অন্তঃপুরে দহন পর্ব ৬

0
410

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-6)

#আরশিয়া_জান্নাত

ক্যাম্পাসের মাঠে বসে আছে অন্তরা, আরোহী, পাখি, আর ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখছে দেবব্রত। তার পাশেই পড়ে আছে গিটার আর কবিতার বই। পাখি হচ্ছে তাদের গ্রুপের সবচেয়ে বাঁচাল মেয়ে। সে সেই কখন থেকে দুনিয়ার সব হাবিজাবি বলে যাচ্ছে। গসিপ করার মধ্যে সে ওস্তাদ বলতে হয়! আর আরোহী ভাবুকের মতো বসে কিসব যে ভাবে সারাক্ষণ। ওর বর্তমানের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একই মজলিশে থেকেও সে বরাবরই নিখোঁজ। আর রইলো দেবব্রত। তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান সবকিছুই গান নিয়ে। সে নিজেই গান বানায়,নিজেই সুর দেয় নিজেই গায়। যদিও সে এখনো বিশেষ কিছুই করতে পারেনি। আপাতত সে আকাশ নিয়েই মহাব্যস্ত। তাহের গরম গরম সমুচা আর পেঁয়াজু নিয়ে এসে ঘাসের ওপর পলিথিন ছড়িয়ে সবকিছু মেলে রাখলো। সালাদটা দেখিয়ে বললো, নিন রাজা বাদশাহদের উত্তরসূরিরা। আপনাদের সেবায় নিয়োজিত দাসকে এসব খেয়ে উদ্ধার করুন!
অন্তরা ভ্রু নাচিয়ে বললো, কিরে কাঁচা মরিচ দিতে বলিস নি? সব দেখি পেয়াজ, খিরা গাজর কিছুই তো নাই? এই সীজনেও যদি শুধু পেয়াজ খেতে হয় মানা যায়?

তাহের বিরক্ত গলায় বললো, এসব আয়েসী আর্জি সরকারী ক্যান্টিনে রাখা তোর বড্ড বাড়াবাড়ি!

পাখি– তুই আছিস সালাদ নিয়ে? তাহের যে সস আনে নি সেটা দেখলি!

তাহের– তোরা আসলেই না শোকর বান্দা। আমি একা গিয়ে ঐ ভীড় টপকে সবার জন্য এসব আনলাম সাথে জোর করে সালাদ ও আনলাম এতে তোদের সন্তুষ্টি নেই। অকৃতজ্ঞের মতো সস আনিনি বলছিস? তোরা কেউ তো হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে যেতে পারিস!
বলেই দেবব্রতের দিকে তাকালো।
দেবব্রত আকাশের দিকেই চেয়ে বললো, তুই হচ্ছিস সোস্যাল ম্যাটারিয়াল। মানবের তরে তোর সকল কর্মকাণ্ড। সবাই যদি এমন কর্মঠ হয় তবে বাউন্ডুলে হয়ে গান গাইবে কে কবিতা লিখবে কে?
আমার মতো কিছু মানুষ ছন্নছাড়া হয়ে বাঁচবার জন্যই জন্মেছে বুঝলি! আমাদের দিয়ে ঐসব ধরাবাধা দায়িত্ব বা কাজ হবে না।
পাখি মুখে সমুচা পুরে দিয়ে বললো, তবে যাই বলিস সালাউদ্দিন মামার হাতে বানানো সমুচা জোশ! ক্যাম্পাস ছাড়লে সবচেয়ে বেশি মিস করবো এই সমুচাকে।
আরোহী– শুধু এটাই মিস করবি? এই যে কড়ই গাছ, সবুজ গালিচার মতো ঘাস, বিশাল বড় দীঘিটা, চারপাশের কোলাহোল, প্রফ দের লেকচার! এতো কিছু থাকতে তুই কেবল সমুচা মিস করবি পাখি? আমি রোজ ক্যাম্পাসে আসার পর কষ্টে বুক ফেটে যায়। দিন তো চলে যাচ্ছে,,,,

তাহের,অন্তরা,পাখি,দেব সবাই আধখাওয়া সমুচা হাতে রেখেই হা করে তাকিয়ে রইলো আরোহীর দিকে।
আরোহী ততক্ষণে চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত।
অন্তরা– ভাইরে ভাই তুই পারিস ও বটে। নিজেও ইমোশনাল হলি আমাদেরো করে দিলি। তোকে কতবার করে বললাম কবির স্যারের প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে ফেল। তাহলেই তো ক্যাম্পাসের আশেপাশেই থাকতে পারবি। স্যারতো এখানে কোয়ার্টারে থাকে। তোর জন্য আমরাও আড্ডা দিতে আসতে পারবো।

আরোহী রেগে বললো, ধুর তুই ও না যা তা! স্যারকে বিয়ে করা লেইম লাগে আমার কাছে। বহুবছর পর নাতিনাতনী যখন জানবে স্যারকে বিয়ে করেছি কি বিচ্ছিরিই না দেখাবে সেটা! এর চেয়ে চিরকুমারী থাকা শ্রেয়।
তাহের– তোর সাথে আমি একমত। স্যার ছাত্রর সম্পর্ক ভিন্ন। এখানে প্রেম ভালোবাসা ঢুকলেই গন্ডগোল।

দেব– মোটেও তা না। ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট গন্ডি নেই। কখন কে কাকে ভালোবেসে ফেলবে তা কি আর সম্পর্কের উপর ডিপেন্ড করে পাগলা?
অন্তরা– আসছেন প্রেম না করা প্রেমগুরু। ভালোবাসার দার্শনিক!
দেব–তোরা মূল্য দিলি না। ইতিহাসের পাতায় যেদিন নাম উঠবে সেদিন ঠিকই আমার সবকয়টা কথা বাণীর মতো মুখস্থ করবি।

তাদের আড্ডা চলতে থাকে পড়ন্ত বিকেল অবধি। লাস্ট ইয়ারে পড়াশোনার চেয়ে আড্ডাটাই বেশি জমে। এই দিন যে আর ফেরার নয়। অমলিন হয়ে লেখা হয়ে যাবে কেবল স্মৃতির পাতায়।
_______________

শামীমা কাপড় ভাঁজ করতে করতে বললো, হ্যাঁ রে খুকী তোর পছন্দের কেউ আছে? ভালোবাসিস কাউকে?

অন্তরা ফোনের দিকে চেয়েই বললো, আছে তো মা। কেন বলোতো?

শামীমা কাপড় রেখে মেয়ের পাশে বসে বললো, কি বলিস? নাম কি তার? কি করে? কোথায় থাকে ভাইবোন কয়জন?

কেন বিয়ে দিবা বললে?

বলে দেখ , ভালো হলে তোর বাবাকে বলবো।

বাবাকে বলে লাভ নেই মা। বাবা কখনোই রাজী হবে না।

তোকে তোর বাবা অনেক ভালোবাসে বলে দেখতে পারিস! তোর কোনো চাওয়াই তো অপূর্ণ রাখে না।

এবার অন্তরা নড়েচড়ে বসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
কিন্তু মা এই চাওয়া যে পূরণ হবার নয়। ইভেন তুমি নিজেও রাজি হবা না।

কেন ছেলে কি হিন্দু? এই তুই দেবের কথা বলছিস নাকি? তোর ঐ বাউল বন্ধু দেবব্রত?

আরেহ না না। কি যে বলো! ও তো আমার বন্ধু জাস্ট।

শামীমা হাঁফ ছেড়ে বললো, তাহলে কে?

আছে একজন।

বলবি তো কে?

আম্মু জানো না ও যা হ্যান্ডসাম। ইয়া লম্বা, চোখগুলো কি সুন্দর। হাসলে গালে টোল পড়ে। ব্ল্যাক কোর্ট গায়ে জড়িয়ে যখন কটকট আওয়াজ তুলে হাটে হায়ইইই কি যে সুন্দর লাগে!

শামীমা তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। তেষ্টায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে, কোথায় দেখলি তাকে আর কবে থেকে চলছে এসব?

ঐ যে ইন্টার থেকেই তো। তুমি তো কত বকতে তখন ভুলে গেলে? রাত জেগে তাকেই তো দেখতাম,,,

মানে তুই সেই তখন থেকেই এসব করছিলি আর আমি টের পাই নি?

হুহ! টের পাওনি কই কত বকা দিছো তুমি!!

তখন তো বকতাম তুই রাত জেগে ওয়েব সিরিজ দেখতি বলে!

হ্যাঁ তো। তাকেই তো দেখতাম।

মানে?

মানে ও হচ্ছে গং ইয়ো। কোরিয়ান এক্টোর আমার জানেমান কলিজার টুকরা!

শামীমা মেয়ের ফাজলামি বুঝতে পেরে রেগে কান মলে দিয়ে বললেন, অসভ্য মেয়ে। সবকিছুতে তোর ফাজলামি।

অন্তরা হিহিহি করে ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলো। শামীমা রেগে কটমট করে বেরিয়ে গেল।

ঘটনাটা চ্যাটিং গ্রুপে বলে আরো কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে লাগলো সে। এদিকে শামীমা পানি খেয়ে দম নিলো। অনীল যে তাকে গুরুদায়িত্ব দিলো তা সে কিভাবে পালন করবে? এই মেয়ে যে দুষ্টুমির চক্করে আসল সত্যি কোনোদিন ই বলে না।

ওমর টং দোকানে চা হাতে নিয়ে বসে ভাবছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। শীতের গা হিম করা বাতাসেও তরতরিয়ে ঘামছে সে। তবে কি তার সন্দেহই ঠিক? সে কি এসব চুপচাপ হজম করবে; দেখেও না দেখার ভান করবে? নাকি কাউকে বলবে এই বিষয়ে? তার ভেতরটা যে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সে জানেনা তার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। ব্যস্ত নগরীর কোলাহলে মিশে যায় তার বুকের হাতুড়ে পেটা শব্দ। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে একটাই বাক্য। বিদঘুটে অতীত কেন পিছু ছাড়েনা তার?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here