অন্তর্দহন,পর্ব:৬+৭

0
2248

#অন্তর্দহন_৬
লেখায়- শেখ অলিন্দ্রিয়া রুহি
অলস দুপুর, ঘুমটা পুরোপুরি ভাবে জুড়ে বসেছে নেত্রে, ঠিক তখনি একটা রিনরিনে গলার আওয়াজে অভ্রর চোখমুখ কুঁচকে গেল। সে চোখ মেলতেই মুখের উপর শায়লার চোরা চাউনিটা দেখে মেজাজ বিগড়ে ফেলল। ধমকের স্বরে বলে উঠল,
-“কী?”
শায়লা থতমত খেল।
-“না মানে, তোমাকে ডাকতে বলছে।”
-“কে?” পূর্বের স্বরেই বলল অভ্র।
শায়লা মুখ গোমড়া করে জবাব দিল,
-“আব্বু। মানে তোমার আব্বু। পাপনরে নিয়ে সভা বসাইছে। তোমাকে ডাকছে।”
-“পাপনরে নিয়ে সভা বসাইছে মানে!” বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল অভ্র। সেই সাথে উঠেও বসল।
শায়লা বিজ্ঞের ন্যায় বলল,
-“ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওদের দু’জনকে পাওয়া গেছে। একদম হাতেনাতে ধরা যাকে বলে। দুটা মিলে আকাম কুকাম করতেছিল নাকি। তাই জন্যে সভা ডাকছে। তোমাকে জলদি যাইতে বলছে।”
-“মানে কী! পাপন আর কে?”
-“উল্লাসী।”
-“আকলিমা কাকীর মেয়ে উল্লাসী না?”
-“হুঁ।”
অভ্র থ বনে গেল। এই দুটিতে মিলে আবার কোন ভোজগট পাঁকিয়েছে কে জানে, তবে যেহেতু সভা বসে গেছে এর মানে মামলা সিরিয়াস! অভ্র শায়লার সঙ্গে কথা বাড়াল না, দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামল।

উঠোনে সভা বসেছে। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রয়েছে। আছে তমিজ উদ্দিন আর তার দুই ভাই। আকলিমার মা-ও এক পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে কাঁদছে। ইতিমধ্যেই তার কানে কিছু উড়ন্ত কথা এসেছে। গ্রামের সবাই নাকি ছি ছি করছে উল্লাসীকে। পাপন ছেলে মানুষ, ছেলেদের এসব ছুকছুকানির স্বভাব থাকেই। তাই বলে সে মেয়ে হয়ে কেন ধরা দিবে? তাও দিন দুপুরে ক্ষেতের মধ্যে! রশিদ হাওলাদারের পুত্র সিয়াম হাওলাদারের জন্যে উল্লাসীকে অনেক আগে চেয়েছিলেন তিনি। সিয়ামও উল্লাসীকে ভীষণ পছন্দ করত। আকলিমা ডাট দেখিয়ে দেয়নি, প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ আজ রশিদ হাওলাদার আকলিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছেন,
-“আল্লাহ যা করেন, ভালার লাইগাই করেন। তোমার এই খা*** মাইয়া আমার পোলার জীবনে আহে নাই, এই লইগা আল্লাহর দরবার কুটি কুটি শুকরিয়া… ”
উত্তরে আকলিমা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। কোনো জবাব দিতে পারেননি। পাপন আর উল্লাসীকে মুখোমুখি দুই পাশে দাঁড় করানো হয়েছে। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে রেখেছে উল্লাসী। থেমে থেমে কাঁদছে তবে নিঃশব্দে। হাতের মুঠ মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। এত লজ্জা, এত হেনস্তা! ইচ্ছে করছে মাটির নিচে মিশে যেতে… আফসোস ধরণী তার প্রতি সহায় হলো না।

অভ্র উঠোনে বেরিয়ে আসলো। একবার দোতলায় তাকাতেই পড়ন্তর সাথে চোখাচোখি হলো। পড়ন্ত কাঁদছে, তার চোখ দুটো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নিজের বিপদের মধ্যে আবার এ কোন বিপদ এসে হাজির হলো! মিথুন উদ্দিন ভীষণ রেগে আছেন। পাপনকে হাতের কাছে পেলে মেরেই ফেলবেন বোধহয়। নাসরিন মূর্ছা যেতে যেতে বেঁচেছেন। তাকে ঘরের মধ্যে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাপনের বয়স মাত্র আঠারো। এই বয়সে তার ছেলের বিয়ে হয়ে যাবে তাও আকলিমার মেয়ে সঙ্গে! কথাটি চিন্তা করলেই বুক দুরুদুরু বেড়ে যাচ্ছে। যদিও মিথুন উদ্দিন শান্ত থাকতে বলেছেন। যেভাবেই হোক, পাপনকে এই বিপদের মধ্য দিয়ে বের করে আনবেন, কথা দিয়ে গিয়েছেন। তবুও শান্ত হতে পারছেন না নাসরিন। গ্রাম অঞ্চলে এসব ভীষণ সেনসিটিভ ব্যাপার। উল্লাসীকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় তো হারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি…

মেম্বার পান চিবুচ্ছিলেন, পানের পিক মাটিতে সশব্দে ফেলে দিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালেন। ঘোমটার জন্য মুখ দেখা যাচ্ছে না। তিনি পৈশাচিক হাসি হাসলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
-“ঘোমটা সরাও মাইয়া। আকামের সময় লজ্জা লাগে না, আর এহনে লজ্জা লাগতিছে? ঘোমটা সরাও।”
শেষ বাক্যটি তিনি ধমকের সুরে উচ্চারণ করলে উল্লাসী কেঁপে উঠে। পাপন তাকায়, তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কেন যে আবেগে গা ভাসিয়ে বাস্তবতা ভুলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে কে জানে! তাদের দু’জনকে দেখেছে তো দেখেছে, একেবারে ওরকম একটি অবস্থায়! আগুন গরম চোখে ঠোঁটে হাসি নিয়ে থাকা সজলের দিকে একবার তাকায় পাপন। সজলই প্রথম তাদের দু’জনকে একত্রে দেখে। তারপর চুপিচুপি গিয়ে সবাইকে ডেকে আনে। সে যদি এটি না করত, তবে এরকম পরিস্থিতি মোটেও তৈরি হতো না। সে এটি কেন করেছে, তাও খুব ভালো করেই জানে পাপন। এতে করে উল্লাসীর জীবন থেকে পাপনকে সরিয়ে দিতে পারবে। উল্লাসী ফোনে বহুবার জানিয়েছিল সজলের কথা। সজল প্রায়শই তাকে ইঙ্গিতে বোঝাতো পছন্দের কথা। উল্লাসী পাত্তা দিতো না। আজ পরিবেশ তার অনুকূলে থাকায় সেই প্রতিশোধ উশুল করে নিলো সজল! তবে সে তো জানে না, এতে করে শাপে বর হয়েছে পাপনের। এখন সবাই উল্লাসীকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিবে। আর পাপন তো এক পায়ে খাঁড়া.. ব্যস, এরপর উল্লাসী তার, আজীবনের জন্য… মাঝ দিয়ে হা মুখ করে কপাল চাপড়াবে সজল। ভেতরে ভেতরে দুর্বোধ্য হাসল পাপন। একদিক থেকে এই ঘটনার জন্য সে খুশিই… একটু ঝামেলা হলেও উল্লাসীকে সে আজকের পর থেকে একদম নিজের করে পেতে পারবে…

ধমক খেয়ে ঘোমটা অল্প একটু উপরে তোলে উল্লাসী। এতে তার নাক আর ঠোঁট টা দেখা যাচ্ছে, তবে চোখ নয়… পাপন দেখল, ঠোঁট জোড়া ভিজে জবজব করছে। নাকের পাঠা লাল… খুব কাঁদছে মেয়েটা? অবশ্য কাঁদার মতোই পরিবেশ! পাপন মনে মনে আওড়ালো,
-“তোমার কান্না আমি খুব জলদি মুছে দেবো উল্লাসী। আর মাত্র কিছুক্ষণ…”
-“এইবার বলেন চেয়ারম্যান সাব, এদের কী বিচার করা যায়?” মেম্বার চেয়ারম্যান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন।
আগত গ্রামবাসীদের মাঝ দিয়ে কেউ একজন বলে উঠল,
-“কী আর করবেন, ধইরা বিয়া দিয়া দেন দুইটারে। শরীরের জ্বালা কমুক।”
উল্লাসীর শরীর রি রি করে শিউরে উঠল। প্রতিটি লোমকূপ কাটাকাটা… কান্নার বেগ বাড়ল। ভরা সমাজের মধ্যে এভাবে কখনো অপদস্ত হতে হবে, তা কল্পনাও করেনি উল্লাসী।
তমিজ উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
-“ওদের কী একসাথে এক কামড়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে? দু’জনে জঙ্গলের মধ্যে কথা বলতেছিল। এই জন্য একেবারে বিয়ে অবধি যাওয়াটা কী ঠিক?”
-“একজন আরেকজনরে বুকের লগে মিশাইয়া কী কথা কইতাছিল, একটু জিগান দি।” বলে উঠল সজলের বাপ। মুখ বাঁকালেন তিনি।
-“নিজের পোলারে বাঁচানির চিন্তা করতাছেন? এই মাইয়াডার গায়ে যে কলঙ্ক লাগল,সেইটা একবারও দেখতাছেন না? এখন এই মাইয়াডারে কেডায় বিয়া করব হ? বাপ মরা মাইয়া… একলা মায়ে আজীবন পালতে পারব নাকি?”
-“উল্লাসীর বিয়ের দায়িত্ব এবং যাবতীয় যত খরচ আছে সব আমার। আমি ঢাকা থেকে ওর জন্য ভালো পাত্র নিয়ে আসবো। তবুও আমার বাড়ির ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে না।” নির্লিপ্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তমিজ উদ্দিন কথাটি বলতেই পাপন চমকে উঠল। মোড় তো অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। সে অসহায় চোখ করে উল্লাসীর দিকে তাকাল। তবে কী উল্লাসী তার হয়েও হলো না?
মুহূর্তেই গ্রামবাসী হৈহল্লা লাগিয়ে দিল। তাদের এক কথা, পাপনের সঙ্গেই বিয়ে দিতে হবে। আকাম করবে একজনের সাথে আর ধরেবেধে অন্যজনের সাথে বিয়ে দেওয়া! এসব চলবে না। পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে দেখে তমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যানের কানে কানে কী যেন বললেন। চেয়ারম্যান হাত ইশারায় সবাইকে শান্ত হতে বলে উঠে দাঁড়ালেন।
-“আমি এগোর সাথে আলাপ কইরা আসি। আপনেরা বসেন সবাই। পোলার বাপ-মা আছে। মাইয়ার মাও আছে। তাদের ছাড়া তো কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না। পোলার মা অসুস্থ হইয়া পড়ছে। আমি তার কাছে গিয়া তার কথাগুলা আগে শুইনা আসি। আর এই আকলিমা, তুমিও চলো আমার লগে। তোমার লগেও কথা আছে।”
চেয়ারম্যান বাসার ভেতর পা রাখলেন। পেছন পেছন আকলিমা, তমিজ উদ্দিন, মিথুন উদ্দিন ও গেল। খোকন উদ্দিন পাপনের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। উল্লাসীর পা জোড়া কাঁপছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, তার সঙ্গে ভয়ংকর কিছু ঘটবে।

প্রায় মিনিট বিশের মাথায় সবাই বেরিয়ে আসলেন। আকলিমার চোখমুখ আগের চাইতে অনেকটা শান্ত এখন। আর কারও কথা তার গায়ে লাগছে না যেন। তমিজ উদ্দিন খোকন উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করলেন, যার অর্থ কাজ হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান আসনে বসে ক্ষণকাল চুপ করে থেকে জনতার সামনে বলতে লাগলেন,
-“পোলার অন্য জায়গায় বিয়া ঠিক করা আছে। খালি মাইয়ার সম্মান দেখলেই হইবো না। পোলার পরিবার আমাগো এলাকার গণ্যমান্য পরিবার গুলোর মধে একটা। তাগো দিকটাও দেখা লাগবো। তাই উভয় পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হইছে যে, পোলারা আগামীকাল সকালেই এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যাইবো। আর আইবো না। তাগো বাড়িটাও বিক্রি কইরা দিবো। আর মাইয়ার মায়রে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিবো। এছাড়াও মাইয়ার বিয়ার সময় ভালো পাত্রের সন্ধান দিবো, বিয়ার যাবতীয় খরচপাতিও দিবো। মাইয়ার মা এতেই খুশি। যেহেতু পোলা মাইয়ারে ঘরের মধ্যে আরও বিশ্রী অবস্থায় পাওয়া যায় নাই, তাই একদম বিয়ার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারতাছি না। প্রেম পিরিতি আজকাল কেডা না করে? এহন এই লইগা সবাইরে ধইরা ধইরা বিয়া দিলে হইবো?”

উল্লাসীর মাথা থেকে ঘোমটা নেমে গেল। রক্তবর্ণের ন্যায় টলটলে চোখজোড়া মেলে পাপনের দিকে তাকিয়ে দেখল, পাপন মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। খুব না বলেছিল, কিচ্ছু হবে না! তোমাকে বিয়ে করে নিব! কই সেসব দাপট? এক ঝড়েই সব ফুস? ভেতরটা তেতো হয়ে উঠল উল্লাসীর। সেই সাথে মনবাড়িতে ভালোবাসার জায়গায় ‘ঘৃণা’ শব্দটা উচ্চারিত হলো বারংবার।
‘ঘৃণা করি তোমারে… ঘৃণা করি আমি…’ ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়ালো উল্লাসী। মাথাটা ঘুরে উঠল তার। সে পড়ে যাওয়ার আগেই আকলিমা তারে ধরে ফেলল। পাপন একদম তাকাল না। খোকন উদ্দিন তার কানে কানে যা মন্ত্র ঢালার ঢেলে দিয়েছেন। অকালে যদি বাপের হাতে মরতে না হয়, তবে চুপ থাকাই শ্রেয়। ভালোবাসা ভালো থাক!

চেয়ারম্যান কে হাত করার জন্য বেশ কিছু অর্থ মিথুন উদ্দিনের গচ্ছা গেল। তারপর আবার আকলিমাকে দিতে হলো! সব কার্যক্রম শেষ করে শেষ বিকেলে ঘরের ভেতর পা রাখলেন তিনি। নাসরিন ছেলেকে ফিরে পেয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি চাইছিলেন,আজকেই রওনা হয়ে যেতে। দাদীমা মানা করলেন। একটা গোছগাছের ব্যাপার আছে তো।
মিথুন উদ্দিন ঘরে ঢুকতেই পাপনকে সামনে পেয়ে গেলেন। নিজের ক্রোধ আর ধরে রাখতে না পেরে ঠাস ঠাস করে পাপনের গালে চড় লাগিয়ে দিলেন। পাপন ছিটকে পড়ল। কোমড় থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে শুরু করলেন পাপনকে। পাপন সব ব্যথা হজম করে নিল। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও করল না। পড়ন্ত শব্দ পেয়ে ঘরে এসে এই অবস্থা দেখে দ্রুত থামাতে এসেও পারল না। তাই বেরিয়ে গেল কাউকে না কাউকে ডেকে আনার জন্য। লম্বা বারান্দায় পড়ন্ত যখন পাগলের ন্যায় ছুটে যাচ্ছিল, তখনি পেছন থেকে অভ্রর গলার স্বর শুনতে পেল।

-“পড়ন্ত! পড়ন্ত, শোন প্লিজ.. পালিয়ে যাইস না। একটু দাঁড়া!”
পড়ন্ত দাঁড়াল। অভ্রকে ঘুরে দেখল। অভ্র কিছু বলার আগেই তার হাত ধরে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
-“বাবা পাপনকে খুব পিটাচ্ছে। তুমি একটু আটকাও, প্লিজ।”
-“কাকা মারতেছে কেন!” বলতে বলতে অভ্রও ছুটলো। পাপনের পিঠ ততক্ষণে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। বেহাল দশা… অভ্র গিয়ে মিথুন উদ্দিনকে জাপ্টে ধরে সরিয়ে আনলো। পড়ন্ত ততক্ষণে মা’কে, নিতুকে, বড় চাচাকে ডেকে এনেছে। তাদের পেছন পেছন বাকি সবাইও চলে এসেছে। নাসরিন ছেলেকে দেখামাত্র আঁতকে উঠে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। মিথুন উদ্দিনের দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
-“তুমি কী মানুষ!কেউ তার নিজের সন্তানকে এভাবে মারতে পারে! ছি..”
-“ও আমার সন্তান না। আমার আজকে থেকে কোনো ছেলে নাই। যে ছেলে আমার সম্মানের কথা একটাবারও চিন্তা করল না তাকে আমার দরকার নাই। আমি ওকে ত্যাজ্য করলাম।”
-“মিথুন! চুপ কর।” হুংকার ছাড়লেন তমিজ উদ্দিন।
-“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? এসব কী বলতেছিস? বাচ্চা মানুষ একটা ভুল না হয় করেই ফেলছে। তাই বলে এই কথা তোর মুখ দিয়ে কেমনে বের হয়?”
মিথুন উদ্দিন তমিজ উদ্দিনের হাত জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন।
-“এই গ্রামে আমাদের আব্বার সম্মান কতটা ছিল, তা কী ভুলে গেছেন ভাই? আব্বাকে সবাই উঠতে বসতে সালাম দিত। কারও কোনো পারিবারিক ঝামেলা হলেও আব্বার কাছে ছুটে আসতো। আব্বা চলে যাওয়ার পর, গ্রামের সবাই আমাদের তিন ভাই কেও সেই একই সম্মানের চোখে দেখেছে। অথচ আজকে আমার সন্তান, সবার চোখে আমাকে নামিয়ে দিল! আমার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল! আপনি যদি না থাকতেন, তাহলে উল্লাসীকে বিয়েই করতে হতো হয়তো। ও কী করে সংসার জীবনের কষ্ট বুঝবে? উল্লাসী কোনো মেয়ে হলো সংসার করার মতো? ও তো আছে ওর আবেগ নিয়ে। ওর চোখ যেদিন খুলবে সেদিন বুঝবে, আবেগ ওর কতকিছু ধ্বংস করে দিছে!!”

মিথুন উদ্দিন হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বেরিয়ে গেলেন। উপস্থিত সবার মুখ গম্ভীর। তমিজ উদ্দিন পাপনকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ওর প্রাপ্য শাস্তি ও পেয়ে গেছে। তিনি বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলেও অভ্র গেল না। সে তাকিয়ে আছে পড়ন্তর দিকে। চোখ ইশারায় বোঝাচ্ছে, পড়ন্তকে কিছু বলতে চায় সে। পড়ন্ত না চাইতেও ইশারায় বাইরে যেয়ে দাঁড়াতে বলল। অভ্র বেরিয়ে আসার মিনিট দুইয়ের মাথায় পড়ন্তও বেরোলো।
-“কী বলতে চাও?” প্রশ্ন করল পড়ন্ত।
উত্তরে ভেঙে পড়া এক অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিত হলো।
-“এগুলো কী হচ্ছে পড়ন্ত! এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে তো তোর কথা বাসায় বলতেই পারব না রে!”
-“এখন আর বলে কী হবে? শায়লা আপু..”
-“প্লিজ, ওর কথা শুনতে চাই না। একটা এক্সিডেন্টে ঘটা বিয়ের কোনো মর্যাদা নেই, অন্তত আমার কাছে। আমি তোকে ভালোবাসি, তোকে চাই আর মৃত্যুর আগ অবধি তোকেই চাইবো। প্রতি রাতে শায়লার আমাকে পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ ছটফট করে, তা যদি তুই দেখতি! অথচ আমি ওর কাছেও ঘেঁষি না। কার জন্য নিজেকে ধরে রাখি, সামলে রাখি, বুঝিস না তুই? আমি যদি শায়লাকে তোর আদরের ভাগ দিয়ে দেই, তবে তুই তা সহ্য করতে পারবি পড়ন্ত? বল আমাকে… একদম মিথ্যে বলবি না, সত্যি করে বল।”

চলবে…

#অন্তর্দহন_৭
লেখায়- শেখ অলিন্দ্রিয়া রুহি

কারও উপস্থিতি টের পাওয়ায় পড়ন্ত দ্রুত পেছন ঘুরে তাকাল। শায়লাকে তাদের দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে পড়ন্ত একবার অভ্রকে দেখল, তারপর অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাল। অভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল শায়লাকে দেখামাত্রই। এই মেয়েটা বিচ্ছুর মতো তাদের পিছনে লেগে আছে, আলাদা ভাবে এক দন্ড কথা বলাও মুশকিল এর যন্ত্রণায়! পড়ন্তকে আড়াল করে অভ্র সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল দেখে পড়ন্ত খানিকটা অবাক হলো। তার চাইতেও বেশি অবাক হলো শায়লা। শায়লার প্রশ্নবিদ্ধ চোখের চাউনি থেকে পড়ন্তকে সরিয়ে দিতেই এমনটা করলো অভ্র! কতবড় সেয়ানা! বউ থাকতে ওপর একটি মেয়ের জন্যে… শায়লা মনে মনে স্থির করল, এবার আর নরম শরমে চলবে না। যা বলার গরম হয়েই বলতে হবে। তবে যদি অভ্রর কানে কথা ঢোকে। অভ্রর কানে ঢোকার আগে পড়ন্তর কানে ঢোকানোটা বিশেষ জরুরি। মেয়েটাও কেমন বেহায়া গো! একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বারবার দেখা করতে আসে!

শায়লা ওদের দু’জনের মুখোমুখি হতেই অভ্র কর্কশ সুরে বলে উঠল,
-“তোর এখানে কী?”
শায়লাও এবার ছেড়ে দিল না। গরম কণ্ঠে জবাব দিল,
-“এটা কী তোমার বাপের জায়গা যে আমি আসতে পারব না?”
পড়ন্ত বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কীভাবে বাপ তুলে কথাটা বলে ফেলল শায়লা! কত অনায়াসে! অথচ অভ্রর বাবা কী ওর বড় চাচা হয় না?
অভ্র দাঁতে দাঁত ঘঁষে নিজের রাগ সংবরণ করলো।
-“ল্যাংগুয়েজ ঠিক কর। নইলে একটা লাথি মেরে এখান থেকে নিচে ফেলে দিবো।”
-“তুমিও তোমার চরিত্র ঠিক করো। নইলে আমিও মগজ ছেঁছে ভর্তা করে ফেলবো।”
-“কী করবি তুই আমার? করে দেখা, আয়..” বলে এক কদম এগিয়ে গেল অভ্র, ওমনি ওর বাহু খামচে ধরল পড়ন্ত। পেছনের দিকে টান দিয়ে চোখ ইশারায় কোনো ঝামেলায় যেতে বারণ করতেই নিজের রাগ দমন করলো অভ্র। অপরদিকে শায়লা তখন ক্ষেপা বাঘিনীর মতো ফুঁসছে। অভ্রর উপর পড়ন্তের এই অধিকার চর্চা তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। সে তেড়ে আসতে আসতে বলল,
-“তুই একটা মেয়ে হয়ে কেমনে আরেক মেয়ের ঘর ভাঙিস? তোর যেন কোনোদিন সুখের সংসার না হয়, অভিশাপ দিলাম।” কথাটি মাটিতে পড়ার আগেই শায়লার গালে অভ্রর পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেল। এত জোরে মারলো যে পড়ন্ত নিজেও ভয় পেয়ে গেল। পেছন থেকে অভ্রকে খামচে ধরে সরিয়ে নিতে নিতে বলে উঠল,
-“এসব কী করছো তুমি!”
শায়লা অগ্নি চোখে পড়ন্তর দিকে তাকাল। দাঁত কটমট করছে সে। ভেতরটায় আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফুঁসে উঠছে। সবকিছু ঝলসে দিতে ইচ্ছে করছে তার। অভ্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“এবার তোর আর পড়ন্তর মধ্যে পার্থক্যটা পেয়েছিস? ও তোর ঘর না, বরং তুই ওর না হওয়া সংসার ভেঙেছিস। তারপরও তোর জন্য ওর মুখ দিয়ে একটা বদদোয়া তো দূর, খারাপ কথাও বের হয়নি! আমি ওকে এত করে বোঝাচ্ছি, সব ঠিকঠাক করে নেওয়ার জন্য। আর ও উল্টো তোর কথা ভেবে আমাকে বোঝাচ্ছিল, যেন তোকে আমি এক্সেপ্ট করে নেই! তোর সাথে সুখের সংসার গড়ি! না শায়লা… তোর জন্য যতটুকু সম্মান আমার ছিল, তাও তুই নষ্ট করে দিলি আজ। আই এম সরি টু সে বাট… তুই একটা কালসাপ। যার আক্রমণাত্মক ছোবল থেকে আমি বা পড়ন্ত কেউই রক্ষা পাইনি। আমার পরিবারও পাবে না। যে নিজের বাবার সমতূল্য বড় চাচাকে মুহূর্তেই কথার মাঝে টেনে অসম্মানিত করতে পারে, সে যে পরবর্তীতে আমার পরিবারে আর কী কী ঝড় তুলতে পারবে, তা বোঝার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি আমার ঘটে আছে। যাক, অল্পতেই তোর আসল রূপটা চিনে ফেললাম, এই জন্যে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”
একদমে কথাগুলো বলে অভ্র পড়ন্তর দিকে ফিরলো। পড়ন্ত ঠোঁট দুটো চেপে ধরে রেখেছে। তার চোখজোড়া টকটকে লাল, নিজের জন্য সৃষ্ট হওয়া অশান্তিগুলো কিছুতেই মানতে পারছে না সে। অভ্র পড়ন্তর কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
-“এবার আরও শায়লা শায়লা করো… আমাকে ভুলে যাবা তো? যাও… আমিও আর নিজের ভালোবাসার দাবী নিয়ে তোমার কাছে আসবো না। হ্যাপি নাউ?”
পড়ন্ত কোনো জবাব দিতে পারল না। তার শব্দ ভান্ডারে শব্দ নেই। সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। অভ্র বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে দিলো সশব্দে, তার ধীরপায়ে ওদের ফেলে সামনে এগিয়ে চললো। শায়লা গালে হাত রেখে ধারালো দৃষ্টির সহিত পড়ন্তকে এফোড়ওফোড় করে দিচ্ছিল। অন্তত একটা সরি তো বলা উচিত! পড়ন্তর মন এটাই বললো, তাই সে সরি বলার জন্য উদ্যত হতেই শুনলো শায়লা গালে হাত ডলতে ডলতে বলছে,
-“তোর জন্য কতটা অপদস্ত হলাম, তা আমি হিসেব করে রাখলাম। মনে রাখিস।”
শায়লা ঘুরে দাঁড়াল এবং গটগট করে চলে গেল। পুরো বারান্দায় একা পড়ন্ত দাঁড়িয়ে রইলো। অসহায়, ব্যর্থ আর ক্লান্ত রূপে। দেয়ালে পিঠ চেপে হাটুতে হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে হাঁপাতে লাগলো সে। একটা পরিবারেই সকলের বসবাস, একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা, আগামীতেও একত্রে মিলেমিশে থাকতে হবে সবাইকে, অথচ ভেতরে ভেতরে জড়তার সৃষ্টি হচ্ছে! একে অপরের থেকে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে! কী একটা অবস্থা..! তা ভুক্তভোগী ছাড়া দ্বিতীয় কারও বোঝার ক্ষমতা নেই বোধকরি!

উল্লাসী গায়ের উপর ভারী কাঁথা চাপিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে। কেমন জ্বর জ্বর লাগছে তার। বাসায় এসে আকলিমার হাতে চড় থাপ্পড় না হলে দশ বারোটা খেয়েছে সে। আর তাতেই পেট ভরে গলা অবধি উঠে গেছে। রাতে আকলিমা খেতে ডাকলেও সে না করে দিয়েছে। অসুস্থ লাগছে- এমনটা বাহানা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে উল্লাসী। আকলিমাও মেয়েকে আর ঘাটাননি। মেয়ের উপর রাগটা না থাকলেও একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে। এরকম একটা কান্ড ঘটানোর আগে একবারও কী তার কথা ভাবলো না? টাকা নাহয় কিছু পেয়েছে কিন্তু সম্মান তো আর পেল না। আর পাবেও না। এটা ঢাকা শহর না। এখানে একটা ঘটনা ঘটলে দুই বছরেও তা ধামাচাপা পড়ে না পুরোপুরি। তার উপর এসব হলো গরম খবর! এখন কী কোনো ভালো ঘরের ছেলে উল্লাসীকে বিয়ে করতে চাইবে? চাইবে না! তার এতদিনের ইচ্ছেটা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। আকলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর প্রার্থনা করেন মনে মনে, একটা প্রস্তাব পেলেই চলবে। উল্লাসীকে পাত্রস্থ করতে পারলেই বাঁচেন তিনি।

এমন সময়ে দরজায় খুটখুট হলো। আকলিমা খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। শশব্যস্ত হয়ে বললেন,
-“কে?”
-“আমি গো আকলিমার মা। সজলের বাপ।”
-“ওহ! আপনে..” বলতে বলতে আকলিমা দরজা খোলেন। সজলের বাবাকে ভেতরে আসতে বলে তিনি মোড়া এগিয়ে দেন। সজলের বাবা বসলেন। তাকে কেমন ইতস্তত দেখাচ্ছে, একটু লজ্জা লজ্জা ভাব, ব্যাপার কী?
-“আপনে এত রাইতে? কী হইছে? সব ঠিকঠাক?” প্রশ্ন করলেন আকলিমা।
-“হ, সব ঠিকই আছে। কী আর অইবো।” বলে সজলের বাবা উশখুশ করলেন।
আকলিমা জহুরি চোখে তাকাল এবার।
-“ঝাইড়া কাশেন, কী কইতে চান,কন?”
এবার আর ভণিতার আশ্রয় নিলেন না সজলের বাবা। খোলাখুলিভাবে বললেন,
-“দেখো আকলিমা, তোমার ছেরিয়ে যেই অকামটা ঘটাইলো, পাড়ায় বাইর হওয়া যায় না। যেইনে যাই, খালি ওর ব্যাপারে প্যাঁচাল। ছোট থেইকা উল্লাসীরে দেখতাছি। চোখের সামনে বড় হইছে। ওর প্রতি আমার মায়া মহব্বতটাই আলাদা রকমের। ওর এই দুর্দশা আমার সহ্য হইতেছে না বুঝছ? শুনছি তিন গেরামে খবর ছড়াইয়া গেছে।অনেকে তোমারেও দোষতাছে। কয়, মায়ে টাকা নিল ক্যান, ছেরিরে বিয়া দিয়া দিতো। এহন এই মাইয়ারে কেঠায় বিয়া করব?”

আকলিমা সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ওই সময় অতগুলো টাকার কথা শুনে আর না করতে পারেননি তিনি। এই বাজারে পঞ্চাশ হাজার টাকাও অনেক কিছু। অন্তত তার মতো একজনের কাছে। তাই আর সাতপাঁচ না ভেবে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন উনি৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে,এর চেয়ে পাপনের সাথে বিয়েটা হয়ে গেলেই বরং ভালো হতো। এখন আর এত চিন্তা করতে হতো না, এত কথা শুনতে হতো না। পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনাটাকে ধামাচাপা দেন তিনি। পাপনকে জামাই হিসেবে ভাবলেও মেজাজ বিগড়ে যায়। না, দরকার পড়লে কোনো তালাক প্রাপ্ত বা বউ মৃত লোকের কাছে বিয়ে দিবে উল্লাসীকে। তাও পাপনের কাছে আর না…

-“উল্লাসীর মা, তোমার চিন্তা আমি বুঝতে পারতাছি। এই জন্যে আমারও ঘুম হইতাছিল না। তাই ছুইটা চইলা আইলাম। একখান প্রস্তাব নিয়া আইছি তোমার মাইয়ার লইগা। তোমার চিন্তা কমানির জন্যে।”

সজলের বাবার এহেন কথায় আকলিমার চোখ জোড়া চকচক করে উঠল। তিনি নিশ্চয়ই সজলের জন্য আকলিমাকে চাইবেন। সজল ফর্সা ছেলে, উচ্চতায় ছয় ফিটের কাছাকাছি। তার সাথে নিঃসন্দেহে উল্লাসীকে মানাবে। আকলিমা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলেন।
-“আপনে সজলের জন্য আমার উল্লাসীরে চাইবেন ভাইজান? আমি তাতে এক পায়ে খাঁড়া। বিয়ার যত আয়োজন করা লাগে, সব কইরা উল্লাসীরে আপনের ছেরার হাতে তুইলা দিমু আমি, কথা দিলাম।”
সজলের বাবা লজ্জিত কণ্ঠে বললেন,
-“আমি সজলের জন্যি ওরে চাবো ক্যান? সজলের বিয়ার বয়স হইছে নাকি? এখনো নাক টিপলে দুধ বেরোয়।”
-“তাইলে কার জন্য উল্লাসীরে কইতাছেন?”
-“ইয়ে মানে… আ..আমার জন্য। দেখো আমার বউ নাই আইজ কত বৎসর হইয়া গেল! আমার চরিত্রে দোষ থাকলে এতদিনে আরেকখান বিয়া করতে পারতাম না কও? আমার আবার চরিত্র ঠিক আছে বুঝছো? কিন্তু তোমার ছেরিরে কেউ বিয়া করব না দেইখা ভাবলাম, আমিই করি। তাতে ওরও বিয়া হইলো, আমারও একটা শেষ বয়সের সাথী হইলো।” বলেই সলজ্জিত ভঙ্গিতে মাথাটা নিচু করলেন তিনি।
আকলিমার মনে হলো তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছে। উল্লাসীকে বিয়ে দিবে এই বুড়ো ভামের কাছে? কী এমন করেছে উল্লাসী যার কারণে এতবড় অবিচার হবে ওর সাথে? মজনুর মেয়ে রুমিজাকে তো এক ঘরের ভেতর থেকে প্রেমিক নিয়ে হাতেনাতে ধরা হইছিল। অবশ্য সেই প্রেমিকের গলায়ই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। পাপনরে.. তুই আমার এ কী সর্বনাশ করলি! মধু খেয়েই চলে গেলি? এখন মৌমাছির বিষাক্ত শূলের গুতো কেন আমার মেয়েকে খেতে হচ্ছে?- কথাগুলি মনে মনে আওড়ালেন আকলিমা। সজলের বাবা উত্তরের অপেক্ষা করছেন।

রুমের ভেতর থেকে আড়িপেতে এতক্ষণ যাবত সবধরনের কথাই শুনছিল উল্লাসী৷ সেও প্রথমে ভেবেছিল সজলের জন্য তাকে চাইবে বুঝি। সজলের জন্য চাইলে সে রাজী হয়ে যেতো। কিন্তু এটা কী শুনলো সে! সজলের বাবার জন্য তাকে…!উল্লাসীর চোখ ভেঙে কান্নারা বেরিয়ে এলো। অপেক্ষা করছে তার মায়ের প্রত্যুত্তর শোনার জন্য। মা তো চাইলেই এখনি সজলের বাবাকে ‘না’ বলে এই উটকো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মা চুপ কেন? তবে কী তিনিও ভাবছেন উল্লাসীকে এই বুড়োর ঘাড়ে গছিয়ে দেওয়ার জন্য?

আকলিমা ক্ষণকাল পর মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন,
-“আমি ভাইবা জানামু। আপনে যান।”
সজলের বাবা গেল না। আরও এক গাদা মন্ত্র আকলিমার কানে ঢেলে দিয়ে তারপর গেল। যার সারকথা এই- উল্লাসীকে সে বহুত সুখে রাখবে। তারও কী কম আছে? আর সাতকূলে কেউ নেই, উল্লাসীকে শ্বাশুড়ির গুতো, ননদের ঠোনা, অথবা দেবরের রসালো আবদার পূরণ করতে করতে বাঁচতে হবে না। বরং নিজের ঘরে রাণীর মতো বাঁঁচবে সে। আকলিমা চুপচাপ সব শুনেছেন। তার মাথা কাজ করছে না। তিনি কোনো স্থির সিদ্ধান্তেই আসতে পারছেন না।
উল্লাসী কাঁথার ভেতর মুখ গুঁজে দিয়ে কাঁদছে। তার মা বলেছে, ‘ভাইবা জানামু’ এর অর্থ সেও এই প্রস্তাবে পঞ্চাশ ভাগ রাজী। বাকিটা ধীরেসুস্থে ভেবে চিন্তে তারপর আগাবে। উল্লাসী যতটুকু আকলিমাকে চিনে, ইনি একজন টাকার পাগল মহিলা। আসলেই সজলের বাবার কম নেই। কোলায় কয় বিঘা জমি আছে, তা সজলের বাবা নিজেও জানেন না বোধহয়। অতবড় বাড়িটা আছে। পুকুর আছে পাঁচটি, সব পুকুর ভরা মাছ! গরু আছে বাইশ টা, ছাগল, হাস,মুরগীর গণনা উল্লাসী জানে না। একটু বেশি বয়স্ক, এই যা… তবুও উল্লাসীর কেন যেন মনে হচ্ছে তার মা রাজী হয়ে যাবেন। এরকম একটা ঘটনার পর এত টাকাপয়সা ওয়ালা জায়গায় উল্লাসীর বিয়ে দিতে পারলেই তিনি খুশি। আজীবন নিজেও পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবেন।

উল্লাসী মনে মনে বলল,
-“তুমি শহরে গিয়ে রূপসী বিয়ে করবে আর আমি এই গণ্ডগ্রামে ওই বুড়ো ভামের সাথে রংতামাশা করব? কিছুতেই না পাপন। মরলে এবার দু’জন একসাথে মরব। আমি সুখী না হলে তোমাকেও সুখে থাকতে দেব না।”
আকলিমা অনেকক্ষণ পর ঘরে এলেন। হারিকেন নিভিয়ে দিয়ে মেয়ের পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। কতক্ষণ পর তার নাক ডাকার আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হলে উল্লাসী উঠে পড়ল। আকলিমার ঘুম খুব ভারী, গভীর। একবার ঘুমোলে পাশে বোমা ফুঁটলেও বুঝি টের পাবেন না তিনি। উল্লাসী ধীর পায়ে পা টিপে টিপে অন্য ঘরটায় গেল। এখানেই একটা ট্রাংক আছে। সেই ট্রাংকের ভেতরেই টাকা রেখে দেয় আকলিমা। উল্লাসী চাবি নিয়েই এসেছে। তালা খুলে ধীরে ধীরে শ্বাস বন্ধ করে ট্রাংকের ডালা তুললো। মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হলে উল্লাসী ভয় পেয়ে গেল এই বুঝি আকলিমা চলে এলো। কিন্তু তখনো আকলিমার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল, তাই শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উল্লাসী। ডালা পুরোটা তুলতেই একটা আইসক্রিমের বাটি চোখে পড়ল তার। এটার ভেতরেই টাকা রাখেন আকলিমা। উল্লাসী দ্রুত হস্তে বাটিটা তুলে নিয়ে ডালাটা বন্ধ করে তালা আঁটকে দিল।
তারপর চুপচাপ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

আজ পূর্ণিমা নয়, তবুও কিছুটা দেখা যাচ্ছে। আর এতক্ষণে অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। বাটির মুখ খুলতেই একটা টাকার বান্ডিল বেরিয়ে এলো উল্লাসীর হাতে। সে বুঝলো, এটা সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা। আরও কিছু খুচরো টাকা পাওয়া গেল। উল্লাসী হাতড়ে হাতড়ে গোণার চেষ্টা চালালো। ছয় হাজার পাঁচশো আশি টাকা আছে আর। উল্লাসী মনে মনে হিসেব কষলো, এগুলো দিয়ে কয়েকদিন চলা যাবে। তারপর বাকিটা দেখা যাবে। একবার ভাবল, স্বর্ণের যেই দুটো চেইন আর একটা আংটি আছে সেগুলোও নিবে কী-না। পরমুহূর্তেই উল্লাসী এই চিন্তা বাদ দিল। এমনিতেই সকাল বেলা টাকা আর তাকে না পেয়ে আকলিমা হার্ট অ্যাটাক করে ফেললেও ফেলতে পারে। তার উপর যদি ওগুলোও না পায়! তাহলে তো হয়েছেই…
উল্লাসী মনে মনে দুর্বোধ্য হাসল। তারপর আবার ঘরের ভেতর ঢুকল। স্কুল ব্যাগে দ্রুত কিছু কাপড় ঢুকিয়ে নিলো সে। বোরকাটা ঢোকাতেও ভুললো না। যা যা হাতের কাছে পেল তাই তাই নিয়ে নিল। একটা চিরুনি, কয়েকটি চুল বাঁধার কাকড়া, ব্যান্ড, একটা ক্রিমের কৌটা, ব্রাশ ইত্যাদি ইত্যাদি…
তারপর একনজর ঘুমন্ত আকলিমাকে দেখে নিয়ে উল্লাসী বেরিয়ে পড়ল নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে…

আজকে ফোনের গেমসেও মনোযোগ দিতে পারছে না পাপন। ফোনের স্ক্রিনে বারবার উল্লাসীর কান্নারত ফোলা চোখমুখ ভেসে উঠছে। কেন যে ওই সময় মুখে কুলুপ এঁটে ছিল সে কে জানে! আসলে একটু বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এর আগে কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি তো, আর না এরকম কিছু হবে ভেবেছিল। হুট করে একটা ঝড়ের মধ্যে পড়েছিল বিধায় মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছিল পাপনের।
আচ্ছা, উল্লাসী কী করছে? এই জীবনে উল্লাসীর কথা আর চিন্তা করাও হবে না বোধহয়। নিজের করে পাবার স্বপ্ন দেখা তো দূরেই থাক! উল্লাসীর অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে। হয়তো ওই সজলের সাথে! সজলের কথা ভাবতেই পাপনের মেজাজ বিগড়ে গেল। একবার যদি সুযোগ পেতো এই ছেলের নাকমুখ ভেঙে থেতলে দিতো একদম। আর যাইহোক, ও সাথে যেন কিছুতেই বিয়েটা না হয় উল্লাসীর। দরকার পড়লে সে বাগড়া দিবে, তবুও ওর সাথে না হোক। সে হেরেছে, সজলও হারবে। সে যেহেতু উল্লাসীকে পায়নি, তাহলে সজল কেন পাবে?
দরজায় খুটখুট করে কী যেন আওয়াজ হলো। ভাবনার গতিপথ মুহূর্তেই থেমে গেল পাপনের। রাতে ভাত খায়নি সে, মা ভাত নিয়ে এলো নাকি? কিন্তু এখন তো অনেক রাত! বারোটার বেশি বাজছে!
পাপন আবার চিন্তায় ডুবলো। ফোন রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই কালো কাপড়ে আবৃত কাউকে দেখে সে চিৎকার দিয়ে উঠতেই দ্রুত তার মুখ চেপে ধরলো উল্লাসীকে। ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আঁটকে দিল সে। পাপন বুঝতে পারল, এটা ভূত নয়, মানুষ। তবুও ভয় কাটছে না। সে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল,
-“ক…কে! কে আপনি?”
-“তোর যম!!” বলে মুখ থেকে নেকাব সরালো উল্লাসী। উল্লাসীর চেহারাটা চোখে পড়তেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল পাপন। এভাবে এই রাতে উল্লাসী আসবে! তাও তার বাসায়, সেটা তো কল্পনারও বাইরে…
-“তোমার কাছে টাকা আছে?”
প্রশ্ন করল উল্লাসী। আর ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে কী যেন খুঁজলো।
পাপন বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“মানে?”
-“মানে আমার মাথা বলদের বাচ্চা!! বলতেছি তোমার কাছে টাকা আছে কোনো?” রীতিমতো ধমকে উঠল উল্লাসী,তবে সবটাই চাপা কণ্ঠে। পাছে কেউ টের পেয়ে যায়!
পাপন ধমক খেয়ে চুপসানো গলায় জবাব দিলো,
-“আছে।”
-“কত?”
-“পনেরোশোর মতোন হবে, কেন?”
-“চলবে। ওটা নিয়ে নাও। আর তোমার কাপড়চোপড়ের ব্যাগ কই?”
-“খাটের তলায়।”
উল্লাসী উবু হয়ে ব্যাগটা টেনে বের করল। ভালোই বড় ব্যাগ! তারপর দ্রুত নিজের কাঁধের ব্যাগটা ওই ব্যাগে চেপেচুপে ভরে নিয়ে পাপনের ফোনটা বিছানা থেকে তুলে৷ নিয়ে বলল,
-“ফোনটা ঢোকাও পকেটে। আর মানিব্যাগ কই?”
-“বালিশের তলে।”
-“আচ্ছা।” বলে সেটাও বের করে পাপনের হাতে দিল।
-“চলো।”
পাপন এতক্ষণ অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল, এইবার আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
-“কই?”
-“তোমার শ্বশুরবাড়ি।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল উল্লাসী। এরকম মাথামোটা ছেলের সাথে কী জন্যে যে প্রেম করেছিল! কে জানে!
-“আমি না কিছু বুঝতেছি না। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবা? প্লিজ!”
-“উফ!” বলে উল্লাসী পাপনের হাত ধরে তাকে বিছানায় বসালো। নিজের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে পাপন। তাও কার সাথে জানো?”
-“সজলের সাথে?” আন্দাজে ঢিল ছুড়লো পাপন।
-“জি না, সজলের বাপের সাথে।”
-“বলো কী! সিরিয়াসলি?” বিশ্বাস করতে চাইছে না পাপন। তার চোখ জোড়া গোল গোল হয়ে উঠল।
-“হুম। আর আমি তুমি ছাড়া কাউকেই বিয়ে করব না পাপন। হ্যাঁ, রাগ জমছিল তোমার প্রতি, কিন্তু ভালোবাসার চেয়ে রাগটা বড় না। তাই চলে আসছি। এখন আর কথা না বাড়িয়ে চলো..”
-“কিন্তু আমার পরিবার!”
-“আমিও তো আমার পরিবার ফেলে আসছি তাই না পাপন? আর একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সবাই আস্তেধীরে মেনে নিবে পাপন। দেইখো। প্লিজ, এবার হয় চলো, নইলে আমাকে আজীবনের জন্য বিদায় দাও। আর আমি এখান থেকে ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করতে দুইবার ভাববো না,বলে দিচ্ছি। ওই বুড়ো ভামের সাথে জীবন কাটানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।”
পাপন মৃদু শ্বাস ফেলল। দুপুরে যদি সে স্ট্যান্ড নিতো, তবে হয়তো কিছু একটা ভালো হতো। সে সময়ে সেও চুপ ছিল। এখন যখন আবারও একটা সুযোগ এসেছে, তখন এটিও হাতছাড়া করার কোনো কারণ নেই।
-“কিন্তু যাব কই আমরা? আর টাকা? আমার কাছে তো অনেক কম আছে উল্লাসী। ফোনটা বিক্রি করতে পারলে হতো। প্রায় হাজার দশেক পাওয়া যাইতো।”
উল্লাসী মৃদু হাসলো।
-“আমার কাছে ছাপ্পান্ন হাজার টাকা আছে। আরও চাই তোমার?”
-“বলো কী! তুমি তো সেই লেভেলের মেয়েরে বাবা! ছেলেরা মেয়েদের ভাগিয়ে নিয়ে যায়, তুমি মেয়ে হয়ে আমাকে ভাগিয়ে নিতে আসছো!”
-“প্রেমিক যদি গাছ বলদ হয়, তখন প্রেমিকাকে একটু চালাক হতেই হয়। এবার পটর পটর না করে উঠো। একটার সময় লাস্ট বাস ছাড়বে। আমরা সেই বাসে উঠে ঢাকা যাব ফার্স্টে। সেখান থেকে সিলেট অথবা চট্টগ্রাম। তারপর ওখানেই বিয়ে হবে আমাদের।”
-“বুদ্ধি খারাপ না তবে ঢাকায় ফিরে আমাদের আর একটা কাজ করতে হবে। ফোনটা ওখানেই সেল দিয়ে দিব। যাতে ট্রেকিং করতে না পারে আর টাকারও প্রয়োজন তাই।”
-“সেসব পরে আলোচনা করা যাবে। এবার চলো প্লিজ। কেউ দেখে ফেললে সব শেষ।”
উল্লাসী তাড়া দিয়ে উঠতেই পাপনও উঠে দাঁড়াল। তারপর শক্ত করে উল্লাসীর হাতটা চেপে ধরে বলল,
-“এই যে ধরলাম, আর ছাড়ব না।”
-“বাপ চাচাকে দেখলেই ছেড়ে দিবা। আর এখন ঢং!”
পাপন হাসে,উল্লাসীও হাসে। দু’জনে খুবই সতর্কতার সহিত উঠোন পেরিয়ে বড় রাস্তায় চলে আসে।
উল্লাসী বলল,
-“আমার সাথে আসো। জঙ্গল দিয়ে যাব। পাঁচ মিনিটও লাগবে না।”
-“বনে বাদারে ঘুরে বেড়াও খুব?”
-“অল্পস্বল্প।”
বলতে বলতে উল্লাসী হাঁটা ধরল। তার পিছু পিছু অন্ধকারের ভীড়ে অজানা আলোর উদ্দেশ্যে পাপনও হারিয়ে গেল। একজোড়া কপোত-কপোতী নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় আঁধারের জীবন নিজ আগ্রহে বেছে নিয়েছে। এদের পরবর্তী জীবনটা সুখের হবে তো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here