অন্তর্দহন,পর্ব:৮+৯

0
1938

#অন্তর্দহন_৮
লেখায়- শেখ অলিন্দ্রিয়া রুহি

চন্দ্র তারকাবিহীন ম্লান আকাশ! বাতাসের তীব্রতা উল্লাসীকে ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে তুলছে। পাপন বলল,
-“জানালাটা লাগিয়ে দাও।”
উল্লাসী বাঁধ সাধলো,
-“থাক না, বাতাস ভালো লাগছে।”
বলে পাপনের কাঁধে মাথা রেখে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল সে। পাপন মৃদু হেসে একহাতে নিজের বাহুডোরে উল্লাসীকে পেঁচিয়ে নিয়ে সিটে হেলান দিয়ে মাথাটা রাখলো। বাস ছুটে চলেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। পৌঁছোতে চার ঘন্টার ন্যায় লাগতে পারে। অর্থাৎ একদম ভোর বেলা তারা ঢাকায় গিয়ে পৌঁছুবে।
-“আচ্ছা, তোমার কী ভয় লাগছে পাপন?” পাপনের মুখপানে চেয়ে প্রশ্ন করে উল্লাসী।
-“প্রথমে একটু লেগেছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি চাইলেই পারব।”
-“তুমি তো কখনো কোনো কাজ করোনি পাপন। বাবার হোটেলে খেয়েছো, মায়ের কোলে ঘুমিয়েছো। এখন তো অনেক কষ্ট করে জীবন যাপন করতে হবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিলাম আমি! এর চেয়ে ওই বুড়োটাকে বিয়ে করলেই ভালো হতো। তুমিও বেঁচে যেতে।” বলতেই উল্লাসীর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে থামিয়ে দিল পাপন।
-“শশশ… এসব অলক্ষুণে কথাবার্তা বাদ দাও। আগামীতে কী হবে তাই ভাবো। আর যত যাই হোক, আমরা টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। কথায় আছে না, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়?”
উল্লাসী আরও শক্ত করে পাপনকে চেপে ধরল।
-“তুমি পারলে আমিও পারব। আর আমরা দু’জনেই পরিশ্রম করব না হয়। তাহলে অনেকটা আগাবে।”
-“হুম। আর বাচ্চাকাচ্চা এখন না। আরো ছয়-সাত বছর পরে, ওকে?”
উল্লাসী লজ্জা পেয়ে গেল। কীসের ভেতর কী! এখনো বিয়েটাই তো হলো না! আর এই ছেলে আছে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে! উল্লাসী হেসে ফেলল। আসলেই পাপন বলদ, গাছ বলদ একেবারে!
-“কী ব্যাপার, হাসছো কেন?” সরু চোখে তাকাল পাপন। উল্লাসী হাসি থামালো না। মুখে বলল,
-“না, কিছু না।”
বুঝতে চেষ্টা করল পাপন। সে এমন কী বলেছে যার জন্যে হেসে কুটিকুটি হতে হবে উল্লাসীকে! পরমুহূর্তেই মাথায় এলো বাচ্চার ব্যাপারটা নিয়ে নয় তো? পাপনও মৃদু হাসল। ইশ! জীবনটা কত সুন্দর লাগছে। এই রাত, রাতের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘপুঞ্জ, এই বাতাস, বাসের ছুটে চলা, বুকের উপর উল্লাসীর রিনঝিন হাসি, সবমিলিয়ে একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছে পাপন। কিছুক্ষণ আগেও কত বিরক্ত লাগছিল নিজের উপর! অথচ এখন মনে হচ্ছে, দুপুরে বিয়েটা হয়ে গেলে এই মজা গুলো মিস করত সে! পালিয়ে বাস স্ট্যান্ড অবধি আসা, তারপর বাকিটা পথও এক প্রকার ভয়ে ভয়ে পার করা, এসব এডভেঞ্চারের জন্ম দিচ্ছে তার মনে।
-“কী হলো? হঠাৎ থম খেয়ে গেলে যে?”
হাসি থামিয়ে চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল উল্লাসী। পাপন ভাবনা থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,
-“না, তেমন কিছু না। আচ্ছা উল্লাসী, তুমি আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে কতদিন ভাত খেতে পারবে?”
-“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
-“বলা তো যায় না! যদি ভর্তা ভাতই জোটে কপালে।”
-“জুটলে জুটবে। কত মানুষ না খেয়ে থাকে, সেই হিসেব করেছো? আর খোদা আমাদের রিযিকে যা লিখে রেখেছে, তাই খাবো আমরা। তারচেয়ে কম বা বেশি না। তাই ওসব চিন্তা না করে আল্লাহর কাছে মন থেকে দোয়া করতে থাকো, উনি যেন আমাদের হারিয়ে না দেন। সবাই যে বলে, ভালোবাসার বিয়ে টিকে না, অভাব আসলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়, এসব যেন আমাদের ভাগ্যের সাথে না হয়। আমরা যেন যুগের পর যুগ একত্রে থাকতে পারি।”
-“আমিন।” একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো পাপন।
-“এই, তুমি সিগারেট খাও?” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্নটা করতেই পাপন থতমত খেলো।
-“ইয়ে মানে.. না খাই না, আবার খাই!”
-“মানে?” উল্লাসীর রাগী কণ্ঠ।
-“আরে, আগে শোনো তো। আমি সিগারেট এভোয়েড করি নর্মালি। তবে যখন বন্ধুবান্ধবদের সাথে কোথাও হ্যাং আউটে যেতাম তখন ওদের পাল্লায় পড়ে দু-একটা টান আর কী..” মিনমিন করে উত্তর দিলো পাপন। উল্লাসী ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
-“এখন আর বন্ধুবান্ধব নাই, সো ওসব টান-ফান বাদ। আমার সাথে সংসার করতে হলে কোনো আজেবাজে কাজে জড়ানো যাবে না, বুঝছো? ঠিকঠাক মতো কাজ করবা, আর সংসার.. আর আমি..”
-“তা তো বুঝলাম। কিন্তু করব টা কী? আমাকে চাকরিই বা দেবে কে?”
উল্লাসী নিচের ঠোঁট কামড় দিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,
-“পরেরটা পরে দেখা যাবে।”

ঢাকায় পৌঁছুনোর আগ পর্যন্ত এভাবেই গুটুর গুটুর করে গল্প চললো দু’জনের। বাস যখন থামলো তখন সাড়ে পাঁচটা বাজছে ঘড়িতে। চারিদিকে আলো ফোঁটেনি অত ভালো ভাবে। রাস্তায় ভীড় নেই, লোকজনের আনাগোনা কম। পাপন আর উল্লাসী বাস থেকে নামলো। উল্লাসীর হাত-পাও কালো মোজায় ঢাকা, মুখে নেকাব। তাকে কেউ চিনে ফেলার উপায় নেই। পাপন একহাতে উল্লাসীকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, অন্য হাতে ব্যাগটা ধরা। দু’জনে মিলে প্যাসেঞ্জার ওয়েটিং রুমে গিয়ে ঢুকলো। আপাতত বাকি সময়টুকু এখানেই কাটানোর প্ল্যান করেছে তারা। প্যাসেঞ্জার ওয়েটিং রুমে শুধুমাত্র একজন বসে রয়েছে। সেও হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। পাপন বেছে বেছে একটা ফ্যানের নিচে দুটো চেয়ারে গিয়ে বসল। চেয়ারে বসা মাত্রই উল্লাসীর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। ঘুমে চোখের পাতা মেলা মুশকিল! পাপন বলল,
-“তুমি ঘুমাও। কোনো ভয় নেই। আমি জাগতে পারবো।”
-“তুমি জাগবে আর আমি ঘুমাবো! এটা কেমন কথা?”
-“আমি সারারাত গেমস খেলে সকালে কলেজ যেতাম। একেবারে দুপুরে বাসায় এসে ঘুম দিতাম। সো আমার অভ্যেস আছে। তুমি ঘুমাও। চট্টগ্রামের বাসে উঠবো যখন, তখন ঘুমানো যাবে।”
উল্লাসী আর কথা বাড়ালো না। পাপন ব্যাগটা কোলের উপর রাখল। উল্লাসী ব্যাগের উপর মাথা দিয়ে পা তুলে দিল সিটের উপর। তারপর ঘুমিয়ে গেল। আর পাপন উল্লাসীকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ফোন বের করে গেমস খেলতে লাগল। ফোনটা ফ্লাইট মুড করা অবশ্য!

সকাল সকাল চিৎকার, চেঁচামেচির শব্দে অভ্র জেগে উঠে বসল। আশেপাশে তাকিয়ে শায়লাকে খুঁজতে লাগল। এই ক’দিনে ঘুম থেকে উঠেই শায়লার বিরক্তিকর মুখটা দেখা অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে যেন। তবে আজ শায়লাকে দেখতে না পেয়ে খানিকটা অবাকই হলো অভ্র। গতকাল রাতেও শায়লা তার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। আজ অবশ্য তাদের ঢাকায় রওনা হওয়ার কথা। সেই জন্যেই কী বাহিরে চেঁচামেচি হচ্ছে? অভ্র হামি তুলে বাথরুমে ঢুকলো। একটা ছোট্ট শাওয়ার নিয়ে গলায় গামছা ঝুলিয়ে বের হতেই তার চোখ দুটো চড়কগাছ। পড়ন্ত বিছানার উপর বসে রয়েছে! এটা কী করে সম্ভব!

অভ্রকে বেরোতে দেখেই পড়ন্ত উঠে দাঁড়াল। জড়সড় ভাবে বলল,
-“এখানে একটা কারণে এসেছি। অন্যকিছু ভাববে না আবার।”
অভ্র মনে মনে হেসে বলল, ‘আমার কাছে কাজ ছাড়া তো আসিস না তুই! এই অভ্র তো তোর গোলাম! তুই বলবি, আর সে সব পটপট করে করবে। শুধু ভালোবাসা চাইতে গেলেই ছ্যাৎ করে উঠে দূরে সরে যাবি।’
মুখে বলল,
-“আবার কী?”
-“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”
-“কী ঝামেলা?”
-“পা..পাপন..” পড়ন্তর কথা শেষ হতে না হতেই অভ্র বলল,
-“আজকে কী ওই মেয়ের সাথে ঘরের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হইছে ওকে?”
-“ধুত না!” বলে বিরক্তি প্রকাশ করে পড়ন্ত।
-“অন্য কাহিনী। উল্লাসীকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাপনকেও পাওয়া যাচ্ছে না। আর…”
-“আর?”
-“উল্লাসীর মা’কে যেই পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিল না বাবা? তাও নাকি নেই! আকলিমা কাকীর ধারণা পাপন উল্লাসীকে নিয়ে ভেগে গেছে। আর যাওয়ার সময় ওই টাকাও নিয়ে চলে গেছে। এখন বাসায় এসে অনেক তামাশা করতেছে।”
অভ্র মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করে বিছানায় গামছাটা ছুঁড়ে মারলো।
-“এই পাপন টাকে যা মন চায় না আমার! বয়স কত? অথচ কর্মকাণ্ড দেখ! কালকেই কতবড় গ্যাঞ্জাম হলো, আর আজকেই…”
-“পাপনকে বকছো কেন? ও তো তাও ওর ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দেয়নি। আর তুমি তো…” বলেই চুপ করে গেল পড়ন্ত। অভ্র গোল চোখে তাকিয়ে রইল।
-“বাদ দাও, যদি কিছু করতে পারো করো, আর নইলে থাক..”
পড়ন্ত চলে যেতে চাইলো, অভ্র বলে উঠল,
-“কী করতে বলিস আমায়? পাপনকে খুঁজে বের করব?”
-“উমম.. না। ওকে খোঁজার কোনো দরকার নাই। বরং বাবা, চাচারা ওকে খোঁজার জন্য তোমায় বললে তুমি এদিক ওদিক খুঁজে এসে বলে দিও, পাইনি। ওর আশা ছেড়ে দিতে। ব্যস।”
-“মানে?” অভ্র অবাক। পড়ন্ত ক্ষণকাল চুপ থেকে বলল,
-“আমি চাই পাপন উল্লাসীকে নিয়ে খুশি থাক। সুখে থাকুক। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট অনেক। সেটা আমি তো বুঝছি, তাই আর কারো ভালোবাসা হারিয়ে যাক, এটা চাই না।” বলেই চলে গেল পড়ন্ত। অভ্র পড়ন্তর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। যখন বুঝতে পারল, তখন ভাবলো, সত্যিই তো! পাপন তার চেয়ে কত ছোট বয়সে! তবুও কতবড় একটা স্টেপ নিয়ে নিলো! আর সে…
অভ্রর নিজেকেই নিজের কাছে লজ্জিত লাগলো।

আকলিমা বারে বারে ফিট খেয়ে পড়ছেন। থেমে থেমে বিলাপের সুরে উল্লাসীকে উদ্দেশ্য করে গালি দিয়ে উঠছেন। বলছেন,
-“ওরে মা** রে.. খা** মা**… চুতমা***.. গেছোস গেছোস, আমারে শেষ কইরা দিয়া গেলি! এমন ক্যান করলি তুই? আমার উপর একটুও তর দয়ামায়া হইলো না!”
গ্রামবাসী অনেকে এসেই আকলিমার বাড়ির সামনে ভীড় জমিয়েছে। কেউ কেউ তামাশা দেখছে, কেউ কেউ আকলিমাকে শান্ত হতে বলছে। কেউ কেউ আকলিমাকেই দোষারোপ করছে,কেন গতকালকেই বিয়েটা দিয়ে দিলো না এই বলে.. শুধু সজলের বাবা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন নিজের ঘরের দাওয়ায়। সজল রাগেক্ষোভে এদিক সেদিক অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েও ওদের কোনো খবর না পেয়ে ব্যর্থ চিত্তে উঠোনে পা রাখতেই সজলের বাবা ডাকলেন,
-“কুনু খবর পাইছোস?”
-“না আব্বা। গেরাম ছাইরা গেছে গা মনে হয়।”
-“তো তোর লইগা এহনো বইয়া থাকবো নাকি? বলদের বাইচ্চা… আরো দূরে দূরে খোঁজ লাগা। ওই ছেরিরে আমার চাই।”
-“আপনের ওরে দিয়া কী কাম আব্বা?” বলেই সরু চোখে তাকাল সজল। সজলের বাবা খুকখুক করে কেশে উঠে চলে গেলেন। কেন তার উল্লাসীকে চাই, এই কথা সজলের সামনে প্রকাশ করলেন না। সজলের মনে সন্দেহের দানা সৃষ্টি হলো। বাবার মতিগতি কেন যেন তার কাছে ভালো ঠেকছে না।

উল্লাসী বাসের সিটে বসে রয়েছে। দুইটা বিরিয়ানির প্যাকেট কিনে পাপনও বাসে উঠল। কিছুক্ষণ আগেই চোরাই মার্কেটে গিয়ে ফোনটা বিক্রি করে দিয়ে এসেছে সে। যেরকম মূল্য চেয়েছিল, তার চেয়েও ভালো মূল্য পেয়েছে। নগদ পনেরো হাজার! ফোনটা একে তো বিদেশী, তার উপর চল্লিশ হাজার দাম! অথচ পাপনের একটুও আফসোস হয়নি। উল্লাসীর জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করতেও তার আপত্তি নেই।

কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিলেই পাপন ঘড়ির দিকে তাকাল। কাটায় কাটায় বারোটা। পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! উল্লাসী আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। পাপন বিরিয়ানির প্যাকেট দুটো জানালার সাইডে রেখে উল্লাসীকে নিজের বাহুডোরে টেনে নিয়ে জানালায় পর্দা ফেলে দিলো। বাতাস আসছে, তবুও ঘামছে মেয়েটা। কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটা। আঙুলের ডগা দিয়ে সেগুলো আলগোছে মুছে দিয়ে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো পাপন।

চলবে…

#অন্তর্দহন_৯
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

সাড়ে ছ’টার দিকে বাস থেকে পাপন আর উল্লাসী যেখানে নামলো, সেই জায়গাটার নাম হালিশপুর। আকাশে বাতাসে আযানের মধুর ধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে। উল্লাসী মন দিয়ে আযানটা শুনে পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর নিকট তাদের এই বিপদের সময় সাহায্য চাইলো। পাপন হাতে ব্যাগ ধরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এখন কোথায় যাবে বা কী করবে, কিছুই মাথায় আসছে না তার। কাজী অফিসটাই বা কোনদিকে- ভাবতেই পাপনের মাথা ঘুরে গেল। তাদের বার্থ সার্টিফিকেটটাই তো আনা হয়নি। ওটা ছাড়া বিয়ে হবে কী করে? আর পাপনের বা উল্লাসীর- দু’জনের বয়সই খুব কম সার্টিফিকেট অনুযায়ী, অর্থাৎ ওটা থাকলেও তাদের বিয়েটা হতে ঝামেলা হতো। ইশ! এখন কী হবে! পাপনের মনে হলো সে মাথা ঘুরে এইখানেই শুয়ে পড়বে। এত চিন্তা আর ভালো লাগছে না।
তাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চিন্তা কিছুটা আঁচ করতে পারে উল্লাসী। সে মৃদু শ্বাস ফেলে। তারও একদমই এসব ব্যাপারে খেয়াল ছিল না। এবার সেই বা কী বুদ্ধি দিবে- তা বুঝে উঠতে পারছে না। আকাশপানে আবার তাকায় উল্লাসী। তার চোখজোড়া ছলছল করছে। তার বিশ্বাস সমস্ত বিপদ থেকে যদি কেউ তাদের উদ্ধার করতে পারে, তবে সেটা মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষেই সম্ভব!

-“এখানে কী নতুন আসছো তোমরা?”

একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর তাদের দুটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করতেই ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল দু’জনেই। সাদা জুব্বা গায়ে ঘন দাড়ির লোকটিকে দেখে উল্লাসীর প্রাণ কেঁপে উঠল। তবে কী বিধাতা তাদেরকে সাহায্য করার জন্য কাউকে পাঠিয়েছেন?
পাপন ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে। চেনে না জানে না, তার সঙ্গে আলগা আলাপের দরকার নেই। বলা তো যায় না, মানুষের ভেতরটা কেমন!

বর্তমান যুগে মানুষ মাকাল ফলে পরিণত হয়েছে। যার উপরটা বড় সুন্দর আর চাকচিক্যময় হলেও ভেতরটা তিতকুটে এবং পঁচা! পাপন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলতেই লোকটি পুনরায় বলে উঠল,
-“তোমাদের এই এলাকায় কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। ঢাকা থেকে এসেছো?”
পাপন জবাব দিলো না তবে মৃদু ভঙ্গিতে মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ’ বলল।
-“পাশে এটা কে? তোমার বউ?”
পাপন দ্বিধায় পড়ে গেল। কী বলবে সে? বউ বলবে? কিন্তু বিয়েটা তো এখনো হয়নি! পাপন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে উল্লাসীর দিকে তাকাতেই উল্লাসী হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। নাহ, এই রাম ছাগলের দ্বারা কিচ্ছু সম্ভব না। আপাতত কারো না কারো সাহায্য তো নিতেই হবে নাকি! উল্লাসী নিজেই এগিয়ে এসে প্রথমে সালাম দিয়ে তারপর বলল,
-“আমার নাম উল্লাসী। আমরা ঢাকা থেকে নতুন এসেছি। এখানে কাউকে চিনি না, আমাদের কোনো আত্মীয় স্বজনও এখানে থাকে না। আপনি কী আমাদের একটা সাহায্য করতে পারবেন?”
পাপন চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। এই মেয়ে এত বোকা কেন! কোথাকার কে, তাকে এত কথা বলে দিচ্ছে অনায়াসে! আসলেই মেয়েদের মাথায় ঘিলুর জায়গায় মাটি দিয়ে ভরা!! গোবর থাকলেও হতো। তাও যদি একটু সার পাওয়া যেতো!
লোকটি এবার উৎসুক চোখে ওদের দুটিকে ঠিকঠাক ভাবে পরখ করে নিয়ে বলল,
-“আমার সাথে আসো তোমরা। ঘরে বসে কথা বলো। এই মসজিদের ইমাম আমি। নামায পড়ে বাইরে বেরিয়েই তোমাদের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা কৌতুহল জাগে আরকী। তোমরা দু’জনেই খুব ছোট তো! আমার বড় মেয়েটার বয়সী… ভয় পেও না। আসো আসো। আমিও এককালে ঢাকায় ছিলাম। তারপর চট্টগ্রামে বিয়ে করলে এখানেই থিতু হই..” লোকটি এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। তার পিছুপিছু উল্লাসী হাঁটা ধরতেই পাপন ওর হাত টান দিয়ে ধরে। উল্লাসী বাঁধা পেয়ে পেছন ঘুরে তাকালে পাপন চোখ কটমট করে বোঝায়, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
উল্লাসী চাপাস্বরে ফিসফিস করে বলে,
-“যদি বাঁচতে চাও, আসো। আর নইলে এই রাস্তায় পড়ে মরতে হবে।”
অগত্যা পাপনও হাঁটা ধরলো। উল্লাসীর মনে যে কী চলছে, তা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারছে না পাপন।

বাসার পরিস্থিতি আপাতত শান্ত। বড় চাচা, মেজ চাচারা চুপচাপ, শুধু মিথুন উদ্দিনই পাগলের ন্যায় এদিক সেদিক ছুটে বেরিয়েছেন পুরোটা দিন জুড়ে। সন্ধ্যের পর ক্লান্ত দেহ,মন নিয়ে ফিরে এসেছেন বাড়িতে। নাসরিন ক্ষণে ক্ষণে বিলাপ করে কাঁদেন। গতকালই পাপনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা উচিত ছিল বলে আফসোস করেন উনি। মিথুন উদ্দিন বিছানায় শুয়ে আছেন। নাসরিনের এই আহাজারি তার একদমই সহ্য হচ্ছে না দেখে তিনি ধমকের সুরে বললেন,
-“ক্যাঁচরক্যাঁচর করবা না তো। উল্লাসী কোনো মেয়ে হলো? ওর মা মানুষের বাসায় কাজ করে, আর তার মেয়েকে আমি আমার ঘরের বউ করে আনবো?”
ঠিক তখনি ঘরের ভেতর পড়ন্ত এসে ঢুকলো। সে ঢুকতে ঢুকতেই মিথুন উদ্দিনের কথাগুলো শুনতে পেয়ে প্রত্যুত্তর করল,
-“বাবা উল্লাসীর মা মানুষের বাসায় কাজ করে, সে কিন্তু ভিক্ষা করে খায় না। কাজ করে তবেই খায়। আর কাজ ছোট বড় নেই। আল্লাহ যার মাধ্যমে যার রিযিক লিখে রাখছেন… তাই তুমি কোনোমতেই উনার কাজকে ছোটো করে দেখতে পারো না। আর উল্লাসী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। ওর আদব কায়দা আছে, নামায রোজা করে। কী হতো মেনে নিলে ওদেরকে?”
-“তুই হঠাৎ সুর পাল্টালি যে? কেন রে? তোরও কোনো চক্কর চলছে নাকি কারো সাথে?”
পড়ন্ত লজ্জা পেলেও মাথা নোয়ালো না। আসলে অভ্রর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকে সে বুঝেছে, নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়। বাচ্চা কাঁদলে তবেই তাকে দুধ খাওয়ায় মা, তাই পড়ন্তকেও আর চুপচাপ, নম্র-ভদ্র থাকলে চলবে না। তার হক আদায়ে তাকেই চেঁচাতে হবে। এতে যদি তাকে ‘বেয়াদব’ উপাধী দেওয়া হয়, তাহলে তাই সই।
-“আমি মোটেও সুর পাল্টাইনি বাবা। যেটা উচিত কথা সেটা বলতেছি। পাপনের সুখটা সবার চেয়ে বড়। সে যদি উল্লাসীকে নিয়ে সুখে থাকতে চায়, তবে থাকতে দেওয়া উচিত। তোমরা তো আবার নিজেদের সিদ্ধান্ত অন্যর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় ওস্তাদ!”
মাঝদিয়ে নাসরিন বললেন,
-“এই কথা তুই আমাকে আগেও বলছিস। আমরা তোর ঘাড়ে কী সিদ্ধান্ত চাপাইছি? হ্যাঁ?”
-“কিছু না। পাপনের জন্য দোয়া করো, ছেলেটা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকে যেন। আর উল্লাসী যেরকম মেয়ে, ও ঠিক সব পরিস্থিতি সামলে নিবে। আমার বিশ্বাস আছে ওর উপর। আর দয়া করে উল্লাসীকে বা ওর পরিবারকে ছোট করে দেইখো না বাবা। বড় লোক ঘরের ছেলে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করলে লোকে ছেলেকে প্রশংসিত করে আর মেয়েকে বলে, ‘যাদুটোনা করে বড়লোক ছেলেকে হাত করছে!’ কী আজব চিন্তাধারা মানুষের! হুহ..‌!” একদমে কথাগুলো বলে থামতেই পড়ন্ত দেখল, তার বাবা-মা তার দিকে কেমম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। পড়ন্ত বিশেষ আগ্রহ দেখালো না। যেভাবে হঠাৎ এসেছিল, সেভাবে হুট করেই চলে গেল।

পড়ন্ত চলে যেতেই মিথুন উদ্দিন নিচু কণ্ঠে বললেন,
-“তোমার মেয়ের হাব-ভাব আমার কাছে ভালো ঠেকছে না নাসরিন। পাপনের মতো এও কী কিছু ঘটাতে চাইছে নাকি?”
নাসরিন ঠোঁট কামড়ালেন।
-“কী জানি বাবা! তবে তোমাকে একটা কথা বলা হয় নাই। তুমি কী না কী ভাববা তাই আর কী বলি নাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বলাটা উচিত।”
মিথুন উদ্দিন উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী?”
পড়ন্ত যখন অভ্রর বিরহে রাতদিন বুক ভাসানো কান্নায় ডুবে ছিল, নাসরিন সেসব লক্ষ্য করলেও কারণটা যে অভ্র তা বুঝতে পারেননি। তবে পড়ন্তর সাথে নিশ্চয়ই অন্য কারো সম্পর্ক আছে আর সম্পর্ক ঘটিত কারণেই সে এরকম মনমরা হয়ে রয়েছে- এমনটা ধারণা করেন তিনি৷ কথাগুলো মিথুন উদ্দিনের কানে ঢালতেই মিথুন উদ্দিন বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। পাপনটা যে কাজ করেছে, পড়ন্তটাও যদি একই কাজ করে, তবে শেষমেশ পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে ভাবা যায়? ভাইদের কাছে ছোট হয়ে যাবে,সমাজের চোখে ছোট হয়ে যাবে। মিথুন উদ্দিন বেশ চিন্তায় পড়লেন। কিছুক্ষণ পর নাসরিনকে বললেন,
-“তোমার মেয়ের মতিগতিও ঠিক লাগছে না। দেখো গিয়ে,সেও এরকম কিছু ঘটানোর অপেক্ষায় আছে কী-না।”
-“তাহলে এখন?”
-“তাকে অপেক্ষা করার সময়টুকুই দিবো না আমি। কালকেই ঢাকায় রওনা হবো আমরা। ওর জন্য বেশ কয়েকটা ভালো ভালো প্রস্তাব আমার কাছে এসেছিল। পড়াশোনা করছে তাই আমি আগ্রহ করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা দিয়ে দেওয়াই ভালো হবে। বিয়ের পর পড়াশোনা যত মন চায় করুক। অন্তত আমার মাথা থেকে চিন্তা তো দূর হবে!”
নাসরিন সায় দিলেন। মিথুন উদ্দিনের পরিকল্পনাই ঠিক। দুটো ছেলেমেয়েই একদম জলে ভেসে যাক, এমনটা চান না তিনি…

হাঁটুতে মুখ গুঁজে ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে রয়েছে পড়ন্ত। মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ইদানীং কোনো কিছুই ভালো লাগে না তার। একটা কথা সবসময় বুকে খোঁচা দেয়, শায়লা আর অভ্র এক ঘরে রয়েছে। কী করছে তারা? অভ্রকে জিতে নিয়েছে শায়লা? নিতে কতক্ষণ! পড়ন্তর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগল। কাঁদবে না কাঁদবে না করে বারংবার অন্তর্দহনের কাছে পরাজিত হতে হয় তাকে। অভ্রকে যত ভুলতে চেষ্টা করে ততই মনে পড়ে বেশি বেশি! ব্রেইন একদিকে, তো মন আরেকদিকে..
এই অসহ্যকর দ্বিধাদ্বন্দ্ব পড়ন্তকে আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।

কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পড়ন্ত চমকে মাথা তুলে দেখলো নিতু কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-“তোমার মন খারাপ আপা? অভ্র ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে?” বলতে বলতে তার পাশে বসে নিতু।
পড়ন্ত মাথা নাড়ালো। মিথ্যে করে বলল,
-“নাহ, পাপনটার কথা মনে পড়ছে। না জানি কোথায় আছে, কী করছে ও!”
নিতু উশখুশ করল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎই চাপা কণ্ঠে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
-“আমি একটা কথা বলতে চাই আপা।”
-“কী কথা?”
-“আসলে আমি… আমি পাপন আর উল্লাসীকে পালিয়ে যেতে দেখেছি।”
-“বলিস কী!” প্রায় চিৎকার করে উঠে পড়ন্ত। নিতুর হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরে উৎসুক কণ্ঠে বলল,
-“তারপর? ওরা কোথায় আছে জানিস?”
-“না আপা। আমি তো রাতে বাথরুমের জন্য উঠছিলাম। তখন পাপনের ঘরে হুট করে কাউকে ঢুকতে দেখে চমকে যাই। নিজেকে ধাতস্থ করে ওর ঘরের দরজায় কান পাতি আর তখনি উল্লাসী আর পাপনের কথাবার্তা শুনতে পাই। উল্লাসীই পাপনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে গেছে। আমি কাউকে ডাকতে চাইছিলাম কিন্তু কেন যেন ডাকিনি। ওদের কথাবার্তায় যে ভালোবাসা আর একে অপরের প্রতি টান টুকু অনুভব করতে পেরেছিলাম, তা আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল।”
পড়ন্ত হেসে উঠল।
-“সিরিয়াসলি! উল্লাসী পাপনকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে? হায় আল্লাহ! আমার ভাইটা এজীবনে অকর্মার ঢেকিই রয়ে গেল!”
নিতু হাসলো মৃদু।
-“হুঁ… আর উল্লাসীর বিয়ে হয়ে যেতো নাকি। ওই সজলের বাবার সাথে।”
-“অ্যাহ!” ভ্যাবাচ্যাকা খায় পড়ন্ত। নিতু শব্দ করে হাসে।
-“হুম.. এইজন্যেই তো উল্লাসী পালিয়েছে। সঙ্গে করে তোমার গাধা ভাইটাকেও নিয়ে গেছে।”
-“হা হা হা!পাপন কে যদি কোনোদিন সামনে পাই, তবে আজীবন টিপ্পনী কাটবো, দেখিস।” বলতে বলতে অট্টহাসিতে মেতে উঠে পড়ন্ত। হঠাৎই একটা ভাবনা তার মাথায় ধরা দেয়, আর সে থমকে যায়। আচ্ছা, সেও কী পারতো না অভ্রকে এভাবে নিয়ে পালিয়ে যেতে? ভাবনায় ডুবে যায় পড়ন্ত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here