তাতে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়েছে নুশি। মানুষ কতটা নিম্নমানের হতে পারে তা তার দেখা হ’য়ে গেছে। এক পর্যায়ে নুশিও কাওকে আর কিছু না বলে উঠে চলে যায়। ভালো লাগছে না তার কিছু। সবকিছু বিরক্তিকর, তিক্তময় লাগছে তার কাছে। তিক্ত কাঁটায় পূর্ণ চারিপাশ।

সারা, অয়ন, ইহান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বুঝলো না। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করার এক পর্যায়ে ইহান বলল,

-‘ কি ছিলো এটা? নুশি এইটা কি বলল?’
________________________

আশপাশ বেশ মনোযোগী দৃষ্টি দিয়ে গহীন চোখে পরখ করছিলো আয়ন্তিকা। ঠিক তখনি তার পাশে এসে দাঁড়ায় অহর্নিশ। অহর্নিশের চেহারা কালো করা। আঁধার নেমেছে যেনো। কি কারণে অহর্নিশ এমন চেহারা বানিয়ে রেখেছে? তা আয়ন্তিকার জানার ইচ্ছে জাগ্রত হলেও জিজ্ঞেস করার মতো অনুপ্রেরণা পেলোনা নিভৃত হতে! তাই সে চুপ রইল।সামনের দিকে পা যুগল ফেলে এগোতে নিতেই ‘উহ্’ করে উঠলো সে!

অহর্নিশের অস্থিরতা মিশ্রিত দৃষ্টি। ব্যাকুল কন্ঠে সে বলল,

-‘ আর ইউ ওকে?’

আয়ন্তিকা চোখ মুখ কুঁচকে ব্যাথা মিটিয়ে নেয়ার প্রয়াস চালায়। মুখ দিয়ে সে অস্ফুটস্বরে বলল,

-‘ ঠিক আছি আমি। কিছু হয়নি আমার। একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম জাষ্ট। ‘

অহর্নিশের অস্থির মন আয়ন্তিকার কথাটা গ্রহণ করতে পারলো না। তার বিশ্বাস হলো না। তাই সে নিচু হয়ে বসে পড়লো। আয়ন্তিকার পা টেনে দেখে এক নির্দিষ্ট জায়গাতে লালচে রূপ ধারণ করছে। কিছুটা দূরেই পড়ে আছে ইটের এক সুক্ষ্ম কোণা। সেই ছোট ইটের টুকরোটাই যে আয়ন্তিকার আঘাত পাওয়ার উৎস তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার।

অহর্নিশ এবার মাথা উঁচু করে দেখলো আয়ন্তিকা চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে পাশের বাশটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অহর্নিশ ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বলল,

-‘ ব্যাথা পাওনি তুমি তাই না?’

আয়ন্তিকার নিভৃতে হতে এবার শব্দফালি এলো
‘ধরা পড়ে গেছিস তুই আয়ন্তিকা। ‘ শুষ্ক ঢোক গিলে আয়ন্তিকা আমতা আমতা করে বলল,

-‘ ইয়ে মানে… পেয়েছি। অতোটা না। এখন ব্যাথা করছে না আর। আপনি প্লিজ পা ছাড়ুন। চারপাশে সবাই দেখছে। উঠে দাঁড়ান আপনি। ‘

অহর্নিশ উঠে দাঁড়ালো ঠিকই। তবে সে এবার আয়ন্তিকা কে চমকে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো। শক্ত করে জরীয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল সে।
আয়ন্তিকার বিষ্ময়কর দৃষ্টি। চমকিত পানে সে তাকিয়ে আছে অহর্নিশের মুখশ্রীর দিকে। অহর্নিশ সামনে আগায়। উদ্দেশ্য তার সামনের হোটেলটি। তারা যে স্থানটিতে এসেছিলো তার ঠিক পাঁচ মিনিট ব্যাবধানে একটা হোটেল রয়েছে। হোটেলটা মূলত পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বিশেষ করে তৈরি করা।

আয়ন্তিকা চারিপাশে তাকিয়ে ইতস্তত বোধ করে বলল,

-‘ সমস্যা কি আপনার? হুটহাট উদ্ভট কাজ করার রোগ আছে আপনার?’

অহর্নিশ আঁড়চোখে তাকায় আয়ন্তিকার দিকে। পরবর্তীতে সে সামনে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ এই পা নিয়ে তুমি হাঁটতে পারবে?’

-‘ পারবো না কেনো সেটা বলুন। অতি স্বল্প আঘাত ছিলো। এই আঘাতে হাঁটতে না পারার কি আছে?’

অহর্নিশ আয়ন্তিকার বলা বর্তমান কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলল না। আয়ন্তিকা কি বুঝবে তার মনের অবস্থা? এই পিচ্চি আয়ন্তিকার হালকা, অতি সামান্য আঘাত লাগলেও যে আজকাল অহর্নিশের পাগল পাগল লাগে। অনুভূত হয় সে নিজে আঘাত পেয়েছে। অথচ পলিটিক্স করার সুবাদে প্রায়ই একটু আধটু আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে সে।তখনকার ব্যাথাগুলো নিছকই তার কাছে নগ্ন মনে হয়। কিন্তু আয়ন্তিকার হাতে হালকা করে একটু গুতো লাগলেও তার কেমন অস্থির অস্থির লাগে।

প্রায় অনেকক্ষণ পর অহর্নিশ তার অধর যুগল প্রসারিত করে বলল,

-‘ দেখে চলতে পারো না? আজ সাবধানে চলাফেরা করলে তো এই আঘাত টা লাগতো না। যদিওবা বাচ্চা বলে কথা। টিনেজারদের কৌতূহল, ছটফট করার স্বভাবটা বেশিই থাকে। ‘

শেষোক্ত কথাটা কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বলল অহর্নিশ। আয়ন্তিকা অহর্নিশের মুখশ্রীর প্রতি গহীন চোখে তাকায়। সে এবার সাহস নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,

-‘ তো আমায় বিয়ে করেছেন কেনো হ্যা?অদ্ভুত! পূর্ণ বয়সের কাওকে বিয়ে করলেই পারতেন। বর্তমানে আপনাকে আমায় নিয়ে যে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাও করতে হতো না। অযথাই আমার মতো বাচ্চা কে বিয়ে করে এখন আমাকে খোঁটা দিচ্ছেন। ‘

আয়ন্তিকার কন্ঠস্বর খানিকটা উঁচু হওয়াতে আশপাশের কয়েকজন মানুষ তাদের দু’জনের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। এতে করে লজ্জায় পড়ে যায় আয়ন্তিকা। তার এখন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা এমন ফিলিং’স জাগছে মনে।

আয়ন্তিকার অবস্থা দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে দেয় অহর্নিশ। ডান ভ্রু উঁচু করে সে বলল,

-‘ পিচ্চি বাচ্চাকে বিয়ে করলে লাভ বেশি ইউ নো? এরা হয় জেলির মতো সফট! আদর করতে ইচ্ছে করে সর্বদা। টিনেজার হওয়াতে বেশিরভাগই ভীতু প্রকৃতির হয়। তাই তাদের কে নিজের আয়ত্তে রাখা যায়। বড়দের বিয়ে করলে লাভ নেই।এরা হ্যাজবেন্ড দের ভয় পায়না।নিজেদের মর্জিতে চলে। ধমকালে উল্টো ধমক দিয়ে বসে। যদিও সবাই না।কিছু কিছু! তবুও রিস্ক নেয়ার কোনো মানে হয়? তোমাকে বিয়ে করার মেইন কারণটা হচ্ছে তোমাকে দেখলেই জাষ্ট আদর করতে ইচ্ছে করে। এই যে কোলে নিয়েছি। আমার তো মনে হচ্ছে কোনো তুলতুলে বস্তু আমার কোলে। একটা চুমু খাই?’

আয়ন্তিকা কিংকর্তব্যবিমুঢ়!লাজুকলতা রূপ ধারণ করেছে সে। দুই ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ব্যাবধান তৈরি করে সে হা করে তাকিয়ে আছে অহর্নিশের দিকে। তার নিভৃত হতে বারংবার বলছে, এটা কে? অহর্নিশ তো? নাকি অহর্নিশ রূপে অন্য কেও? তবে আয়ন্তিকা নিশ্চিত হলো এই লোক অহর্নিশ হতেই পারে না। তার ভয়ংকর মানব তো ছিলো ভয়ংকর স্বভাবের। গাম্ভীর্যের অধিকারী। আর ইনি তো…

আয়ন্তিকা অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে বলল,

-‘ আপনি কে?আ..আপনি ঠি..ঠিক আছেন?’

স্ব- শব্দে হেঁসে দেয় অহর্নিশ। সে জানতো আয়ন্তিকা এমন কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করবে। প্রতুত্তরে অহর্নিশ বলল,

-‘ আমি তোমার একমাত্র হ্যান্ডসাম বর। ভুলে গেছো? পায়ে আঘাত পেয়ে সৃতিশক্তি চলে গেলো কিভাবে? স্ট্রেঞ্জ! ‘

আয়ন্তিকা থতমত খায়। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা অহর্নিশ। পদে পদে সে অহর্নিশ এর কথায় অবাকের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করছে। তৎক্ষনাৎ
আয়ন্তিকার মনে পড়লো সারার কথা। সারা বলেছিল অহর্নিশ হাস্যরসক মানুষ, গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাবের নয়। তবে কি তাই সত্যি? এতোদিন ভুল ধারণা নিয়ে ছিলো সে?

হাঁটার পথে অহর্নিশের অবলোকন হয় আয়ন্তিকার ওষ্ঠযুগল! বাঁকা হাসি দেয় সে। নিজের ইচ্ছে কেনো অপূর্ণ রাখবে? যেখানে এই পুরো মানুষটাই তার। টুপ করে জনমানবের দৃষ্টি এড়িয়ে লিফট এ উঠে সে আয়ন্তিকার খয়েরী বর্ণের ঠোঁটে শব্দ করে একটা চুমু খায়। প্রথম চুমু খেয়ে মাথা উঁচু করে খানিক বাদে ফের সে মাথা নিচু করে দ্বিতীয়বার একই কাজ করে। পরবর্তীতে অহর্নিশ সটান হয়ে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে নেয়। অদ্ভুতুরে হাসি তার অধর কোণে বহাল!

চলবে…

#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১০

-‘ আয়ন্তিকা কে তুই কি পছন্দ করিস অহর্নিশ?নুশি সেদিন কি বলেছিলো সেটা?এগ্রিমেন্ট, মিস্ট্রি সল’ভ হোয়াট ইজ দিজ?’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অহর্নিশ তাকায় অয়নের দিকে।অয়ন এর চোখমুখে চিন্তার ছাপ এঁটে সেঁটে আছে। অহর্নিশের উত্তর সম্পর্কে তার জানা আছে তবে সে আজ চাইছে একটু ভিন্নতা আসুক। সে যা ভাবছে তা না ঘটুক। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অহর্নিশ হাতের ফোন টেবলের ওপর শব্দ করে রেখে বলল,

-‘ এটা জানার জন্য আর্জেন্ট আসতে বলেছিস?দু মাস আগের কাহিনি এখন?’
-‘ হ্যা,ব্যাস্ত ছিলাম এতদিন। প্লিজ উত্তর দে অহর্নিশ। মিথ্যা বলবিনা। ‘

অহর্নিশ রেগে যায় কিছুটা। কর্কশ কন্ঠে উচ্চ স্বরে সে বলল,

-‘ তুই জানিস আমি কতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছি? ‘
-‘ আমি যার জন্য ডেকেছি তোকে সেটাও কিন্তু খুব বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। তুই জানিস সেটা! এবার উত্তর দে,’
-‘ না করিনা পছন্দ। কি কারণে ওর মতো মেয়েকে আমি পছন্দ করতে যাবো? এবার পেয়েছিস উত্তর? যাচ্ছি আমি! ‘

অহর্নিশ উঠতে নিলে অয়ন তাতে বাধা প্রদান করে। রাগান্বিত কন্ঠে সে বলল,

-‘ তাহলে ওকে বিয়ে করলি কেনো? কেনো আয়ন্তির জীবনটা নষ্ট করলি বল? তোর কি মেয়েদের কে ব্যাবহার্য বস্তু মনে হয়? নুশি সেই দুমাস আগে কিসের এগ্রিমেন্ট, মিস্ট্রি সলভের কথা বলছিলো? খুলে বল! ‘

অহর্নিশের ঠোঁট বাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। কপালের সামনে পরে থাকা চুলগুলো কে সে পিছন ঠেলে দিয়ে বলল,

-‘ বলতে বাধ্য নই! ‘

অয়ন রেগে গর্জে উঠে বলল,

-‘ অবশ্যই বাধ্য তুই। এভাবে একটা মেয়ের জীবন নিয়ে তুই খেলতে পারিস না। দোহাই লাগে বল। ‘

শেষোক্ত কথাটা আকুতির সুরে অয়ন বলার পর অহর্নিশ দমে যায়। সিদ্ধান্ত নেয় পুরো বিষয় খুলে বলার। আর কতদিনই বা এসব নিজের ভেতর চেপে রাখবে? একদিন না একদিন তো তাকে সব খোলাসা করতেই হবে। নিজের ভেতর চেপে রাখতে রাখতে সে অস্থির হয়ে পড়েছে।
শুষ্ক ঠোঁট যুগল সে জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে শীতলতা প্রদানের চেষ্টা করলো। থমথমে কন্ঠে বলল,

-‘ আয়ন্তিকা কে বিয়ে করার আমার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না অয়ন। সব করতে হয়েছে নানার জন্য। তাকে বাঁচানোর জন্য! ‘

অয়ন চমকে উঠলো প্রচন্ড। উত্তেজিত হয়ে বলল,

-‘ হোয়াট? পাগল হইছিস? তোর নানা তো মারা গেছে না? তুই-ই তো বললি। ‘

-‘ নানা মারা যায়নি। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, হটাৎ একদিন গায়েভ হয়ে যান তিনি। তারপর চার বছর পেড়িয়ে যাওয়ার পরও পুলিশ তার হদিস পায়নি। শেষে কোনো এক মাধ্যমে জানা যায় সে মারা গেছে। নানু বলেছিলো। তিনি জানতে পেরেছেন কোনোভাবে। আমাদের তখন নানুর কথাই মেনে নিতে হয়েছিলো। কারণ সে বলেছিল এ বিষয়ে যেনো আর কোনো কথা না হয়। নানুর ওপর তখন কেও কথা বলতে পারতো না। তাই সবাই চুপ ছিলো। আমিও ছিলাম না দেশে। ‘

-‘ তারপর? তোর নানা বাচলো কেমনে? বিয়ার সাথে সম্পর্ক কি ‘

অহর্নিশ লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

-‘ নানু বলছে নানা বেঁচে আছে।নানাকে আঁটকে রাখা হয়েছে। কারণ হিসেবে নানু বলেছে, নানা একটা উইল করেছিলেন। সম্পত্তির! সেখানে লিখা ছিলো জমিদার বাড়ির সকল সম্পত্তির ৬০% উত্তররাধীকারি হবে এই বংশের সন্তানের প্রথম সন্তানের নামে। তবে আরো কিছু রুলস ছিলো এতে, কাজিন এবং কাজিনের মধ্যে বিয়ে হতে হবে এবং তাদের বাচ্চাই মূলত ৬০% সম্পত্তির মালিক হবে। এমন অদ্ভুত উইল নানা কেনো করেছিলো জানা নেই। আমাদের জমিদার বংশে আয়ন্তিকা বাদে আর কোনো মেয়েই না। থাকলেও তার বয়স অতি স্বল্প। তাই আয়ন্তিকার সাথে নানু বিয়ে দিয়েছে। আমিও রাজি ছিলাম যেহেতু সব জানি। ‘

অয়ন কৌতূহল নিয়ে বলল,

-‘ তো? তোর নানার কিডন্যাপ হওয়ার সাথে এসবের কি সম্পর্ক? ‘

-‘ নানাকে যে আঁটকে রেখেছে সে আমার আর আয়ন্তিকার বাচ্চাটা চায়।বাচ্চাটা যেহেতু ৬০% সম্পত্তির মালিক হবে তাই তাদের সেই সম্পত্তি চাই। কিডন্যাপার’রা এতোটা চালাক পুলিশ কিংবা র্্যাব এদের কাছে কিডন্যাপ সম্পর্কে বলতে গেলে বুঝে যেতো। নানাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতো। আঘাত করে ছবি পাঠাতো।এ কারণেই আয়ন্তিকা কে বিয়ে করা। জাষ্ট এই মিস্ট্রি টা সল’ভ করার জন্য! কিডন্যাপার কারা জানিনা তবে আমার নানুমনিকে কেমন সন্দেহ হয়। ‘

-‘ আমারও সেইম মনে হচ্ছে। আর এগ্রিমেন্ট? ঐটার কি কাহিনি? ‘

অহর্নিশ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলল,

-‘ মাহির কে চিনিস?’

অয়ন কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে বলল,

-‘ তোর ফ্রেন্ড না? ‘
-‘ হু। ‘
-‘ তো ওর কথা হুট করে?’
-‘ কজ এগ্রিমেন্টের কাহিনি ওকে ঘিরেই। ‘
-‘ খুলে বল! ‘

অহর্নিশ থমথমে কন্ঠ ফের বলল,

-‘ প্রথম যেদিন মাহিরকে নিয়ে আমাদের গ্রামে ঘুরতে যাই তখন ও আয়ন্তিকা কে দেখে পছন্দ করে ফেলে। কিন্তু আয়ন্তিকা ওকে পাত্তা দেয়না।ও অনেক ভাবে চেষ্টা করছিলো আয়ন্তিকার এটেনশন পাওয়ার কিন্তু আয়ন্তিকা বরাবরই ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে। এটা যখন ও আমাকে বলল তখন আমি বলেছিলাম আয়ন্তিকা কে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে একমাত্র আমি পারবো। ও তৎক্ষনাৎ একটা এগ্রিমেন্ট তৈরি করে। যদি আমি আয়ন্তিকা কে নিজের প্রেমে ফালাতে পারি তাহলে ৫ কোটি টাকা দিবে।আর যদি আয়ন্তিকা আমার প্রেমে না পড়ে তাহলে ওকে রিটার্ন দিতে হবে ৫ কোটি! আমি রাজি হয়ে যাই যদিও টাকাতে ইন্টারেস্ট ছিলো না। ইন্টারেস্ট ছিলো আয়ন্তিকার প্রতি। ও তেমন কাওকেই পাত্তা দিতোনা।জেদ চেপেছিলো আমার। আমি ওকে নিজের প্রেমে ফালাবো, দ্যাট’স ইট! এছাড়া ওর জন্য আমার কোনো অনুভূতি নেই। যা করি সব ওকে উইক করার জন্য। ‘

পরাপর তিনটা থাপ্পড় মারে অয়ন অহর্নিশের গালে।রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে। চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। অয়ন উঁচু কন্ঠে বলল,

-‘ তুই কি জানিস অহর্নিশ তুই ঠিক কতোটা নিচে নেমে যাচ্ছিস। নানার কথাটা নিতে পারলাম বাট এগ্রিমেন্ট? ছিহ্! মানুষের জীবন কি তোর স্বস্তা মনে হয়? ‘

অহর্নিশ কিছু বলল না। অয়ন থাকতে পারছে না এখানে।অহর্নিশ ঠিক কতোটা নিম্নতর হয়ে গেছে তা ভাবতেই ওর লজ্জা লাগছে। অহর্নিশ খারাপ তা সে জানতো। খুব ভালো করে জানতো। কিন্তু এতোটা? একটা মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছে ও। আগে তো এমন ছিলো না। হটাৎ কি হলো এই ছেলের?

অয়ন আঙ্গুল অহর্নিশের দিকে তাক করে বলল,

-‘ যা করছিস না এখন?তারজন্য একদিন তোকে আফসোস করতে হবে। তার থেকে ভালো আগেই ঠিক হয়ে যায়। আর তুই যতোই বলিস আয়ন্তিকার প্রতি তোর কোনো অনুভূতি নেই। সেটা হবে মিথ্যা! অনুভূতি না শুধু ভালোবাসিস তুই ওকে। সময় থাকতে শুধরে যা, ‘

অয়ন বেড়িয়ে যায়। অহর্নিশ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে তপ্তশ্বাস ফেলে। নিজ রুম হতে বের হয়ে সে আয়ন্তিকার রুমে আসে। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আয়ন্তিকা ঘুমে! চুপিসারে এসে সে আয়ন্তিকার পাশে বসলো। কাঁপা একহাত আয়ন্তিকার গালে সন্তপর্ণে রেখে দিয়ে বলল,

-‘ আসলেই কি আমি তোমায় ভালোবাসি?উইক হয়ে যাচ্ছি তোমার প্রতি? কিন্তু উইক তো তোমার হওয়ার কথা ছিলো আমার প্রতি। উল্টোটা হচ্ছে বলে মন বলছে কেনো?’

.

শুভ্র সকালের আর্বিভাব ঘটেছে ক্ষনিক আগে। পূর্ব দিকে সূর্য মাত্রই তার আগমন বার্তা জানাচ্ছে।আসা মাত্রই চারিদিকে নিজের হলদেটে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। বহুক্ষণ আধারে নিমজ্জিত থাকা প্রকৃতি এখন আলোর বিলাসে মগ্ন। আরামের বিছানা ছেড়ে কাজের তাগিদে উঠে পড়ছে মানুষ।সেই যে দুই মিনিট ধরে আয়ন্তিকা চোখ খোলার প্রয়াস চালাচ্ছে তাতে সে বরাবরই ব্যার্থ হলো। ঘুম কড়াভাবে কাবু করে নিয়েছে তাকে। এত ঘুম কোথা থেকে উদয় হলো বুঝতে পারছে না সে। প্রতিদিন সূর্যের দেখা পৃথিবীতে মেলার আগেই সে উঠে পড়ত কিন্তু আজ..

পরিশেষে চোখ খুলে নেয় আয়ন্তিকা। আলসেমিতা ত্যাগ করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই পাশে তাকিয়ে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়! মাটিতে বসে থেকে মাথা বেডে এলিয়ে আয়ন্তিকার এক হাত আঁকড়ে ধরে অহর্নিশ ঘুমে বিভোর। আয়ন্তিকা তার চোখ যুগল বড়সড় করে তাকিয়ে আছে। এই লোক এখানে কেনো?এভাবে ঘুমিয়ে আছে কেনো? তার রুমে কখন আসলো? আয়ন্তিকা একটু বেশিই অবাক হয় অহর্নিশ কে নিজের রুমে দেখে। কারণ তাদের সংসার জীবনের পার হওয়া এই দুই মাসে অহর্নিশ কখনো আয়ন্তিকার রুমে আসেনি। শুধু রুমে কেনো সে কখনো আয়ন্তিকার রুমের পাশ দিয়ে অব্দি যায়নি।

আয়ন্তিকা হাত নাড়াচাড়া করলে অহর্নিশ বিরক্ত নিয়ে বলল,

-‘ উফফ… জান, নড়াচড়া করো না তো। ঘুমাতে দাও।’

আয়ন্তিকা কাঁদো কাঁদো চাহনিতে তাকিয়ে থাকে অহর্নিশের পানে। পরবর্তীতে সে কন্ঠস্বর গাঢ় করে বলল,

-‘ এইযে শুনছেন? এখানে ঘুমিয়েছেন কেনো? নিজ রুমে গিয়ে ঘুমান। আর আমার হাত ছাড়ুন। স্কুলে এক্সাম আছে আজ। লেট হয়ে যাচ্ছে। ‘

আয়ন্তিকার কন্ঠস্বর একটু বেশিই জোরে ছিলো।যার ফলস্বরূপ অহর্নিশ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চোখ ডলে সামনে তাকাতেই সে ইতস্তত বোধ করে। নিজ হাতের মুঠো হতে আয়ন্তিকার কোমল, তুলতুলে হাত টাকে মুক্ত করে দেয়। ভুলবশত কাল সে আয়ন্তিকা কে দেখতে দেখতে এখানেই মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুমের মাঝেই হয়ত আয়ন্তিকার হাত আঁকড়ে ধরেছিলো।

অহর্নিশ পরিস্থিতি সহ প্রশ্নগুলে এড়িয়ে যেতে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-‘ ফ্রেশ হও। রেডি হয়ে নিয়ে ডাইনিং এ আসো। তোমায় স্কুল দিয়ে আমি নিজের কাজ করতে যাবো।’
-‘ আমি কিছু জিজ্ঞেস… ‘

আয়ন্তিকা কে থামিয়ে দিয়ে অহর্নিশ ফিচেল কন্ঠে বলল,

-‘ বাধ্য নই উত্তর দিতে। ‘

অহর্নিশ চলে যায়। আয়ন্তিকা যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অভিমান জন্মে তার একটু,
তবে তৎক্ষনাৎ সে মাথা থেকে সকল কিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ২০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিয়ে এগোয় আয়ন্তিকা ডাইনিং রুমের উদ্দেশ্যে। ডাইনিং রুমে আসতে খেয়াল হয় অহর্নিশ প্লেটে খাবার সার্ভ করছে। ডান হাতের দুইটা আঙ্গুলে তার শুভ্র রাঙা ব্যান্ডেজ করা। ভ্রু কুঁচকে যায় তার। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে সে ব্যাকুল হয়ে বলল,

-‘ আপনার আঙ্গুলে কি হয়েছে? ‘
-‘ কেটে গিয়েছে। সবজি কাটার সময়। ‘
-‘ সবজি কেনো কাটতে গিয়েছেন? ‘
-‘ বাসায় আরকিছুই ছিলো না। আমি তা খেয়াল করিনি। তাই আজ সকালে আপাতত সবজি, ভাত দিয়েই ব্রেকফাস্ট করতে হবে। ‘

আয়ন্তিকার কষ্ট হয়। সে কি পারতো না এই জিনিসটার দিকে খেয়াল রাখতে? তাহলে তো এটলিষ্ট অহর্নিশের আঙ্গুল আহত হতো না। অহর্নিশ চেয়ার টেনে দিয়ে আয়ন্তিকা কে বসতে বলল। অতঃপর সে নিজেও পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে। ব্যান্ডেজ করার ফলে হাত দিয়ে ঠিকমতো খেতে পারছে না অহর্নিশ। তা দেখে আয়ন্তিকা সঙ্কোচ ফেলে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

-‘ আমি খাইয়ে দেই?’

অহর্নিশ মাথা তুলে আয়ন্তিকার দিকে দৃষ্টিপাত দেয়, আয়ন্তিকার কাঁপা হাত এবং অস্বস্তিজনিত মুখশ্রী দেখে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। তবে মুখে সে বলল,

-‘ দরকার নেই। নিজের খাওয়া শেষ করো। ‘

অতঃপর অহর্নিশ খাওয়ার চেষ্টা করলে আয়ন্তিকা তার প্লেট টেনে নিয়ে নিজের কাছে আনে। ভাত হাতে তুলে নিয়ে অহর্নিশের মুখের সামনে ধরলো। অহর্নিশ একবার ভাবলো কঠোর হয়ে ধমকে না করে দিবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে আয়ন্তিকার হাতে খাওয়ার লোভটা দমন করতে পারেনা। সন্তপর্ণে খাওয়া শুরু করে আয়ন্তিকার হাত থেকে। অনভিজ্ঞ হাতে খাওয়ার ফলস্বরূপ তার ঠোঁটের চারপাশে খাবার লেগে যাচ্ছে কিন্তু তবুও অহর্নিশের নিভৃতে প্রশান্তি অনুভূত হয়। কারণটা কি? অহর্নিশ তা খুঁজে পায়না। খাওয়ার এক পর্যায়ে আয়ন্তিকার একটা কথা শুনে অহর্নিশ বিষ্ফোরিত নয়নে তার পানে তাকায়। বিষম খেয়ে চমকে তাকিয়ে আছে সে!

চলবে…

#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here